|| জীবন থেকে পালিয়ে ||
সারাদিন খেটে এসে রঘু ঘরের দাওয়ায় বসে পড়ল । শোভা তাড়াতাড়ি জলের লোটাটা এগিয়ে দিল । ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে রঘুর একটু আরাম হল । মালতী দেখতে পায় নি । নইলে এসেই পাপা পাপা করে গলা জড়িয়ে ধরতো ।
মেয়েটার বয়স পনেরো হয়ে গেল ! এখনও খুবই সরল সোজা । তবু বিয়ে দেওয়া দরকার । তার মুলুকে এত বয়স পর্যন্ত মেয়ে কেউ ঘরে রাখে না । কিন্তু ছোট খাটো সংসারে দিতে গেলেও বিশ পঁচিশ হাজারের ধাক্কা । তারপর অন্য খরচ ।
বস্তির অন্য মেয়েদের সাথে দূরে উঠোনে মালতী খেলছে । মুখটা যেন সীতা মাইয়া ! মাথায় তেল নেই,গায়ে সাবান নেই । তারপরেও এমন রূপ । এই রূপই ওর কাল !
দালাল এসে তিনদিন ঘুরে গেছে । চল্লিশ হাজার দেবে । কিন্তু ! মেয়ে বিক্রি ! না এসব আর ভাববে না । দেশের মুলুকে যখন ছিল তখন খুবই অভাব ছিল । কিন্তু এই লোভ ! ছিঃছিঃ ।
যাদব ওর দেশের মুলুকের আদমি । খৈনি ডলতে ডলতে তারও এক কথা ! দালালের কাছে দিয়ে দেওয়াই ভালো । নইলে কবে লুট হয়ে যায় । তাতে জীবন সংশয়,থানা পুলিশ,অপবাদ,অর্থদণ্ড,হয়রানি !
বস্তির দেখভাল করে জগদীশ । তিনদিন এসেছে । মালতীকে নিয়ে দিঘা যাবে । আগাম দুহাজার দেবে । রেটটা নাকি বেশি দিচ্ছে ! রাজি না হলে মালতীকে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে ! মালতীর জন্য ওদের কম ভাড়ায় থাকতে দিয়েছে । নইলে এই ঘরের ভাড়া ষাট টাকা হয় !
রঘু শহর মুলুকে এসে দু বছর কারখানায় কাজ করেছে । কারখানা বন্ধ হয়ে গেল । আয় বন্ধ,মাথার ছাদ হারিয়ে কারখানার বস্তি ছেড়ে,শেষে রিকশা চালিয়ে পেট চালাচ্ছিল ।
তখন মালিকের গ্যারেজের এক কোনে সংসার পেতে কাটিয়েছে । বিনিময়ে তাকে মালিকের গাড়ি সাফাই করতে হত,গ্যারেজ ধুতে হত । আর মালিকের রিক্সা দৈনিক ভাড়ায় চালাতো ।
টোটো আসায় রিকশার বাজার গেল । অগত্যা সে এখন মুটের কাজ করে । বস্তিতে উঠে এসেছে কয়েক মাস হল ।
পরের দিন রঘু খুব সকালে অনিন্দিতা দিদিমনির বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল । দিদিমনিকে দশ বছর রিকশায় স্কুলে পৌঁছে দিয়েছে । খুব রাগি,রাশভারী । রঘু দিদিমণিকে ভয় পায় । একটু নড়চড় হলেই ধমকায় । খুব সময় মেপে চলেন । কিন্তু বিপদে আপদে দিদিমনির সাহায্য সে পেয়েছে । ওই একজনকেই সে বিশ্বাস করে ।
দরজা খুলে দিদিমণি বেরিয়ে এলেন । এই ক বছরে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন ! অবসর নিয়েছেন । রঘুকে দেখে চিনলেন । এবার রঘুর আসার কারণ জেনে ওকে অভয় দিলেন । রঘু কেঁদে ফেলল ।
দিদিমণি ওকে রুটি জলখাবার খাইয়ে শান্ত করলেন । তিন অবিবাহিতা,ঠিক এমনটাই চাইছিলেন । মালতীর সব দায়িত্ব তিনি নেবেন । ওর মাসের মায়না দুহাজার রঘুকে পাঠিয়ে দেবেন । মালতী এখন পড়বে । সময় হলে মালতীর বিয়ের ব্যবস্থাও তিনি করবেন ।
রঘু ছোটবেলা শুনেছে তাদের গ্রামের পাশের অরণ্যে আগে শের ছিল । তাদের চেহারাটা আলাদা । তারা রাতের বেলা হানা দিত । এখন আর নেই ।
কিন্তু শহরের এই জন অরণ্যে শের দিনের বেলা সর্বত্র বিচরণ করে । তাদের চেনা বড় দায় !
শেষ রাত । শহর নিদ্রায় মগ্ন । মালতীকে যথা স্থানে রেখে দুটি প্রাণী গুটিগুটি পায়ে ফিরে চলল নিজেদের জন্মভূমির টানে নিজেদের মুলুকে ।
জন্মভূমি অন্তত তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবে না !
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন