শ্রাবণ মাসে
কাশীনাথ হালদার
মানুষ প্ৰকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত। প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য মানুষ উপভোগ করে প্রাণভরে। প্রকৃতির নিয়মেই আসে ঋতু বৈচিত্র্য। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ―এই ছয় ঋতু ঘুরে ফিরে আসে, চক্রাকারে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে গ্ৰীষ্মের সজীব-কঠোর তৎপরতা আর রুক্ষতার অবসান ঘটায় বর্ষা। এই বর্ষায় শীতল হয় তাপদগ্ধ বসুন্ধরা। বর্ষা আসে আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুটি মাসকে সঙ্গে নিয়ে। সুতরাং বর্ষা ঋতুর শেষ মাস হলাে শ্রাবণ।
শ্রাবণ মাসকে বলা যায় কবি-সাহিত্যিকদের মাস। কখনাে সোঁদা মাটির গন্ধে, কখনাে বকুল, কদম, কেয়াফুলের আঘ্রাণে মেতে ওঠেন কবি-সাহিত্যিক। আম জাম কাঁঠাল লিচু আনারস ইত্যাদির সাথে ইলিশও এসে পড়ে লেখায় এবং রেখায়। বিদ্যুৎচমক আর ঝিরিঝিরি কিংবা অঝোর ধারার বৃষ্টি, সৃষ্টি করে নতুন প্রাণের স্পন্দন। জোড়া লাগায় ফুটি-ফাটা মাটির ― একাকার হয়ে যায় মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। সম্ভবত, এমন কোনাে কবি-সাহিত্যিক নেই, যাঁর লেখায় বর্ষা আসেনি কিংবা আসেনি আষাঢ়-শ্রাবণের অনুষঙ্গ।
শ্ৰাবণ মাস বিভিন্ন ক্ষেত্রের নক্ষত্রদের পতনের মাস। শ্রাবণ মাস ব্যথাভরা
মাস। যে কবির কবিতা-গল্প-গানে বর্ষার ছড়াছড়ি, যাঁর সমগ্র কাব্যজীবনের ওপর রয়েছে বর্ষার প্রভাব, যার লেখনীতে
চিত্রিত হয়েছে―
"আজি শ্রাবণ ঘন গহন মােহে
গােপন তব চরণ ফেলে,
নিশার মত নীরবে নাথ
সবার দৃষ্টি এড়ায়ে গেলে।"
― সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে আমরা হারিয়েছি এই শ্রাবণের বাইশে। শুধু কী তাই, এই শ্রাবণে আমরাও হারিয়েছি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বদেশী আন্দোলনের উদ্যোগীপুরুষ উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপীঠভৈরব সাধকপ্রবর বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ মনীষীদের। বাংলা মায়ের এইসব কৃতী সন্তানদের আমরা দৈহিকভাবে হারিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাদের কীর্তি, তাদের সৃষ্টির মধ্যে তারা অমর হয়ে আছেন ― আছেন আমাদের সমস্ত হৃদয় জুড়ে।
আবার এই শ্রাবণ মাস হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র মাস। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, শ্রাবণ মাসে কিছু আচার পালন করলে তাদের মনস্কামনা পূরণ হবে। এজন্য যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা আলাদা গুরুত্ব দেন শ্রাবণ মাসকে।
শিবভক্তরা শ্রাবণ মাসকে শিবের মাস মনে করেন। এই মাসের প্রতি সােমবারই তাঁরা নিষ্ঠা সহকারে ব্ৰত ধারণ করেন। এই ব্রতের অন্যতম অনুষঙ্গ শিবের মূর্তি বা শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা। এই মাসে প্রতিদিন শিবভক্তরা স্নানের পর শিবস্তোত্র পাঠ করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিবদুর্গার আরতিও করেন। শিবভক্তদের
বিশ্বাস, এই মাসে স্ফটিকের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলে গৃহস্থের কল্যাণ হয় এবং শুভফল লাভ হয়।
শ্রাবণ মাস যা কিছু শুভচিন্তা, যা কিছু
শুভকথা ― তা শােনার মাস। মাঙ্গলিক কথা ও মাঙ্গলিক আচারে পূর্ণ থাকে এই মাস। এই যে এত সব আচার-অনুষ্ঠানের অবতারণা, তা হয়তাে শ্রাবণ শব্দের উৎপত্তি 'শ্রবণ' থেকে এসেছে বলেই।
আবার পুরাণমতে, সমুদ্রমন্থন হয়েছিল শ্রাবণ মাসে। সমুদ্রমন্থনের ফলে অমৃত ও অন্যান্য অনেক কিছু সঙ্গে উঠেছিল তীব্র বিষ বা হলাহল। আর সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেন শিব। তাই শ্রাবণ মাস দেবাদিদেব শিবের উৎসর্গীকৃত বা নিবেদিত।
●
********************************
Kashinath Halder
Vill. – Jelerhat
P.O. – Doltala Ghola
P.S. – Baruipur
Dist. – South 24 Parganas
West Bengal ● India
PIN – 743376
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন