Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। ধলু ও মিস্টি-ঘাস ।। নাসির ওয়াদেন


ধলু ও মিস্টি-ঘাস

নাসির ওয়াদেন


       রোশনারা ঘর থেকে হাঁক ছাড়ে,' কোই রি অ্যাস ন্যা, কতি গেলি রি মা?'
কোন উত্তর না পেয়ে রোশনারা ক্ষুদ্ধ হয়। রাগের চোটে বলে, মাগীটা দিন দিন ধ্যাঙড় হোছে, যখুন তখুন ইতিউতি চলি যেছে, বুলা ন্যাই ,কুয়া ন্যাই। তা ও আস্ ন্যা, শুনতে পেলি?
   মাটির ঘরের দাওয়া থেকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে বিবিজান। একসময় ধপ্ করে বসে পড়ে মাটিতে। মাথাটা ঘুরে যায়। গত তিন মাস হল ডান চোখটা অপারেশন করেছিল। কিন্তু কোন ফল পাইনি। উল্টো চোখটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যে চোখটাতে একটু আধটু দেখতে পেত, সেটাও দিন কয়েক থেকেই আবছা দেখছে। ডাক্তার দেখানোর একটা কানাকড়িও নেই ঘরে। থাকবে কি করে, এই বুড়ো বয়সে আব্দুল হালিমের গায়ে কি আর তেমন শক্তি আছে। জোয়ান বয়সে হালিমের যখন গায়ে ত্যাজ ছিল, জোর ছিল, তখনই ধলুকে কিনে এনেছিল ঘরে।  তারও গায়ে-গতরে মোষের মত শক্তি। যেদিকে ঝাঁপাত, সেদিকেই জোশ পেত, টাকাকড়ি হাতে লাগত, রোজগারপাতিও হত ভালোই । সংসার চলত বেশ ভাল, রমরমিয়ে। গরীবের সংসার বলে কথা।
       গহরজান বিবিকে বিয়ে করে ঘরে তোলে হালিম। পাড়ার লোকেরা তাকে ভালোবেসে ডাকত 'আবদুল হালিম' বলে। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করেও ডাকত 'হালুম'।  লেখাপড়া কম জানা হালিমও সেটাকে সানন্দে উপভোগ করত, আনন্দও পেত। মনে মনে নিজেকে মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলা ভাবত। গহরজানও দেখতে সুন্দরী ছিল বলেই পাড়ার মোড়লের ছোঁড়াটা ছোক্ ছোক্ করে ঘুরত,গা ঘেঁষে থাকার চেষ্টা করত।
গহরজানকে ফুসলাত আর বলত, মেরি পিয়ারী জান, তুম দিল মে লাগ যাও, ও লো,,,
গহরজান সে-রকম নষ্ট মেয়ে নয়। রীতিমতো শরীয়ত মেনে চলা পরিবারের মেয়ে। মা ও বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। তাঁদের মেয়ে কি করে কুলাঙ্গার হতে পারে, কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে না।
      একদিন সন্ধ্যেবেলায় হালিম তার সন্তানতুল্য ধলুকে মাঠ থেকে আনতে যায়। ফেরার সময় ধলু দৌড়ে বাঁশ বনে ঢুকে পড়ে। ভর-সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে দুজনের যে লুকোচুরি খেলা চলছে তা দেখতে ভালোই লাগছে। কিছুতেই গোয়ালে গিয়ে গলায় দোড়্যা পড়তে রাজি নয় সে। তাই, এই আলো-আঁধারির খেলাটায় বেশ জমে উঠেছে দুজনের। আকাশে মিটমিট করে জ্বলা কয়েকটি তারা এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দুষ্টু মিষ্টু খেলা দেখতে তাদেরও লাগছে ভয়ানক মজা। পূবদিকের উত্তরকোণে তখনও চাঁদ ভাগ্নে তার গায়ের লেবাস খুলে ফেলেনি, একটা আস্ত কালো চাদর জড়িয়ে রয়েছে। উত্তর দিক থেকে শিরশির করে হিমানী বাতাস এসে হামলে পড়ছে বাঁশঝাড়ের গায়ে। ছেঁড়াফাটা গেঞ্জিখানা পড়ে হালিমও ছোটাছুটি করছে। নাছোড়বান্দা ধলুকে একটু টাইট দেবে, মনে মনে ভেবে,খুব দৌড় দৌড়াচ্ছে‌। ধলুও তার প্রিয় বাবাতুল্য হালিমকে নাকানিচোকানি খাইয়ে, মাঝে মাঝে মালিকের দিকে কটরমটর চোখে তাকিয়ে দেখছে। তারপর আবার অন্য অন্ধকারে ঢুকে পড়ছে। বাঁশের পাতায় শনশন করে বইছে বাতাস, ভেসে যাচ্ছে গাছের মিস্টি গন্ধ । একটু শীত শীত ভাব জানান দিচ্ছে সন্ধ্যেটা।
   -- ও সুন্দরী গহরজান,মেরি জান! আ মেরে দিল মে, লাগা দে দিল,,, বলে অশ্লীল ইঙ্গিত করে মোড়লের ছোঁড়াটা।
-- তখনও আসমিনার চোখে পৃথিবীর নরম আলোর স্বাদ এসে পড়েনি। তিন মাসের জমাট ভ্রুণ পেট ভরে আছে গহরজানের। মরদ হালিমের আদরের সন্তান। তিলে তিলে চাঁদের পলে পলে বেড়ে ওঠার মত সেও মাতৃগর্ভে রক্ত ঘাম খেয়ে বাড়ছে। মাঝে মাঝে স্ফীত পেটের উপর হাত বুলিয়ে আদর করে গহর ।
'বাছা, তুমাকে হামরা কত্ত যত্নআত্তি করে বড় করব । তুমি হামাদের প্রথম সন্তান। তুমার মুখ দেখেই তো হামরা বেঁচে থাকার স্বপ্নটাকে সত্যি করে রাখবো।' মনে মনে এসব কথা ভাবছে একলা ঘরে বসে গহর। সেই সময়ে এক অসভ্য ছায়া, কামনাসক্ত নরখাদক এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কুকথা, অকথা বলে বুকের কাছে টেনে নিতে চাইছে তাকে।
  -- কি হলো গহরজান! কুথা বুলছো না ক্যানে, হামাকে কি তুমার পছন্দ হোছে না?
চুপচাপ সে। ভয়ার্ত চোখে দাওয়ার শক্ত খুঁটিটা হাতে  চেপে ধরে বসে আছে। মনে শঙ্কা জাগছে। হয়তো এখনই ক্ষুধার্ত নেকড়েটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। টুকরো টুকরো করে দেবে তাদের সাধের সরল স্বপ্নটাকে। ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে তার ইজ্জত। মনে মনে উপায় খোঁজে। বলে, আল্লাহ, তুমি রক্ষাকর্তা। হামারে এ বেপদ থেকি অক্ষা করো।
     চাঁদ একটু একটু করে তার গায়ের কালো চাদরখানা খুলে ফেলছে গৌরবর্ণ শরীর থেকে। আলো আঁধারির মাঝে একটু আলোর ঝিলিক এসে পড়ল উঠোনে। বাতাসের হিমানী উত্তাপও কমে আসছে ধীরে ধীরে।
-- তাহলে হামার কথা শুনবি না মাগী। তবে দ্যাখ, এখুন তো তোর ভাতার বাড়িতে ন্যাই, কে তোকে বাঁচায় দ্যেখি-- বলে দাওয়ার দিতে এগিয়ে যায় ক্ষুধার্ত নির্লজ্জ নেকড়েটা।
-- খবরদার হারামজাদা!  যদি একটা পা এগুয়েছিস তো, তোকে এই আঁশ বটি দিয়্যা তিন টুকরা কোরা কুত্তাদের খাওয়াবো। হামিও গোহারজান আছি, আদম মুন্সির বিটি বটে।
চাঁদের আলোয় আঁশবটিটা চিকচিক করে উঠেছে। তার লকলকে জিভেও লালা ঝরছে। কতদিন মানুষের রক্ত পান করেনি।‌ মানুষের রক্তের স্বাদ তো অপূর্ব। তাই তো, মাঝে মাঝে গহরজানের আঙ্গুলের রক্ত চেখে দ্যাখে। আস্ত একটা নোংরা মানুষের রক্ত পানের উৎসাহে বটিটাও চাঁদের আলোয় ঝিকিমিকি করে ওঠে।
-- আয়! দেখি তোকে আজকে কে বাঁচায়?
  'বাবা গো, মা গো'-- বলে নেকড়েটা ছুটে পালিয়ে যায়। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বিন্দু দিয়ে আলপনা তৈরি করে উঠোনের মাটি।

                                দুই

   আসমিনার জন্ম হওয়ার পরে পরেই মারা যায় গহরজান।  মা-মরা মেয়েটাকে দূর সম্পর্কের এক পিসি-ফুফুর কাছে মানুষ করতে রেখে আসে হালিম। একদিকে না-খেতে পেয়ে ধলু হাড় জিড়জিড়ে হয়ে পড়ে। মোড়লের ছেলের রোষে মাঠের অফসল ঘাস খাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় ধলুর। একদিন দড়ি ছিঁড়ে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে মোড়লের ফলন্ত পেঁপে গাছ খেয়ে ফেলে। গাছ খাওয়ার অপরাধে ধলুর কারাবাস হলো গোবিন্দপুরের খোয়াড়ে। দিন দুয়েক সেখানে জেলখাটার পর গহরজানের চাঁদির হারখানা বিক্রি করে জামিন করে আনে হালিম। দূর সম্পর্কের ওই পিসিফুফুর অকাল মৃত্যুর পরেই আসমিনা ফিরে আসে তার বাবার ঘরে, মেয়ে ও ধলুকে নিয়ে বেশ সুন্দর জীবন কেটে যাচ্ছিল হালিমের। মেয়েটাও দেখতে দেখতে সতেরটা বসন্ত পার করে পলাশ শিমুলের মত উজ্জ্বল ও চকচক করে ফুটে উঠতে লাগল গরীবের ঘরে, যেমন করে ভাঙ্গা ঘরের চাল থেকে চকচকে আলোর ঝরনা ঝ'রে সুন্দর করে তোলে সুখের চাঁদকে। বাপ-মেয়ে মিলে ধলুর সেবা যত্নে ধলু আবার নতুন করে জীবন ফিরে পায়।

      হাওয়া বদল হলে যেমন স্বস্তি আছে, বাংলার মাটিতেও নতুন হাওয়া এসে মাঠঘাটের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে যায়। খাঁ খাঁ করা মাঠে সবুজের প্রাণ, ভালোবাসার গন্ধ, নতুন ধানের প্লাবন, সোনালী স্রোতের ইন্ধন, আকাশ বাতাস যেন কৃষিতে মশগুল। এতদিনের চাপা ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া থেকে নতুন করে বাঁচার বাতাস, প্রেরণার উচ্ছ্বাস পল্লীবাসীর জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে,গড়তে থাকে সোনার বাংলা। মাঠে মাঠে সবুজ ঘাস ভরে ওঠে সারা বছর ধরে। ধলুকে আর বেড়া  ডিঙিয়ে পড়শির ঘরের ফসলে মুখ দিতে হয় না। মাঠের ঘাস পেট পুরে প্রাণ জুড়িয়ে উপভোগ করে। কচি কচি ঘাসের স্পর্শে ধলুর ক্ষীণ শরীর স্ফীতকার হয়ে ওঠে।
      সোমত্ত মেয়ে আসমিনাকে একাকী ঘরে রেখে বাইরে কাজ করতে মন বসে না হালিমের। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। কখন কালকেউটেগুলো এসে তার মা-মরা একমাত্র মেয়েটাকে ডালকুত্তার মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। তারই ভয়ে ভয়ে থাকে সে। অবশেষে মেয়ের প্রস্তাবেই রাজি হয় হালিম। ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের বাপ-মরা এক বিধবা মেয়ে, রোশনারাকে শাদি করে ঘরে তোলে। তাতে একদিকে মেয়েটার একটা হিল্লে হয়, তেমনি তারও ঘর সংসার গুছিয়ে তোলার একজন মেয়েলোক জোটে। আসমিনাও বেশি বেশি সময় দিয়ে বিড়ি বেঁধে দু-চার পয়সা রোজগার করে, সংসারের  খরচ জোগায়।
      মাঝে মাঝে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাপ  মা-মরা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, লক্ষ্মী মা হামার! ইবার তো তোর বয়স হলো, এ্যাকটো সুন্দর পাত্তর দেখ্যা তোর  শাদি দিয়্যা দিবো।
আসমিনা লজ্জা পেয়ে বলে, কি বলো বাবজান, হামি বুঝি বোঝা হুয়ে গ্যেলছি।
  -- না না মা, তা বুলছি না। তবে তো জানিস সোমত্ত বিটি ঘরে রাখতে ন্যাই। কখন কার কুনজর পড়ে।
-- হামি কি তুমার ভীতু মেয়ে নাকি? তুমি ভয়ডর করো না বাপ,হামি সব সামলে লিব।
-- তা বুললে হয় মা, তোর ঘর সংসার হোবে, ছেলেপুলে হোবে, তাদের নিঙ্ সুখে থাকবি।
  -- ধ্যাত!  বলে আসমিনা লজ্জায় মুখ ঢাকে। পাশের ঘরে ঘুমাতে যায়। সামনের বারান্দায় রোশনারাকে সাথে নিয়ে ঘুমায় হালিম। ভাঙাচোরা বাড়িতে কখন যে হুলোবেড়াল ঢুকে পড়বে তার কি কুনো গ্যারান্টি আছে।

                        তিন

   -- হামাকে ডাকছো মা! এইতো হামি একটু মালতি দিদির বাড়িতে গেলছিলুম। তুমি নিচে নামছো ক্যানে? পড়ি য্যাবা যি--
-- হতচ্ছাড়ি মেয়ে। যখুন তখুন এদিক-ওদিক চলি য্যাছি। দাঁড়া,অ্যাজ তোর বাপ এ্যাসুক,ওকে বুলছি তোকে শীঘ্রই বাড়িছাড়া করাব। মিনসেকে‌ বুলি  কালকেই তোকে য্যামুন ত্যামুন যাকেই পাব তারই সাথে তোর শাদি দিয়্যা দিমু। --বলে গালি দেয় রোশনারা।
  আসমিনা চুপ করে থাকে। মিষ্টি করে মায়ের গা-গতরে হাত বুলিয়ে বলে, দ্যাখো মা, হামি তো তুমাকে না বুলি কতি য্যাইনা। তবে মিছিমিছি আগ করছ ক্যেনে, হামি চলি গেলে তুমার বুঝি খুউব ভাল লাগবে?তুমি ভাত রাঁধতে পারব্যা? ভাত বেড়ে দিতে পারব্যা? ঘরদোর ঝাঁট দিতে পারব্যা? তাছাড়া হামিও তো বিড়ি বেঁধি টাকা ওজগার করি। করি না তুমিই বুলো?
  এবার রোশনারা চুপ করে যায়। মনে মনে ভাবে, সত্যিই তো মেয়েটা নিজের পেটের না হলেও' মা মা' বলে অজ্ঞান। বিয়ে দিলে তো পরের বাড়ি চলি য্যাবে। তখুন তাদেরকে দেখভাল করবে কে?
আসমিনা তার মাকে সান্ত্বনা দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, মা! তুমিও হামার আপন মা। হামার আসল মা মারা গেলেও তুমিই তো মায়ের আদর দিঙেই হামাকে বড় করাছো। কেন এরকুম মিছিমিছি রাগ করছো মা?
  মা ডাক শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যায় রোশনারার।

      বাড়ির বাইরে হালিমের গলার স্বর শোনা যায়। গোফুর যেন কার সঙ্গে একটা কথা বলছে। মা ও মেয়ে দুজনের কান যায় ওদিকে।
-- দেখো হালুম ভাই, ইবার বাজার খুব তেজি লয়। তুমি তো জানো গরু কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যে কি  তোলপাড় চলছে। চারিদিকে 'চোর,চোর 'ধ্বনিতে ভরে গেলছে। বাইরে পাচার করাও খুব রিস্কি। বলে থামে হসরত পেক্যার।
-- তা তো ঠিকই বুলছো হসরত। তবে একটো কথা শুনো। ই-বছর কোরবানির বাজারে গোরুর চাহিদা কিন্তু আছে। তাছাড়া ওই কতদিনের ধলুকে বেচতে কি মন চাহে--  কিন্তু ওই যে বলি, ভাগ্যে না থাকলে ঠকঠকালে কি ঘি মেলে?
-- মানে বুঝলে তো  ভাইয়া। তোমার দরকার টাকার, হামার দরকার লাভের। হামাকেও তো  দুট্যা পয়সা কোরতে হোবে। কি বলো হালুম? হামি তো ঘরে পুষবো না, হামাকেও হাটে তুলতে হোবে, বড়লোকদের ইনিয়ে বিনিয়ে ফুসলিয়ে বিক্রি করতে হোবে। দুট্যা পয়সা রোজগার করে লাভ করতে হোবে।-- বলে একটা ক্রূর হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দাড়িতে হাত বুলাতে থাকে প্যাকার হসরত।
  -- কি আর করব বলো, ডাক্তারবাবু সামনের রোববারে ডেট দিয়্যাছে। তোমার ভাবির চোখের অপারিশান করাবে। একটা চোখ তো লষ্ট হলো, এটাতেও ছানি পড়্যাছে। অপারিশান না করলে নাকি ই-চোকও লষ্ট হুঙ্ য্যাবে। বলি, চোখের জন্যই তো দুনিয়া, চোখ না থাকলে দুনিয়াটা তো আঁধার, কালো পর্দার মতো।
--  চলো, চলো। দেরি করোনা, কোন মাঠে আছে গরুটা। বলে তাড়া দেয় প্যাকার।
  -- ওই যি, উতোর মাঠে! ঘাস খেয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। বলেই, হাঁটতে থাকে দুজনেই।
   কিছুটা দূরে যেতেই মধ্যি মাঠে সবুজ ঘাসে মুখ লাগিয়ে চড়ে বেড়াতে দেখছে ধলুকে। সে প্রাণ ভরে ঘাস খেয়ে, পেট পুরে তবেই ঘরে ফেরে।
   চলতে চলতে পিলে চমকে উঠে হালিমের। একটা সময়ে গরুটার কাছে পৌঁছেও যায় তারা। প্যাকার শিং দুটো ধরে মুখখানি ফাঁক করে দাঁত দেখে।
' চার দাঁতে। বলিষ্ঠ দেহ। বাজারে কাটবে ভালই ', মনে মনে হিসেব কষে হসরত পাইকার।
নির্বাক চোখে তাকায় ধলু হালিমের মুখের দিকে।
'' কই, কোনদিন তো হালিম এভাবে মুখ হাঁ করে দাঁত দেখেনি। এক অচেনা মানুষ কেন এভাবে তাকে আঁকড়ে চেপে ধরেছে। তবে কি সত্যিই এবার তাকে চিরতরের জন্য চলে যেতে হবে। '' দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল ধলুর।
   সেসময়ে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হালিমও তার দু চোখের জল কাঁধে ঝোলানো পুরনো গামছাখানা দিয়েই মুছতে থাকে বারবার,,,,

                                                     ===========০০============       


নাসির ওয়াদেন
সৌম্য জেরক্স কলেজ রোড
পোঃ --মুরারই, পিন-- ৭৩১২১৯
জেলা --বীরভূম, পঃ বঃ, ভারত


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