রথ
পূজা পাত্র
বছর আটেক আগে - আজকেরই দিন। এমনই মেঘলা থমথমে দিন - যেনো গুমোট মেরে বসে আছে বোধহয় আজকেরই কথা ভেবে।
আমার বড় কষ্ট হয় ওদের জন্য। আমার দুই আত্মীয় প্রেমিক-প্রেমিকা। কি নাম ছিল তাদের তা আমার মনে নেই এই মুহুর্তে। আমি তাদের শৈল আর প্রবাল নামে ডাকতাম। দুজনই কিশোর - কিশোরী। বয়স চৌদ্দ বা ষোলো সম্ভবত। প্রবাল আমাদের শৈলর থেকে বয়সে একটু বড়।
আমাদের শৈলর মুখ খানি বড় মায়াবী, আর চোখ দুটো কৌতুহলী।তখন অবশ্য দেহে জোয়ার আছড়ে পড়েনি। যে তাকে আজকের চোখে সুন্দরী মনে হবে। কিন্তু আমার চোখে সে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। আর এক জনের চোখেও-সে প্রবাল। মুখ খানা তার পুরো গোল ঠাকুরের মুখের আদলে গড়া।যত্নেই বিধাতা মহাশয় বানিয়ে ছিলেন বোধ করি। মেদবর্জিত গলা আর চিবুক।ঠোঁট দুটো এবং মুখের নিচের অংশটায় বেশ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বিধাতা। তবে গোলাপি নয় ঠোঁট এর রঙ বেগুনি বরং কালচে বেগুনি। চুল গুলো ঠিক আজকের মত সুন্দর নয়,কিন্তু ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মরুভূমির ভাঁজের মত তবে মাঝারি ধরণের -খুব লম্বা নয়। গায়ের রঙ শ্যামলা।
আর প্রবাল আমার দেখা অন্যতম সুন্দর কিশোর। চেহারাটা ছিপছিপে নয় প্রয়োজনীয় মেদ দিয়ে গঠিত। অত্যন্ত ফর্সা। মুখটা কিছুটা লম্বাটে ধরণের কিন্তু উজ্জ্বল চোখ ভ্রু দুটো ঘন কালো। গোঁফের রেখা তখনও বেরোয়নি বোধহয়। ঠোঁট দুটো বিশেষ আকর্ষণীয়। অনেকটা নীল অপরাজিতার মাঝে গোলাপি অপরাজিতা।একালে তাকে দেখে যে কেউ কিউট গুবলু হট ইত্যাদি বলত বোধহয়। কিন্তু আমায় ওর ঘাড়ের আর পায়ের তিল টাই বেশি দৃষ্টি কেড়েছে। হাইট দুজনের প্রায় একই।প্রবাল একটু লম্বা শৈলর থেকে। দুজন দুরকম। একজন সূর্যের মতো আর একজন সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষীয়মান চাঁদ। কিন্তু নিজ অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান বরং একটু অন্যরকম সৌন্দর্য নিয়ে।
সেবারও রথের দিন ছিল।তার কিছু আগে থেকেই বোধহয় দুজন দুজনের প্রেমে পড়েছে। সারা দিন দুজনে প্ল্যান করেছে বাড়ির লোকের চোখে ধুলো দিয়ে কি করে এক সাথে রথ টানবে কিন্তু কেউ বুঝবেও না। সে যাই হোক প্ল্যান আর এক জনও দারুণ করে রেখেছে শৈলর বন্ধু তৃণা। ওকে ছাড়া শৈল অচল।
সেসব না হয় হল। কিন্তু সেদিন শৈল এরকম মন মরা কেনো ছিল? ওকে এরকম দেখলেই প্রবাল রেগে যায়।ওর মনে হয় এত দ্বিধা দন্দ্ব নিয়ে প্রেম করার কি দরকার বাবা।এত কেনো ঢং করে মেয়েটা।এরকম প্রেমিকা কি ও চেয়েছিলো? সে ও যাই বলুক ভালো ও খুবই বাসে শৈলকে।
কিন্তু সেইসবের আগেই প্ল্যান ভেস্তে গেলো। হঠাৎ করে দুপুর থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি সুতরাং বেরোনোর ইতি গজঃ। কিন্তু না ওসব বৃষ্টি থাক ছাতা নিয়েই শৈল রথ টানতে যাবে। প্রবাল ও এসেছিল। কথা যখন দিয়েছে আসবে তো বটেই। দুজনের এক সাথে রথ টানা হয়েছিল কিনা আমার মনে নেই। কিন্তু শৈল বলেছিলো ওরা ভুট্টা খেয়েছে আর বৃষ্টি তে ভিজেওছে এক সাথে কিছুটা দূরত্বে।
এইসব কিছু সবার চোখে না পড়লেও একজনের চোখে পড়েছিলো। প্রবাল - শৈলর মাস্টারমশাই। তিনি তো বলেই গেলেন ' রথ দেখা কলা বেচা এক সাথে চলছে দেখছি' । কি জানি কি করে ওনার চোখে ধরা পড়লো। ওরা দুজন কিন্তু খুব সতর্ক ভাবেই দেখা করত। বন্ধু নয় বরং দুজনকে অপরিচিত বন্ধুই বেশি মনে হতো। এমনই আচরণ ছিল তাদের তবুও কেউ যে হঠাৎ সেই আচরণের মুখোশ খুলে আসল জিনিসটাই বুঝে যাবে ভাবেনি ওরা।
প্রবাল এসবের ধার ধারে না।সে বলে, 'মাস্টারমশাইও এক সময় প্রেম করেছে, ও আবার কি বলবে।'
কিন্তু সেদিন যখন শৈল আর তৃণা পড়তে গেলো মাস্টারমশাই তাদের বলেছিলেন - "বাল্য প্রেমে অভিসম্পাত"।
কি এই অভিসম্পাত - ও ওরা বুঝতে চায়নি পাছে ভয়ংকর একটা অর্থ বেরোয়।
আজ তৃণার কাছে শুনি ওদের নাকি আর প্রেমটা নেই। এখন ওরা জানে এর অর্থ কী। তবু নাকি শৈল মানতেই চায় না এইসব।
হঠাৎ রথের আগমনের আনন্দে রোড থেকে একটা কোলাহল এলো। আমি আর তৃণা শৈলকে নিয়েই রথ দেখতে যাব। আর প্রবাল? সেও হয়তো রথ দেখতে আসবে অন্য কোথাও অন্য কোন খানে অথবা আসবে না।
==================
পূজা পাত্র
বৈদ্যবাটি, হুগলি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন