
হালখাতা - বাঙালিয়ানা
শ্যামল হুদাতী
-------------------------------
সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর তৎকালীন ভারতবর্ষে হালখাতার প্রচলন শুরু হয়।মূলত হালখাতা উৎসব উদযাপন করা হতো রাজাদের খাজনা প্রদানের 'পুণ্যাহ' অনুষ্ঠানের রীতি ধরে।'পুণ্যাহ' উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা চলছে এখনও পর্যন্ত।
নববর্ষের সাথে 'হালখাতা' শব্দটি অঙ্গাভঙ্গি ভাবে জড়িত। হাল শব্দের অর্থ লাঙ্গল। আবার কৃষকের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে নববর্ষ। মোঘল সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা নিতেন হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে ।অসময়ে খাজনা দেওয়ার যন্ত্রনা থেকে কৃষককে মুক্তি দিতে সম্রাট আকবর ফসলি সন চালু করেন। এই ফসলি সনই বঙ্গাব্দ হল কালক্রমে। জমিদারের ঘরে খাজনা পৌঁছে দিতেন কৃষকরা। সেই সময় ঋণের ভার লাঘব করার রীতিও ছিল। অনেক সময় কৃষকদের ঝড় জলে তাদের ফসল নষ্ট হতো ।সেই ক্ষেত্রে কৃষকদের ঋণ মুকুব হতো। আবার সঠিক সময় কর জমা দিলে জমিদাররা নজরানা পেতেন। সেই সময় জমিদার বাড়িগুলোতে সাজো সাজো রব দেখা যেত। আবার এটাও শোনা যায় যে হিজরি সন থেকে বঙ্গাব্দের প্রচলন ।সেই হিজরিসন আবার হযরত মোহাম্মদের মক্কা ত্যাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ।মোহাম্মদের মদিনা গমনকেই হিজরতের শুরু ধরা হয়। এই উৎসব আর যাই হোক ধর্মীয় বিবেক তৈরীর জন্য ব্যবহার করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস নিজেই।
বাঙালিরা বছরটি ভালরকমই যাক আর খারাপের শেষ হোক। সজনে খাঁড়া চিবিয়ে,ঢাকের বাদ্দি
আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরাতনকে বিদায় দেন। তবে বাংলা নববর্ষের চেয়ে শহর কলকাতা বেশি মজে থাকত চড়কে আর বাবু বাড়ির গাজনে। নিম্নবর্গের মানুষ সেখানে পার্ফরমার উচ্চ বর্ণ সেখানে আমুদে দ্রষ্টা। জোড়াসাঁকো সোনাগাছি রাস্তার ধারে ভিড় করে মানুষ গার্ডেনের বানফোঁড়া দেখত।
শেষ শতকের দ্বিতীয় তৃতীয় দশক থেকেই বই পাড়ায় নববর্ষ পালনের ধুম লেগে যায় ।কল্লোল, এম সি সরকারের হয়ে সেই আড্ডা ডালপালা মেলেছে অন্যদিকে । নববর্ষকে সাদর অভিবাদন জানিয়েছে শান্তিনিকেতন। ১৯৩৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন এবং নববর্ষ অনুষ্ঠান একসঙ্গে পালন শুরু হয় ।শেষ জন্মদিনও এই অনুষ্ঠানে সাক্ষী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু নববর্ষ কে নিছক ইউরোপীয় হ্যাপি নিউ ইয়ার এর বঙ্গজ সংস্করণ হিসাবে দেখেননি কখন ও। নববর্ষ তাঁর চোঁখে প্রবৃত্তির দায় মুক্ত হয়ে অন্তরে উদ্ভাসিত জীবনের দিকে যাত্রা। ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে ফারাক বোঝাতে লিখেছেন ,আমাদের নববর্ষ এমন সহজ নয় ,এমন কোমল নয় শান্তিতে পরিপূর্ণ এমন শীতল মধুর নয় । স্বাভাবিক আমাদের দেশে জানুয়ারির আবহাওয়া আর চৈত্রের বৈশাখী আবহাওয়া এক নয় । স্বস্তি বলতে শুধু বিকালের দমকা হাওয়া ,সর্বব্যাপী ঝড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জায়গায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ভূমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হোক।ভূমা শব্দটির আভিধানিক অর্থ বহুত্ব। বহুত্ব আঁকড়ে এখন বাঙালিয়ানারা শিখড় সন্ধানে।
বাংলা মাসের চৈত্র পড়লেই বাঙালিয়ানায় আবেগের ঢেউ ওঠে। এই আবেগ ছাড়ের আবেগ। কোন বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছাড় নয়। এটি এক অন্য ছাড় , যা পেলে নিজেকে বিজেতা বলে মনে হয়। দোকানে দোকানে ছাড়-ছাড়-ছাড়! বিপুল ৫০ শতাংশ ছাড়, মজুরিতে ছাড়, তিনটে কিনলে একটা ছাড়। চাল ,ডাল,বিছনার চাদর, জুতো ছাড়, জামা সবেতে ছাড়, কে কোন ছাড়, কে কাকে ধরে আছে, কে কাকে ছাড়ে। বসন্তের শেষ বেলায় দারুন সুখবর।
অনলাইন কেনাকাটা হোক বা অফলাইন সশরীরী হাজিরই হোক, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যেকোনো পণ্যই ছাড় পাওয়ার অধিকারী হিসেবে গণ্য। পহেলা বৈশাখ আসছে যাকে ছোটবেলায় অনেকেই ভাবে একলা বৈশাখ, কেন যে সে একলা এই ভেবে মনে ক্ষণিকের বিষন্নতা জন্মায়। নিজেকেও একলাই লাগে তখন। ইচ্ছা করলে কেউ খুব দৃশ্য কার্ড কিনতে পাওয়া যেত না । মাঝে মাঝে নিজের অংক খাতার পাতা ছিড়ে একে লিখে ফেলত , তুমি আমার বন্ধু হও নববর্ষের কার্ড লও ইতি ১লা বৈশাখ।
বাঙালী সংসারী হিসেবী বড়রা কেউ কেউ টাকা জমিয়ে চৈত্রে সেলে দুর্গাপূজার কেনা কেটার প্লান ও করে থাকতেন। উপহারের সামগ্রী সস্তায় কেনা গেলে দু পয়সা সাশ্রয় ত হয় - যেখানে দোয়াথোয়ার ব্যাপার আছে। আমি বাঙালি চৈত্র সেলে কেনাকাটা ই আমাদের বাঙালিয়ানা কালচার।
চৈত্র মাসে রেডিমেড কাপড়ের দোকানে কিছু কথোপকথন -
-ওটা কত ভাই? না না ওই পাশেরটা।
-এইটা নিয়ে নিন বৌদি মাত্র .....
- ওটানা - ডানদিকেরটা
-একদম ফ্রেশ মাল।
- কত?
-না না মাসিমা ওর কমে পারব না। মা'ক্কালি বলছি।
-১০০ টাকায় দিয়ে দাও
-আপনার পছন্দ হয়েছে, তাই কেনা দামে ছেড়ে দিচ্ছে কিন্তু।
কেনা দামে সবাই সব ছেড়ে দেয়। কিংবা কেনার দামের চেয়েও কমে। নিজের ক্ষতি করে। পয়লা বৈশাখের প্রত্যেক বিক্রেতা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী।
বেশিরভাগ খরিদ্দার দক্ষ দামাদামির শিল্পী । সে এক দৃশ্য অবলীলায় ১০০টাকার জিনিস ১০ টাকায় চায়। সেই আকুল টানাপড়েনের পর - না ভাই তাহলে আর নিলাম না। ক্রেতা উল্টোমুখী হাঁটেন। বিক্রেতা চেঁচিয়ে তার মুখ ফেরাতে চান। অবশেষে রফা হয়। এ এক উল্টো নিলামের জগত। নিলামে দাম বেড়ে যায়। চৈত্র নিলামে কমে যায়। আর সারা বছর বাঙালি এই অসামান্য প্রতিভা নিয়ে বৈশাখমুখী এপ্রিলের জন্য অপেক্ষা করে।
নিজস্ব বর্ষপঞ্জী প্রয়োজন হয় ধর্মের ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য স্মরণ করে। বাঙালির ক্ষেত্রে যেমন বাংলা ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণ পবিত্রতর বা কল্যাণকর বলে ধারণা হয়। না হলে সারাদিনে যা স্মরণে আসে না পূজা পার্বণে তাকেই খোঁজ কেন? এ এক যুক্তিহীন গতানুগতিকতা। এই যে চৈত্র সেল কেন্দ্রিক উন্মাদনা আত্মস্বার্থ সাধন। অন্য যেকোনো উপলক্ষে যদি এই ডিসকাউন্টে ডাক ওঠে জাতি ধর্ম ভুলে লোকেরা কেনাকাটা করতে যাবে। লক্ষী গণেশ পুজো করে হালখাতায় হিসাব করা ও মিষ্টি মুখ সেই পরিসরে আছে যা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন বাঙালিয়ানা প্রমাণ করে সেখানে ও বিভ্রান্তি কম নয়। কারণ বাংলার প্রাণ যে বাংলা ভাষা, তার কদর, গুরুত্ব তার প্রতি ভালোবাসা ক্রমশ কমছে। ভাষা হারিয়ে গেলে জাতিত্ব থাকেনা অর্থাৎ জাত যায়। যদি মনে করি বাঙালিয়ানার পরিচয় হয় দুর্গাপূজা, তাদের অষ্টমী সকালে লালপাড় শাড়ি বা বড়পাড়ের ধুতির ধাক্কা, মুখের সামনে লাউড স্পিকার নিয়ে ভুল উচ্চারণে পুরোহিতের সংস্কৃতি মন্ত্র পাঠ, ফোনে চ্যাটিং বা জিভে ইংলিশ অবশ্যই বাঙালিত্ব।
অনেকেই বলে থাকেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। আমরা বাঙালিরা নিজেরাই কমবেশি দোষী- এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। বাঙালিরা নিজেরাই বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে নিজেদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে দিনের পর দিন। কিন্তু তারা গর্বের সঙ্গে দেখাবেন পহেলা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো - তারা কত ভালবাসেন। বাংলা ভাষা বিপন্ন একথা বলার জন্য সে ভোরবেলা হাঁটতে রাজি, একুশে ফেব্রুয়ারি গান গাইতে, কবিতা পড়তে রাজি। কিন্তু এই ভাষা কি কিভাবে বাঁচানো যাবে সে বিষয়ে সে একটি পদক্ষেপ খরচ করতে রাজি নয়। অথচ সেই চায়ের টেবিলে, অফিসের টেবিলে বড় বড় বুলি মারতে ওস্তাদ। সে বলবে, হিন্দি আগ্রাসান এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গুলোর উপর দোষ চাপিয়ে সে পরম আনন্দ পায়। অথচ সে যখন তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে যায়, প্রথমে বেছে নেয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোকে। এমনকি অনেক অভিভাবকরা হিন্দিকে বেছে নেয় ফাস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে। যখন প্রশ্ন করা হয় বাংলা কেন ব্রাত্য? অদ্ভুত অদ্ভুত উত্তর আসে - হিন্দিতে মার্ক্স ভালো আসে, সর্বভারতীয় পরীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া, বাংলায় ভালো বই নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার সন্তানকে আপনারা সবাই গর্বের সঙ্গে ইংরাজি সঙ্গে হিন্দি পড়াচ্ছেন। আবার বাবা-মারা অধিক চিন্তিত যে তাদের সন্তানরা বাংলা ভাষা পড়ছে না, ভুলে যাচ্ছে, বাংলা বানান ভুল করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন হল আমরা বাংলা ভাষার জন্য কি করছি যে আমাদের সন্তানরা বাংলা পড়ার জন্য আগ্রহী হবে?
আবার অনেকে জোর গলায় বলেন বাংলা ভাষার উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো বই নেই। একথা অস্বীকার করে কিছু নেই। ইতিহাস থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ভালো বই পড়তে গেলে ছাত্রছাত্রীকে ইংরেজি ভাষায় পড়তে হবে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলে ইংরেজিতে দিতে হবে। এই দেশে বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষা কিন্তু কেউ কি কেউ কি চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষায় লিখিত সাহিত্যকে ভারতের অন্যান্য ভাষায় এবং বিদেশি ভাষায় যথার্থ অনুবাদের? সব মিলিয়ে ভাবনা আর চিন্তাতে রয়েছে অমিল, দৈন্য। আমাদের কখনোই দোষ দেওয়া উচিত নয় অন্য ভাষাকে, দোষ দেওয়া উচিত নিজেকে, নিজেদের। কোন একটি দেশ যদি নিজেদের দুর্বল করে রাখে, তাহলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এসে তাকে অধিকার করবেই। এমন সংস্কৃতি তৈরি করেছি যেখানে সমস্ত জায়গায় দুর্নীতি চরম। আমরা সারাদিন রাজনৈতিক দোষারোপ করতেই ব্যস্ত। কিন্তু আমরা সমাধানে রাস্তা খুঁজতে মোটেই আগ্রহী নই। আমরা শুধু নিশ্চিত মনে পহেলা বৈশাখ নতুন জামা কাপড় বা হালখাতার পরিকল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ছি আবার ভাবছি রাজনৈতিক নেতারা আমাদের জীবন পাল্টে দেবে।
আমাদের কাছে পহেলা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজার মধ্যে রীতি আচার উৎসাহ ভরে পালন করি। নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে মঞ্চে বক্তৃতা মারি আর চলে উৎসব বছর পর বছর। কিন্তু এভাবে আমাদের সংস্কৃতি কতদিন টিকবে? কিন্তু আমাদের নিজস্ব বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টি যদি না থাকে তাহলে ভৌগোলিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা থাকল বা না থাকল তাতে কি এসে যায়? একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে সমগ্র জাতির জন্য চিন্তা করবো কি করে? এইভাবে কি চলতে পারে? এখন বাংলা চ্যানেল গুলো দেখুন। যে রিয়েলিটি সো-গুলো চলে, সেখানে গান বলতে হিন্দি গান। আবাল-বৃদ্ধ- বনিতা নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই মজে আছেন এই রিয়েলিটি শো সংস্কৃতিতে। আরও একজন হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখার্জি, আরতি মুখার্জী তো নয়ই, নিদেনপক্ষে একজন কুমার শানু তৈরি হবে কিনা সন্দেহ। বাচ্চাদের গান শেখা এখন আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে।
আমরা এমনিতেই মিশ্র জাতি, কালের নিয়মে তার চরিত্র পরিবর্তন অনিবার্য। কোন আর্থ রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবাসী যদি বিপন্ন বোধ করে - বাঙালিয়ানায় জোয়ার লাগবে বলে আমার ধারণা। তাই চিংড়ি, ইলিশ,পাবদা, কই, মিষ্টি, মিষ্টি দই ,মা দুর্গা, ব্যান্ডের গান, সত্যজিৎ রায় ও পয়লা বৈশাখ নিয়ে যতদিন পারে বাঙালি বলে - চলুক শুভ নববর্ষ।
------------------------------------------------
শ্যামল হুদাতী
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড,
কলকাতা ৭০০০৬৮
মোবাইল নাম্বার - ৯৮৩১৮০০১৯১
WhatsApp number 9831800191
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন