বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
হাবিবা খানম
ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে যার লেখা পড়ে প্রকৃতার্থে মননে এক অসম্ভব ভালোলাগা সংবেদনশীলতা নিরবধি প্রশান্তি অনুভব করতাম, মাঝে মাঝেই সৃষ্টির সাগরে ডুব দিয়ে খুঁজে পেতাম বাংলার অফুরন্ত সৌন্দর্যের রূপ রস বর্ণ গন্ধ তিনি হলেন সকলের প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নিরিখে বলা যায় বিভূতিভূষণের সাহিত্য যেন পল্লী বাংলা কে নতুন করে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছিল। যথার্থ সাহিত্য যে আমাদের চিরন্তন মননের খোরাকের পাশাপাশি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে তার অব্যর্থ উদাহরণ বিভূতিভূষণ। বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি, নান্দনিকতা, নিসর্গ, আর গ্রাম্য জীবনকে কেউ যদি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলে আনেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চরিত্রের উপস্থাপন, অতুলনীয় গদ্য আর দৈনন্দিন জীবনকে বাস্তবিকভাবে সাহিত্যে তুলে আনা থেকে ভাষার অপরূপ উপস্থাপন সবকিছু মিলিয়ে তার লেখা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রকৃতির জীবন শিল্পী। বাংলা কথা সাহিত্যের ব্যাপ্তিতে যার তুলনা পাওয়া ভার।বাংলা কথাসাহিত্যের অনবদ্য স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ আটপৌরে গ্রাম্য জীবন নিয়ে লেখকের রচনা। লেখকের উপন্যাসে ফিরে আসে তৎকালীন সমাজের কথা, সাধারণ মানুষের কথা। বিভূতি ভীষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সংগ্রামের। ঘনঘন বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। কখনও ঘাটশিলা, কখনও ভাগলপুর, কখনও ছোটনাগপুরের মালভূমি, কখনও বা বিহারের ছোট শহর। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের চরিত্র হয়ে উঠেছে অনায়াসে। তাঁর কথায় "যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথা বলতেই হবে। তাদের সে গোপন সুখ দুঃখকে রূপ দিতেই হবে।' প্রবাসী সাময়িক পত্রে 'উপেক্ষিতা' ছোট গল্প দিয়ে সাহিত্য জীবন শুরু এবং শেষ উপন্যাস 'ইছামতি'। ছোট গল্পের মধ্যে লেখক বাস্তব জীবনের অখ্যাত চরিত্রগুলোকে এঁকেছেন।
যার কলমে রচিত হয়েছে অপরাজিতা, পথের পাঁচালী, আদর্শ হিন্দু চাঁদের পাহাড়, মৌরিফুল, ইছামতী'র মত বিস্ময়কর উপন্যাস ও গল্প। যার লেখায় প্রেম, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মচেনায় নিগুঢ় তত্ত্ব বিদ্যমান।রবীন্দ্রযুগের আগে ও পরে জীবন্ত অবস্থায় বাংলা সাহিত্যে যে ক'জন লেখক প্রবল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এবং তা আজও বিদ্যমান আছেন তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একজন।তিনি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতেন গভীর ও নিবিড় ভালোবাসা দিয়ে। তার সৃষ্ট চরিত্র অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, দোবরু, পান্না, শঙ্কর, হাজারি ঠাকুর প্রমুখ এখনও কালজয়ী হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানব জীবনকে অবিচ্ছিন্ন সত্তায় ধারণ করেছেন। তার রচনা শুধু প্রাকৃতিক বর্ণনা নয়, এতে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও অপরাজিত বাংলা সাহিত্যের দুই অমূল্য সম্পদ। যদিও তার সব লেখাই উল্লেখ করার মতো।১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের চব্বিশ পরগনার মুরারিপুর গ্রামের মামার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পুরোহিত। বিভূতিভূষণের ছোটবেলা দারিদ্র্যের মধ্যেই কাটে।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৪ সালে স্থানীয় বনগ্রাম স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯১৮ সালে ডিস্টিংশনে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।কর্মজীবনের শুরুতে তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি সোনারপুর হরিণাভি স্কুলে, কলকাতা খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল ও ব্যারাকপুরের কাছের গোপালনগর স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে মন প্রাণের একাত্মত তাই সাহিত্য সাধনা। পল্লী বাংলার সৌন্দর্য বন জঙ্গল কে এত নিপুণভাবে সাহিত্যে লিপিবদ্ধ করে গেছেন যা এখনো পাঠক মননে গভীরভাবে দোলা দেয় ভাবতে শেখায়। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্য কে তার কালজয়ী সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করে ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণ মৃত্যুবরণ করেন। কেবল 'পথের পাঁচালী'ই নয়, তাঁর প্রায় সব লেখাই আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন পাঠকেরা। যাপিত জীবনের জঠরযন্ত্রণা, দুই চোখে দেখা বিচিত্র ঘটনা, অর্জিত অভিজ্ঞতা—সবই মুখ থেকে কাগজে-কলমে স্থানান্তর করে গেছেন তিনি। তাই তো আজও একইভাবে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে তিনি সমাদৃত। এখনো বাঙালি পাঠক মননে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সমানভাবে পঠিত ও প্রশংসিত ।
================
হাবিবা খানম- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন