শিরোনাম-অভিমান
শ্মশানে বাবার শরীরটা ছুঁয়ে বসে আছে শৈবাল। আর কিছুক্ষন পরে মানুষটা মুছে যাবে পৃথিবী থেকে। যে শরীরটাকে এতদিন বাবা বলে জেনে এসেছে সেই শরীরের সাথে তার সমস্ত রাগ, মান, অভিমান সবকিছু হারিয়ে যাবে চিরতরে। গঙ্গার জল বয়ে যাচ্ছে তিরতির করে। বৈকালিক শীতল হাওয়া স্পর্শ করতে পারে না চোখের নীচে জমে থাকা অশ্রুর শুকনো দাগ। চারপাশে সকলের ব্যস্ততা।কানাঘুষোয় ভেসে আসছে কথা। সবার অনুসন্ধিৎসু মন সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরটাকে জরিপ করছে। তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছে কারন। শৈবাল কেও বিঁধে যাচ্ছে কৌতুহলী তীর। শৈবাল গুম হয়ে বসে আছে।তার ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন-কেন বাবা কেন, এত বড় একটা পদক্ষেপ নিয়ে কেন আমাকে অপরাধী করে গেলে। অদূরে আর একটা মৃত শরীর ছুঁয়ে বসে আছে কারো সন্তান। চোখে তার অশ্রুধারা।শৈবালের মনে হয় কাঁদার জন্য অধিকার অর্জন করতে হয়। সেই অধিকার বাবা তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে চিরতরে। কাল সকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
গতমাসে শৈবালের চাকরিটা গেল। লকডাউনে অনেকে হারাচ্ছিল চাকরি। শৈবাল তাই টেনশনে থাকত। চাকরি খুইয়ে সংসার চালাবে কিভাবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার মধ্যে বাবার চিকিৎসার খরচ। ওষুধ আর অন্য সব মিলিয়ে একটা মোটা অঙ্ক। ধার দেনা করে চালিয়ে নেবে ভেবেছিল। স্ত্রীকে বলেছিল নতুন চাকরি না পাওয়া অবধি একটু সমঝে চলতে। অহেতুক খরচা যেন না হয়। বাবা সেদিন এসে বলেছিল চশমা যেন কিভাবে ভেঙে ফেলেছে। শৈবালের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল, তাই বেশ চিৎকার করে বলেছিল-রোজ রোজ চশমা ভাঙলে খরচা জোগাবার ক্ষমতা নেই। একে তো রোগ বাঁধিয়ে বসেছ, তোমার জন্য আমাকে এবার ভিক্ষে করতে হবে।
-আমার জন্য তুই ভিক্ষে করবি ,সে আমি মেনে নিতে পারব না টুকু।
তারপর কথা কাটাকাটি চেঁচামেচি, শৈবাল রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। স্ত্রী মিনতি ছেলেমেয়েরা যে যার কাজে ব্যস্ত। না খেয়ে দোর দিয়েছিল বাবা। শৈবাল ভেবেছিল মাথা ঠান্ডা হলে বাবা সবকিছু ভুলে যাবে। কিন্তু বাবা যে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেবে সে ভাবতেও পারেনি।
থানা পুলিশ পোষ্ট মর্টেম।কাজের খোঁজ করে বাড়িতে ফিরেছিল,পুলিশ তখন নিয়ে যাচ্ছিল বাবাকে। সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরটাকে ছুঁতে চেয়েছিল। বাবার পা দুটো স্পর্শ করে ক্ষমা চাইতে চেয়েছিল।
গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওই সন্তানের মত সেও বাবার বুকে মাথা রেখে একটু কেঁদে হাল্কা হয়। ছোটবেলায় বায়না করলে বাবা বকুনি দিত। অভিমান করে মুখ লুকিয়ে মায়ের আঁচলের ছায়ায় কাঁদত। কিন্তু বাবা যখন আদর করে কাছে ডেকে গায়ে হাত বোলাত, সেই স্নেহের স্পর্শে সে ভুলে যেত সব অভিমান। সত্যি ই সেও তো যায়নি বাবার কাছে। বাবা যখন না খেয়ে দোর দিয়েছে সেও তো নিজের ভালবাসা মাখা হাত দিয়ে বাবাকে স্পর্শ করে খেতে ডাকেনি। তাহলে বাবা একাজ করত না। সাদা কাপড়ে ঢাকা বাবাকে ছুঁতে পারে না শৈবাল। বাবা যেন তাদের মাঝে অভিমানের সাদা হিমশীতল পর্দা তুলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে চিরতরে।
আকাশে উড়ছে কালো ধোঁয়া। নশ্বর দেহের মান, অভিমান চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেছে। নীল আকাশে মিশে যাবার আগে সেই ধোঁয়া হাতে স্পর্শ করে মাথায় ঠেকায় শৈবাল। মনে মনে বলে মাথায় হাত রেখে বাবা বল তুমি ক্ষমা করেছ আমায়।Mrs. Nandini Pal
CEERI Colony, PILANI -333 031.
Rajasthan (INDIA).
Ph:9460515378
Email: nandinipal1975@rediffmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন