...................................
সখি , ভাবনা কাহারা বলে, সখি, . যাতনা
কাহারা বলে
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী 'ভালবাসা '
'ভালবাসা '-
সখি ভালবাসা কারে কয়! সেকি কেবলই
যাতনাময়।
রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতার শেষ প্রতিযোগী 'পিয়াসা ' যখন মঞ্চ থেকে নামল তখন ঘড়িতে রাত নয়টা। এরপর ফলাফল ঘোষণা ও পুরষ্কার বিতরণী উৎসব । প্রত্যেক বারের মত এবারও প্রথম পুরস্কার পিয়াসার ঝুলিতে। সব কিছু যখন মিটলো, তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা পার করেছে । মা নিশ্চয় রাস্তা - বাড়ি করছেন । বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছেন। না হলে এই সব দিন গুলো তে উনি উপস্থিত থাকেন । দেরি না করে পিয়াসা পা চালালো । ওদের বাড়ির সামনের গলি টা অন্ধকার।
হঠাৎ দেখে ' অয়ন "উলটো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে । কাছে যেতেই বলল ''এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম ,কিন্তু কাজটা হল না , তোমার বুঝি কমপিটিশন ছিল? দেখা যখন হয়েই গেল, চলো বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি।''
' পিয়াসা জানে অয়ন ওর জন্যই অপেক্ষা করেছে। গান গাওয়ার সময় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অয়নকে স্টেজে থেকে ও লক্ষ্য করেছে । পিসতুতো দাদার বন্ধু অয়ন। সেই সুত্রেই ওর সাথে পরিচয় । ঠিক এই ভাবেই পিয়াসার জীবনের সঙ্কটপূর্ণ দিন গুলো তে অয়ন ধূমকেতুর মতো এসে হাজির হয়।
একবার ওর পার্ট ওয়ান বাংলা ফাস্ট পেপার পরীক্ষার দিনে হঠাৎ করে বন্ধ্ ডাকে কোনো এক রাজনৈতিক দল। অয়ন না থাকলে সেবার ও পরীক্ষায় বসতে পারতো না। সেবার ওর পরীক্ষার সেন্টারের পাশে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে অয়নের নিমন্ত্রণ ছিল। আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে ওকে পরীক্ষা হলে পৌছে দেয়। কিন্তু আত্মীয়রা বাড়ির সঠিক ঠিকানা বা কিরকম আত্মীয় প্রশ্ন করাতে অয়ন নিঃচুপে এড়িয়ে গেছে।
পিয়াসার তখন ফাইনাল ইয়ার, মামাতো দিদির বাড়ি গিয়ে একটা সঙ্গীত অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। দিদি সেদিন ওকে নিজের হলুদ তাঁতের শাড়িতে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিল । সেদিনের বিশেষ অতিথি ছিল সৌম্য । সৌম্য সম্পর্কে দিদির শাশুড়ির দূর সম্পর্কের দাদার ছেলে । বিদেশে কর্মরত। ছুটিতে বাড়ি এসে আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করতে এসেছে । সেই উপলক্ষ্যেই জামাইবাবু পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন । গান শুনে সৌম্য সোজাসুজি পিয়াসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে আসে জামাইবাবুর কাছে ।
সুদর্শন, এন.আর.আই পাত্র, পিয়াসার বাবা মা হাতে চাঁদ পান। খুব তাড়াতাড়ি পাকা কথা ও বিয়ের দিন স্থির হয়ে যায় । নিদৃষ্ট দিনে দক্ষ মেকআপ আর্টিস্টের ছোঁয়ায় লাল বেনারসি আর চন্দনে পিয়াসা যখন অপরূপা, বিসমিল্লা খাঁর সানাই বেজে চলেছে, সারা বাড়ি রজনীগন্ধা আর জুঁইয়ের সৌরভে আমোদিত, ঠিক তখনই খবর এলো ষোলো কিলোমিটার দূরে বরযাত্রীদের বাস আটকে পড়েছে । মাওবাদীরা রাস্তা কেটে দিয়েছে। গলি পথে বাস ঢুকবে না। পিয়াসার বাবার তখন দিশেহারা অবস্থা । পাত্রপক্ষ প্রথমে এতদূর বিয়ে করতে আসতে রাজি ছিল না, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। পিয়াসার বাবা চেয়েছিলেন তার আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু,বান্ধব, পাড়া, প্রতিবেশীদের নিয়ে একমাত্র মেয়ের বিবাহ কার্যটি সম্পন্ন করতে । বাড়িসুদ্ধু লোক ,নিমন্ত্রিত অতিথিরা ছোটাছুটি শুরু করেছেন,, কেউ কিছু সুরাহা করতে পারছেন না। এদিকে লগ্ন সময় প্রায় অতিক্রান্ত হয়,হয়।
হঠাৎ রব উঠল ,"বর এসে গেছে ,বর এসে গেছে ।"
বর কি ভাবে এলো?
অয়ন কুড়ি টা বাইক বাহিনী নিয়ে গিয়ে বর সহ পুরো বরযাত্রীদের নিরাপদে নিয়ে চলে এসেছে । সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উলু ধ্বনি,শঙ্খ ধ্বনি মালাবদলে চারহাত এক হয়ে গেল । পিয়াসার চোখ তখন ইতিউতি খুঁজচ্ছিল অয়ন কেই। পরদিন কন্যা বিদায়ের আগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে বারবার অয়ন কে ডেকে পাঠায় কিন্তু ওর কোন পাত্তা পাওয়া যায় না। বিদায় বেলায় একটা ভীষণ চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে ও গাড়িতে চেপে বসে , ব্যাকুল দৃষ্টিতে অয়নকে খুঁজতে থাকে দুটি চোখ , নাহ্ ত্রিসীমানা মাড়ায় না অয়ন।
এন. আর.আই পাত্রের সাথে পিয়াসা উড়ে যায় ওয়াশিংটন । তারপর শুধু স্বপ্নের ঘোরে কাটতে পিয়াসার দিনগুলো । পিয়াসার মনে একটা কালচার ডিফারেন্সের ভীতি কাজ করছিল। দীর্ঘ দিন বিদেশে থাকার ফলে সৌম্য খুব উদার ও স্বাবলম্বী । সৌম্যর সহযোগিতায় ওর বিদেশে দিন যাপনের ভীতি কেটে যায় । উইক এন্ডে ওরা বেড়িয়ে পরে এদিক,ওদিক। প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে পৌছে যায় ওয়াশিংটনের আনাচেকানাচে । ছবিতে দেখা মেরিল্যান্ড, গ্রেট ফলস্ পার্ক আজ পিয়াসার চোখের পাতায় । এই ভাবে কেটে যায় বছর তিনেক । হঠাৎ ই একদিন খবর আসে সৌম্যর বাবা মৃত্যু শয্যায়। তড়িঘড়ি তে ওরা দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরেই সৌম্য ধুম জ্বর নিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়। জানা যায় ও সোয়াই ফ্লু তে আক্রান্ত । বিমানে সফরের সময় কোন ভাবে জীবাণু সংক্রমিত হয়েছে সৌম্যর শরীরে । একদিকে শ্বশুর মশাই অন্য দিকে অসুস্থ সৌম্য । পিয়াসার তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ।
তিন দিনের মধ্যে নার্সিংহোম থেকে আসে সৌম্যর মৃত্যু সংবাদ । খবর শুনে দিগবি- জ্ঞান শূন্য হয়ে পাগলের মতো মতো নার্সিংহোমের দিকে ছুটতে থাকে পিয়াসা । হোঁচট খেয়ে পরে যায় ।
পিয়াসা কে তড়িঘড়ি তে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। মিসক্যারেজের খবরে এক লহমায় পিয়াসা মূক- বধির হয়ে যায় । জীবন্ত লাশ হয়ে দিন কাটাতে থাকে। ওর মানসিক অবসাদ কাটাতে ডাক্তারের পরামর্শে , বাবা চাকরিতে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে মেয়েকে সাথে করে দেরাদুনে চলে যান । দেরাদুনে যাওয়ার পর কিছুটা শারীরিক ও মানসিক উন্নতি হয় পিয়াসার । একটা মিশনারি স্কুলে চাকরি নেয় । স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ওকে একটা অনাথ আশ্রমের ফাদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ও আশ্রমে যাতায়াত শুরু করে । আশ্রমের বাচ্চা দের মধ্যে ও খুঁজে পায় ওর সন্তান কে। আশ্রমের বাচ্চা দের পড়ানো , গান শেখানোর দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে তুলে নেয় । ছুটির দিনগুলো তে কোন পাহাড়িয়া উপত্যকায় বাচাদের নিয়ে দলবেঁধে চলে যায় পিকনিকে । কখন বা ওদের নিয়ে বিচিত্রা অনুষ্ঠান বা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে । পিয়াসার বাবা ,মা মেয়েকে প্রান ফিরে পেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বাচ্চা দের সাথে ওর দিন গুলো সুন্দর কাটতে থাকে ।
এরপর কেটে গেছে বহু বছর । পিয়াসা চাকরি তে অবসর নিয়েছে । কালের নিয়মে বাবা, মা চলে গেছেন তাও বেশ কয়েক বছর ।
পিয়াসার দাদামশাই এর একমাত্র উত্তরাধিকারী ওর মা। তিনি বিশাল এলাকা জুড়ে একটি বাগান বাড়ি দিয়ে গিয়ে ছিলেন মাকে। এতদিন যাবদ সেটির দেখাশোনা করতেন ওদের বাড়িতে আশ্রিত এক অকৃতদার মামা । তার মৃত্যু তে বাগান বাড়ির দায়িত্ব আসে পরে পিয়াসার উপর। পিয়াসা হঠাৎ করে শিকড়ের টান অনুভব করে । ও ফিরে যায় কিশোরী বেলায় । সৌম্যর যাবতীয় সম্পত্তি ও দেরাদুনের বসতবাড়ি অনাথ -আশ্রম কে দান করে দাদামশায়ের বাড়ি চলে আসে পিয়াসা । ওর ইচ্ছে জাগে শেষ জীবনটা পাহাড় ছেড়ে সমতলে দাদামশায়ের বাড়িতে কাটাবে।
আসার সময় আশ্রমের ফাদার কে বিদায় জানাতে গেলে তিনি বলেন, পিয়াসার জন্য আশ্রমের একটা ঘর সযত্নে রক্ষিত থাকবে । সমতলে ভালো না লাগলে যেদিন খুশি ও দেরাদুনের আশ্রমে ফিরে আসতে পারে ।
পিয়াসার দাদামশায়ের বাড়িটি অনেকটা এলাকা জুড়ে ,বাড়ি সংলগ্ন একটা প্রকান্ড দীঘি । শীতকালে দিঘি তে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা চলে । দাদামশাই শিশুকালে পিয়াসা কে পাখি চেনাতেন। ও এই বাগান বাড়ি তে বাচ্চাদের স্কুল খুলতে চায়। । তারই সাথে একটা গানের স্কুল । বাচ্চারা বাগানে ছোটাছুটি করে খেলা করবে, পাখি দেখবে।
,পিয়াসা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে , পুরোনো কাজের লোক বাগান তদারকিতে ব্যস্ত, এমন সময়ে বাড়ির সামনে একটা দামী বিদেশি গাড়ি এসে দাঁড়ায় । শহরের নাম করা প্রোমোটর সাহেব দেখা করতে চান পিয়াসার সাথে । তিনি একটা টাউনশিপ্ তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছেন। টাউনশিপটি বাস্তবায়িত করতে পিয়াসার বসতবাড়ি সহ দিঘিটি তাঁর চাই। দিঘিতে আবাসনবাসীর জন্য সুইমিং পুল হবে। পিয়াসার বাগানে হবে তৈরী হবে কোঅপারেটিভ স্টোরস ।
টাউনশিপের নাম""পিয়াস্ সিটি"।
এর পরিবর্তে তিনি পিয়াসা কে দেবেন ওয়েল ডেকোরেটিং একটা থ্রি বেড রুম ফ্ল্যাট । নীচের তলার একটা ফ্ল্যাট মডিফিকেসন করে গানের স্কুল খুলে দেবেন। পাশের জমিতে থাকবে সুসজ্জিত মন্টেসরী স্কুল । তাতে ইনডোর গেমস , সিকিউরিটি থাকবে। পিয়াসার স্কুলের বাচ্চারা আবাসন সংলগ্ন পার্কে খেলতে পারবে। এরপরও পিয়াসার ব্যাঙ্ক একাউনটে জমা পড়বে বেশ কয়েক লাখ টাকা । পেশাদারি কায়দায় তিনি বোঝাতে থাকেন যে তিনি পিয়াসা কে কোনমতেই ঠকাচ্ছেন না । এসব কথা কিছুই পিয়াসার মাথায় ঢোকে না, ও দেখতে থাকে রিমলেস চশমা, রূপালী ব্যাকব্রাশ করা চুল ,ভারিক্কি চেহারা , দামী বিদেশি গাড়ির আড়ালে সেই কোঁকড়া চুলের উজ্জ্বল চেহারার লাল সাইকেলের রোগা ছেলেটিকে।
সকাল বেলায় শহরের নামকরা ব্যবসায়ী অয়ন চৌধুরি করলার রসের গ্লাস হাতে তার বাড়ির লনে পাইচারি করছেন, এমন সময় তার ব্যক্তিগত আইনজীবী এসে হাজির হল। অয়ন চৌধুরি একজন সৎ , জনদরদী ব্যবসায়ী । তিনি কয়েক জন দরিদ্র ছাত্রের পড়াশোনার খরচ বহন করেন। এছাড়া ও তিনি বিভিন্ন চ্যারিটেবেল সংস্থায় ,বন্যার ত্রাণে , পথশিশুদের সেবায় মুক্ত হস্ত দান করেন । শহরের মানুষ জন তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে । তবে কোনদিনই তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চান না।
আইনজীবী চক্ষু বিস্ফারিত করে তাকে একটি আইনের কাগজ ধরিয়ে দেন। তাতে লেখা আছে,
'''শ্রীমতী পিয়াসা মিত্র তার বসতবাড়ি ও দিঘি সহ জায়গাজমি শ্রী অয়ন চৌধুরি কে দান পত্র করেছেন। ""
চমকে ওঠে অয়ন , পিয়াসা মিত্র। পিয়াসা .......... পিয়াসা .............. পি....... য়া .....সা...............
..
পিয়াসা কে সেদিন ও চিনতে পারেনি। ছুটে যায় পিয়াসার বাড়ি । গিয়ে দেখে সেখানে তালা ঝুলছে । ধুস্ ,চাবি তো অয়ন কাছেই । আইনজীবী ওকে চাবি হস্তান্তর করেছেন । পুরোনো কাজের লোকের কাছ থেকে জানতে পারে , পিয়াসা আজ দুন এক্সপ্রেসে দেরাদুন ফিরে যাচ্ছে । অয়ন গাড়ি নিয়ে পাগলের মতো ছুটে যায় হাওড়া স্টেশন ।
দুন এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণীর এ . সি কম্পার্টমেন্টে নিজের সিটে গুছিয়ে বসে হঠাৎ জানালার কাচের ভিতর দিয়ে পিয়াসা দেখে অয়ন উৎভ্রান্তের মতো প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে ওকে খুঁজে চলেছে। মনে পড়ে যায় ওর কন্যা বিদায়ের দিনটির কথা। সেদিন ওর দুটি চোখ পাগলের মতো খুঁজে ছিল শুধু অয়নকেই। শুধু একটি বার......
ও তাড়াতাড়ি দুপাশের পর্দা টেনে দেয় । পিয়াসার দুচোখে বয়ে যাচ্ছে শ্রাবণের ধারা । ট্রেন হাওড়া স্টেশন ছেড়ে দেরাদুনে দিকে রওনা হয়।
------------------------
মৌসুমী দত্ত ।
চিত্তরঞ্জন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন