'মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা'
তাড়িত দুঃখের মত চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল/রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ,উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে/তিরের ফলার মত ভাষার চীৎকার /বাংলা বাংলা.../কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ কর?'আল মাহমুদের এই কবিতা পড়লেই কেন জানি না ভেসে ওঠে সেই মুখগুলি যারা ঢাকায় এবং অসমের শিলচরে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন.১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরর শান্তিপুর্ন আন্দোলনে পুলিশের বর্বরোচিত গুলি চালনায় আব্দুস সালাম,রফিক উদ্দিন আহমেদ,আবুল বরকত এবং আবদুল জব্বর নিহত হন। পরবর্তীকালে অরথাত১৯৬০ সালে অস্ম সরকার অসমিয়াকে একমাত্র সরকার স্বীকৃত ভাষা ঘোষনা করলে শিলচরের বাংলাভাষী মানুষ আন্দোলনে শামিল হন।সেই একই বর্বরোচিত কায়দায় পুলিশের গুলি চালনায় সেদিন শিলচর রেলস্টেশনে ১১ জনের মৃত্য হয়.১১ টি প্রাণের বিনিময়ে অসম সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং বাংলাভাষা তার স্বমর্যাদা ফিরে পায়। এই নিহত ১১ জনের মধ্যে একজন মহিলা ছিলেন তাঁর নাম কমলা ভট্টচার্য।ইনিই পৃথিবীতে ভাষা আন্দোলনে নিহত প্রথম মহিলা শহিদ। পরবর্তীকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এবং আমাদের দেশে আপন ভাষার জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে অমর ঘয়ে আছে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে-এই দিনগুলি ।
এই কথা বলছি এই কারণে যে ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার ভাষা আন্দোলনে নিহত বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তুর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' রূপে স্বীকৃতি এবং ইউনাইটেড নেশনস পরবর্তীকালে অর্থাৎ ২০০৮ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস' রূপে ঘোষণা করে। বাংলা ভাষার পক্ষে এ কম গৌরবের নয়। তবু মনে হয় এ গউরবের অর্থ আমরা আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
ঢাকার শহিদদের আত্মবলিদানের কথা যদি আমরা হৃদয়ঙ্গম করতাম তাহলে ক্রমাগত ভাবে আমরা আমাদের ভাষাকে এইভাবে অবহেলা করতাম না।এই ভাষার জন্য যঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাশীল?বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষার প্রতি যতটা শ্রধাশীল আমরা ততটা হতে পারলাম না কেন?তারা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে রেখেছেন বলেই ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন এই ভাষাকে সর্বত্র প্রয়োগ করতে এবং বলা যায় সফলও হয়েছেন। তাই প্রশ্ন জাগে আমাদের কি সত্যিই অধিকার আছে ২১ শে ফেব্রুয়ারি' 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' পালনের?আমরা ২১ শে ফেব্রুয়ারি এই বাংলায় যেভাবে পালন করি আর তারপর সারা বছ ধরে বাংলাভাষা কে নানাভাবে লাঞ্ছিত করি তাতে এই কথাটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এসব হুল্লোড় ছাড়া কিছু নয় ।শহুরে উচ্চবিত্ত বাঙালিরা বাংলা ভাষা্য কথা বলতে হীনমন্যতায় ভোগেন। মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তরাও এখন তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার ফলে সেই সব ছেলেমেয়েরাও আর বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিচ্ছেনা, অভিভাবকেরাও সেই দলে শামিল হয়েছেন। এই প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা যে ভাষায় কথা বলছে তা তো বাংলা ভাষা নয়,এ এক জগাখিচুড়ি ভাশা।তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না।তারা পারিপার্শ্বিক অরথাত টিভি এবং এফ এম রেডিয়োর দৌলতে এসব শিখছে।এর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার কোনো প্রতিবাদ নেই। বেড়েই চলেছে বাংলা ভাষার নামে জগাখিচুড়ি ভাষার একটা সংস্কৃতি । বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষাকে একটা উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন অরথাত বলতে চাইছি তাদের জন্যই এই 'বাংলা ভাষা' আজ বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষ যেটা করে দেখিয়েছেন আমরা পারলাম না কেন?আসলে আমাদের আন্তরিকতার অভাব আছে।তাই অতুলপ্রসাদের 'মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা' শুধুই গান হয়ে থেকে যায়, আমাদের প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারে না। আজ আমরা মাতৃভাষাকে ভুলতে বসেছি,তাচ্ছিল্য করতে শিখেছি।দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা বানান ভুল,শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যেও লক্ষ্য করছি অতি সাধারণ শব্দগুলিও তারা ভুল বানানে লেখেন।অরথাত এমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আছে যে বাংলা যেভাবেই হোক লিখে দিলেই চলবে।আপন ভাষার প্রতি আমাদের এই তাচ্ছিল্য এই উদাসীনতা আমাদের পরিচয়কেই হেয় করছে একথা আমরা বুঝেও বুঝতে চাইছিনা।আমরা নিজের দেশ এবং ভাষা কে যদি ভালবাসতে না পারি তাহলে 'ভালোবাসা' কথাটারই অমর্যাদা করা হয়।অনেক বাঙালি আছেন তাদের ইংরাজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে গর্ব করতে গিয়ে তারা বলেন অদের বাংলাটা ভাল করে আসে না। হায় বাঙালি! আমরা নিশ্চয়ই অন্য ভাষা শিখবো প্রয়োজনে অন্য ভাষায় কথা বলবো বিশ্ব নাগরিক হওয়ার ভাবনা থাকবে মাথায় কিন্তু আমরা ভারতীয় এবং বাঙালি এই আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে নিশ্চয় নয়।দুজন বাঙালি যখন পরস্পর হিন্দি কিংবা ইংরাজি ভাষায় কথা বলে তখন মনে হয় কাকেরা কলরব করছে। মধুসূদন দত্তের ' আত্মবিলাপ' থেকে আমরা কোনো শিক্ষায় গ্রহণ করিনি।'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমতুল্য' এ কথাকেও আমরা আমল দিইনি।
চারিদিকে কান পাতলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে বাঙালির ভাষা এবং সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। কিন্তু তাই বলে আমাদের হাত গুতিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভাষার কারণে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছে। আমাদের দোষেই নতুন প্রজন্ম বাংলা থেকে সরে যাচ্ছে।বাংলা ভাষাকে বাণিজ্যিক,প্রশাসনিক, বৈজ্ঞানিক এবং প্রাযুক্তিক ক্ষেত্র আমরা এখনও কার্যকর করে তুলতে পারিনি, তা করতে হবে।বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ এঁরা বহু পরিশ্রমে বাংলা ভাষাকে যুগোপযোগী করে তুলেছিলেন।আমাদের মধ্যে এখন আর সে আন্তরিকতা নেই।উন্নাসিক বাঙালিদের বাদ দিয়ে আমরা যারা এই ভাষাকে আন্তরিকভাবেই ভালোবাসি এবং এ ব্যাপারে যত্নবান হই তাহলে আমাদের এই প্রাণের ভাষাকে কেউ ছোট করতে পারবে না।কাজেই ভাষা আন্দোলনে নিহত বীর শহিদদের প্রতি আমরা যদি যথাযোগ্য সম্মান জানাতে চাই তাহলে মনে রাখতে হবে ২১শে ফেব্রুয়ারি হুল্লোড়ের দিন নয়, মাতৃভাষাকে ভালোবাসব অবহেলা করব না,অপমানিত হতে দেব না সেরকম হলে এই ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা আত্মবলিদান দেব-এই শপথ নেওয়ার দিন।
--------------------------------------------------------------
আশিস চৌধুরী, বার্নপুর,পশ্চিম বর্ধমান।