শাশ্বতী চ্যাটার্জী
মিতালি হনহন করে আমাদের কাছে এসে বলে, রবি,আজ একদম ভোরে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি।তোর স্বপ্নতত্ত্বের গবেষণা কী বলে তা জানতে আসলাম।
রবি বলে, তুই শান্ত হয়ে বোস আগে।পরে কথা হবে।
কিছুটা শ্বাস নিয়ে মিতালি বলতে শুরু করে, জানিস আজ ভোরে হঠাৎ দেখি একটা ছোট মেয়েকে একজন মানুষ জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর ছোট মেয়েটা 'মা মা' বলে চিৎকার করে কাঁদছে।লোকটার মুখের গড়নটা খুব রাগী।ভয়ে একেবারে ঘাম দিয়ে ঘুম ভেঙে যায়।
- একটু ভেবে দেখ তো, এই মেয়েটাকে তুই আগেও স্বপ্নে দেখেছিস কিনা? অথবা সেই মানুষটাকে?
- তা ঠিক বলতে পারবো না।আমার তো স্বপ্নের কথা মনে থাকে না।
- সব স্বপ্নের কথা প্রায় কারোরই মনে থাকে না।কিন্তু কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষের মনে থাকে।বিশেষ করে যে স্বপ্ন দেখে মানুষ ভয় পায়,তা অনেক সময় মানুষের মনে থাকে।
- কথাটা ঠিক বলেছিস।ওই মেয়েটাকে আগে দেখেছি কিনা মনে নেই।তবে একটা টালির চালা ঘরের ভাঙা দরজার সামনে ছেঁড়া কাপড় পরা এক মহিলাকে কিন্তু আমি আগেও দেখেছি।
- কবে?
- বেশ কয়েকবার দেখেছি।
- কিন্তু এই স্বপ্নের সঙ্গে তুই ওই স্বপ্নকে মেলাচ্ছিস কেন?
- আসলে যে মেয়েটা 'মা মা'বলে চিৎকার করছিলো, আমার মনে হচ্ছে এটাই ওর মা।
- কেন এমন মনে হচ্ছে?
- তা জানি না।কিন্তু ওই মানুষটা এই ভদ্র মহিলাকে থাপ্পড় মারছে - এমন স্বপ্ন আমি আগে দেখেছি বলে মনে হয়?
- তাতেই বা এই মেয়েটার সাথে লিংক করছিস কেন?
- তখনও আমি শুনেছি যে একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না।আর আজ সকালে দেখা ওই মেয়েটার কান্নাটা যেন অনেকটা এক রকম।
- আচ্ছা,তোর জন্ম তো এই কলকাতাতেই?
- না,আমার জন্ম বিহারে ভাগলপুরে। বাবা তো তখন জিএসআই এ ফিল্ড ওয়ার্কার ছিলো।গ্রামে গঞ্জে মাইন অফিসারদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।
- তোরা কলকাতায় কত বছর ধরে আছিস?
- তা ১৮/১৯ বছর তো হলোই।
- তোর ছোট বেলার কথা কিছু মনে পড়ে?
- হ্যাঁ,প্রথমে আমরা কাশিপুরে আসি।ওখানেই একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই।তারপর চলে আসি এখানেই।বাবা ফ্ল্যাট কেনে।
- ভাগলপুরে কোন গ্রামে তোর জন্ম বলতে পারবি?
- মার মুখে শুনেছি,ওখানে শালবাথান নামে কোন গ্রামে।
- এখনই তোর স্বপ্নের কোনো সমাধান করতে পারছি না।পড়ে ভেবে বলবো।আচ্ছা কাল তুই ইউনিভারসিটি যাবি?
- হ্যাঁ,কাল যেতেই হবে। কেন তুই যাবি নাকি?
- যেতে পারি।একবার স্যারের সঙ্গে দেখা করা দরকার।সে যাক,তোর বাবা কি অফিস যাচ্ছেন?
- হ্যাঁ।সামনের বছর জানুয়ারিতে তো বাবা অবসর নেবে।
- ও,ঠিক আছে।যদি কাল ইউনিভারসিটি যাই, তবে তোদের ডিপার্টমেন্টে একবার যাবো।
- ঠিক আছে।আমার স্বপ্নটা নিয়ে ভাবিস কিন্তু।
মিতালি চলে যেতেই রবি আমায় বলে,
- কাল ১২টা নাগাদ একবার মিতালিদের ফ্ল্যাটে যাবো।তুই রেডি থাকিস।
পরের দিন যথা সময়ে মিতালিদের ড্রয়িং এ বসে রবির সঙ্গে মিতালির মায়ের কথাবার্তা শুরু হয়।রবি প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময় করে জিজ্ঞেস করে,
- মাসিমা মিতালির জন্ম তো ভাগলপুরে,তাই না?
- হ্যাঁ,তখন তো ওর বাবা চাকরি সূত্রে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো নানা জায়গায়।রবি,হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
- আপনি হয়তো জানেন যে কাল মিতালি যে স্বপ্নটা দেখেছে,সেটা নিয়েই ভাবছি।
- তুমি এখন ওর স্বপ্ন নিয়ে পরে আছ!ছাড়ো তো ওইসব।ও একটা স্বপ্ন দেখলো আর তুমি তা নিয়ে ভেবে মরে যাচ্ছ।
- মাসিমা ওটাই তো আমার গবেষণার কাজ।
- তা ঠিক আছে।তবে ওই প্রসঙ্গ ছেড়ে দাও।ওটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
- না মাসিমা,আমার গবেষণার ক্ষেত্রে সবই খুব গুরুত্বপূর্ণ।আপনি শুধু বলুন,ওর যখন জন্ম হয়,তখন আপনারা কোন গ্রামে থাকতেন?
- গ্রামের নাম তো আমার মনে নেই!
- কিন্তু মিতালি যে বলল,গ্রামের নাম শালবাথান।
- তাই!হয়তো হবে।আমার মনে নেই।তবে আমি ঐ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলতে চাই না।
- কিন্তু মাসিমা এটা যে আমার জানা খুব দরকার।
- কিন্তু আমার তো প্রায় কিছুই মনে নেই।তাছাড়া আমি ঐ প্রসঙ্গে কিছু বলতেও চাই না।
- ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না,কিন্তু এই টুকু বলুন যে কোন হাসপাতালে মিতালির জন্ম হয়?
- হাসপাতালে নয়,বাড়িতেই ওর জন্ম হয়।গ্রামের দিকে সেই সুযোগ তখন ছিলো না।তোমরা চা খাবে?
- হ্যাঁ,খেতে পারি।
মিতালির মা যখন চা বানাতে যায়,তখন রবি নেটে মগ্ন হয়ে যায়।মিতালির মা চা নিয়ে আসলে রবি সোজাসুজি প্রশ্ন করে বসে,
- আচ্ছা মাসিমা,শাল বাথান গ্রামে তো একটা সরকারি গ্রামীন হাসপাতাল আছে।তাছাড়া ওখান থেকে তিরিশ কিলো মিটার দূরে শহরে তো একাধিক হাসপাতাল ও নার্সিং হোম আছে।আপনি কেন তাহলে কোনো হাসপাতালে গেলেন না?
- আমি তো তোমায় বললাম,আমি এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলবো না।
- ঠিক আছে আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না।তবে আমাকে কিন্তু জানতেই হবে।দেখি কি করা যায়!তবে একটা অনুরোধ করবো মাসিমা?
- বলো।
- মিতালির বার্থ সার্টিফিকেটটা একটু দেখবেন?
আমি লক্ষ করি মুহূর্তে মিতালির মায়ের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেছে।মুখে প্রবল রাগ।উনি বলে ওঠেন,
- অসম্ভব।এবার তোমরা আসতে পারো।
রবি বলে,
- আমি কিন্তু সন্দিগ্ধ মনে ফিরে যাচ্ছি।হয়তো অন্য কোনো ভাবে আমাকে খোঁজ নিতে হবে।
- তুমি এটা নিয়ে পড়ে আছো কেন?প্লিস এসব ছেড়ে দাও রবি।আমার সংসারের অশান্তির কারণ হয়ে উঠো না তুমি।
- একটা কথা আপনাকে আমি দিতে পারি,আমরা এই তিনজন ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ এইসব কোনো কথা জানবে না।
- তুমি কি বলতে চাইছ?
- আমার গবেষণা বলছে,মিতালির শৈশবকাল খুব সহজ সরলভাবে কাটে নি।কোনো একটা রহস্য এখানে আছে।একজন দুস্থ মহিলা,একটা ভাঙা চালা ঘর - ইত্যাদি কিন্তু এই স্বপ্নের মধ্যে আছে।
মিতালির মায়ের মুখে ঘনীভূত রাগ গাম্ভীর্য যেন ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে - অনেকটা গরমে হিমালয়ের বরফ গলার মতো।এবার সামান্য ভেজা গলায় মাসিমা বলেন,
- প্লিস রবি,তুমি এখানে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না।তোমার গবেষণা থেকে মিতালির জন্মের কথা বাদ দাও।
- আমার কাজ আমাকে করতে দিন মাসিমা।তবে আপনাকে তো কথা দিয়েছি,আমাদের কোনো আলোচনাই কোনো চতুর্থ ব্যক্তি জানবে না।
- মাথা নিচু করে মাসিমা কিছু সময় বসে থেকে যখন আমাদের দিকে তাকায়,তখন ওনার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।উনি অনেক ভার মুক্ত হয়ে বলেন,
- তোমরা আমায় কথা দিয়েছ যে কোনো চতুর্থ ব্যক্তি আমাদের এই আলোচনা জানবে না।তবে চতুর্থ একজন আছে যে সব জানে।সে হলো, মিতালির বাবা।
চোখটা আঁচল দিয়ে মুছে মাসিমা গড়গড়িয়ে বলে যায়,মিতালি আমাদের সন্তান না।আমরা নিঃসন্তান দম্পতি।ভাগলপুরের সেই শালবাথান গ্রামে মিতালির জন্ম।ওর বাবা ওদের উপর ভীষণ অত্যাচার করতো।ওর মা আমার বাড়িতে কাজ করতো।আমাকে সব বলতো।একদিন ওর বাবা অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে চলে যায়।আর মিতালির মা কয়েকদিন পরেই পথ দূর্ঘটনায় মারা যায়।লোকাল পুলিশের পরামর্শে ছোটো মেয়েটা আমাদের কাছে সাময়িকভাবে থাকে।ইতিমধ্যে ওর বাবার প্রমোশন হয়।কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে যায়।তখন একদিন আমরা দুজন মেয়েটাকে নিয়ে থানায় যাই।অফিসারকে বলি যে আমরা নিঃসন্তান।আমরা মিতালিকে নিয়ে কলকাতা যেতে চাই।
- কিন্তু এভাবে তো কোনো শিশুকে আনা যায় না মাসিমা।থানার অফিসার আপত্তি করেন নি?
- উনি দায়মুক্ত হয়েছেন।সেই অজ গ্রামে কোথায় নিয়ম আর কোথায় কানুন।উনি শুধু আমার স্বামীর অফিসের কিছু কাগজপত্র দেখে নোট রেখে আর আমাদের কাছ থেকে একটা ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের কলকাতায় চলে আসতে বলেন।
- তখন মিতালির কত বয়স ছিলো মাসিমা?
- পাঁচ বছর তিন মাসের মতো।
রবির মুখে একটা প্রশান্তির হাসি।ও বলে,আমরা খুব খুশি মাসিমা। এমন দারুন একটা মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।আর আবার বলছি,মিতালির এই স্বপ্নের কথা আমার গবেষণাপত্রে থাকবে না।থাকবে শুধু আমাদের হৃদয়ে।ধন্য আপনারা।
এবার আমি বলি,মাসিমা একবার আপনাকে প্রণাম করতে দিন। একটা প্রশান্ত মনে আমরা বাড়ির পথ ধরি।
- সমাপ্ত -
শাশ্বতী চ্যাটার্জি
বি টি রোড, কলকাতা ৭০০১১৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন