google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নববর্ষের কামনা ।। সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

নববর্ষের কামনা ।। সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়

  

নববর্ষের কামনা 

  সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়       

             

সুরসিক শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন 'নতুন বছর নতুন বছর বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই।যখনই কোন নতুন বছর এসেছে এক বছরের বেশী টেকেনি।' কথাটা হয়তো তিনি অভিমান থেকে বলেছিলেন।নতুন বছরের আনন্দ উদ্দিপনা ভালোভাবে উপভোগ করার আগেই আরেকটা নতুন বছর এসে হাজির হয়,অন্তরে অতৃপ্তি রয়েই যায়।অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণ একটা গোটা নতুন বছরে মানুষ কতরকম আশা আকাঙ্খা মনে মনে পোষন করে থাকে আর বছরটা  সেই আশা আকাঙ্খার কোনটির অর্ধেক, কোনটির সিকি ভাগ পূরণ করে পালিয়ে যায়,অনেক স্বপ্ন,অনেক আকাঙ্খা অপূর্ণই থেকে যায়,একবছর সময়টা তাই নেহাতই স্বল্পপরিসর ।নতুন বছর তাই তার হয়তো সাধ জাগায় কিন্তু সাধ পূরণ করতে পারে না।

আসলে সময়টা হয়তো ঠিকই থাকে,একটা নতুন বছরে আমরা যা যা আশা করি বা স্বপ্ন দেখি তার তালিকা এতো বড় এবং ক্রমশ এতো বড় হয় যে সময় তার সাথে তাল দিতে পারে না।সাধারণ   সংসারজীবী মানুষ হিসেবে আমাদের স্বপ্নগুলো  আকাঙ্ক্ষার যতোটা অংশ অধিকার করে থাকে তার চেয়ে বেশী জায়গা অধিকার করে থাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপন্নতাগুলো থেকে মুক্তির প্রার্থনা।উদাহরণ স্বরূপ একবিংশ শতকের ভয়ংকর মহামারী।মানুষ সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শুধু প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির ফলে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলেও ক্রমবর্ধমান অজানা আশঙ্কাগুলির জন্য মানুষ আনন্দ উল্লাস যাপনের মধ্যেও আতঙ্কিত হয়ে থাকে।নতুন বছরে আমরা আর্থিক সচ্ছলতা, বাহ্যিক সুখভোগ,মানসিক শান্তি, শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদির জন্য যা যা দরকার সবই কামনা করি।এর সাথে সাথে বিগত দিনের বিপদ, লাঞ্ছনা, অপমান,অসম্মান, অসহায়তা,বঞ্চনা, নানা গ্লানি,জরা-যন্ত্রণা গুলো ভুলে যেতেও চাই।তার সাথে চাই জীবনে  এগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে ।আর যেহেতু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যাপ্ততা সার্বিক সুখ শান্তি দিতে পারে না সেটা জেনে এও প্রার্থনা করি-

'দাও প্রেম, কর ক্ষমা,বন্ধ কর যত অনাচার
তবেই মুক্তি পাবে হে মানব,শেষ হবে সব পাপাচার
এসো বড়দিন মোদের মাঝে, এসো ফিরে নব আশা
বরিণু তোমায় যীশুর মন্ত্রে - দিয়ে
 যত ভালোবাসা।'

(এক আধুনিক কবি কৃপাময় ব্যানার্জ্জীর কবিতাংশ)

তারপর আমরা উপলব্ধি করি যে শুধুমাত্র মানবজীবনে সুখ শান্তি থাকলেই হয় না,অন্যান্য জীবজন্তু গুলোও তো জীবনের অংশ।আমাদের তাদের প্রতি প্রেমকেও চরিতার্থ করতে হবে  নইলে কোথাও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।তখন পশু পক্ষির জন্যও প্রার্থনা করি।প্রখ্যাত পশুপ্রেমী পিটার সিঙ্গার দেখিয়েছেন, পশুরা শুধু ইচ্ছা-অনিচ্ছাহীন যন্ত্রবৎ ক্রিয়াশীল কোন জীব নয়,বরং এদেরও সুখ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনার অনুভূতি আছে।তাই এদেরও জৈবিক মর্যাদা আছে এবং মানুষের মতো এরাও বেঁচে থাকার অধিকার পাওয়ার যোগ্য।কিন্তু সবুজ প্রকৃতিই বা বাদ যাবে কেন? নির্বাক অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের উপরই বা অত্যাচার নেমে আসবে কেন? বিশেষত এই অত্যাচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন মানুষ স্বয়ং করে থাকে।জনৈক সন্ন্যাসী  বলেছেন পৃথিবীর সব মানুষ শেষ হয়ে গেলে প্রকৃতি আবার নিজের খেয়ালে পৃথিবীকে সবুজ-সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলতে পারবে।প্রকৃতিকেও তাই মানুষের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।সুতরাং সার্বিক সুখের অনুসন্ধানে নববর্ষের কামনায় সমস্ত জীবজগতের জন্যই প্রার্থনা প্রয়োজন।

কিন্তু এরপরও খামতি থেকেই যায়,হৃদয় যেন পরিপূর্ণ তৃপ্তি পায় না।উন্নত বিজ্ঞান, উন্নত প্রযুক্তি,উন্নত গবেষণা, উন্নত জীবন-যাপন,উন্নত যানবাহন(যেমন চালকহীন যান),উন্নত ভাববিনিময় পদ্ধতি,ব্যবসায় উন্নতি, বানিজ্যে উন্নতি, শিল্পে উন্নতি,শাসন ব্যবস্থায় উন্নতি,উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা এসব  প্রতিটি নতুন বছরই কিছু না কিছু নতুন সংযোজন হয়ে থাকলেও কোথাও দুঃখকষ্ট যেন থেকেই যায়।তখন উপলব্ধি হয় শুধু বাহ্যিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্ই পরিপূর্ণতা আনতে পারে না,মানবজীবনে প্রতিটি নব বর্ষে চাই মূল্যবোধে নব নব  সংযোজন,মানুষের আচার ব্যবহারে উন্নতি,হৃদয়বেত্তার  উন্নতি।খনিতে অজস্র কয়লা খননের পরও কোথাও সামান্য হীরা খন্ড খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।কয়লা খনিজ সম্পদকে ঐশ্বর্যশালী করে কিন্তু হীরা খনিজপদার্থকে উন্নত করে।অশুদ্ধ কয়লার পর্যাপ্ততার থেকে অপর্যাপ্ত শুদ্ধ  কয়লা আমাদের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান বস্তু । হীরা ভরসার প্রতীক,উৎসাহের প্রতীক।আমরা অসুখের সময় যে নানারকম অষুধ খাই সেগুলি আমাদের শরীরের নানা ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে মেরামত করে কিন্তু আমরা যখন একটু প্রাকৃতিক  দুধ জোগাড় করতে পারি তখন ক্যালসিয়াম ইত্যাদি সহযোগে সামান্য পরিমাণে হলেও আমাদের অজান্তেই শরীরের হাড় বা অস্থিমজ্জাকেও কিছুটা উন্নত করে মূল কাঠামোকে মজবুত করে। মানসিকতা,সততা,নিষ্ঠা, সহমর্মিতা এগুলির উন্নতি ঘটলে মানবসভ্যতার কাঠামো মজবুত হয় ।

গল্পে আছে একজন প্রযুক্তি বিদ্যায় পারদর্শী ছাত্র রাস্তায় যেতে যেতে এক বৃদ্ধ ক্ষীণ দৃষ্টি ননমেষপালককে উচ্চ প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করে তার পালে কতগুলি মেষ আছে কয়েক মিনিটের মধ্যে বলে দিয়ে তাকে অবাক করে দিয়েছিলো।সে নাসার কোন এক উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আড়াই হাজার ডলার খরচ করে স্যাটেলাইট থেকে চিত্র সংগ্রহ করে কাজটি করেছিলো।জবাবে বৃদ্ধ মেষপালক তাকে বলেছিলো 'বাবা তোমাকে  আমি চিননি না কিন্তু না জেনেই বলতে পারি তুমি কে।তুমি হলে পড়াশোনা করা অত্যন্ত বড়লোকের  একজন মেধাবী ছেলে।'বৃদ্ধের সহজ সরলনএই কথা শুনে ছাত্রটির মনে যে উপলব্ধি এল,তার ও বৃদ্ধের মধ্যে জাগতিক ও মানসিক বিভেদরেখার যে সামান্য সংকোচন হলো সেইটিই হলো  মূল্যবোধের সংযোজন,সমস্ত  বিদ্যার নির্যাস।

খন্ডিত প্রাপ্তির মধ্যে তাই শান্তি নেই,পূর্ণতার পথেই শান্তি।শাশ্বত চিন্তাই সৎ চিন্তা, বিশুদ্ধতাই পূর্ণতার প্রতীক।এই পূর্ণতাকেই রবীন্দ্রনাথ শুধু শেষ সত্য হিসেবে গ্ৰহন করেননি,শেষ অবলম্বনও বলেছিলেন।শেষ জীবনে নেপোলিয়ন উপলব্ধি করেছিলেন,তিনি যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তা পেশীশক্তির মাধ্যমে কিন্তু যিশুখৃষ্ট যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ভালোবাসার মাধ্যমে।নিজকৃত উৎপীড়নের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হিটলার নিজে নিজেকে হত্যা করেছিলেন।কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষ মানুষের হত্যা কাহিনী ও হাহাকার সম্রাট অশোককে চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত করেছিল।
       
এই নিরিখে একটা নতুন বছর কত দ্রুত পেরিয়ে গেল তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সে মানবিক মূল্যবোধ ও সভ্যতার উন্নতির জন্য কতটুকু নির্যাস রেখে যেতে পারলো তার হিসেব।নতুন বছরে তাই শুধু উন্নত চিন্তা, উন্নত কর্ম বা উন্নত জীবনই নয়, বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ কর্ম এবং  বিশুদ্ধ জীবনের জন্যও আমাদের প্রার্থনা থাক।



Sushil Kumar Banerjee 
Lower Chhinnamasta 
Radhanagar Road 
Near Muri Factory 
Asansol 713325
Dist -P Bardhaman 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন