Featured Post
মাদুর, ডোকরা, পুতুল, পট ও মুখোশ-শিল্প প্রসঙ্গে ।। সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
হারিয়ে যাওয়া শিল্প : মাদুর, ডোকরা, পুতুল, পট, মুখোশ
সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
শীত আসছে। কনকনে ঠান্ডায় দুপুরবেলা ছাদে মাদুর পেতে কমলালেবু খাওয়ার মধ্যে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। লোডশডিংয়ের রাত্রে এই মাদুর পেতে ভাই বোনদের লুডো খেলা আর ঝাল মুড়ি খাওয়া। করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে যখন চারিদিকে লক ডাউন,তখন ফিরে এলো পুরোনো সেই দিনের কথা গুলি। দরকারের সময় কিছুই পাওয়া যায়না।বাড়িতে একটিও মাদুর, সত্রঞ্চি নেই। অগ্যতা ই -কমার্সের মাধ্যমে মাদুর কিনতে গিয়ে সাক্ষাৎকার হলো নানান ধরনের মাদুরের সাথে।গুণাগুণ বিচার করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম,যে এতদিন নিজের বাংলা কে জানার চেষ্টা টুকু করিনি।কত বাহারি মাদুর বাজারে পাওয়া যায়।
গভীর ভাবে ভাবিনি যে মাদুর , মোড়া বানাতে কত নিপুণতা লাগে। আজ যখন শৈশব কে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, তখন শৈশবে ফিরিয়ে দেয় এই ছোটো ছোটো জিনিসগুলি।
আমফানের দাপটে চারিদিক বিধ্বস্ত হয়ে গেছিলো। বিদ্যুৎ,জল, মোবাইল পরিষেবা সব বন্ধ হয়ে এক অন্ধকার যুগে চলে গেছিলাম আমরা। এত কঠিন সময়ে হেরে গেলে তো চলেনা। মনকে ইতিবাচক চিন্তায় ফিরিয়ে আনল কিছু হারিয়ে যাওয়া অভ্যাস। গাছ পরিচর্যা , সেলাই বোনাই, রান্না বান্না,গল্পের বই পড়ার মধ্যে দিয়ে মানুষ উঠে দাড়ানোর সাহস পেলো। সেই বইয়ের পাতা ঘাটতে ঘাটতে বাংলার অনেক অজানা তথ্য পেলাম। সেই তথ্য গুলির মধ্যে একটি হলো আমাদের কুটির শিল্প। এই কুটির শিল্প আজ প্রায় লুপ্তপ্রায়। তবে বারে বারে দুর্গাপূজার মণ্ডপের সাজসজ্জায় ফুঠে উঠেছে এই বিরল শিল্প।কোভিড-১৯ টীকার অভাবে মানুষ এাসে রয়েছে।তাই এ বছর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানোর মতন মন হয়ত অনেকেরই নেই। অনেক মানুষের চাকরি নেই। ব্যবসায় ধাক্কা খেয়েছেন অনেকেই। এর সাথে ধাক্কা খেলো বিভিন্ন শিল্পী ও কারিগরদের রুজি রোজগার। এই পূজার সময় প্যান্ডেলে কত থিম ভিত্তিক কারুকার্য থাকে। এই একটি সময়ের জন্য এই শিল্পীরা অপেক্ষা করেন । যেকোনো শিল্পী পারিশ্রমিক এর পাশাপাশি নিজের গুণের অনুরাগী খোঁজেন। এটাই এদের বিশাল মঞ্চ ছিল নিজেদের পারদর্শিতা প্রদর্শন করার। বাংলার শিল্পী ও শিল্পের লেখার মধ্যে দিয়ে বাংলার সংস্কৃতি কে আমাদের মনে যদি বাঁচিয়ে রাখা যায়,তাহলে তো শিল্পী রাও বেঁচে থাকবেন। দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে প্রায়শই সাবেকি কারুকার্য করা হয়। সেই উৎস ধরেই বাংলার হারিয়ে যাওয়া শিল্প নিয়ে আজকের লেখা।
মাদুর শিল্প:
হারিয়ে যাওয়া শিল্প নিয়ে তাহলে প্রথম বলি মাদুরের কথা। ২০১৮ সালে ব্রহ্মপুর বোড়াল সর্বজনীন দুর্গোৎসবে মাদুর দিয়ে মন্ডপ সাজানো হয়। কথিত আছে সিন্ধু সভ্যতা থেকে মাদুরের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে এর বেশি প্রচলন পাওয়া যায় মধ্য যুগে।ইতিহাস বলছে সেই সময় গরিব মানুষেরা মাটিতে মাদুর পেতে শুতেন। মাদুরের ব্যবহার আমরা সকলেই জানি।অধুনা পশ্চিম বঙ্গ মাদুরকাটির জন্য জি আই ট্যাগ পেয়েছে ।এটি একরকম আইন, যার দ্বারা শিল্পকলা কে সংরক্ষিত করা হয়।মেদিনীপুর জেলা মাদুর উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। মাদুর আর সত্রঞ্চি নাকি নবাব আলীবর্দী খাঁ র সময়ে দরকারি বস্তু ছিল। ১৭৪৪ সালে নবাব বাধ্যতামূলক আইন তৈরি করেন জায়গীরদারদের জন্য।আইন অনুযায়ী প্রত্যেক জায়গীরদারকে রাজসভার কাজের জন্যে মাদুর জমা দিতে হতো।
পরবর্তীকালেএই মাদুর বিক্রী করেই শিল্পী অলক কুমার জানা জগৎ বিখ্যাত হলেন।
ডোকরা শিল্প:
মাদুরের পাশাপাশি ডোকরা শিল্প অনেক যুগের সাক্ষী। এই ডোকরা শিল্প দিয়েও মা দুর্গার মন্ডপ সাজানো হয়েছে।
আউশগ্রামের দ্বারিয়াপুরের ডোকরা শিল্পীদের হাতে তৈরি ১০ ফুটের দুর্গাপ্রতিমা ২০১৯ সালে শোভা পেয়েছে কলকাতার বেলেঘাটার একটি পুজোমণ্ডপে। এই দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতে প্রয়োজন হয়েছে ৫ কুইন্টাল পিতল, ৩০ কুইন্টাল কয়লা, ৩০ কেজি ধুনো, ৫০ কেজি মোম এবং কিছু কাঠ।
সুশীল সাখুজা একজন ডোকরা শিল্পী। ইনি জাতীয় পুরস্কার পেয়ছেন ডোকরা শিল্পের জন্য। তবে উনি ছত্তিশগড়ের অধিবাসী। কথিত আছে বস্তারের রাজা নিজের স্ত্রীর জন্য একটি গয়না বানাবেন বলে ঠিক করেন। শিল্পীকার ডোকরার গয়না বানিয়ে রাজাকে দেন, তাতে রাজা খুব খুশি হন এবং সাম্মানিক উপাধী দেন।
বাঁকুড়া জেলার বিকনা গ্রামে বহু বছর আগে ডোকরা শিল্প শুরু হয়েছিল। আগে শিল্পী রা লক্ষ্মীর ভাঁড়, চাল মাপার কুনকে, দেবদেবীর মূর্তি,পশু পাখিদের মূর্তি বানাতেন। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে এসেছে গয়নার বাক্স,কানের দুল,গলার মালা,চুড়ি, খোঁপার কাঁটা,হাঁসুলি। প্রয়াত শিল্পী যুদ্ধ কর্মকার ১৯৮৮ সালে এই ডোকরা শিল্পের জন্য রাষ্ট্র পতি পুরস্কার পান। বর্ধমানের দরিয়াপুর এই শিল্পের জন্য বিখ্যাত।
বাংলার পুতুল:
পূজার মন্ডপ সাজানোর সাথে সাথে আমাদের ঘরেও শোভা পায় নানান ধরনের পুতুল।
এই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কত মৃৎ শিল্পী মাটির পুতুল গড়ে তুলছেন। কথায় আছে "গেঁয়ো যোগী ভিক্ পায় না"। নিজের মাটিতে সন্মান না জুটলেও, বিদেশে এদের খুব কদর।
১৮৫১ সালে ঘূর্ণির এক কারিগর শ্রীরাম পালের তৈরি পুতুল স্থান পেয়েছিল লন্ডনের এক প্রদর্শনে। সেই প্রথম কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য করলো এই বাংলাকে।পুতুলের কথা যখন উঠল,তখন ঘূর্ণির কথা বলতে হয়। ঘূর্ণি একটি জায়গার নাম।এটি কৃষ্ণনগরের পার্শ্ববতী অঞ্চল। ঘূর্ণিতে যে মাটির পুতুল তৈরি হয় ,তার সূত্র পাত হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে। শোনা যায় নাটোর থেকে কারিগর নিয়ে এসে তিনি পুতুল গড়াতেন। সেই পুতুল এখন জগৎ খ্যাত। জলঙ্গী নদীর তীরের মাটি দিয়ে এই পুতুল তৈরি হয়।
ছাঁচে বানানো পুতুল এক সময় খ্যাত ছিল লোকেদের মাঝে। শোনা যায় অমন নিটোল গড়ন বাংলার বাকি দশ মহল্লার পুতুলের থেকে জয়নগর মজিলপুরের পুতুলকে আলাদা স্তরে নিয়ে গেছে। তবে প্রচার না পাওয়ায় আজ এই শিল্প অবলুপ্তির পথে।
বিষ্ণুপুরেও পুতুলের বিশাল নাম ডাক। বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল বা হিম পুতুলের খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে। এই পুতুল গুলো হিঙ্গুল বা হিম এক ধরনের খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। অনেক আগে বিষ্ণুপুরের পুতুলগুলো রাঙিয়ে তুলতে লালচে রঙের এই পদার্থ ব্যবহার করা হত। এই রং দিলে বেশ চকচকে হত পুতুলগুলো। এই কারণেই পুতুলগুলোর এমন নাম রাখা হয়েছিল। এখন শুকনো গুঁড়ো রং দিয়েই হিম পুতুলকে রঙিন করা হয়। হাত দিয়ে কাঁচা মাটিকে টিপে পুতুলের রূপ দিয়ে শুকোনো হয় রোদে। পরে ভেষজ রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। এক আঙুলের মতো হয় এই পুতুলের উচ্চতা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এই পুতুল কাজে লাগে।
পটচিত্র:
এই প্রসঙ্গে উঠে আসে পট চিত্রের কথা। পটচিত্র যেনো বাঙালি রমণীর কপালের লাল টিপ এর মতন শোভা বর্ধন করে এই বঙ্গজননীকে।
আমরা অনেকেই জানি পট কথাটি এসেছে পট্ট কথাটি থেকে।পট্ট মানে কাপড়। অনুমান করা যায় বহু বছর থেকেই পটচিত্র আমাদের বাংলার সাথে জড়িয়ে আছে। এই পটচিত্র যারা বানান তাদের পটুয়া বলে। পৌরাণিক কাহিনী, লোককথা পটচিত্রে পটুয়ারা এঁকে ,গান করে লোকেদের কাছে প্রচার করতেন বহু যুগ আগে। কালীঘাট অঞ্চল এই পটচিত্রের জন্য বিখ্যাত। বিভিন্ন পুজামন্ডপ এই পটচিত্রের আদলে বানানো হয়।
পট বললে পাটের কথা বলতে হয়। সোনালী পাটের নানান দ্রব্য বাজারে পাওয়া যায়। গত বছর বর্ধমান জেলার আলোমগঞ্জের পুজো সেজে উঠেছিল পাটের সাজে।
এই শিল্পটি বেশি দেখা যায় উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিন দিনাজপুর জেলায়।আমরা ইতিহাসের পাতায় পাই ১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড শ্যামসুন্দর সেনকে নিয়ে কলকাতার হুগলি নদীর তীরবর্তী রিশড়া নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুরের নিপুণ শিল্পীদের হাত ধরে সোনালি পাট পরিনত হয় ধোকরা মাদুরে। এই শিল্পের উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থের আর প্রচারের প্রয়োজন, যা লগ্নী করার লোকের অভাব।
মৃৎ শিল্পীরা পশ্চিমবঙ্গের কোনায় কোনায় রয়েছেন,কিন্তু কতটাসমাদর পান তারা? টেরাকোটার মূর্তি,গয়না গড়িয়াহাট এলাকায় বিক্রি হয়। আসল না নকল সে জানি না। তবে মুর্শিদাবাদ যে এর আতুর ঘর, তা জানি। টেরেকোটা শুনলেই অনেকেই পোড়ামাটি বলে থাকেন । সবই যদি এতই সোজা হতো তাহলে, ভ্রমণ পিপাসুরা মুর্শিদাবাদের মন্দিরের টেরেকোটা কাজ দেখতে যেতেন না।
ছউ মুখোশ:
এর সাথে পুরুলিয়ার ছউ মুখোশের কথা না বললে অন্যায় হবে। ছৌ মুখোশের জগৎজোড়া নাম। আনুমানিক দেড়শো বছর আগে, বাঘমুন্ডির রাজা মদন মোহন সিং দেওর আমলে এই মাস্ক বানানো শুরু হয়।আজ এত বছর পথ চলে, সে এখন বাংলার ও বাঙালির পরিচয়।
জি আই আইনের দ্বারা ছৌ মুখোশ,কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ, পটচিত্র,ডোকরা শিল্প কে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব শিল্প বলে রক্ষা করা গেছে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ নিজের সংস্কৃতি কে বাঁচিয়ে রাখতে আইনের দ্বারস্থ হয়ে জি আই ট্যাগের আবেদন করছেন। তবে সেটা করার আগে নিজের সংস্কৃতিকে জানাটা সব থেকে জরুরি।
অনেক জেলাই তো ঘুরলাম এই লেখার মাধ্যমে, তবে মাঝে মাঝে চিন্তা হয় এই প্রজন্মকে নিয়ে। এই প্রযুক্তির যুগে গরগর করে পশ্চিমবঙ্গের জেলার নাম গুলো কজন বলতে পারবে, সে নিয়ে সংশয় রয়েছে। আদৌ কি সব বাঙালি বাংলার মাটি ও বাঙালিয়ানা নিয়ে গর্ব করে! হয়ত করে বা হয়ত করেনা। আম জনতার কাছে বাঙালি মানে রোজকার রান্নায় ভাত আর মাছের ঝোল। খুব বেশি হলে রসগোল্লা,মিষ্টি দই। কলকাতার অধিবাসীরা মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের টপিক এ তর্ক করতে ভালোবাসেন। ওঁরা ওতেই আটকে আছে।এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প গুলো যদি দিশা পায়, তবে আমাদের ইতিহাস আগামী প্রজন্মর মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন