Featured Post
গল্প ।। নি পা ত ন ।। চন্দন মিত্র
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নি পা ত ন
চন্দন মিত্র
জয়দেবদা আবার বিয়ে করেছে শুনে সক্কালবেলাতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। মাসছয়েকও হয়নি ছাড়াছাড়ি হয়েছে। এর মধ্যে আবার বিয়ে! আহা রে সুষমাদির ভাগ্যটাই খারাপ! বখাটে ছেলেকে ভালোবাসার ফল তো ভুগতেই হবে! বিয়ে করার আর ছেলে পেল না! এইজন্য বলে— যার সঙ্গে মজে মন...
সুষমাদি পড়াশোনায় বেশিদূর এগোতে পারেনি। অঙ্কে সে বরাবরই কাঁচা। অঙ্ককে ভূতের থেকে বেশি ভয় পেত। নাইন পর্যন্ত যা হোক পাঁচ-সাত পেয়ে পেয়ে বিশেষ বিবেচনায় উতরে গেছে। কিন্তু মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, স্ট্রেচারে শুয়ে একেবারে হাসপাতালে পৌঁছে যায়। এইভাবে সে কেবল অঙ্ক থেকে নয়, পড়াশোনা থেকেও জন্মের মতো নিষ্কৃতি পায়। যেটুকু বিদ্যা সে রপ্ত করেছিল, সেটুকু দিয়েই সে বাবার মুদিখানা দোকানের হিসাবনিকাশ বেশ সামলে নিতে পারে।
জয়দেবদার পড়াশোনার খতিয়ান আরও খারাপ। সম্ভবত প্রাইমারি স্কুলটাই সে ঠিকমতো শেষ করেছে। মদ-তাড়ি-গাঁজা সবেতেই সে হালকা হালকা পাঠ নিয়েছে। বাবা-মা আর তিন ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবারের সে কনিষ্ঠ সদস্য। পরিবারের মালিকানায় আছে আট-দশ বিঘে ধানজমি ও খান চারেক বড়সড় পুকুর। বড়দা-মেজদা খেতের কাজ আর পুকুরের মাছচাষের দিকটা দেখভাল করে। জয়দেব সাধ্যমতো তাদের সঙ্গ দেয়। সম্ভবত কেউই চায়নি জয়দেব বিয়ে করুক। কারণ, সংসারে অনর্থক খরচ বাড়বে। বোকাসোকা ছেলেটার হয়তো চোখও খুলে যাবে; নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে চাইবে। তখন বড়-মেজো বউয়ের আয়েশি যাপনে হয়তো তার আঁচও পড়বে। তবে হ্যাঁ, জয়দেবকে দাদা-বউদিরা যতটা বোকা ভাবত সে ততটা বোকা নয়। সংসার থেকে নগদ কিছু হাতে না-পেলেও সে ঠিক সুযোগ বুঝে উপার্জন করে নেয়। নীলুদের জমি লিজে নিয়ে সে ঝিঙে, শসা, ঢেঁড়স, উচ্ছে, চিচিঙ্গে, কাঁচালঙ্কা, টম্যাটো এইসব সবজি ফলায়। সেইসব সবজি পাইকারি না দিয়ে নিজেই সংগ্রামপুর, বাসুলডাঙ্গা, কপাটহাট, রত্নেশ্বরপুর ইত্যাদি বাজারে বিক্রি করে আস। এছাড়া মাছধরায়ও সে দক্ষ। প্রায় সারাবছরই সে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী-খালে ছিপ বা জাল ফেলে ভেটকি, চিতল, রুই-কাতলা-মৃগেল, পারশে বা গলদা চিংড়ি ধরে। এসব মাছ সে নগেন্দ্রবাজারের আড়তে বিক্রি করে আসে। বর্ষা এলে তার রাতের ঘুম চলে যায়। পাঁচ-ব্যাটারি টর্চ আর বর্শা হাতে নিয়ে সে মাঠে মাঠে কই, মাগুর, শিঙি, শোল, ল্যাঠার সন্ধান করে বেড়ায়। এইসব জিওল মাছ সে আড়তে নিয়ে যায় না, ডায়মন্ড হারবারের প্রফেসার ও ডাক্তারদের বাড়িতে বা কোয়ার্টারে চড়াদামে বিক্রি করে আসে। সেই টাকা সে বাজে খরচ করে উড়িয়ে দেয়নি। বরং তিলতিল করে সেই টাকা সে ব্যাঙ্কে জমিয়েছে। এইভাবে তার অ্যাকাউণ্টে যে লক্ষাধিক টাকা জমে গেছে একথা কাকপক্ষীতেও টের পায়নি।
এহেন জয়দেবদার ভিতরেও প্রেম উছলে উঠেছিল সুষমাদিকে দেখে। পাশের গ্রাম মহারাজপুরের গোষ্ঠমেলায় গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয় সাত-আট বছরের ছোটো সুষমাদির। মাসখানেক পরে একদিন আসন্ন সন্ধ্যায় মহারাজপুরের ছেলেরা সুষমাদিও জয়দেবদাকে আবিষ্কার করে দক্ষিণ-মাঠের নির্জন পাকুড়তলায়। হইচই বেধে যায়। ছেলেরা নাছোড়বান্দা, দুজনকে বিয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। জয়দেব বলেছিল— আমি সুষমাকে ভালোবাসি। আমাকে তো তোরা ভালো করেই চিনিস ; হিজলডাঙায় বাড়ি। আমাকে এক সপ্তা সময় দে।
এক সপ্তাও সময় দিতে হয়নি। দুদিন পরেই ভোরবেলা জয়দেবদা সুষমাদিকে নিয়ে হাজির হয়েছিল ডায়মন্ড হারবার স্টেশনে। সেখানে টিকিট কেটে অপেক্ষা করছিল কেষ্ট, শিবে, নোদো আর শেখর। সবাই মিলে চেপে বসেছিল শেয়ালদাগামী আপ ডায়মন্ড হারবার লোকালে। গন্তব্য, সুভাষগ্রাম। পাড়ার ছেলে মিন্টু গড়িয়ায় মোজার কলে কাজ করে বেশ পয়সা করেছে। সুভাষগ্রামে দুকাঠা জায়গা কিনে মুলিবাঁশের দরমা দিয়ে ঘর বানিয়ে সে সস্ত্রীক থাকে। বউ মিনতিও হিজলডাঙার মেয়ে। রবিবার। জয়দেব আগেভাগে খবর দেওয়ায় মিন্টু ও মিনতি উভয়েই ঘরে ছিল।
সুভাষগ্রামে ট্রেন যখন পৌঁছাল তখন সকাল ছটা। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। মিন্টু ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে আগাম কথা বলে রেখেছে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। সবকিছু রেডি রাখতে হবে। পাঁচটায় তিনি চলে আসবেন। জয়দেবদা ও সুষমাদিকে অভুক্ত রেখে বাকিরা বেশ সাঁটিয়ে মাছমাংস সহযোগে ভুরিভোজ সেরে নেয়। ঠাকুরমশাই যখন এলেন, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা পঁচিশ। দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাঙালির টাইমে কমপক্ষে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ছাড় তো দিতেই হয়। যাবতীয় মাঙ্গলিক কর্মকাণ্ড সেরে ঠাকুরমশাই, জয়দেবদা ও সুষমাদির চার হাত এক করে দিলেন। এমন সময় কোত্থেকে একটি ছেঁড়া স্যান্ডেল এসে পড়ল জয়দেবদা ও সুষমাদির মিলিত চার হাতের উপর। ঠাকুরমশাই তাঁর পৌরোহিত্যের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমন ভয়ানক অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হননি কোনোদিন। তিনি ছেঁড়া স্যান্ডেলটির দিকে তাকিয়ে মন্ত্র ভুলে গেলেন। সুষমাদির চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরতে লাগল। উপস্থিত সকলেই এমন অশুভ লক্ষণ দেখে অমঙ্গল আশঙ্কায় হতভম্ব হয়ে গেল। মুখ খুলল জয়দেবদা— ঠাকুরমশাই চালিয়ে যান। উপর থেকে আমার ঠাকুরদা তাঁর নাতি ও নাতবউকে আশীর্বাদ করল। বুড়ো আমাকে খুব ভালো বাসত। একসঙ্গে হুঁকো টানতুম তো, নাতির বিয়েতে বুড়ো আর আনন্দ ধরে রাখতে পারেনি। তাই এই নমুনাটি পাঠাল। মিনতি মাসখানেক আগে মিন্টুর ছেঁড়া স্যান্ডেলজোড়া টিনের চালে গুঁজে রেখেছিল। তার একপাটি পতনের ফলেই এমন অনাসৃষ্টি! তখনই সবাই জেনে গিয়েছিল— বিয়েটা টেকার নয়। নচেৎ ছেঁড়া জুতোটা পড়বার আর সময় পেল না। ঠাকুরমশাই একটা শান্তি স্বস্ত্যয়নের বিধান দিয়েছিলেন। জয়দেবদা তৎক্ষণাৎ তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। সুষমাদিও সায় দিয়ে বলেছিল—ওসবের দরকার নেই। আমার মানুষটা ভালো। ওর কথাই আমার কথা। তাছাড়া জুতো পড়ার উপর শুভ-অশুভ কিছুই নির্ভর করে না।
বিয়েটা শেষমেশ টেকেনি। দুই দাদা, দুই বৌদি, বাবা-মা কেউই জয়দেবের এই বিয়ে মেনে নেয়নি। মেনে নেবেই বা কেন তাদের বাড়ির ছেলে কী এতই ফ্যালনা, যে পণ পাবে না! আর তাছাড়া সামান্য এক মুদির মেয়ে হবে হালদার বাড়ির বউ! এমন অশান্তি ঘনিয়ে ওঠে যে, সুষমাদি বাপের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ বলতে থাকে জয়দেবদা নাকি বাড়ির লোকের সঙ্গে যুক্তি করে সুষমাদিকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
জয়দেবদা আবার বিয়ে করেছে শুনে সক্কালবেলা মেজাজটা বিগড়ে গেল। শুনলাম তার বাড়ির লোকজন নাকি এই বিয়েটাও মেনে নেয়নি। তারা জয়দেবদাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জয়দেবদা নতুন বউকে নিয়ে আমাদের পাড়ায় নরেশদের ঘর ভাড়া নিয়েছে। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে চললাম নরেশদের বাড়ি। সুষমাদির কথা ভেবে চোখে জল এসে গেল। জয়দেবদাকে আজ ছাড়ব না। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে ও পার পাবে না। যা হয় হবে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব! ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। জয়দেবদাই আমাকে প্রথম দেখতে পেল। গামছা পরে হাতে একটা ঝুলঝাড়া নিয়ে সে নতুন বাসস্থান ঝাড়ামোছায় লেগে পড়েছে। আমাকে সাদরে আহ্বান জানিয়ে বলল— আরে নবীন যে, এসো ভাই! সুষমা, কোথায় গেলে গো, দ্যাখো কে এসেছে! তোমার ছোটো মামার ছেলে গো। আমাদের নবীনচন্দ্র ...
===============================
চন্দন মিত্র
ভগবান পুর ( হরিণডাঙা )
ডায়মন্ড হারবার , দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন