google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re রম্যগল্প ।। বাঘের ভয়ে ।। দেবাংশু সরকার - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

রম্যগল্প ।। বাঘের ভয়ে ।। দেবাংশু সরকার

 

বাঘের ভয়ে

            দেবাংশু সরকার


      কয়েক মাস হল কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন সনাতন বাবু। দশ বছর আগে তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের পর সনাতন বাবু মনের দিক দিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করেছিলেন। সারাদিন নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন। কারও সাথে কথা বলতেন না। কোনও কিছুতে সাড়া দিতেন না। বেশ ভালো গানের গলা ছিল সনাতন বাবুর।  পুজো পার্বনে পাড়ার ফাংশানে কখনও মহঃ রফি, কখনও কিশোর কুমারের গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিতেন। সেই গান যেন হারিয়ে গেল তার গলা থেকে। শোকে দুঃখে যেন এক ভাবলেশহীন পাথরে পরিনত হয়েছিলেন। আসলে সনাতন বাবু খুব ভালোবাসতেন তার স্ত্রীকে। সেই ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়াতে যেন তার দেহ মনের ভিতটা নড়ে গিয়েছিল। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে অনেক ক্ষত সেরে যায়। অনেক যন্ত্রণা নির্মূল হয়। সনাতন বাবুও সময়ের নিয়মে তার মানসিক যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠেছিলেন। হয়েছিলেন শোকমুক্ত। ফিরে এসেছিলেন স্বাভাবিক জীবনে। যোগদান করেছিলেন চাকরিতে। 

      যদিও স্ত্রী বিয়োগের ফলে সনাতন বাবু পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েননি। তার ছেলে শুভর আন্তরিক সেবা যত্নের ফলে ধিরে ধিরে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছিলেন। তারপর আরও দশ বছর কেটে যায়। এরমধ্যে শুভর বিয়ে দিয়ে তিনি সোমাকে পুত্রবধু রূপে ঘরে এনেছেন। সকালে মর্নিংওয়াক করে, বাজার করে, সোমার সঙ্গে গল্প গুজব করে অলসভাবে তার দিন কাটে। মাঝে মাঝে সোমার বাপের বাড়ির লোকেরা সোমার সঙ্গে দেখা করতে এলে, সনাতন বাবু তাদের সঙ্গে গল্প গুজব হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠেন। বিশেষ করে সোমার মা যখন আসেন, তখন যেন আনন্দের বান ডাকে সনাতন বাবুর মনে।

      অর্চনা দেবী একজন ডাকসাইটে নৃত্য শিল্পী। বয়স হলেও, তার টানটান মেদহীন চেহারা দেখলে মনে হয় যেন এক তন্বী যুবতী। সেই সঙ্গে তার ঘাড় অবধি সোনালী চুল যেন তার রূপের এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। সোমা সুন্দরী হলেও তার মায়ের তুলনায় যেন অনেকটাই সাদামাটা নিস্প্রভ। অর্চনা দেবী আর সোমাকে পাশাপাশি দেখলে, কে মা আর কে মেয়ে বোঝা সত্যিই মুশকিল! সোমার বাবা দেবেশ বাবু ব্যবসায়ী। অতি ব্যস্ত মানুষ। কালে ভদ্রে আসেন সোমার সঙ্গে দেখা করতে। বেশিক্ষণ থাকেন না। সোমার সঙ্গে দেখা করে দু একটা কথা বলে চলে যান। কিন্তু সোমার মা অর্চনা দেবী প্রতি সপ্তাহেই আসেন সোমার সঙ্গে দেখা করতে। সোমার সঙ্গে কথা বলেন, গল্প গুজব করেন। তার থেকে অনেক বেশি কথা বলেন সনাতন বাবুর সঙ্গে। কেবল কথাবার্তা নয়, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠেন দুজনে। গল্প গুজব হাসি ঠাট্টায় কখন যে সময় কেটে যায় বোঝা যায় না। সনাতন বাবু কিছুতেই ছাড়তে চান না অর্চনা দেবীকে। কিন্তু এক সময়ে ছাড়তে হয়। অর্চনা দেবী বিদায় নেন। তখন আবার মন মরা হয়ে পড়েন সনাতন বাবু।

      সনাতন বাবু ভাবেন এভাবে চলতে পারে না। জীবনে একটু পরিবর্তন, একটু বৈচিত্র আনা দরকার। ভাবেন সামনেই নববর্ষ। তাই সপরিবারে কয়েকদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? দীঘা, পুরী, দার্জিলিং, দেওঘর অনেকবার হয়েছে। তাছাড়া ঐ সব জায়গায় গেলে আবার তার স্ত্রীর কথা মনে পড়বে। চোখের সামনে ভেসে উঠবে পুরানো দিনের স্মৃতিগুলো। স্ত্রীকে হারানোর ব্যথাটা হয়ত আবার মোচড় দিয়ে উঠবে। তার চেয়ে বরং অন্য কোথাও, আরও কিছু দুরে যাওয়াই ভালো। কারন সনাতন বাবুর হাতে এখন অফুরন্ত সময়। শুভও খুব একটা ছুটি নেয়না, তাই তার ছুটি পেতে খুব  একটা অসুবিধা হবে না।

      সন্ধ্যার পর শুভ অফিস থেকে ফিরলে সনাতন বাবু তার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেন বসন্ত আর গরম কালের মাঝের কয়েকটা দিন মধ্য প্রদেশ যাবেন। ঘুরে দেখবেন কানহা ন্যাশনাল পার্ক। সোমাও এক কথায় রাজি। খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির মাঝে, জঙ্গলের পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে থাকা বন্য জন্তুদের দেখার মজাই আলাদা। সনাতন বাবুর প্রস্তাব শুনে সোমা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। সোমার আনন্দ দ্বিগুন হয় যখন সনাতন বাবু ফোন করে দেবেশ বাবুকে তাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ব্যস্ত দেবেশ বাবু তার ব্যবসার কারনে যেতে রাজি না হলেও, অর্চনা দেবী এক কথায় রাজি হয়ে যান। 

          বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে উচ্ছসিত সোমা সনাতন বাবুকে বলে, "দারুণ আনন্দ হবে, তাই না বাবা!"

          - "শুধু আনন্দ? শুভ থাকবে, তুমি থাকবে, তোমার মা থাকবেন, আমি থাকব। একেবারে জমে যাবে। তবে তোমার বাবা গেলে আনন্দটা পরিপূর্ণ হত। ঐ একটু ফাঁক থেকে গেল!"

      নববর্ষের ঠিক দুই দিন আগে দেবেশ বাবুকে ছাড়াই সনাতন বাবু, শুভ, সোমা এবং অর্চনা দেবী লাগেজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুটা আগেই পৌছালেন সাঁতরাগাছি স্টেশনে। নিজেদের সীট খুঁজে বসলেন। সঠিক সময়ে ছাড়ল পুনে হামসফর এক্সপ্রেস। সনাতন বাবুদের গন্তব্য মধ্য প্রদেশের গোন্ডিয়া স্টেশন। সেখান থেকে কানহা ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় দেড় দিনের ট্রেন যাত্রা। পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে যাত্রীরা। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজবের মধ্যেই মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে সনাতন বাবু বলছেন, "দেবেশ বাবু এলেন না, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! দেবেশ বাবু এলে আনন্দটা পরিপূর্ণ হত।"

      - "আরে ছাড়ুনতো মশাই, ঐ খিটকেল মার্কা, বেআক্কেলে, বেরসিক বুড়োটা আসেনি ভালো হয়েছে। ও ব্যবসা নিয়েই থাকুক।  তাছাড়া কে নেই, কি নেই অত ভেবে লাভ নেই। তার বদলে কে আছে, কি আছে সেইসব নিয়ে ভাবুন।" কপট রাগ দেখিয়ে বলতে থাকেন অর্চনা দেবী, "আমি থাকব, আপনি থাকবেন, কদম গাছ থাকবে, যমুনা নদী থাকবে, কুঞ্জবন থাকবে, আপনার হাতে বাঁশি থাকবে, আমার পায়ে নূপুর থাকবে, হাতে মালা থাকবে, কোকিলের কুহুতান থাকবে, জলকেলিরত হংস মিথুন থাকবে, নৃত্যরত ময়ুর ময়ুরী থাকবে। আর কি চাই? ট্রেনটাকে পৌঁছতে দিন। তারপর আমাদের দেখে কে! একেবারে প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দেব আপনাকে।" কথা বলতে বলতে একটা চটুল হাসি খেলে যায় অর্চনা দেবীর মুখে।

      - "ম্যাডাম, কানহাতে কোকিল, ময়ুর আছে। রাজহাঁস থাকলেও থাকতে পারে! কিন্তু কদম গাছ নেই। যমুনা নদীও নেই। তার বদলে জঙ্গল ভর্তি শাল গাছ আছে। বানজারা নদী আছে।" উত্তর দেন সনাতন বাবু।

      - "ঐ হল। যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন। যাহা কদম গাছ, তাহাই শাল গাছ। যাহা যমুনা নদী, তাহাই বানজারা নদী। ওসব কি আছে, কি নেই ছেড়ে আমাদের প্রেম লীলা কেমন জমবে, সেটাই চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকুন। ভাবুন মশাই ভাবুন। ভাবতে থাকুন আমরা রাধাকেষ্ট সেজে কি করব? আপনি শিখি পাখা বেঁধে মুরুলি বানাবেন, আমি কাঁখে গাগরি নিয়ে কোমর দোলাব। কখনও আবার ঘুরে ঘুরে নাচব। উফ ভাবলেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি! কথা শেষ করে অর্চনা দেবী গাইতে শুরু করলেন।

      - "তুমি বন্ধু কেষ্ট হইলে,
         আমি হব রাধা।
        তোমার আমার লটর ঘটর,
        একই সুতায় বাঁধা...।"

      গানের সাথে সাথে তার দুহাতে ফুটে উঠল নাচের মুদ্রা। দুপায়ে নৃত্যের ছন্দ। শাশুড়ি মাতার কথাবার্তা শুনে এবং নাচ গান দেখে শুভরতো 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' অবস্থা। মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ছুটে গিয়ে একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে সে। হাসতে হাসতে তার পিছু নেয় সোমা।

      - "থামুন ম্যাডাম। আপনার নৃত্যগীতাদিময় আবেদনের ধাক্কায় আমার শুকিয়ে যাওয়া যৌবনের দুকূল ছাপিয়ে আবার যেন জোয়ার আসছে। আমার মাথা থেকে পা অবধি প্রেম রসে ওভারলোড হয়ে যাচ্ছে। আমার সারা শরীর ফুটো করে সেই রস বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি কিছুতেই আর নিজেকে সামলাতে পারছি না! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না! মনে হচ্ছে ঐ গ্যালন গ্যালন প্রেম রস এই বুঝি এদিক ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে! এ যেন এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি আবার জেগে উঠছে। অগ্ন্যুৎপাত কেবল সময়ের অপেক্ষা।"

      - "ধরে রাখছেন কেন? যে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তাকে বেরিয়ে আসতে দিন। প্রেম রসকে বের হতে দিন।  দিনের আলো দেখতে দিন।"

      - "বলছেন?" অর্চনা দেবীর উত্তরের অপেক্ষা না করে, তড়াক করে একলাফে সীট থেকে নেমে সুগায়ক সনাতন বাবু বহু বছর পর আবার গলা ছেড়ে গান ধরেন। সেইসঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথার উপর ঘোরাতে থাকেন। কখনও কিশোর কুমারের গান আবার কখনও রফির গান গেয়ে চলেছেন সনাতন বাবু। বিপরীতে থেকে ভেসে আসছে অর্চনা দেবীর সুললিত কন্ঠের, "তুমি বন্ধু কেষ্ট হইলে..."। নাচে গানে মেতে উঠেছে দুই পৌঢ় পৌঢ়া। একে একে ভিড় করতে শুরু করেছে অন্যান্য যাত্রীরা। তাদের কেউ হাততালি দিচ্ছে। কেউ আবার মুখে দুই আঙুল ঢুকিয়ে সিটি বাজাচ্ছে।

      ট্রেন পৌছালো গোন্ডিয়া স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে আরও তিন ঘন্টা গাড়িতে করে গিয়ে হোটেলে পৌছালেন সনাতন বাবুরা। একেই দেড় দিনের ট্রেন জার্নি তার উপর আরও তিন ঘন্টা গাড়ি চড়ার ধকলে সবাই ক্লান্ত। হোটেলে ঢুকেই নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন সকলে। সারাদিন হোটেলে বিশ্রাম নিলেন। 

      আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা থেকে অনেক দুরে সকলের মনে এক খুশির ঝলক। নববর্ষটা কাটবে প্রকৃতির মাঝে, সবুজ বনানীর কোলে।  সকাল দশটার মধ্যে সনাতন বাবুরা বেরিয়ে পড়লেন কানহা সাফারির জন্য। 

      পরপর অনেকগুলো জিপ দাঁড়িয়ে আছে সাফারির জন্য। নির্দিষ্ট জিপে উঠলেন সনাতন বাবুরা। জিপের মাঝের সারিতে বসেছে শুভ আর সোমা। পেছনের সারিতে ডান দিকে বসেছেন সনাতন বাবু। ঠিক তার পাশে গা ঘেঁষে বসেছেন অর্চনা দেবী। জিপ চলতে শুরু করেছে।  গাইড কানহার ইতিহাস এবং ভৌগলিক অবস্থান বর্ননা করছে। জিপ এগিয়ে চলেছে বাফার জোন দিয়ে। বিভিন্ন প্রকার হরিণ, লাঙ্গুর, বুনো শুয়োর, পাখি দেখা যাচ্ছে। ট্যুরিস্টদের চোখে মুখে খুশির ঝলক। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মাঝে কিছু গাছ কেটে ফাঁকা করে রাখা হয়েছে। গাইড সেই দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, "একে বলে ফায়ার লাইন। জঙ্গলে আগুন লাগলে যাতে সেই আগুন ছড়িয়ে না পড়ে তারজন্য গাছ কেটে ফাঁকা করে রাখা হয়েছে।"

      গাইডের কথা শুনে অর্চনা দেবী ফিসফিস করে সনাতন বাবুকে বললেন, "দেখেছেন আমাদের মধ্যে কোনও ফায়ার লাইন নেই। কিন্তু আমরা দুজনেই কিরকম 'লাইন' মারার জন্য 'ফায়ারি' হয়ে উঠেছি। দাবানল জ্বলে ওঠা কেবল সময়ের অপেক্ষা।"

      উত্তরে সনাতন বাবু কিছু বলতে গেলেন। তার আগেই গাইড বলতে শুরু করল, "এবারে আমরা বাফার জোন ছেড়ে কোর জোনে প্রবেশ করব। এতক্ষণ পাখি, হরিণ দেখলাম। ভাগ্য ভালো থাকলে আমরা বাঘের দেখা পাব। তবে আগেও বলেছি, আবার বলছি কেউ কোনও শব্দ করবেন না। জঙ্গলের প্রাণীদের বিরক্ত করবেন না। মনে রাখবেন এটা লোকালয় নয়। এটা জঙ্গল। এখানকার নিয়ম আলাদা। আমাদের জঙ্গলের নিয়ম মেনে চলতে হবে।"

      এগিয়ে চলেছে জিপ। দুদিকে ঘন জঙ্গল। কিছুদুরে দেখা গেল একপাল হরিণ এক দিকের জঙ্গল থেকে বের হয়ে ছুটতে ছুটতে অন্য দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। গাইড নিচু গলায় বলল, "মনে হচ্ছে কাছাকাছি কোথাও বাঘ আছে।" ড্রাইভার গাড়ির গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। জিপ কয়েক মিটার এগোতেই রাস্তার ডানদিকের জঙ্গল থেকে আচমকাই বেরিয়ে এল বিশালাকার এক বাঘ। মুখে ধরা এক হরিণ। মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে, বাঘের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার অন্তিম এবং অক্ষম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হরিণটা। হরিণের গলা কামড়ে ধরে হেঁটে চলেছে বাঘটা। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে হরিণের গলা দিয়ে। এই বিভৎস দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে নিল হতচকিত ট্যুরিস্টরা। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল জিপের গাইড। সনাতন বাবু জিপের একেবারে ডান দিকে বসেছিলেন। বাঘটা সব থেকে কাছাকাছি ছিল সনাতন বাবুর। সনাতন বাবু কেবল চোখ বন্ধ করলেন না, ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে জাপটে ধরলেন পাশে বসে থাকা অর্চনা দেবীকে।

      সামনে জিপ ভর্তি মানুষ। কিন্তু বাঘটা ভাবলেশহীন ভাবে কোনও দিকে না তাকিয়ে দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেল অন্য দিকের জঙ্গলে। গাইডের ডাকে চোখ খুলল ট্যুরিস্টরা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল ট্যুরিস্টরা নীরব হয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। ভাবে বাঘটা আবার ফিরে এসে তাদের আক্রমণ করবে নাতো? ক্রমশ বিহ্বলতা কাটতে থাকে ট্যুরিস্টদের। কিন্তু সনাতন বাবুর আতঙ্ক যেন কিছুতেই কাটছে না! এরমধ্যে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে ট্যুরিস্টরা। কিন্তু সনাতন বাবুর মধ্যে কোনও পরিবর্তন নেই!  এখনও দুচোখ বন্ধ করে রেখেছেন। হতভম্ব অর্চনা দেবী অনুভব করছেন সনাতন বাবুর বাহু বন্ধন ক্রমশ যেন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। আতঙ্কিত সনাতন বাবুর গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ছে অর্চনা দেবীর কপোল যুগলে।  শুভ জানে তার বাবা মনের দিক থেকে খুবই নরম আর দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। যে কোনও মানসিক ধাক্কা সামলাতে তার অনেক সময় লাগে। অন্যের সাহায্য ছাড়া সনাতন বাবু মানসিক চাপ সামলে উঠতে পারেন না। সেইজন্য সে তার বাবাকে সাহস যোগাতে বারে বারে বলতে থাকে, "চোখ খোলো বাবা। আর কোনও ভয় নেই। বাঘ চলে গেছে।  চোখ খুলে দেখো, সামনে কোনও বাঘ নেই।" কোনও সাড়া দিলেন না সনাতন বাবু। বরং মনে হল আরও আতঙ্কিত হয়ে আরও জোরে জাপটে ধরলেন অর্চনা দেবীকে।

      সোমা খুব বিরক্ত আর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে তার শ্বশুরের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে। বাবাকে চোখ খোলার কথা বলতে বলতে শুভ ক্লান্ত হয়ে, একটু থামতেই সোমা চিৎকার করে তার শ্বশুরকে তিরস্কার করতে থাকে, "অনেক হয়েছে বাবা। এবার চোখ খুলুন। সব কিছুর একটা লিমিট আছে। আপনার ভয়েরতো কোনও লিমিট দেখা যাচ্ছে না। এবার ভয়টয় ছাড়ুন, চোখ খুলুন। তাছাড়া চোখ বন্ধ করে আপনি যা করছেন সেটা অন্যায়। কেবল অন্যায় নয়, রীতিমত অসভ্যতা। একজন সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে আপনি এসব করতে পারেন না। মনে হচ্ছে জঙ্গলে ঢুকে সমস্ত সামাজিকতাকে ভুলে গিয়ে, আপনি রীতিমত জংলি হয়ে উঠেছেন।" এত কথার পরেও সনাতন বাবুর দিক থেকে কোনও সাড়া নেই! অনেকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেও কোনও কাজ না হওয়াতে হতাশ হয়ে চুপ করে যায় সোমা।

      সোমা থামতে জিপের ড্রাইভার বলে, "চোখ খুলুন সাহেব। চোখ খুলে দেখুন আপনার কান্ড কারখানা দেখে বনের বাঘ লজ্জা পেয়ে হরিণকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এবার আপনি মেম সাহেবকে ছাড়ুন।" 

      শত অনুরোধেও চোখ খুললেন না সনাতন বাবু। তার বদলে মুখ খুললেন।  দরাজ গলায় গান ধরলেন। কিশোর কুমারের কালজয়ী গান - 'জড়িয়ে ধরেছি যারে....।'

                        ।। সমাপ্ত ।।



দেবাংশু সরকার।

ধন্যবাদান্তে,
দেবাংশু সরকার,
মোবাইল নং - 8902737584,
ঠিকানা - 34/10A, M.G.ROAD, 
              BUDGE BUDGE 
              KOLKATA  - 700137.
 



      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন