ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে কয়টা খড়েরআঁটি নিয়ে মাঠের দিকে হনহন করে হাঁটা দেয়
তারিন দাদু;
আজকের দিনে জমিতে, বাগানে, ঘাটে, খামারে, বাড়ির প্রবেশ দ্বারে খড়ের আগুন দেয়;
সে কোন ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি;
তারিন দাদু, আমার ঠাকুরদার ছোট ভাই;
আমাদের আবাদি জমিগুলো বেশির ভাগটাই
বেদখল হয়ে গেছে ;
তবুও দাদু যায়, জমি গুলোর প্রতি খুব যে মায়া;
যে জমিতে এক সময় নিজের হাতে
সোনালী ধান ফলিয়েছে,
যে বাগানগুলোতে নিজের হাতে সবজি ফলিয়েছে,
সেগুলো এখন অন্যের দখলে;
অথচ, পয়লা বৈশাখে খালি পায়ে পৌঁছে যায়
সে জমির আলপথে;
আলপথও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে;
ছোট হয়ে আসছে পাড়া-পড়শির হৃদয়গুলো;
সুতি খালে আর ঢোকে না জল …
একে একে অনাবাদি হয়ে পড়ছে জমি,
চোখের সামনে দেখা সমাজটাও;
গ্রামের বাড়িতে এখন তেমন কেউ থাকে না;
তবে পালে-পার্বণে মোটামুটি প্রায় সকলে
আসে, আমরাও …
এখানে বছর শেষে চড়ক মেলা বসে;
চড়ক গাছ ঘোরে বনবন করে;
বনবন করে ঘোরে শিব সন্ন্যাসী;
শুরু হয় শিবের গাজন;
ছোট ছোট অনেক দোকান বসে;
জেনেরেটরের আলোতে মাঠ জুড়ে আলো;
আলো আর আলো .…
আর শিকড়ের টানে ফেরা মানুষের মুখ;
একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে কত কথা;
অতীতের কথা , বর্তমানের কথা;
কিন্তু, ভবিষ্যতের কথা কেউ বলে না;
বলে কেবল, আমার তারিন দাদু;
এখানে পয়লা বৈশাখে, বাংলার নববর্ষে
গোষ্ঠের মেলা বসে;
সেই সকাল থেকে শুরু হয় উৎসবের আমেজ;
রোদ্দুরে বসে নিম-হলুদ মাখা;
পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা,
গাছ থেকে কাঁচা আম পাড়া …
তারিন দাদু , গাই গরু দুটো ও বাছুরটাকে
স্নান করিয়ে আলতা-সিঁদুর পরিয়ে দেয়;
দুপুরে একশো ঢাকি ঢাক বাজাতে বাজাতে
গ্রামের রাধা-কৃষ্ণ যুগল কে নিয়ে যায়
মেলার মাঠে;
পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করে গ্রামের মানুষ;
গ্রামের দেহাতি মানুষগুলো এভাবেই বেঁচে থাকে;
বেঁচে আছে সহজ-সরল, সুখ-দুঃখ নিয়ে
আমাদের তারিন দাদুর মতো;
এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে,
সে গ্রাম থেকে অন্য আরেক গ্রামের মন্দিরের
রাধা-কৃষ্ণের যুগলগুলো চলে আসে;
তারপর সন্ধ্যা নামলে
মেলার মন্দিরের পাশে বেঁধে রাখা গরু ডেকে উঠলে
শুরু হয় পূজা;
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন …
এখানে এখনও পুতুল নাচ হয়;
তারের পুতুল …
পুতুল নাচের গানে সেই প্রাচীন গল্প;
সে দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বারবার
মনে হয় আমরাও কি নেচে চলেছি!
হয়তো হবে …
তারিন দাদুর কথা কীভাবে অস্বীকার করবো!
হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলা;
আমাদের পাড়া-গাঁয়ের গোষ্ঠের মেলা;
আশেপাশের গ্রামের মানুষগুলো সারাটা বছর
অপেক্ষায় থাকে,
বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শখের জিনিস কেনার;
পূজা চলে, পার্বণ চলে, বছর আসে, বছর যায়;
তারিন দাদুরা তাকিয়ে থাকে নতুন প্রজন্মের দিকে;
যারা চলে গেছে রুটি রুজির তাগিদ দিয়ে শহরে, ভিন রাজ্যে;
কেবল এটুকুই আশা, কদিনের জন্য হলেও
শিকড়ের টানে, মাটির ঘ্রাণে ফিরে আসে
মাটির কাছাকাছি;
আবার ভাবে, যেখানে আছে ভালো আছে,
ভালো থাকে সকলে;
সুখে থাক পয়লা বৈশাখের মতো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন