অচেনা ওই পাগলীটা
সুপ্তা আঢ্য
ব্যস্ত শহরের প্রতি কানাচ আনাচের সবখানটুকুই বড়ো ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা ঘেরা মুহুর্তেই প্রতিটি শহরবাসীর সকাল গড়িয়ে দিনশেষে রাত হয় আবার ঘুম ভেঙে রাত ফুরিয়ে দিন। কিন্তু প্রতিটি পুরুষ ,নারী,বৃদ্ধ, শিশু সকলের দিনের যাপন কি একই রকম! হয়তো নয়----তবে একটা জায়গায় সবার এক! দিন আর রাত একচক্রেই আসে; দিনে রাত আর রাতে দিন চাইলেও কেউ করতে পারে না----আকাশমার্গে যিনি আছেন তিনি তো হিসেবের নড়চড় হতেই দেবেন না। তবে স্টেশনের পাশের বাজারের এককোণে আধ ময়লা শাড়ি পরে জড়িয়ে গুটিয়ে বসে থাকা ওই পাগলীটার হিসেবের সবটাই ছাড়পত্রে। সে কি ও পাগল বলে নাকি নিঃস্ব রিক্ত বলেই বড়ো কাছের ওনার---সেটা উনিই জানেন। কাছের জনই তো প্রিয়জন আর প্রিয়জনের জন্যে সব হিসেব ভালোবাসায় মেটে বলেই সাত খুন মাফ।
যাই হোক,অনেক তো শিবের গীত গাওয়া হল---এবার বরং গল্পে ফিরি। স্টেশনের আসা যাওয়ার দুইপাশের বাজারে পথচলতি ভিড় লেগেই থাকে সারাদিন। সন্ধ্যে বিকেলে ফিরতি পথে সবাই বাজার করে ফিরতে পারে বলে তাদেরও সুবিধা আর বিক্রি করতে বসা মানুষগুলোর বেশ দুপয়সা আয় ও হয়। এরই মধ্যে ওই পাগলীটা কোথা থেকে যেন এসে এখানে আস্তানা নিয়েছে। বয়স চল্লিশের দোরগোড়ায়----মাথার জট পাকানো ধুলো মাখা চুল কোমর ছাড়িয়েছে। গায়ের রঙ ধুলো ময়লায় ঢেকে গেলেও সোনার বরণ রঙ কে আটকাতে পারে নি। চোখ মুখের চেহারায় বেশ বড়ো ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়। সে যাই হোক---কে যে কখন প্রাসাদ সিংহাসনে বসবে আর কে কখন পথের ধুলোয় শ্রী রাধিকা হয়ে লুটোবে সেটা কেউই আমরা জানিনা। এই পাগলীটাও জানত না ওর আগে থেকে নির্দিষ্ট হয়ে থাকা ভবিষ্যতকে। চোখ মুখ দেখলেই সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞানহীনতা বেশ বোঝা যায়। এদের শরীর নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই বলেই বোধহয় লজ্জা বোধ আর তাকে ঢেকেঢুকে রাখার ইচ্ছে কোনোটাই নেই। আর এদের মন চেতন,অচেতন স্তর ছাড়িয়ে অবচেতনে সর্বক্ষণ স্থিত বলেই শরীর মন নিয়ে কোনো বিলাস এদের স্পর্শ করতে পারে না। তবে নেই বিলাস ওকে যেমন স্পর্শ করে বাকি সকলকে আবার বহুবিলাস স্পর্শ করে----পাগলী হলেও নারী তো! আর নারীর প্রতি চোখ পুরুষ নারী উভয়েরই থাকে----দৃষ্টিসুখ যাই থাকুক। পাগলীটার পরনের শাড়িটা নামমাত্র শরীরে---বাকিটুকুর কিছুটা কোমরের কাছে জড়ানো আর কিছুটা রাস্তার ধুলো মাখছে। যার শাড়ি তার অবশ্য এদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই।সে আপন খেয়ালে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকে নিনির্মেষে। কেউ খাবার দিলে খায় নাহলে নোংরা ঘোলাটে চোখ নিয়ে তাকিয়েই থাকে আকাশে। পথচলতি মানুষগুলোর কেউ কেউ একটু কৌতূহলী, কেউ বিরক্ত, কেউ বা আবার একটু সহানুভূতি দেখাতে চান আবার কিছু মানুষ ওর ধুলো মাখা শরীরেও লোলুপ দৃষ্টিতে সুখ ভরতে চায়। তবে বাজারের মানুষগুলো ওকে নিয়ে বেশ চিন্তিত----আসলে এই মানুষগুলো নিত্য যাপনের সাথে সাথে ধর্মটাকে আঁকড়েই বেঁচে থাকেন। রোজ বাজার বন্ধের আগে অল্প দূরে মায়ের মন্দির লাগোয়া ঠাকুর মশাইয়ের বাড়িতে ওকে রেখে আসেন তারা। বয়োঃবৃদ্ধ ঠাকুরমশাই আর ওনার স্ত্রী পাগলীটাকে নিজেদের কাছে রাখতে চাইলেও ভোরের আলো ফুটলে ওকে আর ধরে রাখা যায় না। ওর অস্থিরতা দেখে ঠাকুরমশাইয়ের স্ত্রী দরজা খুলে দিতে বাধ্য হন রোজ ভোরে। খোলা দরজা দিয়ে মেয়েটা দৌড়ে বেরিয়ে গেলেও উনি দরজার পাল্লাটা ধরে দাঁড়িয়েই থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত ওর ছায়াটা দেখা যায়। প্রথম সকালে ওর ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ওর জন্য প্রার্থনা সেরে দরজাটা খোলা রেখেই ভিতরে চলে আসেন নিত্যদিনের কাজে। সবাই ওকে পাগলী বলে হাসাহাসি করলেও এই বৃদ্ধ মানুষদুটোর কেমন জানি মায়া পড়ে গেছে ; ওকে পাগলী বলে ভাবতেই পারছেন না। দিনে দিনে এক অপত্য স্নেহের মায়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু যার প্রতি এত স্নেহ তার এসবে কোনো হেলদোল নেই।নিজের মনের জগতে নিজেই রানী ও---- স্নেহ,ভালোবাসা,ব্যঙ্গ, ঘৃণা,কৌতূহল কোনো কিছুই ওর অনুভূতিকে স্পর্শ করতে পারে না। আসলে স্নেহ তো আর সেসব বোঝে না----আত্মার সংযোগ হলে স্নেহরস আপনিই নিঃসৃত হয় ফল্গুধারার মতো। মেয়েটাকে কোনোদিন সকালে কিছু খাওয়াতেই পারেন না উনি----ঠাকুরমশাইয়ের নিত্য পূজার শেষে দুজনে সকালের চা খেতে হঠাৎ করে আপন হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়েই আলাপ করেন দুজনে।বড়ো ইচ্ছে,মেয়েটাকে নিজেদের কাছে রাখা----হয়তো চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করতে পারবেন না, কিন্তু নিজেদের কাছে রাখলে মরুভূমিতে অপত্য স্নেহের বর্ষণ তো হতেই পারে।
যাকে নিয়ে এত ভাবনা----সকাল হতেই সে ওই নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে একদৌড়ে বাজারের পাশটাতেই চলে আসে বসে থাকার জন্য। বসে থেকে ও কি যে পায় ----তা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই জানে না; এমনকি ও নিজেও জানে না। ওর নির্লিপ্ত ঘোলাটে দৃষ্টি কাউকে খোঁজেও না কখনো। বাজারের মানুষগুলো ভীষণই চেষ্টা করছে যদি ওনার ঠিকানা খুঁজে পেয়ে পরিবারের কাছে পোঁছে দেওয়া যায় ! কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও কোনো কুল কিনারা করতেই পারছে না কেউ। আসলে সংসারে যে অপ্রয়োজনীয় সে তো ব্রাত্য----তার ওপর সে মানুষটা যদি স্বাভাবিক জ্ঞানশূন্য হয় তাহলে তাকে না চেনাটাই সবথেকে স্বাভাবিক। এই চরম সত্যিটাই এখানকার সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আর যতটা সম্ভব সারাদিনের হাজার কাজের মাঝেও ওকে চোখে চোখে রাখে। এই ক' মাসেই অপরিচিতা এই মহিলার প্রতি একটা টান তৈরি হয়ে গেছে স্টেশন লাগোয়া বাজারের ক্রেতা বিক্রেতা সকলের তো বটেই----নিত্যযাত্রীদেরও। আসা যাওয়ার পথে মহিলারা মাঝেমধ্যেই ওর জন্য শাড়ি এটা ওটা এনে দিলেও ওর কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই---সেসব জিনিস পাশেই পড়ে থাকে অবহেলায়। মাঝেমধ্যে কুকুরগুলো মুখে টেনে নিয়ে নিজেদের মধ্যে খেলায় মেতে ওঠে আর পাগলীটা ওদের দেখে হাততালি দিয়ে হাসে। কুকুরগুলো অন্য পাগল দেখলে চিৎকার করে তাড়া করলেও এই পাগলীটাকে কিছুই বলে না বরং ওর গা ঘেঁষে বসে থাকে।
দিন সময় নিজের চালে চলতে চলতে বছর শেষের বসন্ত নিজের সময়েই এসে জানান দিয়েছে। সবার মনেই এক অন্য রঙের ছোঁয়া----পাগলীটাও বাদ যায়নি এই ছোঁয়ার ছোঁয়া থেকে। কদিন ধরেই রাস্তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাসী পলাশ ফুলগুলো জট পাকানো চুলে গুঁজে গুনগুনিয়ে গান করতে শুনছিল সবাই ওকে। সে গানের কথা কিছু বোঝা না গেলেও রেওয়াজি গলাটা জাত চিনিয়ে দিচ্ছিল ওর। পথচলতি মানুষগুলোর দুদণ্ড দাঁড়িয়ে ওর সুরে মন বেঁধে ঘরে ফেরাটা নিত্য অভ্যেসের মধ্যেই জায়গা করে নিচ্ছিল । পাগলীটাকে নিয়ে আলোচনাটা সময়ের সাথে থিতিয়ে এলেও ওর সুরেলা কণ্ঠই এখন এ অঞ্চলে আলোচনার প্রধান বিষয়। ও আজকাল সন্ধ্যের পরেও ঠাকুরমশাইয়ের বাড়ির খোলা উঠোনে বসে খোলা গলাতেই গান করে যায় একের পর এক; গানের কথাগুলো ওর নিজের হলেও সুর সেই রবিঠাকুরেরই । বহু সুর মিলেমিশে ওর গানে এক হয়ে গেছে--জড়ানো কথাগুলো সব বোঝা না গেলেও সুরে সুর বেঁধে যায় অবলীলায়। বহু নামী শিল্পীই ওর সুরেলা কণ্ঠের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে। ঠাকুরমশাই আর ওনার স্ত্রী ত্রিসন্ধ্যা ইষ্ট নাম জপের পর হঠাৎ পাওয়া মেয়েটার জন্যই প্রার্থনা করেন মায়ের কাছে। এতবছর ধরে মায়ের সেবা করে আসা মানুষ দুটোর দৃঢ় বিশ্বাস, জগজ্জননী মা ওই হতভাগিনীকে কৃপা থেকে বঞ্চিত করবেন না।
এ শহরের মানুষজন বেশ ধুমধাম করে বারো মাসের তেরো পার্বণে মেতে ওঠেন। আর রঙিন ঋতুর রঙিন উৎসব দোলে যে এরা বাঁধন হারা আনন্দে মাতবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।চারিদিকে সাজো সাজো রবে মানুষগুলোর মনও বেশ সেজে উঠছে নানা রঙের দোলায়। রঙ পিচকিরি আবীরের দোকানে রঙিন হয়ে উঠেছে বাজার আর সেখানের মানুষগুলো। চারিদিকে বসন্ত উৎসবের রঙিন পোস্টারগুলোও বেশ দৃষ্টিসুখকর। মাঝেমধ্যেই থেকে থেকে বসন্ত ফাগুনের গান হাওয়ায় ভেসে এসে মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দখিন হাওয়ার সাথে হাল্কা সুর কানে ভাসতেই ওর ঘোলাটে চোখ দুটো হঠাৎ হঠাৎই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ক্ষণের জন্য। এ ঘটনা সকলের দৃষ্টি এড়ালেও ফুলওয়ালি টগরের তা চোখ এড়ায় না। পরপর কয়েকদিন এই ঘটনা দেখে বাড়ি ফিরে স্বামী মেয়েকে কথাটা না বলে ও থাকতে পারে না।টগরের স্বামীর স্টেশন চত্বরে একটা চা জলখাবারের দোকান থাকায় পাগলীটার সব খবরই জানা ওর। টগরের কাছে শুনে ওর স্বামী বলে "পাগলীটা শুধু বড়ঘরের মেয়েই নয়,বড় গাইয়েও বটে।গলার সুর দেখেছ---বড় বড় গাইয়েদের হার মেনে যেতে হবে।" স্বামীর কথায় দুঃখ প্রকাশ করে টগর বলল "ভগবানের কি বিচার বলতো! এমন একজন মানুষ বোধ বুদ্ধি হারিয়ে পথের ধুলোয় পড়ে আছে কাঙালিনীর মতো। কত তো খোঁজ করলে তোমরা---কোনো খবরই পাওয়া গেল না বলো!"
"সেই তো টগর! কথায় বলে না--ভগবানের মার দুনিয়ার বার; এমন রাজরানী না হলে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়! চিনলেও কেই বা আগল পাগলকে ঘরে রাখতে চায়---তাই তো কেউ চিনলই না ওকে।তবে ওর নিজের লোকেরা না চিনলেও আমরা ওকে আগলেই রাখব।" স্বামীর কথায় বেশ নিশ্চিন্ত হল টগর; মেয়ে হওয়ার যে বড় জ্বালা। পাগলই হোক আর যাই হোক নেকড়েগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবে না কেউই। টগর আর ওর স্বামী যখন পাগলীটাকে নিয়ে আলোচনা করছে, পাশের ঘরে তখন ওদের ক্লাস টুয়েলভে পড়া মেয়ে বইয়ের ভাঁজে আঙুল রেখে কান খাড়া করে বাবা মায়ের কথা শুনছিল। পাগলীটাকে ও ও দেখেছে বারকয়েক; আর পাঁচটা পাগলের থেকে আলাদা কোনোকিছু চোখে পড়েনি ওর। বরং এই কদিন ওর গানের কথা শুনে বন্ধুদের সাথে হাসি মজা আর ব্যঙ্গের চোখেই দেখেছে ওকে আর ওর গানকে ।ওদের বয়সী মেয়েদের কাছে রঙিন পৃথিবীটাই বাস্তব সত্যি---- এই সমস্ত অপ্রকৃতিস্থ মানুষগুলোর ভেতরেও যে অন্য একটা পৃথিবী আছে সেটা ওরা বোঝেই না; আসলে আঠারোর যৌবন যে তলিয়ে দেখতে জানে না। তবে আজ বাবা মায়ের কথা শুনে বেশ কৌতুহল হচ্ছিল অদ্রিজার। পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কয়েকজন বন্ধুর সাথে স্টেশন লাগোয়া বাজারটায় যখন ওরা পৌঁছল পাগলীটা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে নিজের কথা বসিয়ে আপনহারা হয়ে গান গাইছিল; ওর চোখেমুখের উজ্জ্বলতায় মিশে ছিল অনাবিল আনন্দ। অদ্রিজার বন্ধুরা বলল "পাগল বোধহয় একেই বলে---কি সুরে কি গান! এই দেখতে তুই এলি! তুইও ওর পাশে জায়গা করবি মনে হচ্ছে।" বন্ধুরা হাসিতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়লেও অদ্রিজার বেশ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল। হতে পারে জড়ানো উচ্চারণ আর অর্থহীন কথায় উনি অপ্রকৃতিস্থ কিন্তু ওনার সুরের জ্ঞান---সেখানে তো স্বয়ং মা সরস্বতী বিরাজ করছেন; বন্ধুদের কথায় রেগে উঠে দৃঢ় স্বরে বলল "কোনো মানুষকে এভাবে বলতে আছে? তোরা ওনার কথাগুলোই শুনলি----ভেতর থেকে আসা সুরটা শুনলি না! বাবা ঠিকই বলেছিল, বড় বড় শিল্পীরা হার মানবে ওনার সুরের কাছে।" অদ্রিজার দৃঢ় প্রতিবাদে ওরা একটু চুপ করলেও পর মুহুর্তেই ওকে ব্যঙ্গ করে বলল "তুই থাক তোর সুর নিয়ে; চল্ রে ও এখন বড় বোঝদার হয়ে গেছে----আমাদের সাথে ওর এখন মিশ খাবে না।চল্ চল্।" সবাই চলে গেলেও অদ্রিজার পা দুটো একচুলও সরল না ওখান থেকে। মোহিত হয়ে ওনার সুরে বিভোর হতে হতেই দেখল একটা সরু কাঠির মধ্যে পাশে পড়ে থাকা পলাশ আর শিমূল ফুলগুলো একটার পর একটা গেঁথে পাগলীটা সেটা মাথায় পড়ার চেষ্টা করলেও বারবার সেটা পড়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ঠোঁট ফুলিয়ে গাঁথা মালাটা একবার দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল আপনমনে; একটু আগের মনখারাপী চোখের চাউনি আর নেই ওই নির্লিপ্ত চোখদুটোয়। অদ্রিজার বড় অবাক লাগছে, এত মানুষের আসা যাওয়া কোন কিছুই লক্ষ্য করেনা ও ---ওর দৃষ্টি শুধুই আকাশে। আরও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ বাড়ি ফিরে আসে ও।
পরদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক অদম্য আকর্ষণে স্টেশন অঞ্চলে গিয়ে দেখল সেই একই ভাবে বসে রয়েছে পাগলীটা; আজ অবশ্য গান গাইছে না---অপলকে তাকিয়ে আছে আকাশের গায়ে। প্রথমদিন ওকে দেখে বেশ নাক সিঁটকেছিল অদ্রিজা , কিন্তু আজ আর সেসব কিছুই মনে হচ্ছে না ওর। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা পলাশের মালা ওর সামনে ধরতেই অদ্রিজার মুখের দিকে তাকিয়ে গুনগুনিয়ে "ও পলাশ ও শিমূল---" সুরে নিজের কথায় গান শুরু করে মালাটা নিয়ে মাথায় পরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আনন্দে। অদ্রিজা কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইল ওর পাশটিতে। অদ্রিজা প্রায় প্রতিদিনই পাগলীটার কাছে আসে; ওর বাবা মাও বাধা দেয়না--- আসলে বাধা দেওয়ার কথা ভাবেইনি কখনও।
অদ্রিজা আর ওর বন্ধুরা এখন বড় হয়ে যাওয়ায় পাড়ায় সকলের সাথে দোলের রঙ মাখতে বের হয় না। ওরা এখন সব মেয়েরা মিলে দোলের সন্ধ্যেয় একটা কালচারাল প্রোগ্রাম করে থাকে। গত দু তিন বছর ধরেই এটা করে আসছে ওরা----এখন অবশ্য আড়ে বহরে বেশ বেড়েছে ওদের এই অনুষ্ঠান। এই অঞ্চলের মানুষজন শুধু উপভোগই করেন না বিভিন্ন ভাবে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহের জোগানও দেন।এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি----সকাল থেকেই অদ্রিজা আর ওর বন্ধুরা বেশ ব্যস্ত। কোনো অনুষ্ঠানে পারফর্ম করা আর অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা দুটো জায়গা। ব্যাক স্টেজে থাকার সাথে সাথে অদ্রিজা অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বটাও নিজের কাঁধে নিয়েছে। নাচ,গান, কবিতা,নৃত্যনাট্যের পাশাপাশি এবার ওরা একটা নতুন ভিন্ন ধারার অনুষ্ঠান রেখেছে----র্যাম্প ওয়াক। এটা একেবারেই হঠাৎ করে এনলিস্টেড কোনো অনুষ্ঠান নয়----আগে থেকেই ওদের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে র্যাম্প ওয়াকের কথা। দশ থেকে ষাট সকলেই ভীষণ উত্তেজিত; টিভি ম্যাগাজিনে দেখেছে নায়ক নায়িকাদের র্যাম্পে হাঁটতে----সেখানে নিজের বাড়ির মেয়েটা সেজেগুজে হাঁটবে এটা ভেবেই সকলে শিহরিত হচ্ছিল। তবে শুধুমাত্র কুড়ির মেয়েরাই নয় তিরিশ চল্লিশের ফ্যাশনেবল্ বৌদি কাকীমারাও নাম লিখিয়েছে এই র্যাম্প ওয়াকের পাতায়। অন্যান্য বছর একটু রাত গড়াতেই অনুষ্ঠান শেষের জন্য সকলে উসখুস করলেও আজ কিন্তু সবটাই আলাদা; সকলে ধৈর্য্য ধরে অধীরে অপেক্ষায় আছে শেষের জন্য। প্রোগ্রাম বেশ জমে উঠেছে নাচে,গানে,কবিতায়,হাসিতে। রঙবেরঙের ফুল পাপড়ির মতোই উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েরা। অদ্রিজাও সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে চক্কর দিচ্ছে। একেবারে শেষ পর্যায়ে র্যাম্প ওয়াক শুরু হতেই উৎসাহ উদ্দীপনায় সকলেই এই মুহুর্ত টাকে ফোন বন্দী করে রাখতে দেরী করল না। ঘরের মেয়ে বৌরাও সাজলে যে কোন নায়িকার থেকে কোনো অংশেই কম নয় সেটার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে বেশ খুশিই হচ্ছিল উল্টোদিকে বসে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। আসলে কথাতেই তো আছে "সাজালে গোছালেই বর আর নিকোলে মুছলেই ঘর।" পাড়ার মেয়ে বৌরাও রোজের ডাল ভাত চচ্চড়ির সাজ থেকে বেরিয়ে খোলা মনে একটু নিশ্বাস নিতে পারছে। তবে এরপরেও যে চমক আছে সেটা কেউ ভাবেইনি; সবশেষে শো'স টপার হিসেবে যে এল তাকে দেখে সবাই চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। সেটা আর কেউই না----স্টেশন লাগোয়া বাজারের ওই পাগলীটা। কি অবলীলায় গুনগুনিয়ে "চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে" গানটা গাইতে গাইতে পারফেক্ট মডেলদের মতোই শাড়ির আঁচল দুলিয়ে পুরো স্টেজে হেঁটে ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল। কে বলবে এই মানুষটা অপ্রকৃতিস্থ! উল্টো দিকের মানুষগুলোর বসে থাকার ক্ষমতাই হল না। উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগল ওর সাজ আর সেই সাজে সজ্জিতা ওকে----পরনে সাদা তসর, গলায় সাদা পুঁতির ললন্তিকা , কানে সাদা দুল কপালে লাল টিপ হাতে জড়ানো পুঁতির ব্রেসলেট আর ঘাড়ের কাছের হাতখোঁপায় সাদা জুঁইয়ের পাশে লাল গোলাপে আজ ও অনন্যা। চারিদিকের ফোন ক্যামেরায় বন্দী হচ্ছিল শুধুই এই নামহীনা।সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই ছবি ভাইরাল হতে সময় নেয়নি একটা রাতও। পরদিন একটু বেলা বাড়তেই একটা বড় গাড়ির সাথে একটা ছোট পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল বাজারের কাছে। সকলে উদগ্রীব হয়ে সামনে এগিয়ে আসতেই গাড়ির দরজা খুলে কয়েকজন সাংবাদিক নেমে এলেন; উদ্দেশ্য, ওর ছবি তুলে একটা স্টোরি কভার করা। এতে নাকি ওর পরিচিতরা ওকে খুঁজে পাবে আর ওদের এই অনুষ্ঠানটা প্রচার পাবে। চাই কি পরের বছর নামী কোনো চ্যানেলে ডাক ও পেতে পারে। বাজারের মানুষগুলো নিজেদের কথা না ভাবলেও ওর কথা ভেবে রাজী হবে ভাবলেও একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলই। তবে শেষ অব্দি ওদের পীড়াপীড়িতে রাজী হতেই রিপোর্টার মেয়েটি সাথের ক্যামেরার ছেলেটিকে ছবি তোলার কথা বলে হাতে মাইক্রোফোন টা নিয়ে দাঁড়াতেই সকলের চেনা শান্ত পাগলীটা ভয়ংকর রকমের হিংস্র হয়ে উঠে ক্যামেরার দিকে বড় বড় ইঁট ছুড়তে লাগল। তারপরেই দৌড়ে এসে মেয়েটার গলাটা দুহাতে চেপে ধরল শরীরের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে। দুজন পুলিশ দৌড়ে না এলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মেয়েটা হয়ত মারাই যেত। ওর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়েটা আর ক্যামেরার ছেলেটি সব ফেলে গাড়িতে উঠেই স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল প্রাণ বাঁচাতে। বাজারের মানুষগুলো এতদিনের চেনা পাগলীটার এই অচেনা রূপে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ গানের আওয়াজ ভেসে আসতেই ঘুরে তাকিয়ে সকলে দেখল আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে সুর ভাঁজছে ও। পাগলের কাণ্ড ভেবে কেউ আর মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের কাজে ফিরে গেল। সারাদিনের শেষে বাজার বন্ধের সময় পাগলীটাকে দেখতে গিয়ে টগর দেখল, ওর জায়গাটা ফাঁকা। একটু অবাকই হল ও----ওকে ঠাকুরমশাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে না দিলে ও তো বোঝেই না কোথায় কখন যেতে হবে! সকলকে চিৎকার করে বলতেই খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল চতুর্দিকে। সারারাত তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না পাগলীটার। রোদেলা বেলায় এসে সবার মনে ফাগুনের দখিনা বাতাস বইয়ে ঋতুশেষের শেষ বেলায় মিলিয়ে গেল দিকশূন্য পুরে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন