কবির উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতের জাতীয় সংকট
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কবি মধুসূদন দত্ত ইংরেজী ভাষার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে বিদেশি ভাষায় লিখে কবি হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জনের লোভে পাড়ি দেন পশ্চিমে। অল্পদিনের মধ্যে উপলব্ধি করেন মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চাই কারও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারে। বিদেশী ভাষা এর উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে না। তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা কখন-ও ছাড়েন নি। তাঁর উপলব্ধি তাঁকে ফিরিয়ে আনে দেশে। মাতৃভাষায় কাব্যচর্চা তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটায়। তাঁর অমিতাক্ষর ছন্দ, বাংলায় লেখা মহাকাব্য, সনেট বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, অলংকৃত করেছে, বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তাকে মহিমান্বিত করেছে। আজ ইংরেজিতে মোহগ্রস্ত বাঙ্গালী সমাজের কাছে এই সত্যটা আবার নতুন করে তুলে ধরা দরকার। আমাদের কাছে কবির উপলব্ধির বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা যে শুধু সাহিত্য চর্চার জগতে একটা ভাষাকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন তা নয়, নিজেদের সত্তা বাঁচিয়ে রাখা একই সঙ্গে দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করার প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। নিজেদের স্বাধীন শক্তপোক্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার স্বার্থেও এটা দরকার।
বলে রাখা দরকার যে বিদেশি সাহিত্য চর্চায় আমাদের আপত্তি নেই। বরং আমরা দেখি যে মধুসূদনের বিদেশি সাহিত্য চর্চা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কবিতার জগতে ছন্দ ও লয়ে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু মাতৃ ভাষার ওপর দখল রেখেই সেটা করা সম্ভব। মাতৃ ভাষার ওপরে দখল রাখতে পারলেই সাহিত্য চর্চায় বিদেশী ভাষার ওপর দখল আসে। আজ আমাদের ভাষার জগতে দখলদারদের প্রতিযোগিতা আগ্রাসী ব্যবসার স্বার্থে, সাহিত্য চর্চার জন্য নয়। দৃষ্টিভঙ্গি হ`ল ভাষাকে ব্যবসা জগতের দাস হিসেবে ব্যবহার করা। এখানেই আমাদের আপত্তি। এতে পেটের খোরাক জুটতে পারে কিন্তু মনের খোরাক নয়। আরও বলে রাখা দরকার যে বিষয়টা নেহাৎ বাংলা ভাষা নয়, বাঙ্গালিয়ানা চাষের বিষয় নয়। মানুষের জীবনে মাতৃভাষার অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় তা যে ভাষা-ভাষীর মানুষই হোক না কেন। তার সৃজনশীলতার পথ খুলে রাখার বিষয়। কবি মধুসূদনের উপলব্ধিটা যে কত গভীরে তা বোঝা যায় মৃত্যুকালে তিনি যে সমাধিলিপি তাঁর মাতৃ ভাষায় লিখে লিপিবদ্ধ করে যান তাতে। সেখানে তিনি তার পূর্বপুরুষকে স্মরণ করেন। জন্মভূমিকে মাতৃসম জ্ঞান করে লিখে যান। এখানে যেন তিনি প্রতিটি বঙ্গবাসীকে বলেন তার পরিচয় তিনি বাঙালি:
সমাধি লিপি ( পৃ :১৯৬ )
(কবি মধুসূদন দত্ত)
দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে ! তিষ্ঠ ক্ষণকাল ! এ সমাধিস্থলে
( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম ) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন !
যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষম-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।
মৃত্যুর প্রাক্কালে তাঁর এই উপলব্ধিটা আগেই প্রকাশ পেয়েছিল যখন তিনি লিখেছিলেন:
বঙ্গদেশে জন্ম মোর
কেউ ভাবে না পর,
আমি সেথায় সাত রাজার ধন
সবাই যে মোর আপন,
তাদের প্রেমে ধন্য আমি
অধম আমি লো,
তাদের আমি বাসি ভালো
নাই যে তাতে গোল,
তবু ঝরে অশ্রুধারা
দুচোখ ভরা জল;
প্রিয়া আমার ওই সুদূরে
তার বিরহে পাগল আমি।
ব্যাকুল আমি যার তরে
সে জেনো মোর জন্মভূমি।
(সেই যেন মোর জন্মভূমি
রণেশ রায়
মধুসূদন দত্তের AN ACROSTIC
কবিতা অবলম্বনে পৃ:৪১৮)
আজকে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় সারা ভারতে দেশপ্রেমিক বিভিন্ন ভাষাভাষীর প্রতিটি মানুষের কাছে কবির এই উপলব্ধিতটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের আর্থ- সমাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদেশি হানাদারী উত্তরোত্তর চেপে বসেছে। নতুন করে বণিকের মানদন্ড আজ রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হতে চলেছে। যে 'স্বাধীনতা' আমরা লাভ করেছিলাম বলে আমরা মোহগ্রস্থ ছিলাম তার চরিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। অর্থনীতিকে বিদেশি বণিকের স্বার্থে বিকিয়ে দিয়ে আমাদের শিল্পসাহিত্যের ওপর নেমে এসেছে ঘাতকের খর্গ। ইংরেজি ছাড়া চলবে না আর তার স্বার্থে মাতৃ ভাষার গঙ্গা প্রাপ্তিতে শোক করার কিছু নেই এমন একটা মনন তৈরি করার চেষ্টা চলছে সরকারি সাহায্যে সব স্তরে। আর এটাকে মদত করা হয় কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যবসার স্বার্থে। প্রধানত দুটো কারনে। প্রথমত মানুষের শৈল্পিক মনোনটাকে যদি সম্রাজ্যবাদের দাসে রূপান্তরিত করা যায় তবে শাসন করতে সুবিধা হয়, তাদের গৃহীত নীতির প্রতি অনুগত করে তোলা যায়। তাতে কর্পোরেট পুঁজি অক্লেশে ব্যবসা করতে পারে। দ্বিতীয়ত শিক্ষাকে ব্যবসার জগতে রূপান্তরিত করা যায়। আজ ভারতসহ এশিয়া আফ্রিকার সব দেশে শিক্ষাকে ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্বায়নের কল্যানে তাকে বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ অবাধে ঢুকছে। পরিবারের বাজেটে শিক্ষার ওপর খরচের বহর কয়েকশতগুন বৃদ্ধি পেয়েছে যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ইংরেজি মাধ্যমকে এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে একজন গরিব পরিবারের সন্তানকেও বাবা মা ঘটি বাটি বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে বাধ্য হয়। সেভাবেই মানুষের মননকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। একেই আমরা ঔপনিবেশিক মনন বলি যা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমলে। আজ আমরা তার উত্তরাধিকারী। দীর্ঘ দুশো বছরের ইংরেজ শাসনে ভারতে যে ঔপনিবেশিক মনন গড়ে উঠেছে তার থেকে এখনও আমরা মুক্ত তো হতেই পারিনি বরং ইংরেজদের দাসত্বের সেই মনন আজও আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। যতই ১৫ই আগস্ট মহাসমারোহে পালন করি না কেন এখনও আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারী। আজ মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে ইংরেজির মাধ্যমে নিজেদের উপযোগী করে তুলে রুটি রোজগারের সুব্যবস্থা করার যে মনন তা ভারতের সব ভাষাভাষী মানুষকে নিজেদের সত্তাকে বিসর্জন দিতে উদ্যত করেছে। আর এই মনন যত আমাদের ওপর চেপে বসবে তত ব্যবসায়িক জগতের সুবিধা। বিদেশি বহুজাতিকদের রাজত্বের ভীত তত শক্ত পোক্ত হয়। আমরা বেঁচে থাকি মেরুদন্ডহীন এক জীব হয়ে। দাসত্বই যেখানে আমাদের শেষ পরিণতি। তাই আজ আমাদের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা তাকে পরিচর্চা করে সামাজিক জীবনে কাজে লাগানোর প্রশ্নটাকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভাবতে হয়। এটা নেহাৎ বাঙালিপনা চর্চার প্রশ্ন নয়। নিজেদের দেশকে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে স্বাধীন ভাবে গড়ে তোলার প্রশ্ন। তবেই দেশ বাচঁবে দেশের আপামর মানুষের সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত হবে। কবির উপলব্ধিটা এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিচার করা প্রয়োজন। তাঁর কবিতার ভাষায় এই তাগিদটাই ফুটে ওঠে যখন তিনি লেখেন:
হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; ---
তা সবে,( অবোধ আমি ! ) অবহেলা করি,
পর-ধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি !
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মন :,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;---
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল কানন !
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে---
`` ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারি-দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে !``
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
দ্রষ্টব্য: মধুসূদন রচনাবলী, সাহিত্য সংসদ
ষষ্ঠ মুদ্রণ আগস্ট ২০১২,পৃ:১৫৯
উপরোক্ত কবিতায় কবি স্বীকার করছেন বাংলা ভাষার যে সম্ভাবনা তাকে আশ্রয় করে যে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন সেটা অস্বীকার করে তিনি কি মারাত্বক ভুল করেছেন। তাঁর এই কবিতার মধ্যেই ধ্বনিত হয় কবি রবীন্দ্রনাথের বার্তা: মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। আমাদের আজ ঘরে ফেরার ডাক এসেছে। শুধু বাঙালিদের জন্য এটা সত্যি নয়। এটা সত্যি সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য। আজকে আমাদের যে মনন আমাদের শিল্প সংস্কৃতি অর্থনীতি সব কিছুকে গ্রাস করতে চলেছে সেটা কি বলে? সেটা বলে ভারতবাসীর জীবনে ইংরেজি ছাড়া গতি নেই। ইংরেজি ছাড়া জীবনজীবিকা অনিশ্চিত, ইংরেজি ছাড়া প্রযুক্তি উন্নতির পথ বন্ধ তাই অর্থনীতি পঙ্গু, ইংরেজি ছাড়া শিক্ষা হয় না। আমাদের আরও ধারণা তৈরি হয়েছে যে সারা পৃথিবী ইংরেজির বশ। সব দেশেই যেন ইংরেজি অনিবার্য। ইংরেজিকে নিঃশর্তে গ্রহণ করাটা বাধ্যবাধকতা। ইংরেজি বাদ দিয়ে দুনিয়ার বাজারের প্রবেশ পথ বন্ধ। সুতরাং ইংরেজি বর্জন করা মানে নিজেকে বন্দি করে রাখা। ইংরেজির ডানা মেলেই পৃথিবীর আকাশে অবাধ বিচরণ সম্ভব। সুতরাং খাওয়া দাওয়া চাল চলল ব্যবসাবাণিজ্য শাসন কাজ সর্বোপরি শিল্প সাহিত্য শিক্ষার জগতে ইংরেজির কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া অনিবার্য। আজকের বিশ্বায়নের যুগে এটাই সত্য। আমরা আজ কম বেশি সবাই সামাজিক জীবনে এই প্রচারের শিকার। এই প্রচারটা যে কত মিথ্যে সেটা আজকের দুনিয়ার দিকে তাকালে জানা যায়। আমরা আমাদের অজ্ঞতার দরুন দুনিয়ার চেহারাটা দেখতে পাই না বা দেখলেও সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকি। আসুন সত্যতা একবার পরখ করে নেওয়া যাক।
বলা হয়ে থাকে যে আজ পৃথিবীর সব দেশই ইংরেজিকে শিক্ষার বাহন হিসেবে মেনে নিয়েছে তাদের উন্নতির স্বার্থে কৃষ্টির স্বার্থে। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। এককালের ঔপনিবেশিক দেশগুলো যারা এখনও সাম্রাজ্যবাদের দখলদারির শিকার সেই সব দেশগুলোতেই মাতৃভাষা ত্যাগ করে ইংরেজিকে আশ্রয় করে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চোখে পড়ে। অথচ যারা সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েছে তারা নিজের মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই উন্নতি করেছে। যেমন জাপান বা চীন। এমনকি তারা প্রযুক্তিতেও নিজেদের মাতৃভাষায় আত্মনির্ভর হয়েছে। ইংরেজিকে ঢুকতে দেয় নি। চিনে গুগুল ব্যবহৃত হয় না। তাদের ভাষাতেই তারা কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। জাপানে তারা তাদের মাতৃভাষাকেই শিক্ষার বাহন হিসাবে ব্যবহার করে। এইসব দেশে সাধারণ মানুষ ইংরেজি খুব একটা জানে না। এসব দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের ভাষাও মাতৃভাষা।এবার আসা যাক ইউরোপে। ইউরোপে বিভিন্ন প্রত্যেক দেশই প্রায় নিজের নিজের মাতৃভাষার মাধ্যমেই দেশ চালায়। ফ্রান্স বা জার্মানের মত দেশে তো ইংরেজি সেভাবে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে ব্রিটেন যখন মুক্ত বাণিজ্যের ঢক্কানিনাদ বাজিয়ে চলেছে আজকের বিশ্বায়নের মত তাকে ভারতের মত দেশে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তখন জার্মানের মত দেশ মুক্ত বাণিজ্য নয় সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল। অন্যান্য ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনে যেখানে দরকার মুক্ত বাণিজ্য যেখানে দরকার সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করেছিল। এমনকি বৃটেনও সম্পূর্ণ মুক্ত অর্থনীতি চালু করে নি। এমনকি নরওয়ের মত এককালের ইংরেজের অধীনে থাকা দেশও তাদের স্বাধীন ভাষানীতি নিয়ে আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্স স্পেন দক্ষিণ আমেরিকার মত দেশে ফরাসি, স্প্যানিশ ও ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য চর্চার গৌরব ইংরেজদের ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা থেকে কম গৌরবময় নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাতৃ ভাষায় শিল্প সাহিত্য চর্চায় ফ্রান্স শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। ডেনিশ ভাষা ডেনমার্কে তাদের জীবনের সবক্ষেত্রেই উন্নতিতে সাহায্য করেছে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর ভাঙাচোরা বিভিন্ন দেশকে একজোট করে সোভিয়েত গঠন করে আঞ্চলিক ভাষাকে যথাযত মূল্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বৃহত্তর সোভিয়েত রাশিয়া। রাশিয়ান ভাষার সাহায্যেই তাদের শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞানে বিপ্লব পরবর্তী পনেরো বছরে যে উন্নতি করেছিল তাকে চোখ ধাঁধানো উন্নতি বলে ব্রিটিশ আমেরিকা সবাইকে স্বীকার করতে হয়েছে। সুতরাং ইতিহাস যা প্রচার করা হচ্ছে তার বিপরীতটারই সাক্ষ্য বহন করে। আরো উল্লেখযোগ্য যে ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করার আগে ভারত ইউরোপের দেশগুলো থেকে উন্নত ছিল। ভারতে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিল না। শিল্প সাহিত্যে উন্নতি করছিল। সেই অবস্থায় ঔপনিবেশিক দখলদারি ভারতকে উন্নতির লড়াইয়ে পেছনে ফেলে দেয়। ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি, ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়ার নীতি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। ইংরেজদের এই নীতির অনুগামী কবি মধুসূদনের ফ্রান্সে গিয়ে চোখ খোলে। উনি প্রত্যক্ষ করেন মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে কি ভাবে একটা দেশ শিল্প সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। তাঁর নিজের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটা সম্ভব মাতৃভাষায়, বিদেশি ভাষায় নয়।তাঁর আফসোসের শেষ থাকে না। তিনি পশ্চিমের জগতে প্রতি তাঁর মোহগ্রস্ততার কথা খোলাখুলি স্বীকার করেন। নিজের দেশ সম্পর্কে হীনমন্যতার কথা স্বীকার করে তিনি তাঁর অপরাধবোধটা, তার হতাশাটা তুলে ধরেন অকপটে নিচের কবিতায় :
ছন্নছাড়া
কবি মধুসূদন দত্তের AN ACROSTIC থেকে একটি ইংরেজি কবিতার ভাবানুসারে
পৃষ্ঠা ৪১৮
[ ৮ ]
আমার আচ্ছন্ন চেতনা
লালায়িত সমুদ্র বিহারে,
আমারে আপ্লুত রাখে
সুদূরের সাগর মোহনা,
সবুজে সবুজে ভরা
সেই উপত্যকা
যে থাকে ঘেরা
পাহাড়ে পাহাড়ে
আমি হয়ে পড়ি নামগোত্রহীন,
আত্নীয় বর্জিত কে সে অধম ;
তবু ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে
পাড়ি দিতে চাই সিন্ধু
দেখি না ঘরের দাওয়ায
একটি শিশির বিন্দু`।
তাহার উন্মাদ ভাবনা
পীড়া দেয় তাকে ,
যশের কাঙাল যে সে !
নিশ্চিত সমাধি তরে
আজ সে ভাসে;
অবোধ সন্তান সে, মা
তারে তুমি করিও ক্ষমা।
উপরোক্ত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে প্রায় দুশো বছর পরে ভারতের প্রেক্ষাপটে কবি মধুসূদনের উপলব্ধিটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আজ ভারতে বিশ্বায়নের খাড়া নেমে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদের জায়গা নিয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদ। বেসরকারিকরণ ঘটে চলেছে সর্বক্ষেত্রে। এমনকি সামরিক ও প্রতিরক্ষা বিভাগকে উন্মোচিত করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাকে ব্যবসার অন্যতম বৃহত্তম ক্ষেত্রে পরিণত করা হচ্ছে যেখানে বহুজাতিক সংস্থার খবরদারি। ইংরেজি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে। মানুষের মনন প্রক্রিয়ায় নেমে এসেছে এক দৈন্যতা দাসত্ব। মাতৃভাষায় পরিচালিত স্কুলগুলো উঠে যেতে বসেছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মানও নেমে গেছে তলানিতে। শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজির মৃগয়া ক্ষেত্র। খরচ সাপেক্ষ এক ব্যবসায়িক শিক্ষা মুষ্টিমেয় মানুষের করে খাওয়ার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাপক সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ তলানিতে পৌঁছেছে। আর মাতৃভাষার ওপর বৈরাগ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রচার চলছে যারা ইংরেজি শিখছে না তাদের ভবিষ্যৎ থাকছে না। এ প্রচারও মিথ্যা প্রচার। দেখা যায় গরিবঘরের মানুষ আজ বাধ্য হচ্ছে বিপুল খরচ করে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করতে। কিন্তু তারা বেশিদূর টানতে পারে না। ইংরেজি মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা নির্ভর পড়াশুনোতে ছেলেমেয়েদের বাড়িতে দেখবার কেউ থাকে না। তাদের নির্ভর করতে হয় স্কুল খরচের পর নম্বর পাইয়ে দেবার উপযুক্ত কোচিংয়ের ওপর যেটা প্রচুর খরচ সাপেক্ষ। স্কুলের বিপুল খরচের পর এই বিপুল খরচ তারা বহন করতে পারে না। তাদের তথাকথিত এই শিক্ষা প্রহসনে পরিণত হয়। যারা খরচ করতে পারে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে তারা পেরে ওঠে না। এদিকে তারা বাংলা মাধ্যম হলে যেটা শিখতে পারত সেটাও পারে না। তবে সরকারি অনুগ্রহে পাশের সার্টিফিকেট পাচ্ছে যা চাকরির জগতেও আজ অকেজো। আমাদের যাদের বয়স হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা বলে সাম্প্রতিক অতীতেও ইংরেজি মাধ্যমে না পড়েও বাংলায় শিখে ছেলেমেয়েরা ব্যাপক হারে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। তারা দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে যা ইংরেজি শিখত তার সাহায্যে উচ্চ শিক্ষায় যেত যা তাদের রুটি রোজগার উপায়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। বাংলাটা নিজের মাতৃভাষা ছিল বলে তাদের ভাবনার জগৎটা অনেক প্রসারিত ছিল। পরবর্তী কালে ইংরেজির খামতিটা মিটে যেত। উপরন্তু তাদের শিল্প সাহিত্যে অনুরাগটা বাড়ত। এমন কি বিদেশি সাহিত্য চর্চায় যারা মনোযোগ দিত, তাদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ভালো করলেও বেশি নম্বর পেলেও সাহিত্য জগতের প্রতি বিরাগ বাড়ছে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদিও যে মুষ্টিমেয় নিজেদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করতে সক্ষম হচ্ছে তারা প্রচুর টাকা রোজগার করছে। কিন্তু গরিবদের বড় অংশ ছিটকে যাচ্ছে। তাই ব্যবহারিক জীবনের উপার্জনের সুবিধার দিক থেকে দেখলেও পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে মেয়েরাই আজ বেশি সুযোগ পাচ্ছে। আপেক্ষিক বৈষম্য বাড়ছে। বরং সরকার যদি মাতৃভাষায় শিক্ষাকে আরো উন্নত করতে গবেষণার মাধ্যমে ও চর্চার মাধ্যমে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলত আর পাশাপাশি প্রয়োজনের খাতিরে আগের মত ইংরেজি ভাষাটা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরো ভালোভাবে পড়বার ব্যবস্থা রাখতো তবে শিক্ষার জগৎটার এই দুরবস্থা হতো না। এটাতো গেল আনুষ্ঠানিক দিক দিয়ে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব। এবার কবি মধুসূদনের উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলা তথা মাতৃভাষার তাৎপর্য কি সেটা সংক্ষেপে আলোচনা করে নেব।
উল্লেখযোগ্য যে শুধু মধুসূদন নন তখন অনেকেই তাদের যৌবনে ইংরেজ সভ্যতায় মুগ্ধ হন। এমনও মনে করতেন ইংরেজদের সভ্য আইনের শাসনেই ভারত ও ভারতবাসীর কল্যাণ। ইংরেজিই এই শিক্ষা সভ্যতাকে বহন করে। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তবে এই সভ্যতার বর্বর দিকটাও তাঁর চোখ এড়ায় নি। সভ্যতার সংকট বইতে তিনি সেটা প্রকাশ করন। আর মাতৃভাষা ছিল তাঁর কাছে মাতৃ দুগ্ধ। শুধু কথা বলা নয় মাতৃভাষা মানুষের এক গভীর মনন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে পুষ্ট করে। মানুষের স্মৃতির উদ্যানে মাতৃভাষা প্রস্ফুটিত সেই ফুল যার বর্ণ গন্ধ আর রূপে স্মৃতির বাগান সেজে ওঠে। মাতৃ ভাষায় মানুষ স্বপ্ন দেখে কল্পনা করে। এই ভাষায় চিন্তা ভাবনা তাকে সম্পূর্ণতা দিতে পারে। এটা মানুষে সহজাত বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু বিদেশি ভাষা আরোপিত। মাতৃভাষায় সহজাত সম্ভাবনার বিকাশ না ঘটলে বিদেশি ভাষা আত্মস্থ করা যায় না। সে বাইরের অতিথি হিসেবেই থেকে যায়। একটা জাতির জাতিসত্তা মাতৃভাষা ছাড়া লালিত হতে পারে না। মাতৃভাষার ওপর দখল থাকলেই বিদেশি ভাষাকে আত্মস্থ করা যায়। ঠিক যেমন নিজের সত্তা থাকলে আত্মসম্মান বোধ থাকলেই অন্যকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যায় তার ভালো মন্দ বিচার করা যায়। না হলে সবটাই হয়ে দাঁড়ায় মেকি। আর এই উপলব্ধিটাই প্রকাশ পায় মধুসূদনের একটা কবিতায় যার বাংলা অনুবাদটা নিচে দেখে নিতে পারি:
বিরহের গান গাহিব না আর
মধুসূদন দত্তের AN ACROSTIC থেকে একটি কবিতা অনুসরণে
পৃ ৪১৮
[ ৭ ]
দিগন্ত সুন্দরী
প্রিয়তমা আমার,
তুমি পশ্চিমের পরী
আমি পানিগ্রাহী তোমার।
প্রিয়া কি জানে
শোকে প্রিয় যে ভাসে,
তার প্রত্যাখানে
হৃদয় বিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাসে।
তুমি কি বোঝো না
তার প্রেমে নেই বঞ্চনা !
প্রত্যাখ্যাত সে যে।
তার প্রেম, অমর সে
যাকে বোঝ না তুমি,
কাঁদে সে হতাশে।
তবু সে,
আজও তোমায় ভালবাসে।
হে প্রিয়ে,
তুমি তার হতাশে
তুমি তার দীর্ঘশ্বাসে
তুমি ফের বাতাসে।
তবু সে,
তোমায় ভালবাসে।
হে প্রিয়তমা
নিঠুর হৃদয়হীনা
তুমি কি ভেবেছ যথা
কাঙাল এই অভাগার কথা,
হতাশায় তার,
কখন-ও বাজে না
তোমার হৃদয় বীণা?
দুর্ভাগ্য এই অভাগার,
শোকস্তব্ধ, আজ সে দুখি।
তবু সে,
তোমায় ভালবাসে।
মায়াবী ললনা
তুমি যে হৃদয়হীনা,
তোমার মায়ায়
ছেড়েছে আপন ঘর,
তার প্রেম যে অমর,
তার বিষাদ বেদনায়
হৃদয় তোমার
ভরে নাকি করুনায় ?
হে বিদেশিনী
তোমায় ,
সে আজও ভালবাসে।
ও ! পুবের পরী
ক্ষম তারে,
চেনেনি সে তোমারে গৃহদ্বারে,
তুমি যে ছিলে মলিন বেশে
মাতৃ অহংকারে,
ত্যাজিছে তোমারে,
ত্যাজিয়া তোমারে হয়েছে বিবাগী,
ফিরেছে তোমারই দ্বারে
ভিক্ষা মাগিবারে,
ফিরায়না তারে।
পুবের পরী,
মহিয়সী তুমি
তুমি মহাময়ী,
হে দয়াময়ী !
মোরে দিও না মরিবারে,
চাই আমি বাঁচিবারে
এ সুন্দর ভুবনে;
লহ তুলে কোলে,
আমার এই বাহু বন্ধনে
জড়ায়ে লই তব গলে,
বিষাদের গান
গাহিব না আর
দীর্ঘশ্বাস পড়িবে না তব বুকে,
কাঁদিব না আর বিরহ শোকে।
আমরা আগেই বলেছি যে বাংলায় তথা মাতৃভাষার ওপর মধুসূদনের অবাধ দখল ছিল। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই বিদেশি ভাষা তার ওপর আরোপিত ছিল না। সেটাকে তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তাতে তিনি যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। তাকে তিনি ভালো বাসতেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন যে সেটা ছিল বিদেশী। সে ভাষা তার কাছে ছিল পশ্চিমের সুন্দরী উর্বশী, তার প্রেমিকা। কিন্তু মাতৃভাষা তাঁর কাছে নিজের মা যাকে তিনি উপেক্ষা করেছেন সাময়িক মোহে পড়ে। সেই মায়ের কোলে তিনি লালিত হয়েছেন পালিত হয়েছেন। তাকে বাদ দিয়ে কবি ভিখিরি হয়ে যান। তার সত্তা লোপ পায়। তাই তাকে মায়ের কোলেই আশ্রয় নিতে হয়। সেখানেই তিনি আশ্রয় প্রার্থী তার উপরোক্ত কবিতায়।
===========================================================
রনেশ রায়
১০/০২/২০১৯