বাংলা বর্ষবরণ বরণ
তপন মাইতি
বাংলা নববর্ষ আমার কাছে আবার নতুন করে শুরু করা বলে মনে হয়।'আসছে বছর আবার হবে বছর বছর এগিয়ে যাবে'র মত।জীবনের অন্ধকার ঘুঁচিয়ে ভোরের আলো দেখার মত সফলতা। জীবনের সব নেগেটিভকে পজিটিভ করবার প্রবল আকাঙ্খা কামনা বাসনা শপথ গ্রহণ করবার দিন।অতীত দিনে যত ভুলভ্রান্তি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে নিজেকে তৈরি করবার বুক বেঁধে ফেলবার দিন।ধূসর উসর মরুভূমির বুকে একটি মরুদ্যান খুঁজে পাওয়ার আনন্দের দিন।নববর্ষ আমার কাছে একটি ঋতুকালীন বিশেষ এক দিন।
'নববর্ষ'একটি নতুন বছরের সূচনার শুভলগ্নের দিন।যা নবায়নের সুযোগের প্রতীক।বৃক্ষের জীর্ণ পাতা ঝরিয়ে কিশলয়ের স্বপ্নে চোখ মেলে দেখবার ইঙ্গিত।শুভ মঙ্গলময় স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে সাদা শাড়িতে দেবী লক্ষ্মী ও দেবতা গণেশের পুজো দিয়ে শুরু হয় বাঙালির ঐতিহ্য বর্ষবরণ পয়লা বৈশাখ,বৈসাবি বা বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব।রামধনু রঙে মঙ্গল শোভাযাত্রা,হালখাতা,মেলা বা উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিল এবং ভারতে ১৫ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়।
৫৭ অব্দে রাজা বিক্রমাদিত্যর সময়কাল থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে তবে এই মন্তব্যটি বিতর্কিত।তবে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা শুরু করেন কর,খাজনা,মাশুল,শুল্ক বা রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া সহজ করবার জন্য। তিনি প্রথম বাঙালি নৃপতি শশাঙ্ক ৫৯০-৬২৫ খ্রিঃ পহেলা বৈশাখ চালু হয়।আর আধুনিক ইতিহাসের ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয় কামনার জন্য হোম কীর্তন ও পুজোর প্রচলন হয় পয়লা বৈশাখ।
বাংলা নববর্ষ এলে আমি স্মৃতিমেধুর হয়ে পড়ি।আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম।আমার দাদু পয়লা বৈশাখ উঠে ভোর ভোর বাস্তুভিটে,যেখান যত জমিজমা,বাঁশবন,খালপাড় ইত্যাদির ঈশান কোনে আগুন জ্বালাত।'দাদু পয়লা বৈশাখ খুব ভোরে উঠে খড়ের আঁটিতে আগুন লাগাও কেন?'এই প্রশ্নটি করবার আগে দাদু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।তবে পাড়ার বয়স্ক অমূল্য দাদুকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন 'দ্যাখ দাদু এসব অনেক ব্যাপার আছে বললে এত্তসব বুঝবি না আর মাথাও ঢুকবে না উপর দিয়ে যাবে।তবু বলছি শোন যতটা সহজ করে বললে বুঝতে পারিস।বয়স কম তো অভিজ্ঞতা ও কম আছে।অনেক কারণে ঈশান কোনে আগুন ধরানো হয়।মদ্দাকথা হল এক বছরে যা কিছু দুঃখ শোকতাপ দুর্দশা আপদ বিপদ দুর্যোগ অপমান অবজ্ঞা জীবনের যত খারাপ কিছুকে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে নিষ্পাপ পবিত্র হয়ে নতুন উদ্যমে চলবার অঙ্গীকার করে নববর্ষে পথ হাঁটা শুরু করতে হয়।আর মনে রাখতে হবে বৈশাখ মাস পড়ে যাওয়া মানেই তাপদাহ।বিকেলে কালবৈশাখী ঝড়।ঈশান কোন হল এখানে সচেতনতার সংকেত।ওইদিকে বাস্তুদেবতা অবস্থান করে এটি লোকবিশ্বাস,শাস্ত্রমতে এবং বিজ্ঞানসম্মত।দেখ বাঁশবন বা আগাছা ভরা খালপাড় প্রভৃতি পোড়ানো হয় এর কারণ ঝড়ের সময় ওগুলো উড়ে অন্য জায়গায় পড়বে না।আর ঝোঁপঝাড়ে আনাচে কানাচে আগাছা পোড়ালে পরিষ্কার হবে এবং অনেক বিষধর পোকামাকড় কীট পতঙ্গ বিনষ্ট হবে বা অন্যত্র পালিয়ে যাবে।আর তিনি একটা কথা মাথায় রাখতে বলতেন এইটা হল ঋতুর শুরু।বছরের প্রথম।জীবনে ভালো কিছু শুরু করবার সুবর্ণ সুযোগ।সেটা জীবনেও হাত ছাড়া করতে নেই।
যাইহোক আমার মা কাকিমারা সমবেত হয়ে ধন সম্পদের অধিষ্ঠত্রী দেবী লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজোর মাধ্যমে হয় বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা করেন।মায়ের হাতে শীলনড়ায় কাঁচা হলুদ নীমপাতা বাটা ও সরষে তেল মিশ্রণে সারা শরীরে মেখে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতাম।ঠাকুমা ঘষে ঘষে ময়লা তুলত পিঠে হাত পেতাম না।খাওয়ার আগে আলি নামক কিছু তিক্ত স্বাদযুক্ত কিছু শিকড় বাকড় খাওয়াতেন আর বলতেন আয়ুষ্মান ভব।এই ছোটোবেলা বলতেন আজকের দিনে কারোর সাথে ঝগড়া ঝাঁটি করবি না।মিথ্যে কথা বলবি না আজকের দিনে। সাদা পাঞ্জাবী পরিয়ে দিতেন এত বড় যে আমার মত দুজন ঢুকে যাবে এমন ঢিলেঢালা।মা বলতেন একবছর গেলে গায়ে ঠিক এঁটে যাবে।দাদু ঠাকমা আমায় কতরকম গল্প বলতেন। আমি বুঝতাম না।শুধু শুনছি বলে হুঁ হুঁ করে যেতাম।বলতেন বেদ-পুরাণের কথা।বলতেন উপনিষদের কথা।বলতেন রামায়ণ মহাভারতের কথা।বলতেন লক্ষ্মী-গণেশের কথা।বলতেন ছোটবেলা কত কষ্টকরে মানুষ হয়েছে।আমি গল্প শোনার জন্য প্রবল আগ্রহে বসে থাকতাম। দাদু ঠাকমার অপার ভালোবাসা আমাকে কতকিছু শিখিয়েছে যা কোনোদিন ভুলবার নয়।
উৎসবের তাৎপর্য হল ভবিষ্যতে প্রত্যেকের সারা বছর মঙ্গলময় সুখময় সমৃদ্ধিতে কাটুক এই কামনা।এই চিরাচরিত অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে হয় মিষ্টি বিতরণ, হালখাতা, ভুরিভোজ,মোড়ে মোড়ে ছোলা জল বাতাসা দান।দুঃস্থদের খিচুড়ি বিতরণ।অন্ন বস্ত্র বিতরণ।রক্তদানের মহড়া।প্রচলিত লোকবিশ্বাস মতে আজকের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভালো থাকলে,ভালো পরলে,ভালো বললে, ভালো খেলে,ভালো আচার ব্যবহার করলে সারা বছর খুব ভালো থাকবে,ভালো পরবে,ভালো শুনবে,ভালো খাবে এ আশা বিশ্বাস করা হয়।এইদিন সব কিছু নতুন হবে। জোড়া শালিক দেখার মতো শুভলগ্ন বা শুভযোগ মনে করে বাঙালিরা।জোড় জোড় বাঙালিরা অতিশুভ মঙ্গলদায়ক বলে বিবেচনা করে।ওইদিনে শাক সব্জি মাছ মাংস পাতে পড়ে সব জোড় জোড়।দিনে ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীরা আসেন।পিঠাপুলি,পায়েস,পান্তভাতে ইলিশ মাছ সে এক আলাদা স্বাদের। ছোটরা বড়দের প্রণাম করেন শুভেচ্ছা ভালোবাসা বিনিময়ে আশীর্বাদ জ্ঞাপন করেন।বৈশাখী মিলন মেলা হয়।মেলায় কৃষিপন্য,লোকশিল্প,কুটির শিল্প জাত বহু হাতের কারুকাজ,মুখোশ সামগ্রী,মৃৎশিল্পের মাটির পুতুল শৌখিন জিনিসপত্র প্রসাধন সাজসজ্জা সামগ্রী প্রভৃতি সম্ভার দেখা যায়।চিড়া মুড়ি খই বাতাসা বাদামছাপা জিলিপির দোকান মেলায় বসে ।মেলায় বিনোদনের ব্যবস্থাতে যাত্রা পালাগান কবিগান পালাগান কীর্তন গম্ভীরা ভাটিয়ালি বাউল গাজন তর্জা ছৌনাচ হয়।রাধা-কৃষ্ণ,শিব-পার্ব্বতী,লাইলী মজনু পালাগান হয়। মেলাতে নাগরদোলা,সার্কাস,নাটক,বায়োস্কোপ, খুব আকর্ষনীয়। এছাড়াও ঘুড়ি ওড়ানো,ষাঁড়ের লড়াই,মোরগ লড়াই,পয়রা ওড়ানো,মিউজিক্যাল চেয়ার, নৌকা বাইচ, বহুরূপী সাজসজ্জা হয়ে থাকে।
মানতেই হবে বাংলা নববর্ষবরণ যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব চোখ ধাঁধানোর মত।এই পয়লা বৈশাখ মিলন মেলা উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে বলীখেলা হয়।রাজশাহীর গম্ভীরা হয়।নববর্ষের প্রথম প্রভাতে ছায়ানটের উদ্যোগে জলবীন রমনার বটমূলে প্রভাতী অনুষ্ঠান হয়।বাংলা নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে রাঙ্গামাটি,বান্দরবন খাগড়াছড়ি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসব বৈসাবী আনন্দ মুখর পরিবেশে পালিত হয়।ত্রিপুরায় বৈসুক সাংগ্রাই বা চাকমায় বিজু এবং গোটা পার্বত্য অঞ্চলে বৈসাবি নামে পরিচিত এই উৎসব।নববর্ষের দিন মারস উপজাতীরা আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী পানিখেলা হয় ।এরা জলকে পবিত্র ভেবে তরুণ তরুণীকে জল ছেটায়। পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব খুব জনপ্রিয়।ঘরে ঘরে পেটুপুজা হয়।মনে রাখবার মত। গত বছরের সব দুঃখ কষ্ট দৈন্য মলিনতা ব্যর্থতা ভুলে আবার নতুন উদ্যমে সুখ সমৃদ্ধি শান্তির মঙ্গল কামনা নিয়ে শুরু হয় নববর্ষ বরণ উদযাপন।
যাইহোক ছোটবেলার একান্নবর্তী পরিবারে পয়লা বৈশাখ উদযাপন ছিল আলাদা এক মাত্রায় এবং অনেক আন্তরিক ছিল।আতিথীতা অনেক হৃদয়ঙ্গম ছিল।এই আর্থ-ভার্চুয়াল আত্মকেন্দ্রিক সামাজিক জগতে ব্যস্ততা আর স্বার্থসিদ্ধির স্বার্থপরতা এই উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।আর অফিস আদালত স্কুল কলেজে সব ইংরেজী ক্যালেণ্ডারের মত চলে।তাই অনেককে এখন হুট করে আজ কত তারিখ?যদি জিজ্ঞেস কর সে ইংরেজী ক্যালেণ্ডারের তারাখটি বলে দেবে।যদি না মনে থাকে হাতের মোবাইলটি দেখে ইংরেজী তারিখটি বলে দেবে ঝটাপট। অর্থাৎ বাংলা ক্যালেণ্ডারের তারিখ ভুলতে বসেছি এমন বাঙালি আমরা।এটা বা ঠিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।তাই চলতে গিয়ে ওই পয়লা বৈশাখ কোনরকম উদযাপন করছি।সেখানে কোথাও আন্তরিকতার অভাব দেখা দেয়।আমরা বাঙালি বারো মাসে তেরো দুগুনে ছাব্বিশ পার্বণ।
সে যাইহোক ভালোমন্দ নিয়ে চলতে হবে।এই পয়লা বৈশাখে শপথ করি আগে সারা বিশ্ব যেমন বলত 'বাঙালি যা ভাবে সারা পৃথিবী তাই ভাবে'।তেমন করে পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণের মাধ্যমে অঙ্গীকার বদ্ধ হই আমাদের চিরাচরিত ঐতিহ্য চিরাচরিত ছিল আছে এবং থাকবেও।
===================
নামঃ তপন মাইতি
ঠিকানাঃ গ্রামঃ পশ্চিম দেবীপুর; পোঃ দেবীপুর; থানাঃ মৈপীঠ কোস্টাল; জেলাঃ দঃ২৪ পরগণা; পিন-743383; পশ্চিমবঙ্গ। ভারতবর্ষ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন