Featured Post
বই আলোচনা ।। বই: আঠারোভাটির ইতিকথা (প্রথম খণ্ড, আবাদ পর্ব), লেখক: ড. স্বপনকুমার মণ্ডল ।। আলোচক: অরবিন্দ পুরকাইত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বই আলোচনা
যোগ্য হাতে সুন্দরবনের উজ্জ্বল ইতিকথা
অরবিন্দ পুরকাইত
সুন্দরবন গবেষণার অন্যতম উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী গ্রন্থ আঠারোভাটির ইতিকথা। 'আবাদ পর্ব' হিসাবে বইটির এটি প্রথম খণ্ড। পর্বে পর্বে উঠে আসার কথা সমগ্র সুন্দরবন তার সামগ্রিক রূপে। লেখক ড. স্বপনকুমার মণ্ডল সুন্দরবনেরই ভূমিপুত্র। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার গোসাবা থানার শান্তিগাছি গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন হুগলি, বর্ধমান ও কলকাতায় বসবাস তাঁর। কর্মসূত্রেই হোক বা সুচারুরূপে জীবনযাপনের নিমিত্ত, অনেক দিক দিয়ে সুযোগসুবিধাবঞ্চিত গ্রাম থেকে অনেক ভুমিপুত্রকন্যাকেই নাগরিক জীবন গ্রহণ করতে হয়, কিন্তু উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে প্রকৃতিরই সন্তানের মতো নির্ভার অন্তত কেবল শৈশব-কৈশোর-কাটানো মানুষের পক্ষে জন্মভূমির টানও সারাজীবনই যাবার নয়। জন্মভূমির প্রতি টান দায়বদ্ধ করেছে তাঁকে আপন গবেষণার বিষয় হিসাবে বেছে নিতে নিজের ধাত্রী একাধারে সহজ সুন্দর রহস্যঘেরা সুন্দরবনকে। জন্মভূমির সঙ্গে যোগাযোগও রয়েছে তাঁর নিয়মিত, জড়িয়ে রয়েছেন সেখানকার উন্নয়নমূলক বিবিধ কাজকর্মে, উদ্যোগে। নিজেরই চেনা জগৎ, ভালবাসার ভূমি, সহজপ্রাপ্ত সম্পদকেই তিনি বেছে নিয়েছেন তার সঙ্গে পরিচয় আরও আরও নিবিড় করতে; তার রহস্যময় সুপ্রাচীন অতীত থেকে বর্তমানের খতিয়ান খুঁজে বেড়াতে; তার গর্ব থেকে দুর্বলতার হালহকিকত সরজমিনে অনুসন্ধান করে দেখতে। এবং দেখাতে। পরিচয় যখন নিবিড়তর হয় তখন ইচ্ছা করেই পরিচিত করানোর। এটা একটা দায়বদ্ধতাও। বিশেষত অপরিচয়, অর্ধ বা আংশিক পরিচয় কিংবা ভুল-পরিচয়ের পাল্লাটাও যেখানে নিতান্ত কম ভারী নয়। তাঁর লেখাজোখার ভুবনও তাই প্রধানত সুন্দরবনময়। সাময়িক থেকে দৈনিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নিজের সম্পাদিত দক্ষিণের সাঁকো পত্রিকা সেসবের অনেকখানিরই ধারক। আর আছে গ্রন্থ। সুন্দরবন ভ্রমণ বৃত্তান্ত, আবাদি সুন্দরবন : ভূমি ও ভূমিভিত্তিক রাজনীতির ধারা ১৯৩০–১৯৭০, মরিচঝাঁপির কৃষ্ণতুলসী, মুখোমুখি, বর্ণদ্বীপ, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ইতিহাস চর্চা ইত্যাদি। সুন্দরবন নিয়ে কম কাজ হচ্ছে না, তার মধ্যে থেকেও তাঁর কাজ অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে গবেষণা জিনিসটা বড় সহজ কর্ম নয়। সুন্দরবনের স্থানিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে স্বপনকুমার মণ্ডল তাই আজ এক সম্ভ্রমজাগানো নাম।
গ্রন্থটি পুরোদস্তুর বিদ্যায়তনিক, যাকে বলে অ্যাকাডেমিক। সুন্দরবন সম্বন্ধীয় লেখাজোখার এক বৃহত্তর অংশই নন-অ্যাকাডেমিক। নন-অ্যাকাডেমিক লেখাজোখাও হেলাফেলার নয় নিশ্চয়ই এবং তার প্রমাণও এই গ্রন্থ – দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য-পরিসংখ্যান, সালতামামি, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত অ্যাকাডেমিক বা নন-অ্যাকাডেমিক কম বইপত্রের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়নি লেখককে। বিশেষত স্থানিক ইতিহাসের চরিত্রই হচ্ছে তার এক বৃহৎ অংশই বেঁচেবর্তে থাকে নন-অ্যাকাডেমিকের আশ্রয়ে। কেবল নন-অ্যাকাডেমিক লেখাজোখার মধ্যে নয়, নন-অ্যাকাডেমিক জগতের মানুষজনের মধ্যেও। ইতিহাস বা ইতিহাসের উপাদান অনেকসময় বলতে গেলে লুকিয়ে থাকে। কোথায় কতখানি লুকিয়ে আছে, কোন সামান্য তথ্য কোথায় অসামান্য হয়ে উঠবে তার কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না। একাধারে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের আকর সুন্দরবনকে প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাসের পথ বেয়ে আধুনিক কাল পর্যন্ত তার উল্লেখ থেকে পরিবর্তমান বৈশিষ্ট্যকে ধরেছেন লেখক সূত্র উল্লেখ-সহ বিভিন্ন মত বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তথ্যসূত্র-সহ বিস্তৃত টীকা-টিপ্পনী রয়েছে, গবেষণামূলক গ্রন্থের যা অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রচুর পরিভাষা এসেছে তাদের ব্যাখ্যা-সহ।
'লেখকের কথা' এবং গ্রন্থের নাম-শব্দ আঠারোভাটি-র উৎস, উল্লেখ, ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে 'আলোকপাত' শীর্ষক প্রথম লেখাটি পেরিয়ে পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে মোট দু'শো ছাপ্পান্ন পাতার বইটি। 'আঠারোভাটির আদিকথা', 'জনবসতি ও মিশ্রসংস্কৃতির বহমানতা', 'সুন্দরবনের লটদার-গাঁতিদার-চকদার প্রসঙ্গ', 'ঔপনিবেশিক শাসনে সুন্দরবনের ভুমিব্যবস্থা এবং অসংগঠিত রাজনীতির প্রবাহ' ও 'সুন্দরববনের লটদার-জমিদারগণের বংশধারা'। পরিশিষ্টে রয়েছে বেশ কিছু 'প্রাসঙ্গিক চিত্র', আর আছে সমৃদ্ধ এক তথ্যপঞ্জি। প্রতিটি অধ্যায়ই প্রয়োজনীয় বিস্তৃতি পেয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ ও ইংরেজ-আমলের সুন্দরবনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আলোচিত হয়েছে সুন্দরবন আবাদের উদ্দেশ্য, কাঠ-মাছ-লবণ-ধান-মধু-মোম ইত্যাদি নিয়ে নানারকম স্বার্থ-সংঘাত এবং সুন্দরবনের সীমানা নির্ধারণ। সুন্দরবনের জনবসতির গতিপ্রকৃতি, সেখানে ঔপনিবেশিকদের সাংস্কৃতিক প্রভাব, সেখানকার পাঁচালি সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক ধারা, সেখানকার বিবাহসংস্কৃতি, ভাটিয়ালি গান, আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় সাজানো। তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছে প্রথম পর্বের লটদারি, সাগরদ্বীপ, ইউরোপীয়দের ব্যর্থতা, পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি, লার্জ ক্যাপিটালিস্ট রুল, রায়তওয়ারি ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র এবং দ্বিতীয় পর্বের লটদারি ও লটদার-গাঁতিদার-চকদার। অসংগঠিত রাজনীতির পটভূমি, সংগঠিত রাজনীতির সূত্রপাত আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে হ্যামিল্টন এস্টেট ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সেখানকার তেভাগা আন্দোলন নিয়ে চতুর্থ অধ্যায়। পঞ্চম অধ্যায়ে লটদার-জমিদারদের বংশধারায় এসেছে বারুইপুরের রাজবল্লভ রায়চৌধুরী, জয়নগরের মিত্র ও দত্ত পরিবার, দুর্গাচরণ লাহা, টাকীর কালীনাথ মুনশি, মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, অদ্বৈতচরণ দত্ত, পিপ্রদাস পালচৌধুরী, ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন, রায়বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী, পাটঘরার জমিদারি : শিবচরণ লাহা থেকে দেবনারায়ণ হালদার, টাকী-শ্রীপুরের ঘোষ বংশ, গণেশচন্দ্র দাস নস্কর, ঈশ্বরচন্দ্র দিন্দা ও কৃষ্ণমোহন মূখার্জি, গোবিন্দচন্দ্র আঢ্য, নীলকণ্ঠ জানা ও চণ্ডীচরণ চট্টোপাধ্যায়।
সমৃদ্ধ বিস্তৃত বিচার-বিশ্লেষণের এই বইটির বেশির ভাগ দিক এখানে আলোচনায় আনা মুশকিল। তাই সূচিপত্রধৃত বিষয়গুলি উল্লেখ করতে হল। অতি প্রাচীনকাল থেকে যে ভূখণ্ডে মানুষের আনাগোনা, পুরাণেও যার উল্লেখ পাওয়া যায়, একদা সমৃদ্ধ নগরী ছিল যেখানে, মধ্যযুগের ভাটিদেশ থেকে ইংরেজ আমলে তার আবাদমহল হয়ে ওঠার ইতিহাস লিপিবদ্ধ এ গ্রন্থে। এ এক বঞ্চনার ইতিহাসও। জঙ্গলপরিকীর্ণ সুদীর্ঘ ভূমিভাগ লটে লটে হস্তান্তরিত হয়ে গেল পয়সাওলা এক শ্রেণির নাগরিকের কাছে। শহুরে বাবুশ্রেণির কেবল ছিল বিনিয়োগজাত লাভের সঙ্গে সম্পর্ক আর বছরে এক-আধবার যত্নআত্তি-সেলাম-সেলামি ইত্যাদি পাওয়ার মানসে নিজ লটে পদার্পণ। তেনাদের অধীনে কত প্রকার যে মধ্যসত্ত্বভোগীর উদ্ভব! গাঁতিদার, দর-গাঁতিদার, চকদার, হাওলাদার, ওসত-হাওলাদার, ঘেরিদার ইত্যাদি। বঞ্চিত হচ্ছেন কারা? বরাবর হয়ে আসে্ন যাঁরা – সভ্যতার পিলসুজরা। সত্যিকার সত্ত্ব তৈরি হয় যাঁদের হাতে। পেটের টানে বহুজন বাঘ-কুমীরের পেটে গিয়েও প্রাণপণ পরিশ্রমে জঙ্গল সাফ করে বের করতেন যাঁরা আবাদযোগ্য জমি, যাঁরা লবণ তৈরি করতেন, মধু-মোম সংগ্রহ করতেন – সেই সমস্ত চাষি-মজুরগণ। শোষিত-বঞ্চিত এই মানুষগুলোর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাঁদেরকে যদৃচ্ছ ব্যবহার করা, শাসন-শোষণ করা। আর উপনিবেশের মধ্যে উপনিবেশ গড়ে তুলে যার মধু লুটত মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এমনকি স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের সমবায় উদ্যোগও রেহাই পায়নি যার হাত থেকে। 'ঊনিশ ও বিশ শতকের ব্রিটিশ শাসনে জঙ্গল উৎপাটন করে, বাঁধ বেঁধে যে ভূমি আবাদযোগ্য হয়ে ওঠে তার মালিকানা চলে যায় শহরে। আবাদভুমির বাসিন্দারা হয়ে ওঠেন জীবনধারণের বিনিময়ে শ্রমদানকারী। এইভাবে গড়ে ওঠে ভূস্বামী ও ভূমিহীন কৃষিজীবীর মধ্যে এক মিথোজৈবিক বন্ধন (Symbiotic bond)। এক পক্ষ লভ্যাংশভোগী এবং অন্যপক্ষ জীবনের দায়ে দিনাতিপাতকারি শ্রমজীবী। আঠারোভাটির আবাদ মহলের পরিচয় পর্বে লটদার-গাঁতিদারদের সুলুক-সন্ধান প্রকৃতপক্ষে আবাদকারী সেইসব মানুষের ইতিহাস সন্ধান, যাদের পরিশ্রম অথবা আত্মত্যাগে অসংখ্য দ্বীপখণ্ড বসবাসযোগ্য হয়েছে।' সুন্দরবনের মিশ্র মানবসত্তা এবং তাঁদের পারস্পরিক প্রায় সমধর্মী যাপনগত সুখ বা সমস্যা যে নৈকট্য তৈরি করে, বনবিবি-সত্যপীরের মতো লৌকিক দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাসেও তার প্রতিফলন দেখি আমরা। 'মেদিনীপুর থেকে আগত কৈবর্ত্য সমাজ, ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে আগত আদিবাসী জনজাতি, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পৌণ্ড্র-নমঃশূদ্র এবং ২৪ পরগণার মুসলিম, পোদ, বাগদি খণ্ড খণ্ড দ্বীপে জাগতিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মানত মানেন এই সব লৌকিক চরিত্রদের। জাতি-ধর্মের ছুৎমার্গ, বর্ণবৈষম্য বা অস্পৃশ্যতা সুন্দরবনের ভূমিতে কখনই মাথাচাড়া দিতে পারেনি। হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্বের অনুশীলন থাকলেও লৌকিক দেবদেবীর মহিমা কখনও সুন্দরবনবাসী অগ্রাহ্য করতে পারেন না।' উর্বর মৃত্তিকা, মাছ-কাঠ ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হয়ে অর্থনৈতিক মন্দা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, বিদেশি আক্রমণের সম্ভাবনা, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার মতো দুর্দিনে সুন্দরবনের তুলনায়-নিরাপদ ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে মানুষ এমনও আভাস দিয়েছে জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যান। সুন্দররবনে মগ-ফিরিঙ্গির অত্যাচার, সেখানকার লবণ তৈরির রূপরেখা তথা তাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি-রাজনীতি, ধানচাষের ধরন-ধারন, সুন্দরবনের সীমানা নির্ধারণ, সেখানকার পাঁচালি সাহিত্য, তার আদিবাসী সংস্কৃতি, পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ভূমিব্যবস্থা নিয়ম, হ্যামিল্টনের সমবায় উদ্যোগ, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি নিপুণভাবে উঠে এসেছে শ্রী মণ্ডলের আলোচনায়। বংশলতিকা-সহ সুন্দরবনের লটদার-জমিদারদের বংশধারা এ গ্রন্থের এক মূল্যবান প্রাপ্তি। 'লটের যে তালিকা এবং লটদারদের যে তালিকা গ্রন্থটিতে নথিবদ্ধ তা অনেক পরিশ্রমের ফসল।' – লেখকের কথা-য় শ্রী মণ্ডলের এ উক্তির যথার্থতা পাঠক হিসাবে উপলব্ধি করতে পারি আমরা।
এমন গোছানো দায়িত্বশীল কাজের জন্যে অনেক সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর। যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে শ্রী মণ্ডলের এ কাজের পূর্ণরূপ আমরা পেতে চাই ক্রমে ক্রমে। তাঁর প্রতি অনেক শুভেচ্ছা। গল্পকার-চিত্রকর লেখকের স্বকৃত প্রচ্ছদ শোভন ও ব্যঞ্জনাময়।
সুন্দরবনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্বন্ধে লেখক যথার্থই বলেছেন, শহরবাসী লটদার, গাঁতিদার, ও নায়েবরা মুসলিম চাষিদের উৎখাত করায় কিছু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক হলেও জীবিকার দায়ে যাঁরা মা বনবিবির আশ্রিত, তাঁরা কখনও সম্প্রদায় চেতনা নিয়ে সচেতন হননি। সুন্দরবন ও সংলগ্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পতনের পর ধর্মশূন্য অবস্থা এই অসাম্প্রদায়িক সমন্বয়বাদী মনোভাবের অন্যতম কারণ বলে মনে হয়।' আর একটু বলা যায়। ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আনীত বা আগত বিভিন্ন বর্ণ-ধর্ম-গোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের প্রতিবেশী বা প্রায়-প্রতিবেশী হিসাবে বসবাস, একই ধরনের জীবন ও জীবিকার লড়াই, মানুষ হিসাবে পরস্পরের আপদ-বিপদ বা সুখ-দুঃখে নিশ্চেষ্ট না থাকতে পারা এবং এসবের ফলে পরস্পর নির্ভরতাও কম ভূমিকা গ্রহণ করেনি এক্ষেত্রে। 'আকস্মিক মৃত্যু নেমে এলে এই লুকনো যখের ধনের সন্ধান অজানা থেকে যেত। পরবর্তী সময়ে পুকুর কাটতে গিয়ে বা বাড়ি বানাতে গিয়ে উক্ত সম্পদ হস্তগত হত। দৈব মহিমা আরোপণ ছাড়া হস্তগত সম্পদের ব্যাখ্যা জনসমাজে প্রকাশ করা সম্ভব হত না প্রায় ক্ষেত্রে।' (পৃ. ২১৮) এখানে একটু সংযোজন করা যেতে পারে। দৈবী মহিমার আরোপে আরও একটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে – হয়তো ভাবত মানুষ – যে, দেবতার মহিমায় পাওয়া অর্থ-সম্পদে সহজে কেউ হাত দেবেন না।
বিস্তৃত বৈশিষ্ট্য আদি উল্লেখ সত্ত্বেও দুটি স্থানে (পৃ. ৭৬ ও ৯১) তাঁর লেখা থেকে প্রতীয়মান হতে পারে যে কাওরা ও মুচি একই সম্প্রদায়ের, বাস্তবে যা ঠিক নয়। একাধিকবার 'হাঁড়ি' কেন! এই ভুলবোঝা থেকেই তো অনেকে 'হাড়ির হাল'কে 'হাঁড়ির হাল' করে ছেড়েছে! হাড়ি সম্প্রদায়কে ছোটবেলা থেকে আমাদের বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে কোনোদিন হাঁড়ি বলতে শুনিনি। দারিদ্র্য-বঞ্চনা্র কিছুটা অন্তত যাঁরা চোখে দেখেননি তাঁদের পক্ষে ভাবা দুরুহ যে তথাকথিত নিম্নবর্ণের একটি সম্প্রদায়ের অবস্থা কতটা করুণ হলে তা প্রবচনে পরিণত হতে পারে!
৮৩ ও ১৮৮ পাতায় ইংরেজি ও বাংলা সালে তফাৎ রয়েছে। পৃষ্ঠা ৯৬-০৭-এ সুন্দরবনের আদিবাসীদের পূজার 'বিবরণ' যেখানে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা ঠিক হয়নি। ৯৭ পাতায় 'উপাচার সাজিয়ে' নয়, 'উপচার সাজিয়ে' হবে। চতুর্থ অধ্যায়ে সূত্র হিসাবে সংখ্যাক্রম ৬০ চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু তথ্যসূত্রতে উল্লেখ বাদ পড়ে গেছে। 'ধানের ওজনে ধলতা নেওয়ার নিয়ম' (পৃ. ১৫৬) লেখার মধ্যে উল্লিখিত শব্দ 'ধলতা' আদতে 'ঢলতা' – বাটখারার বিপরীত দিকে পাল্লার ঢলে পড়ার চিত্র আছে। ১৬৪ পাতায় লেখার রাজবল্লভ বংশতালিকায় হয়ে গেছে রামবল্লভ। উক্ত বংশতালিকায় দুর্গাচরণের পাশে বন্ধনীতে রায়চৌধুরী উপাধিপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে, আদতে যা হবে চৌধুরী – রায় আগে থেকেই ছিল। ১৭১ পাতার কন্দর্পনারায়ণ পরের পাতার বংশতালিকায় হয়ে পড়েছে কন্দর্পরাম। ২০১ পাতায় সাগর আইল্যান্ড সোসাইটি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ১৮১৯ সাল ১৯১৯ হয়ে গেছে। ২১৮ পাতায় 'যতীন্দ্রনাথের' হয়ে গেছে 'সতীন্দ্রনাথের'। ২৩০ পাতা থেকে বংশতালিকায় প্রয়াত বংশধরগণের নামের পূর্বে 'ঁ' এসেছে, আগের বংশতালিকাগুলোতে যা নেই। সাগরদ্বীপের জমিদার উত্তরপাড়ার প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায় সূচিপত্রে হয়ে গেছে পিয়ারীমোহন।
এত অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পরেও কোনও কোনও স্থলে লেখককে 'মনে হয়' বলে উল্লেখ করতে হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবুও এমন দু-এক স্থলে মনে হয়েছে যে সেই সব বিষয়ে অধিকারী মান্য কোনও কোনও লেখকের লেখা থেকে সাহায্য নিয়ে আর একটু সুস্থির জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল হয়তো বা। এইরকম এক গ্রন্থে একটি নির্ঘণ্টর প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হবেই। প্রুফ দেখাকে কিছুতেই প্রশংসা করতে পারা গেল না। প্রচুর বানানভুল, ছাপার ভুল, বানান ও ছাপার অসঙ্গতি রয়ে গেছে।
পুরো বইজুড়ে চাষি-মজুর-শ্রমিক নির্বিশেষে সকল মানুষকে সম্ভ্রমসূচক বাচনে সম্বোধন আলাদা করে ভাল লেগেছে।
শেষ করি প্রজাকল্যাণকামী শাসক, হিন্দু-মুসলমান সকলের শ্রদ্ধেয় শাসক খান জাহান আলির সমাধিসৌধের গায়ে (খালিফাতাবাদে 'ঠাকুরদিঘি'র পাড়ে) আরবি অক্ষরমালায় উদ্ধৃত কবিতার পঙ্ক্তি দুটি উল্লেখ করে :
'তোমার কাজেতে হবে তোমার বিচার
তাহাতে সন্দেহ নাই কিছুমাত্র আর।'
----------------------
পুস্তকের নাম : আঠারোভাটির ইতিকথা (প্রথম খণ্ড, আবাদ পর্ব)
লেখকের নাম : ড. স্বপনকুমার মণ্ডল
প্রকাশকের নাম : অনন্যা প্রকাশনী (সোনারপুর, কলকাতা – ৭০০ ১৫০)
প্রকাশকাল : ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রচ্ছদ : স্বপনকুমার মণ্ডল
মূল্য : তিনশো টাকা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন