রুমি ও সুমি দুজন খুড়তুত ও জেঠতুত বোন। রুমির বাবা সুরেশ দাশ ও মা কেয়া দাশ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। রুমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। রুমি তখন ছয় মাসের। সুরেশ ও তার স্ত্রী কেয়া রেল লাইন পার হচ্ছিল। হয়তো তাদের খুব তাড়া ছিলো । হতে পারে। কিন্তু রেললাইনে তাদের তাড়াহুড়ো করা উচিত হয় নি। সেই সময় দু দিক থেকে দুটো থ্রু ট্রেন পাশ করছিলো। রেলওয়ে ট্রাকের মাঝখানে যখন তারা চলে এসেছিল,তখন তারা দেখতে পায় দুদিক থেকে থ্রু ট্রেন আসছে। তারা হতচকিত হয়ে পড়ে। কি করবে এগিয়ে যাবে না পেছিয়ে আসবে ঠিক করতে পারে না ওই ফ্র্যাক্শন অফ এ মিনিট সময়ে। তবুও পার হয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো। সঙ্গে মহিলা। সুরেশের কোলে আবার বাচ্চা ছয় মাসের মেয়ে। দেরি হয়তো হতো কিন্তু কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া উচিত হয় নি। ফলে যা হবার তাই হলো। দুজনের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে শত শত যাত্রীর চোখের সামনে। এর মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলো ছয় মাসের ওই মেয়েটা। বাবার কোল থেকে ছিটকে এসে পড়লো ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্মের একদম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রীর গায়ের ওপর। কি জানি বাবাই হয়তো তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিলো হবে। বরাত ভালো লোকটি তাকে লুফে নিতে পেরেছিলো। সকলেই ঐ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে একাগ্রচিত্তে ওই দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তারাও অনেকে সহযোগিতা করে ছিলো বাচ্চাটিকে ধরার। বাচ্চাটি তাতে সামান্য চোট পেয়েছিলো। পাশেই ছিলো রেলওয়ে হসপিটাল। বাচ্চাটিকে সেখানে ভর্তি করে দেওয়া হলো। বাচ্চাটি আর পি এফের তত্ত্বাবধানে হসপিটালে রইলো । পুলিশ সুরেশের পকেট সার্চ করে আই ডি কার্ড পায়। লাশ দুটি মর্গে পাঠিয়ে লোকাল থানা মারফৎ সুরেশের বাড়িতে খবর পাঠায়। সুরেশের দাদা রমেশ মর্গে গিয়ে বডি দুটি ও বাচ্চাটিকে সনাক্ত করে। পোস্ট মর্টেম হয়ে গেলে বাচ্চা সহ বডি দুটিকে বাড়ি নিয়ে যায়।
বাচ্চাটির পিতা মাতার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যাবার পর রমেশ ও রানি বাচ্চাটিকে আইনগতভাবে দত্তক নিলো যাতে তাদের মেয়ের সঙ্গে সমানভাবে মানুষ হতে পারে। তখন থেকে বাচ্চাটি রমেশ ও রানির কন্যা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলো। যাতে তার শৈশবের ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাকে তাড়া করে না বেড়ায়। তাহলে ওদের সংসারের সকলের থেকে ও মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যাতে না পড়ে সেজন্য রমেশ ও রানিমা'র কাছে আর তার দিদি সুমির সাথে সমানভাবে মানুষ হতে লাগলো। রুমিও ওর জেঠু জেঠিমাকে নিজের বাবা মা আর জেঠতুত দিদিকে নিজের দিদি বলেই জানে।
রুমিকে মানুষ করতে টাকার কোন অভাব হয়নি ।কারণ সুরেশের অফিসের টাকা ,লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অ্যাকসিডেন্টাল বেনিফিটের টাকায় ওর ভালোভাবে চলে যায়। তাছাড়া রমেশের আয় ভালো ছিলো। যদিও ওদের দুজনের বয়সের ব্যবধান বেশি নয়। মাত্র পাঁচ মাসের। তাই যমজ কন্যা রূপে মানুষ হতে লাগলো। রমেশের একটি পুত্রসন্তান ছিল কিন্তু সে ছিল লিউকোমিয়ার পেশেন্ট। বেশি দিন বাঁচেনি। মাত্র চার - পাঁচ বছর বয়সেই তার মৃত্যু হয়। সেজন্য এমনিতেই তারা শোকে জর্জরিত তার ওপর এই দুর্ঘটনায় তারা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলো। তবুও রমেশ ও রানি মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো, যে দায়িত্ব তার ভাই, সুরেশ ও ভ্রাতৃবধূ, কেয়া তাদের ওপর দিয়ে গেছে তা তারা যে কোন মূল্যে পালন করবেই । আর তাই রমেশ ও রানি তাদের ভাইঝি ও মেয়েকে সমানভাবে মানুষ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দুই বোন কখনও বুঝতে পারেনি যে তারা এক বাবা ও এক মায়ের পেটের সন্ততি নয়। দুই বোনের মধ্যে ভাবও যতো ঝগড়াও ততো। কখনও ঝগড়াঝাটি হলে রমেশ ও রানিকে সামাল দিতে হয়।
রুমি ও সুমি দুজনেই বুদ্ধিমতী। দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে বি. এ. পড়ছে। দুজনের ইচ্ছা ক্রিকেটার হওয়া। একজনের আইডল মিতালী রাজ তো অন্য জনের ঝুলন গোস্বামী। রমেশও ওদের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছে এবং ওদের খুব উৎসাহ দিয়েছে ভালো ক্রিকেটার হওয়ার। রমেশ ও সুরেশ দুজনেই ভালো ফুটবলার ছিলো। কলকাতার তিনটি নামী ক্লাবে খেলতো। ফুটবল খেলেই ওরা চাকরি পায় ইষ্টার্ন রেলওয়ের স্পোর্টসের কোটায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিলো ঠিক যেন হরিহর আত্মা। একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল ছিল। ভাইপোর মৃত্যুতে সুরেশ ও কেয়া খুবই শোকাহত হয়ে পড়েছিলো। ক্রিকেট একাডেমি থেকে দুই বোন প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন, উদীয়মান ক্রিকেটার হয়ে একাদিক্রমে স্কুলে, কলেজে, রাজ্য স্তরে এবং কাঙ্খিত জাতীয়স্তরের সুযোগ্যা হয়ে উঠে আজ দেশের গর্ব যে তারা দেশের হযে খেলছে, একজন ব্যাটসম্যান আর অন্যজন বোলার হিসেবে।স্বর্গ থেকে সুরেশ নিশ্চয়ই তার মেয়ে রুমিকে আর্শীবাদ করছে। আর তাই বুঝি দুর্ঘটনায় অনাথ হয়ে বেঁচে যাওয়া অভাগী রুমির ভাগ্য জয় ঘটেছে। তার এই কৃতিত্বের পিছনে তার দাদা, রমেশ ও বৌদি,রাণীর নিরলশ প্রচেষ্টার জন্য তাদের আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি লাভ করেছে।
কথা প্রসঙ্গে রমেশ তার দুই মেয়েকে বলে, " দ্যাখো তোমরা এখন যথেষ্ঠ প্রতিষ্ঠিত। আমরা চাই তোমাদের বিয়ে ধূমধাম করে দি । হ্যাঁ,পাত্র তোমরা নিজেরাই নিজেদের মতো নির্বাচন করে নিতে পারো। তবে খুব ভেবেচিন্তে।কিন্তু আমার তো পেনশনটুকু ছাড়া আর কোন আয় ও সংস্থান তেমন নেই। তবে যা আছে মোটামুটিভাবে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমরা চাই ধূমধাম করে হোক। তাই তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে নাও। আমাদের কিছু দিতে হবে না। তোমরা অর্থ সঞ্চয় করো যাতে আমাদের মনের সাধ পূর্ণ হয়।
যেন এমন না হয় যে আমাদের অর্থ তেমন নেই বলে আমাদের দুই প্রিয় কন্যাকে যেমন তেমন ভাবে পাত্রস্থ করতে হয়। তোমরা সুখী হলেই আমরা খুশি।"
=================
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন