Featured Post
ছোটগল্প ।। অসম সুখ ।। পারিজাত ব্যানার্জী
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বাহ!ভারী সুন্দর তো ওই যুবকটি! এইমুহূর্তে সারা হলঘরের দৃষ্টি যার দিকে নিবদ্ধ। কেউ তার লম্বা কাঁধ পর্যন্ত চুলের অনুরাগে ব্যস্ত, কেউ মজেছে তার নিখুঁতভাবে সৃষ্ট দুই ঠোঁটে। কারও ডুব দিতে মন চায় ওর ঘন নীল দুই চোখের সমুদ্রের আর্দ্রতায় , কেউ শুধুই আকৃষ্ট হয় ওর বলিষ্ঠ শরীরের বাঁধুনিতে। আমি যদিও ওসব কিছুই দেখছি না। এ সব ছাপিয়ে যে স্নিগ্ধতা ওর শিরায় শিরায় প্রবাহিত, আমি কেবল তাকেই ছোঁয়ার চেষ্টা করছি শুধুমাত্র! আমি জানিনা, এই আবেগকে কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়, আমি যদিও মানি, ওর শুভ্র পেলব নিদাগ আত্মার সঙ্গে নিঃসন্দেহে রয়েছে আমার বহুকালব্যাপি পরিচয়!
"মিঃ সেন, ছেলেটি কি অপূর্ব বাজাচ্ছে না ভাওলিনটা? ওর দিক থেকে তো চোখ ফেরানো যাচ্ছে না!"
আমি হাসি বাদল বর্মণের দিকে তাকিয়ে। "চোখ ফেরানো উচিতও নয়! ওর সবটুকুকে আহরণ করার আমি তো মনে করি এইটুকুই পরে থাকে সময়, যখন ও ব্যস্ত নিজের ঐকান্তিক শিল্পচর্চায়!" বেশি কথা আর বাড়াই না। আরেক পেগ হুইস্কি নেওয়ার অছিলায় আমি সরে যাই ওনার সামনে থেকে এরপর।
আসলে এই মুহূর্তটুকু আমার। আমি একলা থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দও এই সময়। যেখানে আমি থাকব আমার সম্পূর্ণ সত্ত্বাকে উন্মোচিত করে, আমার প্রতিটি কণায় কণায় মিশে থাকবে আমার পরিচয়। যে অস্তিত্ব সংকট আজন্মকাল ঘিরে থেকেছে আমায়, তার থেকে সাময়িক হলেও ঘটবে প্রকৃত মুক্তি!
ঠিক এমনই এক প্রবল নিঃসঙ্গতার সময়ই ওই যুবক সবার থেকে দূরে ডায়াসে বসে নিজের ভাওলিনে তুলল সুরের ঝংকার!আহ, অমন বেদনা সত্যিই কতদিন সাধ করে পাইনি আমি! কোনোদিন আদৌ পেয়েছি কি? মনে নেই, হয়তো ঈশ্বরই জানেন!
হ্যাঁ আমি ঈশ্বর মানি। ওনার প্রগাঢ়তায় খুঁজে পাই শান্তি। স্তম্ভিত হচ্ছেন? কেন, সমকামিতার সাথে ঈশ্বরবাদের তো কোনো সম্বন্ধ নেই? যখন কোনো পুরুষ কোনো নারীকে ভালোবাসে, তখন তো কেউ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়না, "তুমি ঈশ্বর মানো?" তবে আমার সঙ্গী নির্ধারণের সঙ্গে কেন এমন জটিল ভাবে জড়িয়ে পেঁচিয়ে যায় এতসব অহেতুক কৌতূহল?
এসবে অবশ্য আজকাল আর আমি অবাক হই না। আমি তো এমন প্রশ্নও শুনেছি, "আচ্ছা, তোমায় দেখতে তো ঠিকঠাকই লাগে, তবে কেন পুরুষ পছন্দ তোমার?" বা "তুমি পৌরুষে আগ্রহী কেন— তোমার কি পুরুষত্বের অভাব?" হাঃ, পুরুষত্ব! ছোটবেলা থেকেই আমি সর্বাঙ্গ সচেতন এক পুরুষের মননই নিজের শরীরে বসত করিয়েছি। নারীর মধ্যে তবু মুক্তির আস্বাদ পাইনি। হ্যাঁ, তারা নিঃসন্দেহে আমার বন্ধু,বোন, জননী— তবে প্রেয়সী— নাঃ, সেরকম কোনো সংযোগ তাদের সাথে আমার ঘটেনি।এটিও কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়াই! হয়তো আমিই সযত্নে এড়িয়ে গেছি তাদের প্রস্তাব, কখনও বিনম্র ভাবে, কখনও রূঢ়তার মোড়কে। তাদের কারও জন্য কিন্তু তেমন কোনও খেদও নেই আমার। একমাত্র শীল্পার সঙ্গে যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল পুরোপুরি অনভিপ্রেত।
শীল্পা আমার নার্সারীর বান্ধবী। একসাথে পাড়ায় স্কুলে সবজায়গায় খেলাধূলা করেছি,পড়াশোনাতেও একে অপরের সাহায্য নিয়েছি নির্দ্বিধায়। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল চূড়ান্ত সখ্যতা। যার ফলে প্রতিটা অনুষ্ঠান উৎসবে একে অপরের সাথে ঘষাঘষি করেই আমাদের বেড়ে ওঠা।
যখন আমার বছর পনেরো বয়স, তখন থেকেই আমি আমার মননের চাহিদাগুলি একটু একটু করে আবিষ্কার করতে শুরু করি। বুঝতে পারি, আর পাঁচজন আমার সমবয়স্ক মানুষের সঙ্গে আমার তফাৎ। ভাবুন তো, অত কম বয়স তখন আমার!নানা, বিশ্বাস করুন, কোনো অজুহাত দিচ্ছি না। তবে সত্যিই বড় বিচলিত হয়ে পড়ি নিজের এই পরে উপলব্ধি করা স্বাভাবিক সব প্রতিক্রিয়ায়। মনে হতে থাকে, আমি 'অসুস্থ' সমাজের এই কঠোর নিয়মাবলীর ফাঁদে পরে। আর তাই প্রাণপণে নিজেকে 'স্বাভাবিক' প্রমাণ করতে আমি শিল্পার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। এক সপ্তাহের মধ্যেই যদিও বুঝে যাই, এ সিদ্ধান্ত অনৈতিক!
মনে আছে, শিল্পা অসম্ভব সুন্দরী ছিল তখন থেকেই। স্কুলের তাবর তাবর ছেলেরা ওর জন্য ছিল উন্মাদ। কিন্তু, আগেই লক্ষ্য করেছিলাম, ও কোনোদিন কাউকে প্রশ্রয় দিত না। 'কেন' জিজ্ঞাসা করলে আরক্ত মুখে মাথা নামিয়ে নিত। ওই এক সপ্তাহব্যাপী নৈকট্যের সময় বুঝলাম, ছোটবেলা থেকেই ও আসলে বোধহয় আমার প্রতিই আসক্ত। সেইটা যদিও বা কথা বলে মিটমাট করে নেওয়া যেত, গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। শিল্পা আবেগোচ্ছ্বাস সামলাতে না পেরে তার বাড়িতে জানিয়ে দিল সব কথা। আর সে রাতেই আমার মা আমার ঘরে এসে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদসূচক ভঙ্গি করে বলল, "আমরা জানতাম, তোরা একেবারে হর পার্বতী জুটি! ছোট থেকেই তাই আমাদের দু'পক্ষের সব ঠিক করা। শুধু তোদের উপর জোর করতে চাইনি কিছু। এবার যখন তোরাই —"
বিশ্বাস করুন, আর ঠিক কি কি বলেছিল মা, তা আজ আর আমার মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, জোর না করলেও আমি কিন্তু সেই বাঁধা পরে গেলাম! অন্য অস্তিত্বের ফাঁদে, অন্য সম্পর্কের দোটানায়।
বেশ কিছুদিন ভয় কোনো কথা বলতে পারিনি কাউকে। এমনকি এড়িয়ে গেছি শিল্পাকেও নানান বাহানায়। বুঝতে পেরেছি, মেয়েটা ভেঙে পরছে পুরো আমার এমন নিরাসক্ত আচরণে, কিন্তু আমার দিকটাও ভাবুন, কোনো উপায় কি আর ছিল আমার তখন?
