ভালোবাসার বাড়ি
বন্দনা সেনগুপ্ত
এই গল্পের সঙ্গে নববর্ষের বিশেষ কোন যোগ নেই। তবে ঘটনাটা ঘটল চৈত্র মাসের একেবারেই শেষের দিকে। আর, তাছাড়া এটা কোন গল্পও না। একটা খুব সুন্দর ঘটনার কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। কারুকে বিব্রত করতে চাই না বলে শুধু নাম ধাম পাল্টে দিয়েছি।
গত পরশু দিন মানে বুধবার ছিল আমার পরিচিত কৃতিশ্রীর জন্মদিন। ফেসবুক তাকে বেশ নামকরা কবি এবং সুলেখিকা বলে জানে। আমার সঙ্গেও ওই পাড়াতেই আলাপ। আমি ওকে বড্ড ভালোবাসি। সে আমাকে ডাকে দিভাই। আর, সেই সম্মানটাও দেয়।
তো আমি ভাবলাম কি মেসেজ না করে ওকে ফোন করি। করলাম। শুভ কামনা জানানো ছাড়াও, যা হয়, মেয়েদের কত্ত কত্ত কথা থাকে। বেশ কিছু ক্ষণ চলল তুমুল আড্ডা।
"ও দি, তুমি গোধূলিদিকে চেনো তো! জানো কি হয়েছে?"
গোধুলিদিকে আমি সামান্য চিনি। কিভাবে জানেন? আমি, কৃতিশ্রী, গোধুলিদি, এবং প্রায় আরও আড়াই তিন হাজার জন একটি ফেসবুক গ্রুপের মেম্বার। গ্রুপটির নাম "ভালোবাসার বাড়ি"। তো কিছুদিন ধরে ওই গ্রুপে ওঁর লেখা পড়ছিলাম। দারুণ মজার মজার লেখা লেখেন উনি। নিজেই বলেন যে শুধু যে যৌবন কালেই দুষ্টু ছিলেন তাই নয়, এখনও মাথার মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি গুজ গুজ করে। আর, সেটা লেখা পড়লেও বোঝা যায়। তাছাড়া উনি আবার আমার দেশের মানুষ। তাই ওঁর লেখা পড়া এবং সেই লেখায় কমেন্ট করতে করতে যেটুকু আলাপ আর কি! ওঁর সম্বন্ধে আর কিছু জানি না।
ওনার লেখা পড়েই জানতাম যে ওঁর একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম ও বিবাহ। অনেক লোকের মধ্যে বড় হয়েছেন। বিয়ের পরও অনেক লোকের মধ্যে থেকেছেন। বুঝতেই পারি কালের নিয়মে অনেকে পৃথিবী ছেড়েছেন, আরও অনেকে বাড়ি ছেড়ে প্রবাসে অথবা বিদেশে চলে গিয়েছেন। খুউব স্বাভাবিক। এবং, ওঁর লেখার মধ্যে কোনও আক্ষেপ দেখি নি। অত্যন্ত পজিটিভ ওঁর সব লেখা।
কিন্তু, সেদিন বনুর কাছে শুনলাম একদম অন্য কথা। ওনার একটিই মাত্র ছেলে। বিয়ে দিয়েছেন। নাতি নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। কিন্তু, আসলে উনি একান্ত একা। উনি থাকেন ওনার নিজের শ্বশুরবাড়িতে। সাবেকি বনেদি বাড়ি। সগুষ্ঠী থাকার মত বিশাল। এখন লোক কমে গিয়েছে। কাজেই রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক। তাছাড়াও, ছোট ফ্ল্যাট বাড়ির যে সুবিধা, তাতো ওই একতলা দোতলা চকমিলানো বাড়ি, ছড়ানো রান্নাঘর আর বাগানে পাওয়া যায় না। তাই বৌমার (ছেলের কি নয়?) ইচ্ছা ছিল এই বাড়ি প্রোমোটারের হাতে দিয়ে দেওয়ার। কোটিখানেক টাকাও তো পাওয়া যাবে! গোধুলীদির স্বামীর একেবারেই মত ছিল না। তাঁর কাছে এই বাড়িই যেন তাঁর জীবন। এখানেই তাঁর মা বিয়ে হয়ে এসেছেন, সন্তানাদি হয়েছে, বাবা মা এখান থেকেই স্বর্গে গেছেন। এটাই তাঁর স্বর্গ। তিনি অন্য স্বর্গ জানেনও না, সেখানে যেতেও চান না। এখন তিনি নেই। গোধূলিদি সেই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে আছেন। ছেলে তার নিজের সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। মায়ের খবর রাখার তার সময় নেই।
যাই হোক, বুনুর জন্মদিনে তিনিও ফোন করেছিলেন। একথা ওকথা বলতে বলতে খাওয়ার কথা উঠতেই তিনি একেবারে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন!
"ভাবতে পারবে না দি ওনার মধ্যে কত্ত অভিমান আর দুঃখ জমে আছে! একটা ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে এলো।"
ওনার কাজের মেয়ে এলেও রান্নার মাসি ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গেছে। উনি নিজেই যা হয় টুকটাক রান্না করে কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু, এত বয়েসে এসে কি টুকটাক রান্না আর খাবার দিয়ে রোজ কাজ চালানো যায়? দুদিন ধরে ওনার প্রেসার নেমে গেছে। একেবারেই উঠতে পারছেন না। কাজের মেয়েকে দিয়ে চা জল হরলিক্সের ব্যবস্থা হলেও আর কিছু খাবার বানাতে পারেন নি। ফলে এত মাথা ঘুরছে যে ওনার পক্ষে ওঠাই মুস্কিল। অথচ, এত অভিমান যে একই শহরে থাকে ছেলে, তাকে খবর দেন নি। দেবেনই বা কেন? যে কোনো দিন কোন উপলক্ষেই তাঁকে মনে করে না, তাকে বিব্রত করার তো কোনও মানে নেই। আর, খবর দিলেও যে সে আসবে, সেই ভরসা তাঁর নেই।
এই পর্যন্ত একটা খুব সাধারণ গল্প হল। এরকম আজকাল অনেক বাড়িতেই দেখা যায়।
কিন্তু, এবারে কাজে নামল "ভালোবাসার বাড়ি"। আমার আদরের বুনু প্রথমে ফোন করল তার এক বান্ধবী, স্মিতাকে। ওকে বলল তুই গোধূলীদির সঙ্গে কথা বলতে থাক। ওনার যেন নিজেকে আর একলা না মনে হয়। গল্পে গল্পে ব্যস্ত করে রাখ্। এক স্মিতা কতক্ষন কত কথা বলবে! তাই আরও চার বান্ধবী আসরে নামল। তারপর বনু ফোন করল এই গ্রুপের মূল উদ্যোক্তাকে, যাঁকে আমরা মজা করে হেডু বলি। কারণ একটাই। এই গোধূলীদি, বনু, স্মিতা, হেড়ু, সবাই আলাদা আলাদা শহরে থাকে। একমাত্র হেডু জানেন কে কোথায় থাকে। গোধুলীদি থাকেন আসানসোলে। খুঁজে পেতে সেখানে দুজনকে পাওয়া গেল। তারপর তাঁদের একজন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তখনই গোধুলীদির বাড়িতে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন রান্না করা খাবার। গিয়ে সেখানে বসে তাঁকে খাইয়ে ওষুধ পত্র দিয়ে তারপর তাঁরা ফিরলেন। বিকেলে আরেক জন গেলেন। তাঁর স্ত্রী রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর, গিয়ে পড়ে কি কি প্রয়োজন সব লিস্ট করে নিজের স্বামীকে দিয়ে আনিয়ে ফ্রিজে গুছিয়ে রেখে গেলেন। হেডু টাকা যোগান দিলেন। দুদিন এরকম করতেই গোধুলীদি এক্কেবারে ফিট। তাঁর আর সাহায্যের দরকার নেই।
সত্যিই ভালোবাসার বাড়ি, নয় কি! গোধুলীদির নতুন বছর অনেক অনেক অজানা অচেনা বন্ধুর শুভ কামনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আপনারাও সবাই ভালো থাকুন। ভালো কাটুক সারা বছর।
===============
বন্দনা সেনগুপ্ত
K G Signature City
Adyalampattu
Chennai 600095
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন