Featured Post

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

ছবি
  নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে  গ্রন্থ-প্রকাশ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে এক ফর্মার ১০টি পুস্তিকা : এই প্রকল্পে লেখক-কবিদের থেকে কোনো খরচ নেওয়া হবে না।        পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বইগুলি প্রকাশিত হবে। লেখক/কবিকে সশ্রদ্ধায় সৌজন্য সংখ্যা দেওয়া হবে।       যাঁদের আগে কোন বই হয়নি , তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। নতুনদের উপযুক্ত লেখা না পেলে বাকিদের লেখা নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরিত হবে।       লেখা সকলেই পাঠাতে পারেন। মেলবডিতে টাইপ করে বা word ফাইলে ।   ই-মেল : nabapravat30@gmail.com  (এবং হোয়াটসঅ্যাপেও)। বইয়ের শিরোনামসহ ১৫টি কবিতা বা ১৫টি অণুগল্প পাঠাতে হবে , শব্দ সংখ্যা বা লাইন সংখ্যার বাঁধন নেই । মনোনীত হলে মানানসই বইয়ের ফরম্যাটে যে কটি যাবে রাখা হবে ।       সঙ্গে লেখক পরিচিতি , ঠিকানা , যোগাযোগের ( কল ও হোয়াটসঅ্যাপ )   নম্বর ও এক কপি ছবি দেবেন। লেখক পরিচিতিতে অবশ্যই জানাবেন, এটি আপনার প্রথম প্রকাশিত বই হবে অথবা পূর্ব প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা। অনলাইন বা মুদ্রিত পত্রিকা বা সমাজ - মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাও পাঠানো যাবে । তবে কোনও গ্রন্থভুক্ত লেখা

গল্প ।। আলোকতীর্থ ।। সৌমেন মণ্ডল


আলোকতীর্থ

 সৌমেন মণ্ডল

 

(এক)

রাঘব সরকার শিক্ষাদরদী মানুষ। শিক্ষক হয়েছেন, তবে এখনো পড়াশোনা ছাড়েননি। যখনই সময় পান বই নিয়ে বসেন। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় তিনি রাজ্যে প্রথম হয়েছিলেন। চাইলে সুসজ্জিত শহরের কোনো স্কুলকে কর্মক্ষেত্র করতেই পারতেন। কিন্তু তাঁর সাধক মন বেছে নিয়েছে গ্রামের এক প্রত্যন্ত স্কুল। উদ্দেশ্য, আলোর সাধনা মনের মতো কিছু মানুষ গড়া।

      ছোট্ট একটা বাজার পেরিয়ে স্কুল। সবুজে শোভিত তার চত্বর। বিল্ডিংগুলি আয়তাকারে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে মধ্যবর্তী প্রাঙ্গনকে। প্রথম দিন এই স্কুলে ঢোকার মুখে রাঘববাবু নিজ আদর্শকে মনে মনে প্রণতি জানালেন। স্কুলে যোগ দিয়ে অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা ও সহকর্মীদের সাথে আলাপ সেরে শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গেলেন। পড়াশুনায় দৈন্যতাকে উপলব্ধি করে মন প্রাণ দিয়ে দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমে তিনি শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাকে প্রস্ফুটিত করতে চাইলেন। কিন্তু যত সময় গড়াল ততই অভিজ্ঞতা অন্যরকম হতে লাগল। একদিন ক্লাস নাইনে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দাম' পড়াচ্ছিলেন। গল্পের একটি বাক্য ছিল 'গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা যায় না'। কথাটির সাথে নিজের অভিজ্ঞতার যেন মিল পেলেন। কিন্তু আশা ছেড়ে দিলে তো আর কিছুই থাকে না, তাই ছাড়লেন না হাল।

      রাঘববাবু স্বপ্ন দেখেন এক সুন্দর পৃথিবীর, যেখানে শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানবতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটবে। সেখানে থাকবে না কোনো সংকীর্ণতা, থাকবে না ভেদাভেদ। মনুষ্যত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে প্রতিটি মুখ। কিন্তু সময়কে বদলানো তো মুখের কথা নয়, তার প্রবল প্রতাপে ব্যক্তি-মানুষকেই একদিন বদলে যেতে হয় অনিচ্ছুক বাধ্যতায়। অবশ্য দু'-একটা ব্যতিক্রম চিরকালই থাকে। অমানুষিক শক্তিসম্পন্ন সেই সব বীর বিপ্লবী বলে গণ্য হয়। বিপ্লব একদিনে সফল হয় না। তার সাফল্যের পিছনে থাকে বিপ্লবকামী বহু মানুষের ব্যর্থতার ইতিহাস। রাঘব বাবু ক্রমশ হয়ে উঠলেন সেই ইতিহাসেরই এক চরিত্র, অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও যিনি প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতার ব্যূহ ভেদ করে আত্মরক্ষা করতে পারেননি।

      ভূতপূর্ব প্রধান শিক্ষক অজিতবাবু ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সেই পদে আসীন হয়েছেন স্থানীয় শিক্ষক গোপাল বাবু। তবে 'ভারপ্রাপ্ত' বললে সত্যের অপলাপ হয়, তাই অনেকে এতে আপত্তি তোলেন। আসলে তিনি স্বঘোষিত। সেই সঙ্গে অনেকটা স্ববিরোধীও বাইরে গৌরভক্ত, অন্তরে দুর্বাসা (অর্থাৎ, যার সাথে বাস করা যায় না)। তাই স্কুলের বহিরঙ্গকে লতায় ফুলে রঙে সাজিয়ে তুললেও অন্তর-কঙ্কালের অস্থিগুলোকে ভেঙেছেন একটার পর একটা। সাথ দিয়েছেন স্থানীয় দুই শিক্ষক ও মোড় কমিটি।

     স্কুলের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে রাঘব বাবু যে সচেতন ছিলেন না এমন নয়। কিন্তু বিনা মেঘেও যে বজ্রপাত হতে পারে তা তাঁর ধারণায় ছিল না। ক্লাস নাইনে পাঠদান করছিলেন তিনি। দু'জন ছাত্রী নেহা ও রিয়া সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এতে ক্লাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। রাঘব বাবু বিশ্বাস করেন অনুশাসন ছাড়া শিক্ষা হয় না। অথচ ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তি দিতে তাঁর কষ্টও হয়। তাই ন্যূনতম শাস্তি হিসেবে নেহা-রিয়াকে কান ধরে দাঁড়াতে বলেন। এর থেকে কম শাস্তি কী দেবেন তা তিনি ভেবে পান না। অন্যদিকে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া নেহা তখন ভাবতে থাকে তার এই স্যারটিকে কোন বড় শাস্তি দেওয়া যায়।

(দুই)

      নেহার ভাবনার ফল ফলতে দেরি হল না। পরদিনই ফার্স্ট পিরিয়ডে গোপালবাবুর অনুমতি নিয়ে তার মদ্যপ বাবা রাঘব বাবুর উপর চড়াও হন। স্টাফরুমে সবার সামনে একের পর এক মিথ্যা ও অশালীন অভিযোগে রাঘববাবুকে তিনি দিশেহারা করে তোলেন। রাঘব বাবু কিচ্ছু বুঝতে পারেন না এ তার সাথে কী হচ্ছে। কার্যকারণের হিসেব মেলাতে না পেরে তিনি থ বনে যান। তাঁর মাথা কাজ করে না, প্রচন্ড কষ্টে বুক মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত-পা অবশ হয়ে আসে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কখনো পড়েননি। বিমূঢ়ের মতো তিনি শুধু মাথা নেড়ে 'না, না, এ সব মিথ্যে' বলে অভিযোগগুলি অস্বীকার করতে থাকেন। নেহার স্নেহান্ধ বাবা তবু ক্ষান্ত হন না, তাঁকেই পাল্টা 'মিথ্যাবাদী' বলে চালাতে থাকেন একের পর এক কথার চাবুক।

      ফার্স্ট পিরিয়ড শেষ। রাঘববাবুর চোখে পড়ল ক্লাস নাইনের চারটি মেয়ে প্রাঙ্গন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রিয়াও তাদের মধ্যে রয়েছে। তিনি হন্তদন্ত হয়ে তাদের ডাকলেন। অস্থির ভগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, – 'হ্যাঁরে রিয়া, কাল তোদের আমি কেন শাস্তি দিয়েছিলাম?' রিয়া তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চটজলদি উত্তর দিল, – 'স্যার, আমি আর নেহা গল্প করছিলাম তাই।' বাকিরা কৌতুহলী চোখে জানতে চায়, – 'কেন স্যার? কী হয়েছে? আপনি এভাবে জিজ্ঞেস করছেন কেন?' রাঘববাবু নেহার বাবার সদ্যকৃত অভিযোগগুলি সংক্ষেপে বললেন। ছাত্রীরা তো শুনে আকাশ থেকে পড়ল। ঠিক একটু আগে রাঘব বাবু যেভাবে পড়েছিলেন। তাদের বিস্ময়ের ভাব কাটতে চায় না। তারা বলে, – 'স্যার, এই কথাগুলো নেহার বাবা আপনাকে বলতে পারল? আমরা তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকটা কথা মিথ্যা। এমন কোনো ঘটনা কাল ঘটেইনি। স্যার আপনি আমাদের কত ভালো করে পড়ান। গোলমাল করলে শাস্তি দেন। আপনার ক্লাসে আমরা কতবার কান ধরে দাঁড়িয়েছি। কৈ কখনো তো আমাদের খারাপ লাগেনি। বরং সেই নিয়ে আনন্দ করেছি। আর তাছাড়া শাসন করবেন না? এটা কেমন? শাসন করাটা তো উচিৎ। আপনি আমাদের স্যার। আমাদের শাসন করেন তো আমাদের ভালোর জন্য।' রাঘববাবুর চোখ ছলছল করে উঠল। ছাত্রীদের তিনি নতুনভাবে চিনলেন। এরা এত ভালো? এত বোঝে? এইটুকু বয়সে? নেহার বাবার সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় মানুষের মধ্যে কত ফারাক। তারা আরো বলতে থাকে, – 'স্যার, নেহার বাবা আপনাকে যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন আমাদের একবার ডাকলেন না কেন? আমরা এসে সব সত্যি কথা বলতাম। গোটা ক্লাস জানে কী হয়েছিল।' একটু চুপ থেকে রাঘব বাবু বললেন, – 'নেহা তো আগে এমন ছিল না? পড়াশোনা করত, ক্লাসে শান্ত হয়ে বসে থাকত।' একজন ছাত্রী তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, – 'স্যার আপনি ওকে চেনেন না। ও সব স্যারের কাছে ভালো সাজে। ও যে কী জিনিস তা আমরা ভালো করে জানি।' রাঘব বাবু আর কথা না বাড়িয়ে ছাত্রীদের বললেন, – 'ঠিক আছে, তোরা ক্লাসে যা। আজ গোপালবাবু আসেননি। কাল তোদের একবার ডেকে পাঠালে আসিস।' ছাত্রীরা সমস্বরে বলল, – 'অবশ্যই স্যার। আমাদের ডেকে পাঠাবেন। আমরা আসব।' রাঘব বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বুক থেকে যেন একটা ভারী বোঝা নেমে গেল।

     পরদিন স্কুলে তুলকালাম কান্ড। রাঘববাবু গোপাল বাবুর কাছে গিয়ে বললেন, — 'স্যার, গতকাল ক্লাস নাইনের নেহা নামে একটি মেয়ের গার্জেন মিথ্যা কথা বলে আমাকে অপমান করে গেছেন। আমি চাই' কথা শেষ করতে না দিয়ে গোপাল বাবু গর্জে উঠলেন, — 'কী মিথ্যা বলেছেন?' প্রার্থনা শেষে ক্লাস নাইনের রিয়া-নিশা সহ কয়েকজন মেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁদের লক্ষ করছিল। রাঘববাবু ডাকলেন, — 'এই, তোরা একবার এদিকে আয় তো।' গোপালবাবু 'ওদেরকে ডাকবেন না' বলে তাদের চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করে হাত নাড়লেন। মেয়েরা তটস্থ হয়ে ফিরে গেল। রাঘব বাবু অসহায় ভাবে তাদের দিকে চেয়ে রইলেন। দৃষ্টির শূন্যতায় দীর্ণ হয়ে উঠল নির্বাক যন্ত্রণা। গোপাল বাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, — 'নেহাকে কান ধরানো আপনার উচিৎ হয়নি।' রাঘববাবু জানালেন, — 'ওরা গোলমাল করছিল তাই একটু শাসন করেছিলাম।' গোপালবাবু বললেন, — 'শাসন করার কোনো ইনস্ট্রাকশন নেই। স্টুডেন্ট গোলমাল করলে আপনি নিজেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবেন।' অপমানে আঘাতে রাঘব বাবুর চোখ মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, — 'বেরিয়ে যাবার জন্য তো শিক্ষক হইনি স্যার।' এমন সময় পার্শ্বশিক্ষক ও পার্শ্বচর সুশান্ত বাবু গোপাল বাবুর প্রতি আনুগত্য দেখাতে অনাহূত হয়েও রাঘব বাবুর দিকে তেড়ে গিয়ে আঙুল তুলে বিস্ফারিত চোখে বার বার একতরফা চীৎকার করতে লাগলেন, — 'আপনি অন্যায় করেছেন, আপনি অন্যায় করেছেন'। গোলমাল শুনে স্টাফ রুম থেকে সমস্ত শিক্ষক বেরিয়ে এলেন এবং এতদিনের শান্ত সংযত রাঘব বাবুকে অকারণে লাঞ্ছনার শিকার হতে দেখে সকলেই ব্যথিত হলেন। সবাই এক বাক্যে বললেন, — 'রাঘব বাবু কোনো অন্যায় করেননি। আমরা সবাই স্টুডেন্টদের শাসন করি এবং করব। শাসন ছাড়া স্কুল চলতে পারে না।' একজন তো গোপালবাবুর সামনে গিয়ে বললেন, — 'আপনি শাসন করেননি গোপাল বাবু? এই সেদিন টুয়েলভের দুটো ছেলেকে মেরে কাঁদিয়ে দিলেন, ভুলে গেলেন? আপনার তুলনায় আমরা তো কিছুই শাসন করি না।' একজন বললেন, — 'গোপালবাবু, ইন্সট্রাকশনের কথা আপনার মুখে মানায় না। ইলেভেনের পরীক্ষার সময় আপনি যে টুকলি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন সেটা কি ইন্সট্রাকশনে রয়েছে? এলাকাবাজি না করে স্কুলের কীসে ভালো হয় সেটা ভাবুন।' আরেকজন স্যার রাঘব বাবুর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, — 'এমন করলে আমরা কেউ ক্লাসে যাব না।' যদিও শেষ পর্যন্ত সবাই ক্লাসে গেলেন। কিন্তু মান হারানোর এই দুঃসময়ে রাঘব বাবুর বুঝতে অসুবিধা হল না যে তিনি কার প্রিয়জন, আর কার প্রয়োজন।

(তিন)

      ঘটনার পর কয়েক দিন কাটল। রাঘববাবু বিধ্বস্ত। স্কুল থমথমে। নেহা নিজের কৃতকর্মের লজ্জায় আর নিয়মিত স্কুল আসে না। সে ভাবেনি তার মিথ্যা অভিযোগ এত বড় রূপ পাবে। স্কুলের সহপাঠীরা এখন তার দিকে অন্য চোখে তাকায়, কানাকানি করে। সে সবার কাছে ছোট হয়ে গেছে। রাঘববাবু বোঝেন তার কষ্ট। কিন্তু চাইলেও তাকে ক্ষমা করে হালকা হতে পারেন না। একদিকে পবিত্র আত্মসম্মান রক্ষা, অন্যদিকে অনুতপ্ত ছাত্রীর মনোকষ্ট দূর করা কীভাবে দু'কূল বাঁচানো যাবে তিনি ভেবে পান না। ছাত্রীটির মুখ দেখলে ভয় হয়, বিশ্বাস করতে পারেন না আর। তার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। এ মনের ভাঙন। বাইরে থেকে তালি দিয়ে তাকে জোড়া যায় না। তবু চেষ্টা করলেন কেউ কেউ। কিন্তু হায়! যে উদ্যোগে সত্য থাকে না, ন্যায় থাকে না, শুধু অনৈতিক শক্তির দাম্ভিক প্রকাশ থাকে, তার পরিণতি যে কখনো শুভ হতে পারে না একথা বহু পরিণত বুদ্ধির মানুষও বোঝে না। তাই যা হওয়ার তা'ই হল। বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে মিটিয়ে নেওয়ার নাম করে জওহরবাবু রাঘববাবুকে অফিস রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন। রুমের মধ্যে গোপাল বাবু আগে থেকেই ছিলেন, সুশান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন, একটু পরে এলেন রক্তিম বাবু। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রীর অভিভাবক আসবেন বলে শোনা গেল। মিনিট দুয়েক চাপা নীরবতার পর রক্তিম বাবু কথা শুরু করার প্রস্তাব দিলেন। অস্বস্তি কাটিয়ে গোপাল বাবু কোমল কন্ঠে শুরু করলেন, — 'দেখুন রাঘববাবু, আপনি যা করেছেন ঠিক করেছেন। কোনো ভুল করেননি। কিন্তু এলাকার পরিস্থিতি তো ভালো নয়। একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে। শুনলাম মেয়েটা আর স্কুলে আসতে চাইছে না। ওর দাদুর ইচ্ছা আপনি ওকে ডেকে একটু স্নেহ-টেহ করে স্বাভাবিক করে তুলুন।' উচিৎ-অনুচিৎ বিষয়ে গোপাল বাবুর ১৮০° অবস্থান বদল দেখে রাঘববাবু বিস্মিত হলেন। বুকে বল পেয়ে তিনি বললেন, — 'অবশ্যই। কিন্তু যে ঘটনাটা ঘটল সেটা অভাবনীয়। এত মিথ্যা অভিযোগ! আর কান ধরানো এখানে নতুন কিছু নয়। আপনারা আমার সিনিয়র। আমি আপনাদেরই অনুসরণ করেছি। কারো কিছু হয় না। অথচ সমস্যা হল শুধু আমার ক্ষেত্রে, এরকম কেন?' কেউ কিছু উত্তর খুঁজে পেলেন না। তাই মৃদু হাসি দিয়ে পাশ কাটালেন সকলে। এমন সময় গোপাল বাবুর ফোন বেজে উঠল। ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট হিমাংশুবাবু রাঘব বাবুর সাথে কথা বলতে চান। গোপালবাবু তাই তাঁর ফোনটি এগিয়ে দিলেন। প্রেসিডেন্ট তাঁর অভ্যস্ত বেপরোয়া গলায় বলতে লাগলেন, — 'শুনুন স্যার, কারো কোনো প্ররোচনায় পা দেবেন না। ওরা মাস্টারি করতে আসে না, সব বাঁদরামি করতে আসে।' ফুল ভলিউমে স্পিকার অন ছিল, তাঁর মধুর বচন প্রত্যেকের কানে গেল। কিন্তু স্কুলের যা পরিস্থিতি তাতে এসব প্রায় সবারই গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই কথামৃত শুনে কার কী প্রতিক্রিয়া হল তা বলা বাহুল্য। একটু পরে নেহার বাবার সম্বন্ধীয় দু-তিনজন লোক ঢুকলেন অফিসে। ছাত্রীর ফ্যামিলি কতটা প্রভাবশালী তা বোঝাতে অত্যন্ত শীতলতার সাথে একজন নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করলেন: 'নেহার মা যদি স্কুলে আসেন তবে স্কুলকে মাথায় তুলে ছাড়বেন। আর তার বাবা সিভিক পুলিশ। থানার বড় বাবুর সাথে যোগাযোগ আছে। চাইলে কেস-কাছারি অনেক কিছু করতে পারেন।' রাঘববাবুর অসহায় অভিমান ধিক্কার দিল সিস্টেমের নীচতাকে, যার জন্য তাঁর এই হেনস্থা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গার্জেন সম্পর্কিত আরেকজন ভদ্রলোক কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সুরে বিনয় ও ভাষায় ঔদ্ধত্য মিশিয়ে ধীর লয়ে শুরু করলেন, — 'আপনি মাস্টারমশাই। ছাত্রীর কাছে আপনাকে ক্ষমা চাইতে বলব না। তার চাইতে আপনি শুধু ওকে ডেকে ' রাঘববাবু এবার আকাশ থেকে নয়, সোজা মহাকাশ থেকে পড়লেন। বুঝতে পারলেন 'ক্ষমা'র কথা বলে এঁরা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছেন। দুর্দমনীয় ক্রোধে তাঁর ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে উঠল। অনুভব করলেন এসব লোকের মোকাবিলায় ইগনোরই শ্রেষ্ঠ পন্থা। সেই পথই তিনি বেছে নিলেন। অবশেষে শেষ দৃশ্যে নেহার বাবার প্রবেশ। আগের দিন তাঁর হাতিয়ার ছিল মিথ্যা, আজ সম্বল ইমোশন। শিক্ষককে নিজের আওকাত বোঝাতে তিনি বললেন, — 'আমার মেয়ে ক্লাসে গল্প করছিল। স্যার শাস্তি দিয়েছেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু মেয়ের যদি কিছু হয় আমি ছাড়ব না।' অর্থাৎ, যুগপৎ দোষ স্বীকার ও হুমকি। পুরো নুন চিনির শরবত। তবে ভারসাম্যকে অটুট রাখতে রাঘব বাবু একথাটাও কানে নিলেন না। গার্জেন পক্ষকে আশ্বস্ত করে মিটিং ভাঙল।

      নৈমিত্তিক এক সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাঘববাবুর কপালে অনেকগুলি অমূলক অপবাদ জুটে গেল: এক. নেহাকে তিনি বিনা অপরাধে শাস্তি দিয়েছেন, দুই. তাকে পুরো ক্লাস (৪০মি.) কান ধরিয়ে রেখেছেন, তিন. একজনকে শাস্তি দিয়ে অন্যজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন, চার. রাঘববাবু নেহার গায়ে হাত তুলেছেন, পাঁচ. ক্লাসের মধ্যে পড়ে যাওয়া কলম তুলতে গেলে বা জল খেলেও তিনি শাস্তি দেন, ছয়. তিনি নাকি তাদের ক্লাসে গিয়ে বলে এসেছেন আর ভালো করে পড়াবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাঘব বাবুর নিজেকে হঠাৎ শরশয্যায় শায়িত দ্বাপরের ভীষ্মের মতো মনে হয়। ছাত্রীর অঘটন ঘটার সম্ভাবনাকে শিখন্ডী করে বিরুদ্ধপক্ষ তাঁর দিকে একের পর এক অপবাদের তীর ছুড়েছে। কর্তৃপক্ষ সত্য ঘটনার স্বাক্ষ্য সামনে আসতে দেননি। তাঁদের যুক্তি, ঘটনার সত্যতা জানাজানি হলে মিথ্যুক মেয়ে অপমানে আত্মহত্যা করতে পারে। রাঘববাবুও চান না কোনো অপ্রিয় ঘটনা ঘটুক। ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সন্তানসম। অথচ তিনিও আর অপমানের বোঝা বইতে পারেন না। দেহ তাঁর নুয়ে পড়তে চায়। তবু ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো মনে মনে বলতে চেষ্টা করেন, — 'হে ঈশ্বর, এদের ক্ষমা করো'

     চেতনে অবচেতনে রাঘব বাবু এরপর আমূল বদলে গেলেন। তাঁর আচরণে যে প্রাণশক্তির স্ফূরণ ছিল তা আর নেই। এখন তিনি নিস্পৃহ, নিরুদ্যম, উদাসীন। অন্তরঙ্গ কয়েকজন ছাড়া বেশি কারো সাথে মেশেন না। ক্লাসে পড়ানোর বাইরে স্টাফরুমে অফিসে অত্যন্ত পরিমিত কথা বলেন। স্কুলে আসতে তাঁর ভালো লাগে না। আত্মপ্রচার, গলাবাজি ও স্তাবকতার ক্লিন্ন পরিবেশে কেবলই দিনগত পাপক্ষয়। এর নিগড় কেটে বেরোতে তিনি গবেষণায় মন দিলেন। এক এক করে তাঁর অনেকগুলি গবেষণা পত্র নামি দামি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হল। ডক্টরেট উপাধি পেলেন। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ যেদিন কলেজে অধ্যাপনার বহুকাঙ্ক্ষিত সুযোগ এল সেদিন জানি না কেন রাঘব বাবুর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। সেটা স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আনন্দে না বেদনায় ঠিক বোঝা গেল না।

(চার)

     এদিকে স্কুল চলতে থাকল আপন গতিতে। হেলে দুলে দুলকি চালে। শাসনশূন্য শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীরা উচ্ছৃঙ্খল, দুর্বিনীত। তাদের দাপটে শিক্ষকরা অতিষ্ঠ। ক্লাসে যাতে গোলমাল না হয় তার জন্য গৌতমবাবু একদিন ছাত্রদের বলেছিলেন, যে কথা বলবে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেবেন। কিন্তু তাতেও জুটেছিল বিড়ম্বনা। স্টাফ মিটিঙে গোপাল বাবু প্রসঙ্গটি তুলে গৌতমবাবুকে তর্জন করেছিলেন। সবাই বুঝেছিলেন গৌতমবাবু উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য আসলে সকলের প্রতি আগাম সতর্কতা। তারপর থেকে এই অবস্থা। এখন উদ্ধত 'ও মাস্টার' সম্বোধন শুনেও শিক্ষককে নির্বিকার থাকতে হয়। কিন্তু এমন আর কত দিন? ভয় হয় মোড় কমিটিকে। তাই কেউ উচ্চবাচ্য করেন না। কিন্তু যাই হোক, প্রকৃতি সামঞ্জস্য চায়। স্কুলে যে আরেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল তা হয়তো তারই খেয়ালে। অফিস রুমের সামনে এসে একজন গার্জেন ভারী গলায় চিৎকার করতে লাগলেন, — 'কোথায় সেই স্যার? আসুক। তুলে আছড়াব।' তাঁর অভিযোগ, তাঁর ছেলে সিক্সে পড়ে। ক্লাস এইটের একটি ছেলে গতকাল তাকে মেরেছে। স্যারকে বলা সত্ত্বেও তিনি ছেলেটিকে শাস্তি দেন নি। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এই অভিযোগের দায় কার? দায় যাঁর সেই গোপালবাবু তখন প্রধান শিক্ষকের হুইল চেয়ারে বসে পাক খাচ্ছেন একবার উত্তর থেকে পূর্বে, তারপর পূর্ব থেকে পশ্চিম হয়ে আবার উত্তরে। বাইরের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ শুনে আতঙ্কিত হয়ে তিনি ব্যাপার বুঝবার চেষ্টা করলেন। বুঝতে পারলেন, ভুল হয়ে গেছে তাঁর। এখন উপায়? দ্বিতীয় পার্ষদ দক্ষিণারঞ্জনবাবু উদ্যোগী হয়ে পরিস্থিতিকে সামাল দিলেন। কিন্তু এ তো পরিপূর্ণ সমাধান নয়। এরকম ঘটনা যদি আরও ঘটে? দেওয়ালে টাঙানো বিপ্লবী মনীষী মহাপুরুষদের ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন নিজের অহংকে চরিতার্থ করতে সহকর্মীদের প্রতি কত অন্যায়ই না করেছেন তিনি। এলোমেলো দৃষ্টি একসময় নেমে এল তাকের ওপর রাখা ধুলো-পড়া লাঠিটার ওপর। এ তিনি আগেও বহুবার দেখেছেন। কিন্তু সে কেবল দেখার দেখা। চৈতন্য মিশিয়ে এই প্রথম দেখলেন। কাছে এসে পরম মমতায় বহু পরীক্ষিত সেই শাসনদণ্ডটি হাতে তুলে নিলেন। মুখমণ্ডলে দ্যোতিত হল এক নতুন সংকল্পের আভাস।

 

 ——————

সৌমেন মণ্ডল, বাগজুড়ি, বাঁকুড়া।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। 'স্বাধীনতা, স্বদেশ ও স্বকাল' বিষয়ক সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩১ আগস্ট ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান