নির্যাতিতাশ্যামল হুদাতী
মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক জীবন সম্বন্ধে জানতে পারি যে মেয়েদের মধ্যে দু চারজন উচ্চশিক্ষিতা হলেও সাধারণ মেয়েরা অল্প শিক্ষিতাই হতো। তাদের বিদ্যা পাঠশালা শিক্ষা পর্যন্ত। এর প্রধান কারণ ছিল মেয়েদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন।
আট বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। এই রূপ বিবাহকে গৌরীদান বলা হতো। অবিবাহিত মেয়েদের দশ বছর বয়স পেরিয়ে গেলেই সেই পরিবারের পরিজনকে এক ঘরে করে রাখত। তাদের ব্রাহ্মণ, ধোপা বন্ধ হয়ে যেত। তখনকার দিনে এক ঘরে হয়ে থাকা বড় রকমের সমাজিক শাস্তি ছিল। সামাজিক কাজে তাদের কেউ নিমন্ত্রণ করত না এবং এটি একটা সামাজিক বয়কট বলা যেতে পারে।
পণ সংক্রান্ত ব্যাপারে তখনকার দিনের প্রথা ছিল ঠিক বিপরীত। বরের বাবাকেই পণ দিতে হতো মেয়ের বাবাকে। এখনো পর্যন্ত এই প্রথা সমাজের নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে। বিবাহের আচার ব্যবহার ও রীতিনীতি ঠিক এখনকার মতই ছিল - সেরকম কোন পরিবর্তন হয়নি।
তখনকার দিনে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল সমাজে। এর ফলে বাল্য বিধবা সংখ্যাও খুব বেশি ছিল। বাল্য বিধবাদের বেশভূষা খাদ্য ইত্যাদি কঠোর বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, সেই যে কোন বয়সেই সেই বিধবা হোক না কেন। প্রথমেই তাকে শুদ্ধাচারিণী হয়ে থান কাপড় পড়তে হতো এবং অলংকার পরিহার করতে হত। মাছ মাংস ও অন্যান্য অনেক খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ বর্জন করতে হতো এবং একাদশীর দিন উপবাসী থাকতে হত। এইভাবে মেয়েদের প্রতি নিদারুন নির্যাতন চলত।
নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতার জন্য রাজা-রাজবল্লভ বিধবাদের পুনরায় বিবাহ দেওয়া রীতি প্রচলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
সেই সময় সধবা মেয়েদের স্বামী শ্বশুর ভাশুর স্থানীয়দের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল ।তারা ভাশুর ও মামাশ্বশুরদের সংস্পর্শে আসতে পারতেন না। যদি কোনক্রমে ভাশুর ও মামাশ্বশুরের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ে হয়ে যেত তাহলে ব্রাহ্মণ মারফত ধান,সোনা উৎসর্গ করে শুদ্ধ হতে হতো । এই প্রথা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ধাপ অবধি প্রচলিত ছিল। সধবা মেয়েদের অবগুন্ঠনবতী হয়ে থাকতে হত বাড়ীতে। বাড়ির বাইরে পা দেওয়া এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। এইভাবে মেয়েদের প্রতি উৎপীড়ন চলত।
মধ্যযুগের সমাজকে কালিমালিপ্ত করেছিল তিনটি প্রথা - (১) কৌলীন্য, (২) সতীদাহ ও (৩) দাস দাসী কেনাবেচা - সব প্রথাই মেয়েদের প্রতি কঠোর নির্যাতনের সমান।
সমাজে কৌলীন্য প্রথা এনেছিল এক অসামান্য জটিলতা। এই প্রথা বিশেষ করে প্রচলিত ছিল বাংলা ও মিথিলাতে। অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশে কৌলীন্য প্রথা সৃষ্টি করেছিলেন সেন বংশীয় রাজা বল্লাল সেন। আর মিথিলাতে কর্নাটকেবংশীয় শেষ রাজা হরি সিংহ। ইতিহাস কিন্তু এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। বল্লাল সেন রচিত অদ্ভুত সাগর ও দানসাগর এ ব্যাপারে কোন উল্লেখ নেই। অনেকে আবার বলেন যে, বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন মাত্র এবং এটা বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র, তাম্রপট্ট, শিলালিপি সমূহ এই ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। প্রাচীন সমাজে অনুলোম বিবাহ এবং প্রতিলোম বিবাহ প্রচলিত ছিল। এর অর্থ প্রাচীন সমাজে অসম্পূর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল যার ফলে সংকর জাতিসমূহ গড়ে উঠেছিল। কৌলীন্য প্রথা সম্বন্ধে যে মতটা দিতে আজ সমীচীন বলে গৃহীত হচ্ছে ,সেটা হচ্ছে পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীতে বাঙালি কুলপঞ্জীকারগণই এই প্রথা প্রথমে ব্রাহ্মণ সমাজে কায়েম করেছিলেন এবং সেই ব্যাপারে তারা বল্লালসেনের নাম জড়িয়ে রেখেছিলেন। ব্রাহ্মণ সমাজের অনুকরণে এটা পরবর্তীকালে কায়স্থ, বৈদ্য ,সদগোফ প্রভৃতি সমাজে প্রবর্তিত হয়েছিল। কৌলীন্যপ্রথা সপ্তদশ শতাব্দীতে সদগোফ সমাজে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত হয়েছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
সমাজে নয়টি গুণের লক্ষণ যেমন আচরণ, শালীনতা, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ ভ্রমণ, নিষ্ঠা, আবৃত্তি তপস্যা, ও দান থাকা দরকার কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজে যাদের কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল তাদের বংশ পরস্পরায় কুলীন বলে সম্মানিত করা হতো এইসব নটি গুণ থাকুক বা না থাকুক। যেমন রাঢ়ীর ব্রাহ্মণ সমাজের কুলীন করা হয়েছিল মুখোপাধ্যায় বন্দোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়দের। সেই ভাবে কায়স্থ সমাজে ঘোষ বসু গুহ ও মিত্র বংশ কে কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল
কৌলিন্য প্রথা সমাজে বিভিন্ন বংশকে উচ্চ ও নীচ চিহ্নিত করে সমাজকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছিল। বরং কুলপঞ্জীকারগণ নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ সৃষ্টি করে সমাজকে ক্রমশ জটিল করে কুপ্রথার সৃষ্টি করেছিল।
কৌলীন্য প্রথাটি ছিল কন্যাগত ব্রাহ্মণ সমাজে। এর অর্থ কুলীনের ছেলে কুলীন বা অকুলীনের মেয়েকে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হতো। অকুলীনের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিলে মেয়ের বাপের কৌলীন্য রক্ষা হতো না। কুলীন রক্ষার জন্য যেন-তেন-প্রকারেণ মেয়ের বাপের কুলীন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হতো। আসল
কারণ অবিবাহিত কন্যা ঘরে রাখা বিপদের ব্যাপার ছিল। একদিকে সমাজ তাকে এক ঘরে করত অন্যদিকে যবনেরা অনেক সময় ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে নিকা করতে কুন্ঠাবোধ করত না।
সেই সময় কুলীন ব্রাহ্মণরা সমাজের এই কুপ্রথার জন্য খুব ফায়দা তুলত। কুলীনব্রাহ্মণগণ অগনতি বিবাহ করতে হত এবং স্ত্রীকে তার পিত্রালয়ে রেখে দিতেন। মেয়েরা এই কুপ্রথার শিকার হতো।
কুলীন কুপ্রথা সেই সময়কার বাঙালি সমাজে মেয়েদের ক্রমশ বিপদে ফেলে দিয়েছিল। সেই সময় মেয়ের বাবাকে অনেক কষ্টকর ও ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াতো তাদের মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে। সেই সময় গঙ্গাসাগরের মেলা গিয়ে মেয়ের বাবারা মেয়েদের সাগরে জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এই দেশের একটা কু প্রথা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ইংরেজ সরকার এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছিল। অনেকে আবার মেয়েকে সাগরে জলে ভাসিয়ে না দিয়ে মন্দিরের দেবতার কাছে তাদের দান করত। তারা মন্দিরে দেবদাসী বলে পরিচিত লাভ করত। এটাও পরে আইন দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
স্বামীর সঙ্গে সহমরণ ব্যাপারটা প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। এব্যাপারে কোন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা জনসমাজে প্রচলিত ছিল না। মনুসহিতায় বিধবা নারীদের আমরণ কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের নির্দেশ দেওয়া আছে। তান্ত্রিকরা সহমরণের বিরোধী ছিল। মহানির্মাণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে এই কুপ্রথা নারী বা আদ্যাশক্তির অবমাননা সূচক। সব সময় যে স্ত্রী স্বেচ্ছায় সহমতা হতেন তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে নেশা সেবন করিয়ে তার প্রভাবে বা বলপূর্বক তাকে পুড়িয়ে মারা হতো । নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতার স্ত্রী সহমৃতা হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় ব্যথিত হয়েছিলেন। এবং এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড বেন্টিক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন।
এই সময় দাস-দাসী কেনা বেচা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। এইসব দাস দাসীর ওপর গৃহপতির মালিকানা স্বত্ব থাকতো । গৃহপতির অধীনে থেকে তারা গৃহপতির জমি কর্ষণও গৃহস্থালির কাজকর্ম করতো। কখনো কখনো মালিকরা তাদের দাসীগণকে উপপত্নী হিসেবে ব্যবহার করত। নবাব সুলতান ও বাদশাহদের হারেমে এরকম অনেক হাজার হাজার দাসী থাকত। দাসীদের হাটে কেনা বেচা চলতো ।অনেক সময় দাম দস্তুর করে মুখের কথাতেই তাদের কেনা বেচা হত। তবে অনেক ক্ষেত্রে দলিল পত্র তৈরি করে নেওয়া হতো। এইরূপ দলিল পত্রকে গৌড়ীয় শাতিকা পত্র বলা হত।
ঋগ্বেদের আমল থেকেই দাসী রাখা ভারতে প্রচলিত ছিল। তবে মধ্যযুগে এই প্রথা বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। হিন্দু সমাজে দাসী কেনা ও রাখা যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রসার লাভ করেছিল তা নয়, চাষা-ভূষার ঘরেও দাসী থাকতো। এমনও দেখা গেছে ছেলের সঙ্গে কোন দাসীর বিয়ে দিয়ে তাকে পুত্রবধূ করে নিত। তখন সেই দাসী দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করত। অনেকে আবার যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য দাসীদের ব্যবহার করত। সমসাময়িক দলিল পত্র থেকে আমরা দাসীর মূল্য সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি গৌরবর্ণ ৩০ বৎসর বয়স্কা দাসীর দাম ছিল চার টাকা। ১৬ বছর বয়স্ক বালিকার দাম ছিল ছয় টাকা পরবর্তীকালে দামের কিছু হেরফের দেখা যায়। চতুর্থ শতাব্দীর আফ্রিকা দেশের পর্যটক, ইবন বটুটা ১৫ টাকায় এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণীকে কিনেছিলেন এবং তাকে নিজের দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজরা যখন এদেশে আসে তখন তারাও দাসী কিনত।
------------------------------
Shyamal Hudati
357/1/13/1, Prince Anwar Shah Road,
P.O. Jodhpur Park,
Kolkata - 700 068
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন