কর্মযোগী ও সেবাব্রতী বিধানচন্দ্র রায়
ও জাতীয় চিকিৎসক দিবস
পাভেল আমান
প্রতিবছর ১ জুলাই ভারতবর্ষে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মদিন চিকিৎসক দিবস রূপে পালিত হয়। আমরা সকলেই বিধান রায়কে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার হিসেবেও তিনি জানি। তবে চিকিৎসক দিবসে তার অবদান গুরুত্ব রাজ্য তথা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছেই চিরস্মরণীয়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন চিকিৎসা একটা পেশা নয় চিকিৎসা মহান ব্রত মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি ছিলেন এক বিরলতম চিকিৎসক যা আজকের দিনেও আমাদের প্রত্যেকের কাছেই শ্রদ্ধা সম্মানের ও ভক্তির চরম দাবিদার।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না শতাব্দীর প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের পর থেকেই মানবতার প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠা চিকিৎসকরাই বাঁচিয়ে রেখেছে মানবজতিকে তাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে । চিকিৎসার সেবাটাকে তারা আবারও সম্মানিত ও মহিমান্বিত করেছে। আমাদের সমাজে, চিকিৎসকরা ঈশ্বরের একটি রূপ হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ তারা রোগ নিরাময় করে মানুষকে নবজীবন দান করে। যখন আমরা জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হেরে যেতে শুরু করি, তখন আমাদের জয়ী করার জন্য চিকিৎসকরাই পাশে এসে দাঁড়ায়। বর্তমানে অতিমারি করোনা ভাইরাসের কারণে সবাই যখন আতঙ্কে জর্জরিত, তখন সমস্ত রোগীর সেবা করতে এগিয়ে এসেছেন এই ডাক্তার, নার্সরাই। নিজেদের জীবনের প্রতি মায়া ত্যাগ করে তাঁরা লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে ডাক্তারদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত ঠিকই, তবে এই করোনা ভাইরাস মহামারীর সময় তাদের ভূমিকা আবারও প্রমাণ করে দিল যে, তাঁরা ছাড়া সমগ্র মানবজাতি অচল এবং তাঁরা আছেন বলেই আমরা সুস্থভাবে বেঁচে আছি।
এবারে আলোচনায় আসা যাক। চিকিৎসক দিবস পালনের নেপথ্যে বিধান চন্দ্র রায়ের বর্ণময় জীবনের আলোকপাতে । তিনি ১৮৮২ সালের ১ জুলাই বিহারের পাটনায় বাকি পুরে জন্মগ্রহণ করেন । চিকিৎসাবিদ্যা নয়, তিনি বাংলার বুকে বিজ্ঞান চর্চার গৌরবময় সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করার যে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তার মূল্য অপরিসীম। বিধানচন্দ্র কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে এল. এম. এস ও এম.বি পাস করেন এবং ১৯০৮ সালে এম. ডি ডিগ্রী লাভ করে বিলেত যান। সেখান থেকে মাত্র দু'বছরে এম. আর. সি. পি এবং এফ. আর. সি. এস পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন।
তিনি সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কলকাতায় কিছু নেতৃস্থানীয় মেডিকেল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । যার মধ্যে আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ, যাদবপুর টি.বি হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, কমলা নেহরু হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, এবং চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন তৎকালীন কলকাতার একজন নামকরা চিকিৎসক। শুধু কলকাতা নয়, বাংলার গণ্ডী ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও, যে পেশা থেকে তিনি অব্যাহতি নেননি। নিজের বাড়িতে প্রতিদিন নিয়ম করে রোগী দেখতেন। নামকরা ডাক্তার বলে, তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজী, জওহরলাল নেহরু কিংবা তাঁদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদেরই চিকিৎসা করতেন না, গরীব-দুঃখীরাও অবলীলায় তাঁর বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পেত, সমান মর্যাদার সঙ্গেই।
জানা যায়, বিধান রায় তাঁর রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে, বাসন্তী দেবী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ''বিধান, তুমি থাকতে উনি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন?'' বোঝা যায়, কী পরিমাণ ভরসা ছিল তাঁর চিকিৎসার ওপর। গান্ধিজী একবার বলেছিলেন, Bidhan is the safety hand of India. আজও কলকাতার বনেদী পরিবারগুলিতে বিধান রায়ের অদ্ভূত চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন গল্প অত্যন্ত জনপ্রিয়। যেমন, যিনি গ্যাস-অম্বলের রোগী, তাঁকে বলতেন বেশি করে চপ-ফুলুরি খেতে। তাঁর অদ্ভূত চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্রান্ত এমনই সব গল্প এখনকার প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয়। ডা: বিধান চন্দ্র রায় রোগীর মুখ দেখেই রোগীর রোগ বুঝতে পারতেন। একজন চিকিৎসক হিসেবে এটা বলতেই পারি এমন অনেক রোগ আছে যেটি মুখ দেখেই বলে দেয়া সম্ভব, চোখ দেখেই বলে দেয়া সম্ভব, কণ্ঠস্বর শুনে ধারণা করা সম্ভব, এমনকি শুধুমাত্র হ্যান্ডশেক করে বলে দেওয়া সম্ভব! বিধানচন্দ্র রায়ের মতন একজন মেধাবী ও এত জ্ঞানী মানুষের পক্ষে সেটি সম্ভব হবে এটি স্বাভাবিক এবং সাধারন মানুষ তার এই ব্যাপারটিতেই অলৌকিক বা অতি অসাধারণ মনে করেছেন এবং তাকে প্রায় ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
চিকিৎসক দিবসে এই মহান চিকিৎসক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার কর্মযোগী বিধানচন্দ্র রায় কে স্মরণ করার পাশাপাশি বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি কোভিড কালে উৎসর্গকৃত চিকিৎসা যোদ্ধাদের। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বেশ কিছু মহানুভব মানবিক উদারচেতা চিকিৎসক এখনো চিকিৎসাকে সেবার পর্যায়ে স্থান দিয়ে মানব সেবায় নিজেদের নিযুক্ত রেখেছে। এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য সমাজে চিকিৎসকদের অবদানকে স্বীকৃতি এবং তাদের কৃতিত্ব প্রদান করা। এছাড়াও, এই দিনটি চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কঠিন পরিস্থিতিতে একত্র হয়ে লড়াই করার উৎসাহ দেয়। এই দিনে, জনগণের মধ্যে আরও বেশি করে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অভিযানের আয়োজন করা হয়। এই দিবসটি উদযাপনের জন্য ফ্রি চেক-আপ ক্যাম্পেরও আয়োজন করা হয়।
চিকিৎসক দিবসে আমরা প্রত্যেকেই বিধান রায়ের জীবন দর্শন আদর্শ মূল্যবোধ স্মরণ করার পাশাপাশি সমাজের প্রকৃত চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য নিষ্ঠায় সম্মান প্রদর্শন করি। ভুলে না যাই এখনো বেঁচে আছে সমাজে প্রকৃত চিকিৎসক, যথার্থ সেবা। ঈশ্বর রূপে এখনো সেই সমস্ত চিকিৎসকেরা আমাদের প্রত্যেকের কাছেই শ্রদ্ধার সম্মানের ভক্তির এবং ভালোবাসার চির ধন্য ও প্রশংসিত। তাদের সেবাদানের নিরঙ্কুশ মানসিকতায় বাঁচিয়ে রেখেছে মনুষ্যত্বের প্রদীপ শিখা।
==========================
পাভেল আমান -হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন