Featured Post
স্মৃতিগদ্য // সুবীর ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শারদীয় আবহে টুকরো কথা
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি এ বছর । ফেব্রুয়ারির শেষে যখন শারদীয় সংখ্যার জন্য গদ্য লেখায় হাত দিয়েছি তখন কে জানত এ বছর সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাবে । শক হুন বর্গি এদের লুণ্ঠনে মানুষ যেভাবে দিশাহারা হয়ে যেত এক অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবী একপ্রকার অবরুদ্ধ । লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণনাশ । যাতায়াত ব্যবসা বাণিজ্যের পথ অবরুদ্ধ । এ হেন পরিস্থিতিতে এ বছর দুর্গোৎসব হবে কী না সংশয় ছিল । যাই হোক্ , মানুষের আবেগ ও এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত বিপুল আয়ব্যয়ের কথা মাথায় রেখেই স্থির হয়েছে পুজো হবে । নিয়মবিধিও পালন করতে হবে করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ।
এ বছর তাই পুজোর সেই উন্মাদনা নেই । মানুষের মন ভালো নেই । বহু বাড়িতে প্রিয়জন হারানোর শোক । তবু জীবনকে এগিয়ে যেতে হবে । সংসারচক্রের এটাই নিয়ম । এ বছর আবহাওয়া কেমন থাকবে জানি না। বাতাসে হেমন্তের আভাস পেতে শুরু করেছি । এ বছর ঋতুচক্রের ভারসাম্য অনেকটা ফিরে এসেছে । সুষম বৃষ্টি হয়েছে । অবশ্য আমফানের মতো মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ও কিছু কিছু স্থানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় বিপুল ক্ষতিসাধন করে গেছে মানুষের ।
এবার এ সময় আকাশ খুব নীল । আমাদের ছোটবেলায় পুজোর সময় এ রকমই নীল আকাশ দেখতে পেতাম । পুজোর দিনগুলিতে বৃষ্টি খুব একটা পেতাম না । বিজয়া দশমীর পর ভোরের ট্রেন ধরে যখন চাকুরিজীবীরা কর্মস্থানে ফিরতেন তখন তাঁদের অনেকের গায়ে হালকা শীতবস্ত্র দেখা যেত । বাতাসে হেমন্তের গন্ধ । ধানক্ষেতে হেমন্তের শিশির পেয়ে ধানের ছড়া তৈরি হবে । শীতকাল আসছে । শীতকাল বাঙালির ঘরে পার্বণের কাল । নতুন ধান্যে হবে নবান্ন । মানুষের বলয় থেকে দুর্যোগের ঘনঘটা কেটে যাক্ । বীজাণু পরাভূত হোক্ । জগৎ ও জীবন আবার স্বাভাবিকতা পাক্ –এই হোক্ আমাদের সবার কামনা ।
(২)
আমাদের ছোটবেলায় এ রকম নানা কম্পানির জামাকাপড় পাওয়া যেত না । বাড়ির সব ভাইদের জন্য একই থান থেকে কাপড় কেনা হত । ফলে একই রঙের জামা দেখলে সবাই বুঝে যেত এরা সব এক বাড়ির ছেলে । তখন টেরেলিন , টেরিকট, ডেক্রন এ সব কাপড়ের নাম খুব শোনা যেত । পুজোর ছুটি হবার প্রাক্কালে আমাদের স্কুল ম্যাগাজিন বেরোত । সে পত্রিকায় আমার লেখা ও নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পেলে সে যে কী আনন্দের হত তা বোধহয় বিশ্বজয় করার আনন্দের থেকে কিছু কম নয় ।
( ৩ )
আমি তখন স্কুলের ছাত্র । দু'চারটে লাইন লেখার চেষ্টা করি । নিজে কবিলেখক হব কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি । তবে হ্যাঁ একটা স্বপ্ন দেখতাম -- সম্পাদক হব। নিজের একটা পত্রিকা থাকবে । কিন্তু আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে আমাদের গ্রামদেশে ছাপাছাপির কথা তো প্রায় দিবাস্বপ্নই বলা যায় ।
আমার এক বন্ধু ছিল মানিক দাস । সুন্দর হাতের লেখা ছিল তার । সে আর আমি একদিন শুরু করে দিলাম হাতেলেখা চালাচালি পত্রিকা । দুটো ফুলস্কেপ কাগজ জুড়ে আকারে বড় করে খানিকটা সংবাদপত্রের চেহারা দেওয়া । সেই পত্রিকার পাতাগুলো আমরাই এঁকে লিখে ভরাতাম --আমার কাগজটা আমি , মানিকের কাগজটা মানিক । নানান উদ্ভট কল্পিত খবর লেখা হত নিজস্ব সংবাদদাতার নামে । একটা উদাহরণ দিই । একদিন প্রবল ঝড়বৃষ্টি হল । আমি কাগজে খবর বার করলাম— 'গতকালকের প্রবল ঝড়ে মানিক দাসের পড়ার টেবিল রাস্তা দিয়ে বৃষ্টির জলের বন্যাতে ভেসে যেতে দেখা গেছে । সেই টেবিলে চেপে স্কুলফেরত কয়েকটা বেড়ালবাচ্চা নিরাপদে বাড়ি এসে পৌঁচেছে' । সঙ্গে ম্যাচিং রঙিন ছবি । এই কাগজ চালাচালির আনন্দ গ্রাম্যসন্ধ্যার অন্ধকার নিঝুম পরিবেশকে বেশ সতেজ করে তুলত ।
কালের নিয়মে একদিন সেই উৎসাহ নিভে গেল । আমরাও পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম । তার দু'দশক পর একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলাম। নাম—উজ্জ্বল একঝাঁক । সে পত্রিকা এখনও চলছে ।
আমার বয়স দিগন্তের দিকে এগুচ্ছে । স্বপ্ন দেখার কোনো বয়স হয় না । স্বপ্নের কোনো এক্সপায়ারি ডেটও হয় না। আমার স্বপ্ন আমার ডালভাতের জীবনে মিশে রয়েছে ।
( ৪ )
চার মূর্তি সিনেমাটা মনে আছে ? এক সাধুবাবা এক হাঁড়ি রসগোল্লা টেনিদাদের নজর থেকে বাঁচানোর জন্য বলেছিলেন ওতে যোগসর্প আছে । আমারও প্রায় এক যোগসর্পের হাঁড়ি বয়ে নিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল । তখন এত সুন্দর প্যাকেজিং-এর চল ছিল না । মানুষজন আত্মীয়ের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যেতেন হাঁড়িতে । আমি তখন কিশোর । বাবা তাঁর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি চলেছেন । সঙ্গে আমি । আর বিশাল এক হাঁড়িতে বড় বড় বোঁদের লাড্ডু । অতএব মুখ বন্ধ সেই হাঁড়ির, হাঁড়ি না বলে কলসি বলাই ভালো, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর । লোক্যাল ট্রেনে ভিড় হয় খুব । তার ওপর স্থানীয় প্ল্যাটফর্ম ট্রেনের দরজা থেকে অনেক নীচে । বেশ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে তবে নামতে হয় । নামার সময় এক হাতে কলসি নিয়ে নামতে গিয়ে আর একটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই আর কী । ভাগ্যের জোরে সামলে নিয়েছিলাম । এ সব ক্ষেত্রে যে প্রথম জনকে আগে নামতে হয় এবং মালপত্র অন্য জনকে ভিতর থেকে এগিয়ে দিয়ে তারপর নিজে নামতে হয় সে কথা না আমি জানতাম না আমার বাবার মাথায় এসেছিল । নামতে না নামতেই এক পুলিশ হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল-- ইস মেঁ ক্যায়া হ্যায় ? আমি হিন্দি বুঝলেও বলতে পারতাম না । তা ছাড়া আমি ভাবলাম ট্রেনে কলসি নিয়ে যাওয়া বোধ হয় বেআইনি । তবু সাহস করে পালটা জিজ্ঞেস করলাম—কেন ? পুলিশটা বোধ হয় বাংলাভাষায় স্বচ্ছন্দ ছিল না । আর না ঘাঁটিয়ে অন্য দিকে চলে গেল । তখনো চার মূর্তি সিনেমাটা দেখিনি । দেখা থাকলে বলতে পারতাম—যোগসর্প ।
( ৫ )
এক সময় বিজয়া দশমীর পর পরস্পর সাক্ষাৎ করার রেওয়াজ ছিল । দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেলে আমরা পরদিন সকাল ন'টা নাগাদ আত্মীয় বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি পরিক্রমা করতাম । প্রথা অনুযায়ী বড়দের প্রণাম , ছোটদের আশীর্বাদ করার নিয়ম । আমরা নিজেরাই তখন ছোট । তাই আমরা প্রণাম করতাম বেশি , প্রণাম পেতাম কম । তারপরই আসত প্লেট সাজিয়ে মিষ্টি নাড়ু নিমকি পায়েস । মিষ্টি খেতে খেতে সবাই যখন হাঁপিয়ে উঠত এবং পরিক্রমাও শেষ বাড়িতে এসে পৌঁছাত , সেখানে অন্য ব্যবস্থা থাকত । তাই সবার নজর থাকত ঐ শেষ বাড়িটির দিকে । সরকারবাড়ি । সেখানে দেওয়া হত আলুর চপ , পিঁয়াজি , বেগুনি । সঙ্গে অবশ্যই অল্প কিছু মিষ্টি । উৎসাহী দাদারা কেউ কেউ তার সঙ্গে চেয়ে নিত মুড়ি ও কাঁচা লঙ্কা । গাছ থেকে পেড়ে ভাঙা হত বাতাবিলেবু । তা-ও কেউ কেউ খেতেন ।
( ৬ )
আমরা যখন কর্মব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছি অনেকেই পুজোর সময় কয়েকটা দিন নিজস্ব ছুটি নিয়ে পাড়ি দিতেন নৈনিতাল, দার্জিলিং, শিমলা বা পুরী । সরকারী পরিবহণের বাস থেকে যে ভদ্রলোক দুবরাজপুরে নেমে গেলেন গ্রামের বাড়ির বাস ধরবেন বলে , তিনি আওয়াজ খেয়ে গেলেন—হয়ে গেল দশ টাকায় পুজো ভ্রমণ । তখন ও রকমই বাসভাড়া ছিল । সে সব মন্তব্য কেন জানি না হজম হয়ে যেত । এমনই মজা পুজোর ছুটির । পুজোর আবহই সহিষ্ণু হতে শেখায় ।
প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করেন—পুজো সংখ্যা কী কিনলেন ?
n কী কিনব ! এখন আর সে উত্তেজনা নেই । তখন এক একটা পুজো সংখ্যা বেরুবার অপেক্ষায় আমরা বসে থাকতাম । কী লিখবেন তারাশঙ্কর বা নরেন্দ্রনাথ মিত্র ।
প্রায় তিন দশক আগে আমার কবিবন্ধুদের বিজয়ার শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছিলাম ছাপানো কার্ডে । সেখানে যা লিখেছিলাম সেই কবিতাটিই এখানে আবার তুলে ধরছি—
এখন দুপুরে রোদ হালকা কম্বলের মতো
আঁটকে আছে গায়ে ;
এখন যোজন পথ অনায়াসে
হেঁটে আসা যায় ।
কোজাগরী পূর্ণিমার সাতদিন আগে
এখন খণ্ডছায়া দালানের দোতলায় ঘষা খায় ।
ভদ্রতার বাড়াবাড়ি এখন চলবে কিছুদিন—
ধূলিময় ক্লাসঘরে প্রতিশ্রুতিপিচ্ছিল সুর
এখনো শুনতে পাওয়া যাবে ।
( ৭ )
খুঁজে পেলাম ১৯৯৫ সালের একটা পাক্ষিক সংবাদপত্র । পুজোর সময়কার । সেখান থেকে একটা অংশ হুবহু তুলে এ লেখা শেষ করছি ।
"গত পুজোয় চোখে চশমা দিয়ে শারদসংখ্যা কাল্পনিক পড়ছি । এমন সময় একটি মেয়ে এসে আমাকে বিজয়ার প্রণাম করল । চিনতে পারিনি । পরিচয় দিতে জানলাম প্রথম যৌবনে যে মেয়েটিকে ভালোবাসতাম এ মেয়েটি তার কন্যা" ।
সুবীর ঘোষ // ৩০১ আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্ট // গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর // দুর্গাপুর –৭১৩২১২ // চলভাষ---৯৯৩২৬৪০৯৪৯
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন