নতুন তৈরী হওয়া হাই রোডের ধারে সাত কাঠা জমির উপর বাগানে ঘেরা পুরানো দোতলা বাড়িটা সকলের চোখে পড়ে। বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে নারকেল, সুপুরি গাছের দল। কয়েকটা আম, কাঁঠাল গাছও আছে। সবুজে ঘেরা বাগানের মধ্যে, হালকা সবুজ রংয়ের বাড়িটা বেশ দৃষ্টিনন্দন। বাগান বাড়িটার পনেরো ফুট দুর দিয়ে চলে গেছে হাই রোড। হাই রোডটা অবশ্য বেশিদিন হয় নি। বছর চারেক হলো হয়েছে। তার আগে ঐ জায়গায় একটা পিচের রাস্তা ছিল। যদিও তখনও রাস্তার দুদিকে কিছু বাড়ি, দোকান, বাজার থাকলেও বেশ কিছু ফাঁকা জমি পড়েছিল। রাস্তার ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল বট, অশ্বত্থ, কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়ার দল। বলতে গেলে সবুজে সবুজে ভরেছিল রাস্তার দুই ধার। এক সময়ে এলাকাটা বেশ নির্জন ছিল। আগে ঐ পিচের রাস্তাটা দিয়ে সামান্য কিছু গাড়ি যাতায়াত করলেও, হাই রোডটা হওয়ার পর উত্তর বঙ্গ থেকে দক্ষিণ বঙ্গে যাতায়াতের সময় অনেক কমে যাওয়ায় যান চলাচল কয়েক গুন বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে কিছু কল কারখানা, বেসরকারি স্কুল, কলেজ গজিয়ে ওঠায় বহিরাগত মানুষজনদের আনাগোনাও বেড়েছে। বেড়েছে বাসস্থানের চাহিদা। ফলে এক সময়ের সরু খানাখন্দে ভরা রাস্তাটার গুরুত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনই রাস্তার আশেপাশের জমির দাম এবং গুরুত্ব চড়চড়িয়ে বেড়েছে। ফাঁকা জমি প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসন। কোথাও আবার কাজ শুরু হয়েছে, পিলার উঠছে, ইটের গাঁথুনী চলছে। অনেক ফ্ল্যাটে বাসিন্দারা চলে এসেছে।
বাসস্থানের চাহিদা ক্রমশ উর্দ্ধমুখী হওয়ার ফলে প্রোমোটাররা আরও জমি খুঁজতে ক্রমশ রাস্তার ধার ছেড়ে ভেতর দিকে ঢুকছে। কিন্তু রাস্তার ধারের সাত কাঠা জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাকে দখল করতে পারছে না। বাড়ির মালিক বিজন রায় কোনো প্রোমোটারকে পাত্তা দেন না।
বিজন বাবু অকৃতদার মানুষ। বদলীর চাকরির জন্য প্রায় সারাজীবন অমৃতসর, পুনে, ফরিদাবাদে কাটিয়েছেন। অবসর গ্রহণের পর নিজ গৃহে ফিরে এসেছেন। বাড়িতে একাই থাকেন। বাবা মা কয়েক বছর আগে পরলোক গমন করেছেন। বিজন বাবু বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ভাই বোন কেউ নেই। কিছু আত্মীয় স্বজন আছে, তবে তারা বেশ দুরে থাকে। সচরাচর দেখা সাক্ষাত হয় না।
রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বিজন বাবু প্রাত ভ্রমণে যান। তারপর চা খেয়ে বাজারে যান। ঘুরে ঘুরে বাজার করেন। একজন রান্নার লোক আছে, রোজ সকালে রান্না করে দিয়ে যায়। আর একজন কাজের লোক আছে, ফাই ফরমায়েস খাটার জন্য। সে সকালে আসে, বিকালে ফিরে যায়।
বিরাট বড় বাগানটাতে নারকেল, সুপুরি, আম, কাঁঠাল গাছের সাথে প্রচুর ফুল গাছও আছে। বিজন বাবু ফুল গাছ খুব পছন্দ করেন। সারাদিন ফুল গাছ পরিচর্যা করেই তার দিন কেটে যায়। ফুল গাছ পরিচর্যা করাই সম্ভবত বিজন বাবুর একমাত্র নেশা। খুব ভালোবাসেন ফুল গাছগুলোকে। যখন ফুল ফোটে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। নিজের হাতে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে জমি তৈরি করেন। তারপর জল সার দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যবধানে চারাগুলোকে রোপন করেন। প্রত্যেক দিন পরিচর্যা করেন। গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, দোপাটিরাই বিজন বাবুর বন্ধু।
নিয়মিত ভোর পাঁচটায় প্রাত ভ্রমণে বের হন বিজন বাবু। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। কিছু কথাবার্তা হয়।
- "সুপ্রভাত বিজন বাবু।" ঘুরে তাকালেন বিজন বাবু। দেখলেন এক অপরিচিত ব্যক্তি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে সেই ব্যক্তি বলতে থাকেন, "আমার নাম অসীম ধাড়া। আমিও ডাক্তারের পরামর্শে মর্নিংওয়াক শুরু করেছি। ইদানিং আমার সুগার ধরা পড়েছে। সেইজন্য ভোর হতে না হতেই ঘর ছেড়ে বের হতে হচ্ছে। জ্বালা, বুঝলেন জ্বালা! মানুষের যে কত রকম জ্বালা, বলে শেষ করা যাবে না। এমনিতে আমি মোটেই আর্লি রাইজার নই। সাড়ে আটটা নটার আগে বিছানা ছাড়তাম না। কি করবো বলুন, সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনী। প্রোমোটারের কাজে ঝক্কিতো কম নয়। ঐ যে সকাল এগারোটায় বের হই, তারপর সারাদিন সাইটে সাইটে ঘুরে বেড়াতে হয়। সন্ধ্যা হলে অফিসে বসে খাতাপত্র দেখতে হয়। সে যে কত রকমের ঝামেলা, আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না...।" একটানা কথা বলে চলেছেন অসীম ধাড়া। বিজন বাবু মাঝে মাঝে 'হ্যাঁ', 'হূঁ' করছেন।
প্রত্যেক দিন ভোরে বিজন বাবুর সঙ্গে অসীম ধাড়ার দেখা হয়। গল্প গুজব হয়। কোনোদিন বিজন বাবুর প্রবাসী জীবনের বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হয়। কখনো বিজন বাবুর ফুলের বাগান নিয়ে কথা হয়। তবে বেশির ভাগ কথা হয় অসীম ধাড়ার ব্যবসার বিভিন্ন রকম সমস্যা নিয়ে। কারণ সিংহভাগ কথা অসীম ধাড়া বলেন। অসীম ধাড়া বারে বারে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে প্রোমোটিং ব্যবসাতে প্রোমোটারের সামান্য লাভ থাকে। কিন্তু ল্যান্ডলর্ডের প্রভুত লাভ হয়।
কয়েক দিন হলো অসীম ধাড়াকে প্রাত ভ্রমণে দেখা যাচ্ছে না। বিজন বাবু অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবিত নন। অসীম ধাড়াকে তিনি যে খুব একটা পছন্দ করেন তাও নয়। আসলে অসীম ধাড়ার একঘেয়ে বকবকানি তার অসহ্য লাগে।
কিছুদিন পরেই অসীম ধাড়ার সঙ্গে বিজন বাবুর দেখা হয়। তবে প্রাত ভ্রমনের সময়ে নয়। একদিন সকাল দশটার সময়ে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল বিজন বাবুর বাড়ির গেটের সামনে। হৈ হৈ করে গাড়ি থেকে নামলেন অসীম ধাড়া, সঙ্গে আরও একজন। হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এলেন বিজন বাবু। আপ্যায়ণ করে অসীম ধাড়াদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বিজন বাবুর সঙ্গে অসীম ধাড়া পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সঙ্গে আসা ভদ্রলোকের।
- "বিজন বাবু, ইনি হচ্ছেন রত্নাকর পুততুন্ড। ইনি আমার ব্যবসার পার্টনার। মানে ফিনান্সিয়াল পার্টনার। আমরা দুজনে একসঙ্গে ব্যবসা করি। সিংহভাগ ক্যাপিটাল রত্নার। আমিও কিছু টাকা ইনভেস্ট করেছি। তবে আমার মেন ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে আমার মেরিট আর আমার কনভিনসিং পাওয়ার। আমি ল্যান্ডলর্ডদের বোঝাই। তাদের কনভিন্স করি। তবেইতো তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করে আবাসন গড়ার। বিনিময়ে তারা লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে। জমিও রইলো, আবার ব্যাঙ্কে মোটা টাকা ঢুকে গেল। ল্যান্ডলর্ডের লাভ হলো কিনা বলুন? কত ফকিরকে আমরা আমীর বানিয়েছি...।"
- "তবে অসীমের একটাই সমস্যা।" অসীম ধাড়ার কথার মাঝেই বলে ওঠেন রত্নাকর পুততুন্ড, "অসীমের গাড়ীর ব্রেকটা ঢিলে। একবার চলতে শুরু করলে আর থামে না। মানে একবার কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না। আমার অবশ্য অত দম নেই। আমি কম কথার মানুষ।" কথা বলতে বলতে রত্নাকর তার ডান হাতের মধ্যমায় পরা হীরের আংটিটা অন্য হাত দিয়ে ঘোরাতে থাকেন। যদিও তার ডান হাতের অন্য তিন আঙুলেও দামি পাথরের আংটি রয়েছে। তবে মধ্যমার আংটিটা সব থেকে বড় এবং দামি। রত্নাকর পুততুন্ড আবার বলতে থাকেন, "বিজন বাবু আমি আপনার বেশি সময় নষ্ট করবো না। আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আপনি একা মানুষ এতবড় দোতলা বাড়িতে থাকেন। ফলে বাড়িটার অধিকাংশ জায়গা অব্যবহৃতভাবে পড়ে থাকে। মেনটেনেন্স এর অভাবে অনেক জায়গা ভেঙেচুরে গেছে। প্লাস্টার চটে গেছে। ক্রমশ বাড়িটা পোড়ো বাড়ির রূপ নিচ্ছে। তাই বলছি আসুন আমরা হাত মিলিয়ে প্রোমোটিং করি। আপনার জমি আপনারই থাকবে। একটা বড় ফ্ল্যাট আপনি পাবেন। সেইসঙ্গে হিসেব নিকেশ করে কয়েক লক্ষ টাক পাবেন। পুরানো বাড়ির মেরামতির ঝামেলা থেকেও মুক্তি পাবেন।"
- "আর আমার বাগানটা?"
- "বাড়ি বাগান, মানে পুরো জমিটা নিয়েই প্রোমোটিং হবে।"
- "কিন্তু ফুলের বাগানটা যে আমি ছাড়তে পারবো না। বাগানটাকে আমি যে খুব ভালোবাসি। বাগানটা যে আমার. প্রাণ।"
- "আরে ছাড়ুনতো ঐসব বাগান টাগান। কুড়ি টাকার ফুল কিনলে সারাদিনের পুজো হয়ে যাবে। এইজন্য এতোটা জমি ফেলে রাখার কোনও মানে হয় না।"
- "এই মানেটা আপনি বুঝবেন না রত্নাকর বাবু। একটা চারা গাছকে বড় করার পর সেই গাছে যখন কুঁড়ি আসে, সেই কুড়ি যখন ফুল হয়ে ফোটে, পরিনতি পায়, পূর্ণতা পায়, সেই পূর্ণতা চাক্ষুষ করার আনন্দ বলে বোঝানো যায় না। এটা অনুভুতির ব্যাপার, উপলব্ধির ব্যাপার।"
- "ফুলের ব্যবসা খারাপ নয়। বেশ প্রফিটেবল। তবে ফুল, কুঁড়ি, উপলব্ধি, অনুভুতি এত কিছু আমি বুঝি না। আমি হচ্ছি ব্যবসা করে খাওয়া বাস্তববোধ সম্পন্ন মানুষ। আপনিতো আর ফুলের ব্যবসা করেন না। শখের ফুল চাষ করেন। ওসব টবেও করা যায়। সে সবের জন্য আপনাকে আলাদা ব্যবস্থা করে দেব। প্রথম দিন আপনার বাড়ি এলাম। চা খেলাম। এবার আপনি মাইন্ড সেট করুন। আজ চলি। পরে আবার কথা হবে।"
কথা শেষ করে বেরিয়ে যান রত্নাকর পুততুন্ড। পেছন পেছন অসীম ধাড়া। বিজন বাবু একান্তে ভাবতে থাকেন কি করবেন? রত্নাকরের সঙ্গে হাত মেলাবেন, নাকি যেমন আছেন তেমন থাকবেন? ভাবতে ভাবতে জানালার ধারে এলেন। দেখলেন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাঁদা ফুল গাছের দল। হলুদ রঙে ভরে গেছে বাগানটা, অপূর সুন্দর লাগছে। দেখে চোখ ফেরাতে পারছেন না বিজন বাবু। রত্নাকরের সঙ্গে হাত মেলালে বাগানের এই শোভা, হলুদের হাতছানি, সবুজের সমারোহ আর দেখতে পাবেন না। হয়তো এই বাগানটাই থাকবে না। হয়তো কেন নিশ্চিত ভাবেই থাকবে না। তখন ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে মনোমুগ্ধকর সবুজের সমারোহের বদলে কংক্রীটের জঙ্গল দেখতে হবে। সেটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে বিজন বাবুর কাছে। মনস্থির করে ফেলেন বিজন বাবু। বাড়ি ছাড়বেন না। কিছুতেই না। এই বাগানকে ধ্বংস হতে দেবেন না।
আবার প্রাতভ্রমনে বের হওয়া শুরু হয়েছে অসীম ধাড়ার। নিয়মিত দেখা হয় বিজন বাবুর সঙ্গে। অসীম ধাড়া জানতে চান বিজন বাবু কি ভাবলেন তার বাড়ি প্রসঙ্গে। বিজন বাবু পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দেন তার আপত্তির কথা। নাছোড়বান্দা অসীম ধাড়া বারে বারে একই প্রসঙ্গ তোলেন। বিজন বাবুও একই উত্তর দেন। ক্লান্তিহীন ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান অসীম ধাড়া। বারে বারে ব্যর্থ হন। কিন্তু অত ধৈর্য নেই রত্নাকরের। রত্নাকর আর অপেক্ষা করতে রাজি নন। রত্নাকর কিছুটা বিরক্ত হয়ে একদিন অসীম ধাড়াকে বলেন, "কি হলো অসীম, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?"
- "চেষ্টাতো চালিয়ে যাচ্ছি। রোজ ভোরে উঠে দৌড়দৌড়ি করছি। কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বুড়ো মহা ঢ্যাঁটা। বলছে ফুল বাগান নষ্ট হতে দেবে না।"
- "ভেতরে ভেতরে অন্য কোনো প্রোমোটার লাইন করছে নাতো?"
- "মনে হয় না। বুড়োর কাজের লোকটাকে টাকা দিয়ে ফিট করেছি। সে সব খবর দেয়। সকালের দিকে ঐ বাড়িতে সে কাউকে আসতে দেখেনি।"
- "কিন্তু আর কতদিন এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে?" অধৈর্য হয়ে পড়েন রত্নাকর।
-"ঐ ঢ্যাঁটা বুড়ো দেবে বলে মনে হয় না। ঐ জমির আশা ছাড়তে হবে।"
- "আশা ছাড়তে হবে মানে? ঐ জমি আমি নিয়েই ছাড়বো। অসীম তুমি ঐ জমির একটা দলিল তৈরী করো। লোক ধরে রেজিস্ট্রি করিয়ে নাও। ছাব্বিশে জানুয়ারি ভিত পুজো করবো। তাড়াতাড়ি করো, হাতে বেশি সময় নেই।"
- "কিন্তু আঙুলের ছাপ দরকার। ওসব জাল করলে পরে সমস্যা হবে।"
- "আরে ছাড়োতো আঙুলের ছাপ! বুড়ো বেঁচে থাকলে তবেতো কেউ আঙুলের ছাপ মেলাবে।"
- "বেঁচে থাকলে মানে?"
- "ঘটে বুদ্ধি থাকলে মানেটা বুঝে নাও।"
- "তার মানে খুণ!"
- "এতে অবাক হওয়ার কি আছে? এর আগে কি কেউ খুণ হয় নি?
- "তাই বলে একটা জমির জন্য একটা মানুষকে...!"
- "তোমাকে অত ভাবতে হবে না। যা বলেছি সেই কাজটা মন দিয়ে করো।"
অসীম ধাড়া রত্নাকরের অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রত্নাকর ফোন করেন জনৈক চুড়োকে। সবকিছু বুঝিয়ে বলেন। এমনকি লেনদেনের ব্যাপারটাও ঠিক করে নেন। বলেন পনেরো দিনের মধ্যে কাজটা করতে।
মধ্যরাত। বাগান বাড়ির মুল দরজা বন্ধ। এদিকে ওদিকে দেখতে দেখতে উঁচু পাঁচিল টপকে বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ে চুড়ো। বাড়ির সামনে পৌছে টোকা দেয় দরজায়। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার টোকা দেয় সে।
ভেতর থেকে ঘুম জড়ানো গলায় বিজন বাবু জানতে চান, "কে?"
- "আমি চুড়ো, আপনার প্রতিবেশী। দরজা খুলুন, খুব দরকার।" কথা শেষ করেই চুড়ো পকেট থেকে হাতে তুলে নেয় আট ইঞ্চির ধারালো ছুরিটা।
দরজা খোলার সাথে সাথে নিপুণ হাতে চুড়ো ছুরি চালাতে থাকে। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বিজন বাবু। সকালে কাজের লোক এসে খোলা দরজার সামনে বিজন বাবুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়। তারপর থানা পুলিশ, পোষ্ট মর্টেম, আত্মীয়দের খবর দেওয়া। দুর দুরান্তরে, প্রবাসে থাকা আত্মীয়রা কেউ বিজন বাবুর মৃত্যু নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। ফলে স্থানীয় থানার তত্ত্বাবধানে রত্নাকর পুততুন্ড, অসীম ধাড়া এবং প্রতিবেশীরা সজল নয়ন শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।
দুই
নিজের চেয়ারে বসে আছেন থানার ডিউটি অফিসার। দরজা ঠেলে ঢুকে আসা এক আগন্তুককে দেখে প্রায় ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন।
- "নমস্কার আমি সুজন রায়। বিজনের যমজ ভাই। দিল্লীতে থাকি। তাই আসতে একটু দেরি হলো।"
- "বসুন। বিজন বাবুর যমজ ভাই আছে, জানতাম নাতো! আপনাদের দুভাইয়ের চেহারায় এতো মিল যে আমার মনে হলো ভুত দেখছি।"
- "হা হা হা। ভুতইতো দেখছেন। একেবারে সত্যি কথা। যখন অবসর নেবেন নাতি নাতনিদের কাছে গল্প করতে পারবেন যে কর্মজীবনে এক সফিসটিকেট ভুতের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল। আমি হচ্ছি সেই সফিসটিকেট ভুত। জেনারেল ভুতেদের সঙ্গে আমার অনেক অমিল। জেনারেল ভুতেদের মাথায় তেল, শ্যাম্পু না দেওয়া উসখো খুসখো জট পড়া চুল থাকে। সাবান মাখে না তাই ওদের শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। দাঁত মাজে না সেইজন্য মুখ থেকেও দুর্গন্ধ বের হয়। অন্যদিকে আমার মাথায় দেখুন তেল চুপচুপে তেড়িকাটা চুল। গায়ে শুধু সাবান মাখি না, সুগন্ধি পাওডারও মাখি। আর দাঁত? দেখুন কি সুন্দর কলগেট মার্কা হাসি আমার।"
সুজন বাবুর কথা শুনে ডিউটি অফিসার নিজের গাম্ভীর্য ভুলে হা হা করে হেসে ওঠেন। বলেন, "সুজন বাবু আপনি পারেনও বটে। আপনার সেন্স হিউমারকে তারিফ করতে হয়।"
- "যেকথা জানতে এসেছি, বিজনের খুণটা নিয়ে কতদুর এগোলেন। কোনো ক্লু পাওয়া গেল?"
- "না এখনো কিছু পাওয়া যায়নি।"
- "ঠিক আছে চেষ্টা চালিয়ে যান। যতদিন না খুণী ধরা পড়ে আমি এখানেই থাকবো। নিয়মিত খবর নেবো।"
মহাসমস্যায় পড়েছেন রত্নাকর। কোথা থেকে সুজন নামে একটা লোক উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। বিজন বাবুর বাগান বাড়িটা দখল করে রেখেছে। কোনো কথাই শুনছে না। বিজন বাবু যে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন সে কথা মানতে চাইছে না লোকটা। বাগান বাড়ির নতুন দলিলটাও রত্নাকর খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনকি দলিলটা কোথায় রেখেছেন কিছুতেই মনে করতে পারছেন না! সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! এখন কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। রত্নাকর ভেবেছিলেন ছাব্বিশে জানুয়ারি ভিত পুজো করবেন। সেতো হলো না, এদিকে মার্চ মাস শেষ হতে চলেছে, পয়লা বৈশাখেও ভিত পুজো করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কি করতে হয় সেটা রত্নাকর ভালোভাবেই জানেন। চোয়াল শক্ত হয় রত্নাকরের। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, নববর্ষে ভিত পুজো করবেনই।
আবার ডাক পড়ে চুড়োর। মধ্যরাতে আবার অভিযানে বের হয় সে। আগের বারের মত পাঁচিল টপকে সে ঢুকে পড়ে বাগান বাড়িতে। পৌছে যায় বাড়ির দরজার কাছে।
- "দরজা খোলা আছে। ভেতরে এসো চুড়ো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।"
চমকে ওঠে চুড়ো। ভয়ে দুতিন পা পিছিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকে।
- "চুড়ো, তোমার জন্য একটা কাজ আছে।"
- "কি কাজ?"
- "আমাকে পরে মারবে। তার আগে আমার কাজটা করো। রত্নাকর তোমাকে যত টাকা দিয়েছে তার ডবল দিচ্ছি। টাকাটা ঐ টেবিলে আছে। টাকাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি কাজটা করে এসো।"
কাজটা কি বুঝিয়ে বলেন সুজন বাবু। সব শুনে কিছুটা ইতস্তত করতে থাকে চুড়ো।
কথা বলতে বলতে সুজন বাবু ধাক্কা দেন চুড়োকে। প্রায় দশ ফুট দুরে ছিটকে পড়ে সে। দৌড়ে পালাতে থাকে চুড়ো। সুজন বাবু চিৎকার করে বলেন, "কাজটা না করলে এর থেকে দশগুন জোরে ধাক্কা দেবো। পৃথিবীর বাইরে গিয়ে পড়বে।"
চুড়ো ছুটে চলে রত্নাকরের বাড়ির দিকে। ভাবে লোকটার থেকে যখন টাকা নিয়েছে, কাজটা সে করবে। এই ব্যাপারে সে একশো শতাংশ সৎ।
অনেক রাত হলেও বাড়ির লাগোয়া অফিস ঘরেই রয়েছেন রত্নাকর। অপেক্ষা করছেন চুড়োর জন্য। কিন্তু চুড়ো এখনো ফোন করছে না! কাজটাতো এতক্ষণে হয়ে যাওয়ার কথা! ভাবতে ভাবতেই চুড়ো এসে হাজির। চুড়োকে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন রত্নাকর। হাসতে হাসতে বললেন, "কি খবর চুড়ো, অপারেশন সাকসেস ফুল?"
কথার জবাব না দিয়ে, পকেট থেকে ছুরিটা বের করে রত্নাকরের উপর এলোপাথাড়ি কোপ বসাতে থাকে চুড়ো। কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়ে সে। এবার তার গন্তব্য বাগান বাড়ি। রত্নাকর জীবিত হোক বা মৃত, তার থেকে টাকা যখন নিয়েছে, বেইমানি করবে না।
খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে চুড়ো। সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন সুজন বাবু। কোপের পর কোপ, কোপের পর কোপ। মোট কতগুলো কোপ মারলো চুড়ো নিজেও বলতে পারবে না।
সকাল হতেই হৈ চৈ শুরু। রত্নাকর পুততুন্ড নিজের বাড়িতেই খুণ হয়েছেন! বিরাট বড় পুলিশ বাহিনী এলাকাটা ঘিরে রেখেছে। লাল বাজার থেকে গোয়েন্দারা এসে গেছেন। আনা হয়েছে কয়েকটা কুকুরকে। আততায়ীকে ধরতে কুকুরগুলো ছুটে চলেছে বাগান বাড়ির দিকে। বাগান বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল দরজার সামনে ছুরিকাহত হয়ে পড়ে আছে চুড়োর মৃতদেহ। হাতে ধরা আছে ছুরিটা। গোটা বাড়ি খুঁজে কোথাও সুজন বাবুকে পাওয়া গেল না! পুলিশ বুঝতে পারছে না চুড়ো কেন আত্মহত্যা করলো? সুজন বাবুই বা কোথায় গেলেন? রহস্যটা থেকেই গেল!
নববর্ষের ভোর। আর কিছুক্ষণ পরেই সুর্যোদয় হবে। নববর্ষের প্রথম সুর্যকিরণের স্পর্শে আবার মাথা দোলাতে থাকবে গাঁদা, গোলাপের দল। হয়তো কেউ দেখবে না। হয়তো কেউ দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠবে না। হয়তো দেখবে। দুর আকাশের ঈশান কোন থেকে হয়তো দুটো চোখ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে গাঁদা, গোলাপের দিকে!
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার , M.G.ROAD
BUDGE BUDGE
KOLKATA - 700137
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন