ভাষা নিয়ে ভাবনা
কিন্তু কেন? অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু জিনিস নিয়ে ভাবনায় মানুষ যখন জেরবার হচ্ছে তখন ভাবনার ভাঁড়ারে ভাষার মত অতিরিক্ত আর একটি বিষয় ঢোকান হল কেন?
স্বভাবতই মনে হয় সুখে-স্বাচ্ছন্দে দিন কাটানো মানুষ অথবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন গুজরান করা লোকগুলোর কাছে ভাষা নিয়ে এই ভাবনার পরিসর কতখানি – বিশাল অথবা ক্ষুদ্র? বিষয়টিতে আবেগ কতখানি আর বাস্তব কতখানি? অনেকেই হয়ত এমন আছেন ভাষা বিষয়টিতে আবেগাশ্রিত একটা বাড়াবাড়ি বা পাগলামি বলে মনে করেন। বিশেষ তাঁরা যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ার চেয়েও হিন্দী ও ইংরিজি মাধ্যমে পড়াশোনার ওপর জোর দেন। আজ বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় চাকরি, শিক্ষা, গবেষণা বা অন্যান্য বহু কারণে আমাদের বহির্মুখী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতেই হচ্ছে। এই গা ভাসানোতে কোনও অন্যায় নেই, নেই কোনও নীতিহীনতা। কথাতেই আছে 'গরজ বড় বালাই'। তাই আন্তর্জাতিকতা আদায় করতে তুখোড় হতে হয় ইংরেজিতে। কারণ এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিকতায় ইংরিজি ভাষার কোনও বিকল্প গড়ে ওঠে নি। তাই ইংরিজির প্রচার, প্রসার আর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। জাতীয় ক্ষেত্রে এখন সেই স্থান বোধহয় দখল করেছে বা করতে চলেছে হিন্দি। আর দিন-কে-দিন হয়ত চেপেই বসবে।
বাংলা ভাষা কোথায় ঠিক সুস্থভাবে বসবাস করছে তা সত্যি বলা খুব শক্ত। এমন কী জনপ্রিয় গনমাধ্যমগুলি পর্যন্ত বাংলাকে সুস্থভাবে পরিপোষণ করছে তাও বলা যায় না। সিনেমা কিংবা বাংলা সিরিয়ালগুলোতে একটা অদ্ভুত ভাষা উজ্জ্বল করে রেখেছে। তাকে অনায়াসেই অভিহিত করা যায় 'খিচুড়ি ভাষা' হিসেবে। একটি বাক্যের খানিকটা বাংলা তো বাকিটা হিন্দি আর ইংরিজির সংমিশ্রণ। শুনলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক যিনি বলছেন তিনি কখনও সঠিক বাংলা শব্দ ভুলে যাচ্ছেন তাই ইংরিজি বলছেন আবার কখনও সঠিক ইংরিজি শব্দ মনে আসছে না তো হিন্দি বা বাংলা। আবার কখনও হয়ত স্রেফ শ্রুতিমধুর করার উৎসাহে এর মধ্যে হিন্দি মিশিয়ে দিচ্ছেন। এতে কিছু মানুষের কিছু সুবিধে হয়ত হচ্ছে। কারোর কারোর মনে হচ্ছে এইভাবে ভাষার ভ্যাজাল দিয়ে স্মার্টনেস অনেকটাই বাড়িয়ে তোলা যাচ্ছে আর ব্যক্তিগত গরিমা।
ইংরিজি বলতে গিয়েও যখন কিছু শব্দ 'পেটে আসে তো মুখে আসে না' গোছের হয় তখন তাকে বাংলা দিয়েই সামলে দেওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ একই বাক্যে আন্তর্জাতিকতা, জাতীয়তা আবার প্রাদেশিকতা বজায় রাখা গেল এ তো কম কথা নয়?
একটি শতছিন্ন আর সহস্র তাপ্পিতে ভরা পোশাক যদি ফ্যাশানের উচ্চতম উদাহরণ হতে পারে তো একটি হিন্দি, বাংলা আর ইংরিজির তাপ্পিমারা ভাষা কী দোষ করল? ভাষা-ফ্যাশানের সেও তো উচ্চতম একটা নিদর্শন হতে পারে?
তাই প্রয়োজনের ক্ষেত্রটা হয়ত বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আবেগের ক্ষেত্রটা? অনেকের কাছে আবেগ জিনিসটা বড় প্যানপ্যানে আর অদরকারি। যাদের কথায় কথায় আবেগে চোখে জল আসে (অথবা মনে) তাদের আমরা যারা তথাকথিত আবেগহীন তারা বলি, লোকটা একটু 'নাটুকে'। আর সেই শব্দটা একটু পালটে দিয়ে যদি বলি 'নৌটঙ্কি' তো বেশ শোনায়। নাটুকে শব্দটা কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে হলেও 'নৌটঙ্কি' শব্দটা বেশ জোরাল। পোড়া লংকার মত ঝাঁঝাল কিংবা ঝকঝকে তীরের মত ধারাল। যার উদ্দেশ্যে বলা হল, হয় কাশতে কাশতে তার প্রাণ যাবে নয়ত তীরের ফলায় মান যাবে।
ফ্যাশান যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে কিছুদিন পরেই হয়ত দেখা যাবে গোটা পোশাক আর কেউ পরছে না বা পরতে চাইছে না। উন্নততর ফ্যাশানের দৌলতে শতছিন্ন বা সহস্র তাপ্পি দেওয়া পোশাক আমাদের প্রীত করবে। কোনও দর্জিই আর হয়ত গোটা পোশাক তৈরি করতে চাইবে না। অথবা যারা তৈরি করছে, যারা তা পরছে এদের পিঠে সবাই গেঁয়ো ভূত বলে ছাপ মেরে দেবে।
ঠিক তেমনি হয়ত একদিন চলে আসবে ভাষা-ফ্যাশানের যুগ। সেদিন নির্ভেজাল মাতৃভাষায় আর কেউ কিছু বলবে না বা লিখবে না। অন্তত তিন চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার শব্দাবলী বা বাক্যাংশ জুড়ে দিয়ে নামাবলীর মত একটি অদ্ভুত মিশ্র ভাষা আমরা পরে থাকব সর্বক্ষণ। ইংরিজি হিন্দি তো বটেই সেই সঙ্গে আরবি, ফারসি, চাইনিজ, গ্রীক, জার্মাণ, জাপানী ইত্যাদি যে যে ভাষা শিখবে সে বাংলার সঙ্গে একাধিক এগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে বলবে এমন কী লিখবে। এইভাবেই গড়গড়িয়ে চলবে ভাষা-ফ্যাশানের জয়রথ। সেই রথের রশি ধরে পুণ্যার্জনের জন্য হয়ত পড়ে যাবে কাড়াকাড়ি।
বিষয়টা হয়ত কিঞ্চিৎ বুঝিয়ে বলা গেল। ভাষার ক্ষেত্রে বাস্তব আর আবেগ কিন্তু অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ভাবুন তো ১৯৫৮ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় ভাষা আন্দোলন অথবা ১৯৬১ সালে ভারতের শিলচরের ভাষা আন্দোলনের কথা? ভাষা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা যদি নাই থাকবে তবে কেন হল সেই আন্দোলন গুলো? কেন সেই আন্দোলন দমনের ধারাল খড়্গে বলি হল অতগুলো তরতাজা প্রাণ? রক্তাক্ত কিংবা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের ঢাকা (২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮) আর আর ভারতের শিলচর (১৯ শে মে ১৯৬১)? শুধুমাত্র আবেগের ইন্ধনে? আবেগবাদীদের কথা ছেড়ে দিন, ঘোর বাস্তববাদী মানুষও কি বিশ্বাস করবে একথা? তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্থানের শাসক কি বিনা কারণেই পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাষাবেগকে খুঁচিয়ে তুলেছিল? কিংবা শিলচরে আসামের তৎকালীন সরকার? ভাষাবেগের মূল্য অনেক বেশি ভেবেই কিন্তু তারা এগিয়ে ছিল।
অনেকেই হয়ত ভাবেন প্রয়োজনের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করলে বাস্তবতা আর আবেগের ভিন্ন ভিন্ন ওজন হবে। তর্কের খাতিরে সেটা যদি ধরে নেওয়াও যায় তাহলেও সেই দাঁড়িপাল্লায় বাস্তবতা মাটি স্পর্শ করে আবেগকে এতটাই লঘু করে দেবে যে সে মহানন্দে আকাশে উঠে পড়বে?
ধরুন আপনি বাড়ি করবেন। ইঁট, কাঠ, স্টোনচিপস, বালি, লোহা, মিস্ত্রী-মজুর সব প্রস্তুত। তবুও কি আপনার বাড়ি হবে যদি একবিন্দু জলও অমিল হয়? জল যেমন মশলাকে নরম করে তেমনি ইমারতকে করে শক্ত। সমাজ গঠনে আবেগের স্থান তাই বাস্তু নির্মাণে জলের মতই। আর বিষয়টা জলের মতই সহজ। আবেগ ছাড়া মানুষের জীবন একটি ঊষর মরুভূমি ছাড়া কিছু নয়। আর মানুষ ছাড়া সমাজেরই বা কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়।
ভাষা মানুষের আবেগ। মানুষের অহংকার। মানুষের অলংকার। ভাষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। আর সংস্কৃতি আনে উন্নয়ন। আর এই উন্নয়ন মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় বংশ পরম্পরায়। আন্তর্জাতিকতায় আচ্ছন্ন অনেকেই হয়ত বলবেন, আজকের বিশ্বে জাতির কোনও অবস্থান নেই। সবাই মিলে বিশ্বটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেই আসবে সামগ্রিক উন্নতি। জাতির চিন্তা হল একটা সংকীর্ণতা। কিন্তু ভাবুন তো। গোলাপ সুন্দর, পদ্ম সুন্দর, সুন্দর জবা, টগর, অপরাজিতা কিংবা অন্য অনেক ফুল। আপনার বাগানে যদি ভিন্ন ভিন্ন ফুলগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রেখে দেন তাহলে বেশি সুন্দর লাগে নাকি সব ফুলোকে যে ভাবেই হোক পাশাপাশি বসিয়ে রাখলেই সুন্দর দেখায়?
খিচুড়ি সুস্বাদু হয় রান্নার গুণে। তার নামমাহাত্মে নয়।
অর্থাৎ স্বকীয়তা একটা মস্ত বড় ব্যাপার। প্রত্যেকটি জাতিরই যেমন নিজ নিজ বৈশিষ্ট আছে, তেমনি মানব সমাজে আর সভ্যতায় তাদের আছে নিজ নিজ অবদান। এই বৈচিত্রকে স্বীকার করতেই হবে। তাই জাতির মতই প্রত্যেক ভাষারও আছে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট। সেটাকে অস্বীকার করে মানব সমাজের উন্নয়ন ঘটানো যায় কি?
বিদেশী শাসকরা কিন্তু আবেগের বশবর্তী নয়, তারা ঘোর বাস্তববাদী। তাই তারা জানে মানুষের আবেগে বাধা দিলে তারা হয়ে পড়ে হতোদ্যম। ভাষা বিশেষভাবে মাতৃভাষার আবেগে যদি অন্তরায় সৃষ্টি করা যায় তো তাদের সংস্কৃতি আর উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। শাসিত জাতি মেরুদন্ড হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে শাসকের পায়ের তলায়। আবেগকে নিয়ে এই বাস্তব চিন্তা –অবাস্তব লাগছে কি?
বাঙ্গালী অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বাংলাকে উৎখাত করে উর্দুকে অভিষিক্ত করার চেষ্টা হয়। পরিণতিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ ভাষা আন্দোলন। আসামেও অসমিয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টায় কিন্তু এই ভাষাবেগই বাঙ্গালী অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীদের গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল ১৯ শে মে ১৯৬১-র প্রবল প্রতিরোধ। একবার ভাবুন তো, আবেগ যদি না সেদিন আন্দোলনের বেগ না এনে দিত তো বাংলাভাষার আজকের এই অবস্থান আমরা ধরে রাখতে পারতাম কি? আর বাঙ্গালীর সংস্কৃতির কী অবস্থান দাঁড়াত যাকে নিয়ে আজও বুক ঠুকে গর্ব করি আমরা? বাঙ্গালী তার ভাষা হারিয়ে সংস্কৃতি হারিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকত এক অভূতপূর্ব মিশ্র সংস্কৃতির পায়ের তলায়। তাতে হয়ত 'কিছু মানুষের' কোনও ক্ষতি হত না কেননা পরাধীন ভারতবর্ষেও তো সেই 'কিছু মানুষের' কিছু ক্ষতি হয় নি?
ভাষাদিবসে আজ এই যে এত সভা, এত শিল্পীর যোগদান—এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্ব-মহিমায়। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল কিছু বাঙ্গালীর বলিদানে। একটা আবেগের স্ফূরণে। সব বাস্তবতা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে আবেগকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল মানবতার স্বার্থেই। ২১শে ফেব্রুয়ারি বা ১৯শে মে মাতৃভাষাপ্রেমীদের কাছে এক মুক্তির দিন। এক মহা পবিত্র দিন।
===============================================
অরুণ চট্টোপাধ্যায়