শেষে মাধ্যমিকের পরের তিনমাসের ছুটিতে যখন দুই পরিবার একসাথে দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আমাদের নতুন সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার অবকাশে, আমি আর থাকতে পারলাম না।
মনে আছে, সবে তখন টাইগার হিলে সুর্যোদয় হচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডা চারদিক। সামনে অকৃত্রিম সৌন্দর্যের পীঠস্থান কাঞ্চনজঙ্ঘা। শিল্পা প্রথমবার সাহসে ভর দিয়ে আমার কানে- কানে বলেছিল সেই আদিম ভালবাসাবাসির মন্ত্র। প্রত্তুত্তরে আমি অস্ফুটে শুধু বলেছিলাম, "শিল্পা, আমি সমকামী।"
ভেবেছিলাম এরপর ঝড় নামবে আচম্বিতে। জীবনের সব খড়কুটো ভেসে যাবে সেই অকাল প্লাবনে। ছিন্ন হবে অনেক কাছের সম্পর্কই। তবু, তেমন কিছুই হল না। নির্বিঘ্নে চারটে দিন কেটে যাওয়ার পর আমরা কলকাতায় ফিরলাম। আর তারপরেই আমাদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ওরা হঠাৎই রাতারাতি স্কুল, পাড়া সব বদল করে ফেলল কারও কিছু জেনে যাওয়ার আগেই।
মা বাবা আজও ওকেই দোষ দেয়। ভাবে, এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই বুঝি আমি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও অবিবাহিত। আমি তাঁদের ভুল ভাঙাতে পারতাম। হয়তো শিল্পার প্রতি করা আমার অবিচারের কিছুটা পরিশোধ হতো তাতে। তবু দুটি ভিন্ন সময়ের এবং যুগের মানুষকে আমার সত্য বোঝানোর মতো কোনো সঠিক পরিস্থিতি আমি খুঁজে উঠতে পারিনি আজও — কিছুটা ওঁদের শরীর স্বাস্থ্য বয়স চিন্তা করে, বাকিটা একান্তই সেই সমাজের জোড়াতাপ্পি দেওয়া ঠিকভুলের অন্তর্দ্বন্দ্বে। আর, কিই বা হতো বলে অশান্তি ছাড়া? মনের মতোন মানুষও আর কই পেলাম এই জীবনে যার জন্য লড়াই করে মেলে ভালোবাসার আস্বাদ?
আজকের ঘটনা অবশ্য ব্যতিক্রম। অনেককেই হয়তো আগে মনে ধরেছে আমার, তবুও এই ভাওলিনবাদকের মতো ঝিমঝিমে মাদকতা এর আগে আমি কারও মধ্যে পাইনি। ওর ওই করুণ সুরের মূর্চ্ছনার যে অভিব্যক্তি, তার সামনে এই প্রথম মনে হচ্ছে,"সমাজ সংসারও মিছে সব!" সত্যিই, অর্ধেকটা জীবন এভাবে কাটিয়ে দিলাম একাকিত্বে, হয়তো ঠিক এই মুহূর্তটির আশায়, এই রোজকার জীবনের খানিকটা হলেও ছন্দপতনের অপেক্ষায়!
"রবিন, তুই এখানে?" চমকে উঠলাম এই ডাকে। 'রবীন্দ্রনাথ সেন'কে ছোট করে অনেকেই রবি বলে ডাকে একমাত্র একজন ছাড়া। শিল্পা! ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝলাম, চমকের আরও বাকি রয়েছে এখনও!
আগেই বলেছি, শিল্পা সেই স্কুল জীবন থেকেই অসামান্য সুন্দরী। তার উপর ওর এখনকার ব্যক্তিত্ব ওর সেই সৌন্দর্যের পারদ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন বহুমাত্রায়। জমকালো কালো শিফনের শাড়ি আর হিরের ছোট্ট পেণ্ডেণ্টেই ও অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে যেকোনো বিশ্বসুন্দরীকে। এই প্রথম ওকে দেখে যেন কথা সরলনা আমার ঠোঁটে!
"কিরে চিনতে পারছিসনা, নাকি মাঝ বয়সে এসে নিজের টেস্ট চেঞ্জ করে ফেলেছিস তুই?"
ধপ করে আমার পাশে বসে ওয়াইনের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করল শিল্পা।
ওর কথাটা কানে কিরকম যেন বাজল। সেই নরম ভীরু মেয়েটার মুখে এমন সংলাপও বসবে কোনোদিন, এতটা দুরাশা বোধহয় কোনোদিন করিনি আসলে।
"না, মানে তুই এখানে?"
শিল্পা হাসল। "আমি এখানে।এখানেই তো আসার কথা ছিল আমার, বন্ধু! হাঃ হাঃ! তবে মানতেই হবে, এর পিছনে তোর কিন্তু বিশাল বড় অবদান রয়েছে! তুই যদি ওই ভোরবেলা কথাকটা না বলতিস, আজ হয়তো আমার জীবনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম হত! আবার, হতোও কি আদৌ? কে জানে?"
আমি সোজা হয়ে বসি। কি বলছে মেয়েটা? কি হেঁয়ালি করছে ও? এতদিন পরে কি ওর কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত?
"শিল্পা, বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু সত্যিই তোকে কখনও দুঃখ দিতে চাইনি—"
হাত তুলে থামিয়ে দেয় ও আমায়, "আরে ধুর, দুঃখ কে পেয়েছে?আমায় দেখে মনে হচ্ছে আমি দুঃখী? তুই সমকামী, সেটা স্বীকার করার ক্ষমতা রাখিস তুই, এটাই তো অনেক বড়! বিশ্বাস কর, সবাই তোর মতো হতে পারেনা! সারাজীবন মুখোশের আড়ালে শুধু কেঁদে বেড়ায়।তবু জাল ছিঁড়ে বেরোতে পারে না। ওই যে দেখ, ওর মতো!"
আঙুল তুলে যার দিকে ইশারা করল ও, তাকে দেখে শিহরণ খেলে গেল আমার শরীরে।এ তো সেই ভাওলিন বাদক!
শিল্পা তখনও বলে চলেছে, "মা বাবা দেখে শুনে বিয়ে দিল জানিস! আমিও আপত্তি করিনি। শ্রীমনকে পছন্দ করেছিলাম কিনা জানিনা, তবে না বলার কোনো কারণ ছিল কি, বল? কোর্টশিপ চলাকালীন অবশ্য ও আমায় সব বলে দেয়। তোর মতোই আর কি, শেষ মুহূর্তে। তবু এবার আর আমরা কেউ ছেড়ে যেতে পারলাম না একে অপরকে জানিস শুধুমাত্র লোক লৌকিকতার ভয়ে। আমার কি ভাগ্য দেখেছিস তো!"
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রয়েছি সোফায়। কি বলা বা করা উচিত এমন পরিস্থিতিতে বুঝে উঠতে পারছিনা। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ইতিমধ্যে। শ্রীমন সবার অভিবাদন কুড়োনোয় ব্যস্ত।
হঠাৎই শিল্পার দিকে চোখ পরতে বুঝলাম আমি ধরা পরে গেছি। ও হাসছে খিলখিল করে। "কি, পছন্দ ওকে?এই, একদম মিথ্যা বলবিনা কিন্তু আজ। " আমি টের পেলাম আমার কানদুটো গরম হয়ে উঠেছে অকষ্মাৎ।
আমার কাঁধে হাত রাখল শিল্পা। "বুঝিরে। আজ আমি সব বুঝি। ভাগ্যিস বিয়েটা হয়েছিল এই 'এল জি বি টি' পার্টিগুলোয় আসার অবকাশ মিলল তাই তারপর। নাহলে আমিও বা কি কখনও টের পেতাম আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাও আসলে 'সম'বিলাসিনী! নানা,আর না। যা রবিন, যা।এবার আর আটকাস না নিজেকে। শ্রীমন এখনও খুব একা জানিস তো, ওর তোকে প্রয়োজন!অনেক তো হল লোক দেখানি, এবারে অন্তত একবার তো বাঁচ তোরা! আমি তো তবু অণুরিমাকে পেয়েছি, দাঁড়া, আলাপ করিয়ে দিই, এই অণু, এদিকে একটু এসো না—"
আমি আবার কানে শুনতে পাচ্ছিনা যে কেন তারপর আর ঠিক কি কি বলল শিল্পা, কে জানে?
======০০======
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন