ছবি গ্রাম -- রিকিসাম
সঞ্জীব রাহা
আজকের এই বিষন্ন মনে ভারাক্রান্ত করোনা কালে চলো বেড়িয়ে পড়ি। ছোটবেলা থেকে আমাদের বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তর্ক-বির্তকের মূল বিষয় ছিল পাহাড় না সমুদ্র ? আমরা বরাবর পাহাড়কে ভোটদিয়ে জিতিয়ে দিয়েছি। এই দুঃসহ গরম, প্যাঁচপেঁচে ঘাম আর খসখসে ঘামাচির হাত থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাঁচবার একমাত্র উপায় পাহাড়কে নির্বাচিত করা। আবার সেই পাহাড় যদি হয় ঘরের পাশে আরশি নগর তবে-তো কথাই নেই। শিলিগুড়ি থেকে সটান চলে আসো কালিম্পং। ব্যাস্ এখানে এলেই তোমার সব কর্তব্য শেষ। এবার এখানের লাভা রোড ধরে আঠারো কিলোমিটার এগুলেই পৌঁছে যাবে ৬৪১৪ ফিট ওপরে পাহাড়ি হ্য্যমলেট ছবিগ্রাম রিকিসাম এ।
ছবি গ্রাম রিকিসাম
এবার বলি কেন ছবি-গ্রাম ? এখানে আসতে গেলে তোমাকে পেরুতে হবে বিশাল-বিশাল পাহাড়, ঘন বন-জঙ্গল (নেওড়া-ভ্যালি অভয়ারণ্য), নদী আর ফুলের সমুদ্র। তাইতো রিকিসাম মানেই দূষণমুক্ত বহুমাত্রিক এক জলজ্যান্ত পটে লিখা ছবির চলমান প্রদর্শনী। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বাস ছাড়তেই একটানে শিলিগুড়ি শহরের জ্যাম--জেলি পেরিয়ে সেবক রোড ধরে বাঘপুলকে ডাইনে রেখে মাত্র আড়াই ঘন্টায় কালিম্পং। এখান থেকে আঠারো কিলোমিটার দূরে আমাদের ছবি গ্রাম রিকিসাম। চির,ওক,সাইপ্রাস,পাইন ও ধুপিবন আর রডোড্রেনডনের মিষ্টি সুবাস গায়ে মেখে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট্ট সেই গ্রাম রিকিসাম। ছোট বলে কিন্তু তাকে অবজ্ঞা কোরও না যেন ? দেখবে তোমার অজান্তেই কখন যেন মেঘ বালিকা পেছন থেকে ছুট্টে এসে তোমায় ছুঁয়ে দিয়ে বলবে আউট। আরে আমাদের মত সমতলের বাসিন্দারা এমনভাবে বারবার আউট হতেই তো রিকিসাম আসে। তোমরা যাঁরা একটু অফ-বিট ঘুরতে ভালবাস তাঁরা কিছুদিন এখানে থাকো, চারপাশটা একটু চোখবুলিয়ে নাও দেখবে মেঘ পরিবারের সকলের সাথে ভীষণ ভাব হয়ে গেছে।
কী দেখবো ?
আসলে বলা ভাল কী দেখবোনা ? ডান দিকে ঘোরো দেখবে ঝুলনযাত্রার মত পাহাড়ের মাথায় আবার একটা পাহাড়ের ধ্যানগম্ভীরএকরকম দৃশ্যপট। আবার ওই জায়গা থেকে বাঁদিকে তাকাও দেখবে ঘন সবুজে ঘেরা পাহাড়ী জঙ্গলের বাঁকেবাঁকে এক অপার রহস্য প্রকৃতির মূর্ত প্রতীক হিসাবে ধরা দিচ্ছে। পিছনের পাহাড়ি পথে বিশ মিনিটের চড়াই পথে পয়দল উঠে যাও দেখবে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথায় সোনার টোপর পরে তোমায় হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। সামনে মেঘের রাজ্য। আসলে এটা রিকিসামএর ভিউ পয়েন্ট। ৩৬০ ডিগ্রি ভিউতে তুমি দেখবে নেপাল, ভূটান, টিবেটান হিমালয় সহ ডুয়ার্সের সমতল ভূমি ও কালিম্পং এর সব পাহাড়। এখানে ১৯০২ সালে ইংরেজদের তৈরি ফরেস্ট বাংলো ছিল যা এখন ভেঙ্গেচুরে ভূত-বাংলো তে রূপান্তরিত হয়েছে। আছে পুরোনো মেটালিক জিপ চলা রাস্তার আভাসটুকু হিলটপ পর্যন্ত।
এবার চলো তোমায় নিয়ে রিকিসাম থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পথ পরিক্রমায় দাঁড় করিয়ে দিই ডামসান ফোর্টের (Damsung Fort) সামনে।ইতিহাস বলছে ১৬৯০ সালে লেপচা রাজা গিয়াব আচুক ( Gyabo Achuk) এই দূর্গ তৈরি করেন।কথিত আছে রাজার ছিল বহু অলৌকিক ক্ষমতা। কিন্তু পাশের দেশ সিকিম ও ভুটানএর ড্রুক সম্প্রদায়ের উপুর্যপরি আক্রমণে ও ছলচাতুরীর মাধ্যমে লেচারাজ আচুক পরাস্ত হন। ইন্দো-ব্টিশ ওয়ার (১৮৬৪) এর সময় ইংরেজরা এই দূর্গের দখল নিশ্চত করে। পাহাড়ের উপরে দেখি জলের উৎস। কথিত আছে লেপচা সম্রাজ্ঞীর এটা স্নানাগার ছিল যা পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সিপাহিদের ঘোড়ার জল খাওয়ার জায়গা বলে চিহ্নিত ছিল। এমনিতেই পরিত্যক্ত এই দূর্গ কালের নিয়মে ও ২০১২ সালের ভূমিকম্পের পর এখন দু'একটা দেওয়াল বিনা সমগ্র দূর্গটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে । প্রতি বছর ২০ ডিসেম্বর এই ডামসান ফোর্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে লেপচা রাজা গিয়াবো আচুকের জন্মদিন পালন করা হয়। সেই উপলক্ষে ফোর্ট প্রাঙ্গণে বসে একদিনের মেলা ও ধর্মীয় পূজার্চনা। বহু দূরদূরান্তর লেপচা সম্প্রদায় সহ সাধারণ মানুষের ঢল নামে পাহাড়ের মাঝে। কিন্তু এই জঙ্গলের এই পথটি হ'ল বার্ড ওয়াচিং এর স্বর্গ রাজ্য। চুপচাপ পায়ে-পায়ে বনের পথে পেয়ে যাবে হিমালয়ান বুলুবুল,ভার্ডিটার ফ্লাইক্যাচার, গ্রিণব্যাকড্ টিট, ইণ্ডিয়ান রবিন,ব্লু ফ্রণ্টেড রেডস্ট্রাট পিপিট, অ্যাসলে পিনিয়া ইত্যাদি-প্রভৃতি বহু পাখ-পাখালি। শুনবে তাদের শিশ-কলকাকলি। দিনের বেলাতেও শুনবে বিভিন্ন ঝিঁঝি পোকার একটানা বিভিন্ন শব্দকল্পদ্রুম । পর্ণমোচী বৃক্ষে গড়া ভার্জিন ফরেস্ট নেওড়া ভ্যাযাচ্ছে না ভয় লাগা লি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত রিকিসামে আছে উত্তুঙ্গ পর্বত, গভীর -গহন অরণ্য, তাই পশুপক্ষী থাকবেনা --তাই কখনও হয় ? এখানে আছে হিমালয়ান রেড -পাণ্ডা,কালো ভালুক, হরিণ। তুমি তো জান হরিণ থাকা মানেই লেপার্ড সেখানে থাকবেই থাকবে। এমনকি গত বছর এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আস্ত এক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি তুলে পঁচিশ হাজার টাকা ইনাম পেয়েছে। জলবায়ু এখানে একশো শতাংশ দূষণ মুক্ত। কটা দিন ছোট্ট ছবি গ্রাম রিকিসাম এলে পায়ে পায়ে হেঁটে এখানকার গ্রামের মানুষের আতিথেয়তায় আপ্লুত না-হয়ে পারবে না। ইচ্ছে করলে যাও লাভা (১৩ কিলোমিটার)সেখান থেকে দু'কিলোমিটার এগিয়ে একটু নীচে নেমে দেখ চেঙ্গি ফলস্ তার অপরূপ জলতরঙ্গ বাজিয়েই চলেছে একটানা। যেতে পরো ৩২ কিলোমিটার দূরে লোলেগাঁও । এখানে আর ঝান্ডিদাড়ায় একটু উঁকি ঝুঁকি মারলে মাউন্ট এভারেস্টেরও দেখা মেলে। একদম হাতের কাছেই রিশপ,পেডং, কালিখাম, ডেলো পাহাড়, রেলি নদীর ঝুলন্ত সেতু।
কোথায় থাকবে?
এটাই তো রিকিসাম গ্রামের ছবি হয়ে ওঠার কাহিনিঃ
এখানে পাশাপাশি দু"দুটো অত্যাধুনিক লজ কাম রিসোর্ট। একটি স্বর্ণাক্ষর অপরটি হামরো। এর পাশেই আরও একটি নির্নীয়মান। লকডাউনের নিয়ম মেনে এখানে অত ভিড়ভাট্টা নেই। আমরা জানি পাহাড়ের উঁচুতে জলের কষ্ট আছে। তাই বহু টাকা খরচ করে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে পাইপ লাগিয়ে জলের ব্যবস্থা করছেন মালিক রোজেন রাই ( +91 94341 42719 ) । মোট নয়টি ঘরের প্রতিটিতে ৪-৫ জনের জন্য সুন্দর গদি আঁটা খাট ডিভানে অনায়াস ব্যবস্থা হয়ে যাবে।সব ঘরগুলোই কাঠের দেওয়াল কাঠের মেঝে কাঠের সিলিং করা, আলমারি ড্রেসিং টেবিল দিয়ে সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো। কোমড দেওয়া ইউরোপিয়ান টয়লেট বেসিন সহ অ্যাটাচ বাথ। চাইলে ২ টো ঘর ছাড়া সব ঘরে গিজারে জল গরমে ব্যবস্থা। রোজেনের স্ত্রী সনু লেপচার সকল সময় সকল পরিস্থিতিতে একগাল ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি তোমাকে প্রভাবিত করবেই করবে এ আমি হলপ্ করে বলতে পারি।বাংলা ইংরাজি হিন্দি নেপালি ভাষায় মিশানো সে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাষায় তখন বোল্ড নাহলে আর উপায় নেই।
যোগাযোগঃ রিকিসাম, লাভারোড,
ডাকঃ আলগাড়া, থানাঃ কালিম্পং, জেলাঃ কালিম্পং। পঃবঃ
চলভাষঃ+91 90646 85896, +91 99327 75319
ভাড়া চার বেডরুম ১৫০০ - ১৮০০ টাকা।
অতিরিক্ত লোকের জন্য ৫৫০/- (জনপ্রতি)
ডর্মেটরিতে ৫০০০ টাকা।
প্রাতিদিন ২ টো মিল ও দুটো টিফিন চা জলখাবার মিলে এক একজনের ৫০০ টাকা ( দিনে ডিমভাত রাত্রে চিকেন ভাত)। সাইট সিয়িং এর জন্য আলাদা ভাড়ার গাড়ি ( ড্রাইভার এন. কে রায়, ফোনঃ +91 999339 71250) ও প্যাকড্ লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে।
**************************
সঞ্জীব রাহা,
পাডিয়া মার্কেট,
হাই স্ট্রিট,
ডাকঃ কৃষ্ণনগর,
জেঃ নদিয়া,
সুচকঃ ৭৪১ ১০১ ।
চলভাষঃ ৯৪৭৫১ ৪৭৯৪৭ ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন