Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

গল্প ।। রণেশ রায়


একই সূত্র


(পূর্বপাঠের পর)


ঊষাদেবী বেশ কিছুদিন ভোগেন। রন্টুর বান্ধবী উনার সেবা যত্ন করে। দরকারে এ বাড়িতে থেকে যায়। ওর বাবা মা প্রায়ই আসেন। মেয়েটির বাবা সুহাস বাবুর বন্ধু ওই পরিবারের হিতাকাঙ্খী। ঊষাদেবীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । বাড়িতে থেকেই এই রোগের চিকিৎসা। যক্ষায় আক্রান্তদের চিকিৎসা হল খাওয়া দাওয়া আর নিয়মিত ওষুধ। মেয়েটি খুবই দক্ষতার ঊষদেবীর  দেখা শোনা করে। এই ব্যাপারটাও পাড়ার কৌতূহলী জনতার চোখ  এড়ায় না। তারা রন্টুর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নির্ভুল সহজ যোগের অঙ্ক কষেন। মুখে মুখেই একে একে দুইয়ের অংকের ফল ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যে ভবিষ্যৎ পরিবারের অঙ্কুর এনারা দেখতে পান। সেটা দুই অর্বাচীন পরিবারের আদিখ্যেতা বলে মনে করেন। এত অল্প বয়সে এই সম্পর্ক নিয়ে বাবামায়ের প্রশ্রয়কে আর যাই হোক অভিভাবক সুলভ নয় বলে মত দেয়। অবশ্য এতে ঊষাদেবীর কিছু আসে যায় না। আর মেয়ের বাবামাকেও আমি নির্বিকার দেখি। এরই মধ্যে মেয়ের বাবামায়ের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে সুহাসের সংগে আমার আর বিপিন মানে মেয়ের বাবার একআক্ষিক সম্পর্কের দৌলতে। দুজনেই সুহাস সম্পর্কে উদগ্রীব তাই দুজনের মধ্যে আলোচনার দরজা খোলাই থাকে। বিপিনবাবুর মেয়ের নাম রীতা। বিপিন বাবু একটা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন। আর্থিক অবস্থা ভালো। কলকাতায় বালিগঞ্জে একটা এপার্টমেন্টে থাকেন। ওনারা আমার বাড়ি আসেন আমরাও ওনার বাড়ি যাই। আমাদের সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার মেয়ের সাথে রন্টু ও রীতারও ভাব হয়। তবে ওদের দুজনের সম্পর্ককে আমার মেয়ে ও তার মা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এ ব্যাপারে আমারও যে রক্ষণশীলতা কাজ করে না তা নয়। তবে আমি মানিয়ে চলি। সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার চেষ্টা করি।


মাস ছয় ভোগার পর ঊষাদেবী ভালো হয়ে উঠেছেন। আগের জীবনে ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এদিকে ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেছে। সেই নিয়ে উনি ব্যস্ত। জীবিকার প্রয়োজনে গানটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমি রন্টুর পড়াশুনার দেখভাল করি। ছেলেটি পড়াশুনায় খারাপ নয়। তবে খুব ভালো নম্বর পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। নম্বর পাবার কৌশলটা সেরকম রপ্ত করে নি।সেই অর্থে ভালো ছাত্রের দলে পড়ে না। তবে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ে। বিশেষ করে গল্পের বই। এটা বোধ হয় বাবা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার কাজ এই ক'মাসে ভালো নম্বর পাবার কায়দাটা যতটা পারা যায় শিখিয়ে দেওয়া। আজকাল প্রশ্নের যা ধরণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি নয় ওপর ওপর জানার প্রয়োজনটা বেশি। এক আধ কথায় বা টিক মেরে যা চাওয়া হয় তার জানান দেওয়া। নিজের জ্ঞান উজাড় করে দেওয়ার দরকার নেই।


আমার বিপিন বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ঊষাদেবী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা হয়ে যায় যার কিছুই জনতাম না। বিপানবাবু সুহাসের পাড়ার বন্ধু ছোটবেলা থেকে। বিপিনবাবু সুহাসবাবুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে গভীরে কিছু না জানলেও ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন যেটা আবার আমি জানি না। সুহাসের বাড়ির সঙ্গে পাড়ার সূত্রে ওদের বাড়িরও যোগাযোগ। সুহাসের এক ভাইয়ের সাথে বিপিনের এখনও যোগাযোগ আছে। বোঝা যায় সুহাসের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা আছে আর তাকে কেন্দ্র করে আকর্ষণ। আর ঊষাদেবী নিজের গুনেই ওদের খুব কাছের মানুষ। সুহাস ঊষাদেবীর বিয়ে থেকে পরবর্তীকালের অনেক খবরই বিপিনবাবু আর বিপিনবাবুর স্ত্রী মিনাদেবী রাখেন। উনাদের কাছ থেকেই জানতে পারি ওদের বিয়ের খবর। বিয়ের পর ঊষাদেবীর গ্রামের স্কুলে পড়াবার খবর। ওখানে স্কুলে চাকরিটা চলে যাওয়ার পর ঊষাদেবী এখনকার বর্তমান বাসস্থানে ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন। 


বিপিনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ছোট সংসার। মা ও মেয়ের জীবন খুবই সাধারণ ছিম ছাম। সেই তুলনায় বিপিনবাবু একটু সৌখিন মনে হয়। তবে সংস্কার মুক্ত খোলা মনের মানুষ। চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল স্ত্রীকে উনি অত্যন্ত সন্মান করেন। মেয়ে বাবা পাগল। পড়াশুনায় মোটামুটি। একটু আবেগপ্রবণ। ভালো কবিতা গল্প লেখে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়লেও বাংলায় আসক্তি। বাংলায় সাহিত্য চর্চ্চা। রন্টুর প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ। যেন এক অধিকার বোধ। রন্টু যেন একান্তই ওর এমন একটা ভাব। অথচ দুজনে সব সময় যে গায়ে গায়ে তা নয়। এক এক সময় দুজনের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক এমন কি হাতাহাতিও হয়। রীতা যেন রন্টুর অভিভাবক বিপিনবাবু আর তাঁর স্ত্রী সেটা যেন উপভোগ করেন। আর দুজনেরই ঊষাদেবীর ওপর অগাধ আস্থা। 


আমার এখন জীবন ঊষাদেবী আর বিপিনবাবুর সন্নিধ্যেই কাটে। স্ত্রীও সঙ্গে থাকে। তিনটে পরিবারকে নিয়ে যেন একটা ত্রিভুজ। আর এই ত্রিভুজের অতিভূজ যেন সুহাস-ঊষাদেবীর পরিবার। সুহাসের অনুপস্থিতিই অতিভুজের বাহুর বাড়তিটুকু যোগ করেছে। সুহাসের প্রতি আমাদের আকর্ষণই তৃতীয় বাহুর বাড়তি অংশটুকু। এখন আর আমার পড়ানোর জীবন নেই। রন্টুর পরীক্ষা হয়ে গেছে বছর দুই হয়ে গেল। এখন ও বারো ক্লাসে পড়ে আমার মেয়ের সাথেই। বিপিনের মেয়েও বিএ ক্লাসে পড়ছে। ও রন্টুর থেকে বড় বলে জানলাম। ও নিয়ে আর আজকাল  আমি ভাবি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে যদিও ওদের সম্পর্ক টা মানতে চান না। ঊষাদেবীও আজ আমাদের মধ্যে একজন। আজকাল ওনার গানের প্রোগ্রাম তেমন থাকে না। আর্থিক টানাটানি চলছে।


দেখতে দেখতে আরও বছর তিনেক কেটে গেল। রন্টু বারো ক্লাস পাশ করে একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছে। রীতা বাংলা নিয়ে এমএ পড়ে। লেখালেখিতে একটু পরিচিতি হয়েছে। ও এখন যেন রন্টুর অভিভাবক। রন্টু এর পর কি করবে না করবে সব ব্যাপারেই ওর কর্তৃত্ব। রন্টুর সঙ্গে সম্পর্কে যেন নতুন মোড় নিচ্ছে। কর্তৃত্বটা বাড়ছে কিন্তু বাহ্যিক আবেগটা কমছে। আজকাল রীতার এক সহপাঠীর সঙ্গে রীতাকে প্রায়ই দেখা যায়। রন্টুর সাথে ওর খুব ভাব। রন্টুর ও ভয় ওর কাছ থেকে সাধন যদি রন্টুকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু রন্টু যে সাধনকে হিংসে করে তা নয়। বরং সাধনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারে। রীতাকে নিয়ে খেপায়। আমি ঠিক বুঝি না। আমার বোঝার কথা নয়। আর বুঝেই বা কি করব। বিপিনবাবুরাই তো আছেন। এ ব্যাপারে উনাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। ঊষা দেবীও নির্লিপ্ত। আমার এখানে মাথা ঘামানোর দরকার কি। তাও আমার স্ত্রী মেয়ে মাথা ঘামায়। আমাকে প্রশ্নে জর্জরিত করে যার উত্তর আমার জানা নেই। এ আমার এক বিড়ম্বনা। তাই আমি আজকাল যথাসম্ভব ওদের এড়িয়ে বিপিনবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি।


আজকাল আমার বিপিনের ওখানে বেশি যাওয়া হয় না। শরীরটা খারাপ। আর একটু অলস হয়ে পড়েছি। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তবে ঊষার বাড়ি যাই। সুহাসের খবর নিই। রন্টু মধ্যে মধ্যে আসে। ফোনে বিপিনের সঙ্গে কথা হয়। একদিন বিপিনের সঙ্গে কথা হলো ও আসবে। আমি সময় ঠিক করলাম। ওরা বিকেলে আসবে। রাতে খেয়ে যাবে। 


বিপিন দিনক্ষণ ঠিক রেখে এল। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম । আজ অনেকদিন পর চুটিয়ে আড্ডা হবে। ঊষা আর রন্টুকেও রাতে খেতে বলেছি। আমি আর বিপিন বসার ঘরে বসেছি। ওরা শোবার ঘরে। বিপিনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলার পর ও পকেট থেকে একটা নেমন্তন্ন পত্র বার করল। রীতার বিয়ে। জানতে পেরে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। পাত্র কে? তবে কি রন্টুর সঙ্গে ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেল। রন্টু হলে তো আমি এ বাড়ির থেকে জানতে পারতাম যদিও এ ব্যাপারে ঊষা কোনোদিন মুখ খোলে নি আমিও প্রশ্ন করি নি। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারি নি। বিপিনকে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম। বিপিন জানাল সাধন পাত্র। তখন ওকে আমি বলেই বসি যে আমরা তো সবাই জানি রন্টু পাত্র। পাড়ার সবাই তাই জানে। বিপিন হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে:


"সে কি তুমি জানো না! বাইরের কারো জানার কথা নয় অবশ্য। তবে আমি ভেবেছি যে ঊষা তোমাকে বলেছে। তুমি জান। তাই আমি বলি নি।"


আমি জানাই যে না এ ব্যাপারে আমিও কিছু জানতে চাই নি ঊষাও বলে নি। তবে ওদের মেলা মেশা দেখে সবাই আন্দাজ করেছি এই মাত্র। বিপিন তখন বলে,


" শোন তোমার সব জানা দরকার। পেছনের অনেক কিছু জানার আছে। ঊষা যখন স্কুলে পড়ায় তখন অন্তঃসত্তাকালীন সুহাসের সঙ্গে ধরা পড়ে। জেলে থাকাকালীন ওর মেয়ে হয়। রীতাই সে মেয়ে। ওই অবস্থায় খুব অসুবিধেতে পড়ে। সে মেয়েকে আমরা বড় করার দায়িত্ব নিই। বছর খানেক পরে ওরা ছাড়া পায়। ঊষার আর স্কুলের চাকরিটা থাকে না। কিছুদিন পরে ওদের ছেলে হয়।ওই রন্টু। আমরা আমাদের কাছে রেখেই রীতাকে বড় করি আর ঊষা ছেলেকে নিয়ে তোমাদের পাড়ায় ও বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গানকে পুঁজি করে জীবন চালাতে থাকে। আর সুহাস তো যথারীতি অন্তরীণ। ও ওর কাজ করে যায়। রীতা একটু বড় হলে ব্যাপারটা জানতে পারে । আমিই ওকে জানাই। তখন থেকে ও ভাইকে আগলে রাখে। ঊষার ওখানে ওর দ্বিতীয় বাসস্থান। বাইরের লোকেদের কাছে অন্যরমম লাগে। এই নিয়ে আমি বা ঊষা কেউ মাথা ঘামাই না।" আমি স্তম্ভিত। ঊষাকে আরও ভালোভাবে চিনলাম। আর চিনলাম এই বিপিনকে।








রীতার বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেছে। রীতা এখন সাংবাদিকতার কাজ করে। সঙ্গে সাহিত্যচর্চা আছে। সাংবাদিকতার জগতে স্পষ্ট বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তার সঙ্গে সে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ ও কিছু স্বার্থগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে। আজের বাজারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে সরকারবিরোধী কথা বলতে স্পর্ধার দরকার হয়। সেটা নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে। আর রাষ্ট্রের চোখে বাবা  যখন এক রাষ্ট্রবিরোধী তখন সেটা জানাজানি হলে ও ক্ষমতাগোষ্ঠীর সুনজরে থাকতে পারে না সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত জীবনে ওর একটা অঘটন ঘটে। সাধনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। ওর শিশুসন্তানকে নিয়ে ও বাবা মানে বিপিনের সঙ্গে থাকে। ইতিমধ্যে ওর মা মারা যায় একটা কঠিন অসুখে। বিপিন এখন অনেকটাই মেয়ে নির্ভর। সর্বক্ষণের সঙ্গী নাতনী। এদিকে রন্টু এখন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। বিয়ে করেছে। গান নিয়েই আছে। গানই ওর জীবিকা। আজ এখানে কাল সেখানে গানের জন্য ডাক আসে। তাতে যা রোজগার চলে যায়। বাড়িতে একটা গানের স্কুলও চালায়। ঊষা আজকাল তার মা মারা যাওয়ার পর নাকি ভাইয়ের ওখানে গিয়ে নিয়মিত থাকে। পাড়ায় বেশি দেখা যায় না। আমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় নি। যা খবর পাই রন্টুর কাছ থেকে । রন্টু মাঝে মাঝে আসে। আমার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে আমরা দুজন। বাইরে জগতের সঙ্গে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবে বিপিনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ফোনেই বেশি কথা হয়। কখনও ও আসে। আমিও যাই। আমার আর বিপিনের মধ্যে এখনও অনুপস্থিত অন্তরিনে থাকা সুহাস। জেনেছি ও দীর্ঘদিন জেলবাসের পর এখন বাইরে। তবে মূল স্রোতে নয়। কানাঘুষোয় ওর সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়। বিপিন কিভাবে জেনেছে যে ও বাইরে কোন এক প্রদেশে জঙ্গল অঞ্চলে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে। ও নাকি এক আদবাসী মহিলাকে নিয়ে থাকে। বিয়ে করেছে কি না ঠিক জানা নেই। তবে কোনোটাই অসম্ভব নয়। আমাদের মত ছা পোষা মানুষের কাছে বিষয়টা অকাম্য হলেও এটা অসম্ভব কিছু না। জীবনের নিয়মে এটা ঘটে থাকে বিশেষ করে ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে। তবে ঊষাদেবীর জন্য খারাপ লাগে। ও নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নেয় নি। ওর সঙ্গে দেখা হয় না বিশেষ তাই এ ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজই শুধু করতে হয়। আর সেজন্যই বোধ হয় নিজের সংসার থেকে দূরে ভাইয়ের ওখানে থাকে। আর ভাই নাকি বিয়ে করেনি। দুজনের পক্ষেই তাই সেটাই বেশি সুবিধেজনক। যাই হোক জীবনে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয় তাই ঊষাও বোধ হয় মানিয়ে নিয়েছে।  আমাদের দিন চলে যাচ্ছে।  বিপিনেরও আমার মত অবস্থা। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। এর মধ্যে পৃথিবীতে নতুন এক দুর্যোগ। করোনা দুর্যোগ। সব কিছু থমকে গেছে। চিন্তা ভাবনা বাজার হাট একের সঙ্গে ওপরের যোগাযোগ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নতুন ধরনের জীবনের বিধান। সব কিছুই ওলট পালট। এর মধ্যে সচল কেবল এক ভীতি। হার হীম হওয়া ভয়। কি জানি কখন করোনা ধরে। আর এ নিয়ে নানা গবেষণা। আমাদের মত বয়স্ক লোকেরা আসতে আসতে একা সব কিছু থেকে দূরত্বে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সময় সবই কেড়ে নেয়। নিচ্ছিলও। কিন্তু অল্প বয়স্কদের এ কি জীবন। বাচ্চাদের  মোবাইল কম্পিউটার হাতে শিক্ষা বন্ধুত্ব খেলাধুলো সব। ছেলেমেয়েদের অফিস বাজার সবেতেই অন লাইন। কতদিন চলবে জানা নেই। অনেকে বলেন এটাই নতুন সভ্যতা। ডিজিটাল সভ্যতা। মেনে নিতে হয়। কেউ একে বিজ্ঞান দিয়ে আবার কেউ ধর্ম দিয়ে বোঝে । আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই যে বললাম আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না পারি বিশ্বাস করতে না পারি অবিশ্বাস করে ছুড়ে ফেলে দিতে। অনিশ্চয়তার ভয়টা আমাদেরও গ্রাস করে। ঊষার অনেকদিন খবর নেই। মধ্যে মধ্যে ফোন করত।  সুহাসের শেষ খবর পাওয়ার পর ওর ওপর দুর্বলতা যেন বেড়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই কাজলের মুখটা ভেসে ওঠে। একটা সহানুভূতির ছোঁয়া যেন নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে যায়। আজ সেটার তীব্রতা কেন যেন বেড়েছে। একটু বেলা হতে বেরিয়ে রন্টুর কাছে যাই। এটা ওটা কথার পর ঊষার কথা জিজ্ঞাসা করি। ও জানায় মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই আসতে পারে না। ওই নাকি প্রায়ই যায়। মাকে আসতে বললেও আসতে চায় না। মামার ওখানেই থাকে। তবে চিন্তার নেই। তাও রন্টুকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। বোধ হয় মায়ের শরীর নিয়ে চিন্তা। আর ঊষার সাবেকি অসুখটা তো ভালো নয়। ওটা নিয়ে চিন্তা তো হবেই। তা ছাড়া ওর জীবনে যে ঝড় বয়ে গেল। শেষ জীবনে একটা ধাক্কা খেল। আর ধাক্কাটা আর কারও কাছ থেকে নয়, সুহাসের কাছ থেকে যার জন্য ও জীবনটাকে বলতে গেলে উৎসর্গ করেছে। জীবনে কিছু পায় নি। আশাও  করে নি। আমি মনে মনে ভাবি। 


দিনকতক পরে রীতার ফোন পাই। রীতা এবার ওর বাবার জন্মদিন পালন করবে। এখনকার ছেলেমেয়ের মধ্যে এই উৎসাহটা খুব দেখা যায়। আমরা কোনদিন ঘটা  করে জন্মদিন পালন হতে দেখি নি। আজ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের ছেলেমেয়ে নয় বাবা মায়ের জন্মদিন পালনেও উৎসাহী। ব্যাপারটা মন্দ লাগে না।  ছেলেমেয়েরা আজ বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠ নয় বলে  যে অভিযোগটা করা হয় তা সর্বতোভাবে সত্যি নয়।  আসলে কর্মজীবনের তাগিদে ওদের জীবনধারণে বদল এসেছে। কাজের স্বার্থে অন্য কোথাও থাকতে হয়। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে ওদের আচার আচরণে পার্থক্য আছে।  আর আমাদের যে রক্ষণশীল জীবন তা সবটা ঠিক তা নয়।  তাই নানা কারণে একটা দূরত্ব এসেছে। এর জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী।  যাই হোক রীতার নেমন্তন্নে মন ভরে ওঠে। আজ এই করনার বাজারে হোটেল রেষ্টুরেন্ট করা  যাবে না। বেশি লোকের সমাবেশ বারণ। তাই আমরা দুচারজন ওদের বাড়িতেই মিলব সেই শুভ জন্মদিনে, সেটাই ঠিক হয়। আমি আর স্ত্রী নিমন্ত্রিত। 


আমরা বিপিনবাবুর জন্মদিনে ওদের বাড়ি যাই। রাস্তাঘাটের যানবাহনের অবস্থা খারাপ ভেবে বিপিন তার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সাধারণত  বিপিন গাড়ি বিশেষ ব্যবহার করে না। । গাড়ি থাকলেও খুব দরকার ছাড়া গাড়ি চড়ে  না। আর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওর গাড়ির ব্যবহারটা কমে গেছে। এখন ওটা রীতাই বেশি ব্যবহার করে। মনে হয় রীতা  আমাদের অসুবিধের কথা ভেবে গাড়ির ব্যবস্থা করে। বিপিনের ঘরে ঢুকে দেখি বিপিন আর এক ভদ্রলোক বসে।  এই গোঁফওয়ালা ভদ্রলোককে আমি চিনি না।  অবাঙালি বলে মনে হল। বিপিন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিপিনের মামাতো ভাই।  দিল্লিতে থাকে। ব্যবসা করে।  কথায় হিন্দি টান ।  বাঙালি হলেও বাঙালি বলে মনে হয় না। নানা বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। আর আজ আলোচনায় করনাই প্রাধান্য পায়। রোগটা কি কতটা সংক্রমক কতটা প্রাণঘাতি এসব মিশিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। দিল্লিতে সংক্রমণ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলেও এখনও মারাত্মক রূপ ধারণ করে নি। তবে আতংকিত সবাই। এরই মধ্যে এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি করা প্রচারের বাহুল্যতা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। আলোচনার মধ্যে রীতা চা নিয়ে আসে।  চায়ের পর্ব শেষ হলে কেক কাটার আয়োজন। সবাই বেশ কৌতুক বোধ করি।  আমাদের জীবনে এটা তো কৌতুক বটেই। ছোটবেলায় জন্মদিনে মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার মধ্যেই মজাটা সীমাবদ্ধ থাকত। বাকিটা আদিখ্যেতা বলে ভাবা হত। এর মধ্যে রীতা এসে বসে। ওর সাংবাদিকতা নিয়ে নানা কথা ওঠে।  ওর সংবাদে যে সংবাদ পরিবেশিত হয় তা নিয়ে ও যে অসুবিধের মধ্যে পরে তাও ও বলে।  বেশ কিছুদিন আগে একটা আদিবাসী অঞ্চলে পুলিশের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ব্যাপারটা ও তুলে ধরে। ওখানকার এক নেতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়।  সেই নিয়ে রীতাকে কম ভুগতে হয় নি।  ওকে গ্রেপ্তার করার কথাও ওঠে।  এ নিয়ে বিপিন যথেষ্ট উদ্বেগে। এই আলোচনায় সুমিতবাবু অর্থাৎ নতুন পরিচিত ভদ্রলোকও যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে।  এরপর কেক কাটার পালা। উৎসাহের সঙ্গে সেটা পালন হয়। রীতার ছোট্ট মেয়ে কেক কেটে গান গেয়ে অনুষ্ঠানকে উৎসব মুখর করে তোলে।


কেক পর্ব শেষ হলে আবার আমরা গপ্পো করতে বসি। জানতাম না যে আমার জন্য এরকম একটা রহস্যের উপাদান সংগ্রহ করে রেখেছে বিপিন। আলোচনার মধ্যে হঠাৎ আগুন্তুক ভদ্রলোক গোফ খুলে ফেলে।  মাথা থেকে একটা কৃত্রিম চুলের গোছা খুলে একধারে রাখে।আমি অবাক হয়ে দেখি সুহাস সামনে বসে যাকে আমি বেশ কিছুদিন আগে ঊষার গানের মজলিসে দেখি। আমি আবেগ প্রবণ  হয়ে উঠে আসি ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য।  ও বলে থাক সামাজিক দূরত্বটা বজায় থাক। আবেগ চেপে নিজের জায়গায় বসি। রীতা জানায় কিছুদিন আগে উনার সঙ্গে বসেই ও ইন্টারভিউ নেয়। সেদিন ওনাকে চিনতে পারে নি। ও জানত না বাবার সংগে উনার ভাব আছে।  আর উনি অন্য কেউ নন সুহাসবাবু, রীতার বাবা, যার সম্পর্কে সে বিপিনবাবুর কাছেই জানতে পারে।


তারপর আমাদের মধ্যে নানা  কথাবার্তা শুরু হয়। সেই কলেজের কথা। ইউনয়ন গঠন সুহাসের রাজনীতি এসব।  কাজলের কথাও। কাজলের কথার সঙ্গে ঊষাদেবী উঠে আসেন। আমি বা বিপিন যে কথার জন্য উদগ্রীব সেটা তোলার সুযোগ পাই।  জানতে চাই এখন  সুহাস  কেমন আছে এখন কি করছে। ওর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি। সুহাস  কিছুই গোপন করে না। ওর জেল জীবন তারপরের জীবনের কথা বলে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না। আমি সেটা উস্কে দেবার জন্য ঊষার কথা রন্টুর কথা বার বার তুলি।  কিন্তু আমরা ওর বর্তমান জীবনের কথা যা শুনেছি তা জানতে পারি না । আমাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি তখন ঊষার ওর ভাইয়ের সঙ্গে থাকার কথা ওর অসুস্থতার কথা বলি। সাহস কোথায় কার সঙ্গে থাকে তা জানতে চাই। এবার সুহাস  মুখ খোলে। ও জানায় রাজনীতিগত ভাবে  দলের সঙ্গে ওর মত বিরোধ হয়েছে। ও মনে করে পূরণ ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে দলের কাজে। তবে এখন অনেকেই সেটা মানছে না।এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ করলে দলে ভাঙ্গন ধরতে পারে। তাই সুহাস চুপ করে সরে আছে। ওর আশা দল যখন ভুল বুঝবে তখন আপনা থেকে দূরত্ব কমবে। এ বিষয় গুলো নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকলেও ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা বেশি উৎসাহী। আমি আবার জানতে চাই ঊষাদেবীর খবর কি? উনার চিকিৎসার কি হচ্ছে? সুহাস বলে:


" কেন তোমরা জান না? ও মারা গেছে"

আমরা আকাশ থেকে পড়ি। আমি বলি:


" রন্টু বলল যে ওর মা মামার ওখানে থাকে। ও অসুস্থ"। সুহাস বলে:


" ওটা রন্টু বলে কারণ ওকে সেটাই বলতে বলা হয়েছিল। ঊষা বেশ কিছুদিন হল আমার ওখানে গিয়েই থাকত। সবাই জানত ও একজন আদিবাসী মহিলা আমার সঙ্গে থাকে । দলের নির্দ্দেশে ও ওখানে মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বে ছিল। সেই সূত্রে ওদের মধ্যে রাজনীতির কাজও করত। বছর তিনেক আগে ও যে গ্রামে কাজ করত সেখানে ম্যালেরিয়া হানা দেয়।  ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ওখানে মারাত্মক। তাতে মৃত্যুর হার আজ কবিড থেকে কম নয়। আর সেটা প্রধানত গরিব মানুষের ঘরেই হানা দেয়। তাতে কাজল মানে তোমাদের উষা মারা যায়।  এটা খবরের কাগজে বের হয়। তবে ঊষা অন্য নামে ছিল। ওখানকার বাইরের জগৎ ঊষা নামে কেউ মারা গেছে বলে জানে না। পুলিশ সাংবাদিক কেউ না। এটা বোধ হয় আমার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পার্টির স্বার্থে বিপ্লবের স্বার্থে আমাকে মেনে নিতেই হয়। ওর আত্মত্যাগ অমর হয়ে থাকবে "


আমি আর বিপিন পরস্পর মুখের দিকে তাকাই। এটাই তবে সুহাসের আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে বসবাসের গল্প।  

            

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক