নববর্ষের হালখাতা
নইমা খাতুন
আজ নববর্ষের হালখাতা নিয়ে শেরিনা খুব ব্যস্ত। ধরা খরিদ্দারদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে।প্রত্যেকের পুরোনো হিসাব মিটিয়ে দেওয়ার সঙ্গে নতুন বছরের ক্যালেন্ডার ও মিষ্টি প্রদান করতে ভুল হয়না শেরিনার।হঠাৎ শেরিনার চোখ গেল দোকানের এককোণে কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা নেংটি পড়া এক ছোট্ট মেয়ের দিকে। তার বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখদুটির দৃষ্টি পরেছে একেবারে মিষ্টির পেকেটগুলির দিকে।ইশারা করে শেরিনা তাকে ডাকতেই মুখ নীচু করে এগিয়ে এলো। তুমি কি কিছু নেবে ? - একথা জিজ্ঞেস করতেই ছোট্ট মেয়েটি বলল - দিদি আমাদের হালখাতা হবে না? মেয়েটির এমন প্রশ্ন শুনে শেরিনার ছলছলে চোখ দিয়ে ভেসে এলো অতীতের স্মৃতি।
নববর্ষের আনন্দে সকলে আজ মাতোয়ারা। শেরিনার খেলার বান্ধবীরা একে ওপরকে বলাবলি করছে - আজ আমাদের বাড়িতে ক্যালেন্ডার আর মিষ্টিতে ঠাসাঠাসি হয়ে যাবে।বাবা আজ রাতে ফেরার সময় আনবেন। বাড়ি ফিরে শেরিনা তার মাকে জিজ্ঞেস করলো - মা আব্বা আজ রাতে মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার আনবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তার মা বলে উঠলো - আমাদের আবার হালখাতা! ওসব বড়লোকদের হয় মা। শেরিনা জিজ্ঞেস করলো - হালখাতা কি মা? ধরা খদ্দেরদের জন্য নতুন বছরে নতুন খাতা হয় রে। ওসব বড়লোকদের ব্যাপারসেপার কিছু বুঝি না রে।আমাদের দিন আনা দিন খাওয়া। যেদিন রোজগার হয় না সেদিন জাওভাত আর মাঠের কুড়োবুড়ো শাক জোটে।
শেরিনার বাবার রোজগারের একমাত্র সম্বল একটি টলি। বড়ো দোকান থেকে ছোট দোকানে মাল পৌঁছে দেওয়ায় আমির আলীর কাজ। এই রোজগারের টাকায় আমির আলী স্ত্রী ও পাঁচ কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে।একটা দিনও তাই তার বিরাম নেই। শেরিনা কন্যাদের মধ্যে বড়ো। মায়ের কথাগুলি শুনে তার মুখ খানা ঝলসে গেল। সান্তনা দেওয়ার জন্য তার মা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল - যদি তোর বাবার মালিকের দয়া হয় তাহলে হয়তো মিষ্টির মুখ দেখতে পাবি। এই আশা নিয়ে শেরিনা অধিক রাত পর্যন্ত বাবার অপেক্ষায় জেগে থাকলো। বাবা বাড়ি ফিরতেই ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো - আব্বা মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার এনেছো? দিনরাত পরিশ্রম করার পর আমির আলী মেজাজ হারিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো - মিষ্টির নিকুচি করেছে, রাস্তায় বাটি হাতে বেরিয়ে পর, উঃ এদের জ্বালায় জান আমার কয়লা হয়ে গেল! বিছানায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নারত শেরিনা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো - বড়ো হয়ে একদিন আমি বিশাল দোকানের মালিক হব! সেদিন শুধুই মিষ্টি খাব!
চোখের জল মুছে শেরিনা এক পেকেট মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার ছোট্টমেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফাতে লাফাতে মেয়েটি বাড়ির দিকে ছুটল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন