Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়


"এ কালে একটু লেখাপড়া জানা থাকাতে, এবং বঙ্গভাষায় অনেক গুলি পাঠ্য পুস্তক হওয়াতে কেবল পরনিন্দা করিয়া সময় কাটাইতে তাঁহাদের আবশ্যকও হয় না, প্রবৃত্তিও হয় না। …নিতান্ত সখ্যতা বা আত্মীয়তা না থাকিলে, সকল পেটের কথা খুলিয়া নিঃশ্বাস ছাড়িয়া তৃপ্তিলাভ করা, এ কালের মেয়েরা পছন্দ করেন না। তাঁহারা বইখানি, কার্পেটটুকু, নিজের স্বামী পুত্র লইয়া দিন যাপন করিতে বা একেলা থাকিতে কষ্ট বোধ করেন না।" —শরৎকুমারী চৌধুরাণীর এই লেখা (ভারতী ও বালক/ আশ্বিন কার্তিক, মাঘ/ ১২৯৮) দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না উনিশ শতকে নারীর লেখাপড়া শেখার উদ্দেশ্য ছিল মূলত আত্মমুক্তির জন্য। শুধু লেখাপড়া শেখা নয়, সাহিত্য সৃষ্টিতেও ছয়'এর দশক (উনিশ শতকের) থেকে নারীরা যে ধারা সূত্রপাত করেছিল তা নারীর আত্মমুক্তির পথকেই প্রসারিত করেছিল। ছয়'এর দশকের পূর্বেই ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপার হরফে নারী রচিত কাব্য 'চিত্তবিলাসিনী' প্রকাশিত হয়। লেখেন কৃষ্ণকামিনী দাসী। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কবি ঠাকুরাণী দাসীর নাম উঠে আসতে থাকে, যিনি কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন। ঠিক সেই বছরই জন্মগ্রহণ করেন কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, যাঁর কবিতা লেখা আত্মমুক্তির উদ্দেশ্যে হলেও কালক্রমে তা নারীকণ্ঠকে আধুনিকতার রাস্তা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল সেকথা বলা যায়। 

গিরীন্দ্রমোহিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কবিতাহার' প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। কবির মাত্র চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ যে উপেক্ষার অতলে তলিয়ে গেছিল এমন নয়, বরং মেরি কার্পেন্টার কবির সাথে সাক্ষাৎ করতে চান কাব্যটি পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কাব্যের সমালোচনা করেছিলেন তাঁর 'বঙ্গদর্শন'-এ। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন মজিলপুর অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেট। থাকতেনও মজিলপুর প্রাসাদে। জানা যায় প্রাসাদের দালানে বসা বালিকা বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়েছিলেন গিরীন্দ্রমোহিনী। বঙ্কিম-সমালোচনা কবি গিরীন্দ্রকে হয়তো কিছুটা পরিচিতি দিতে পেরেছিল, কিন্তু তাঁর কবিত্বের যে যথার্থ মূল্যায়ন যে করা হয়নি (বলা ভালো, চেষ্টা করা হয়নি) তা সমালোচনার অংশটি কিছুটা পড়লেই অনুমান করা যায়— "ইহা পূর্ণবয়স্ক কোন স্ত্রীর প্রণীত হইলেও প্রশংসনীয় হইত, পৌঢ়বয়স্ক কোন পুরুষের লিখিত হইলেও প্রসংসনীয় হইত। ইহার অনেক স্থান এমন, যে তাহা কোন প্রকারেই অল্প বয়স্কা বালিকার রচনা বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না।" আসলে বঙ্কিমের সমালোচনায় এই 'বিস্ময়'কে ঘিরেই ইতিবাচকতার অভাব। অথচ গোটা 'কবিতাহার' কাব্যে যেভাবে বৈচিত্রময় কবিতার ফুলে 'হার' রচনা করেছেন কবি, তা যথেষ্ট গঠনমূলক আলোচনার দাবিদার। বিস্ময় তো সেখানেই যেখানে নারী পিতৃতান্ত্রিক অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসে 'বঙ্গমহিলার হীনাবস্থা'কে সমাজের চোখে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন নিজের তাগিদেই; যা আধুনিক যুগের বাংলা কবিতায় নারীর কলমে প্রথমবার। 'বঙ্গমহিলার হীনাবস্থা' কবিতায় বাংলার নারীর পিছিয়ে থাকার চিত্র, বিদ্যার্জন ছেড়ে সেঁজুতির ব্রতে ডুবে থাকার চিত্র, অবলা নারীর অত্যাচারে ভূমিকা নেওয়া শাশুড়ি প্রমুখ নারীদের চিত্র, পশুর সাথে নারীর প্রভেদহীনতার চিত্র, ইউরোপের সাথে এদেশের নারীশিক্ষা-সংস্কৃতির পার্থক্যের চিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা নারীর আত্মমুক্তির পথকে চূড়ান্ত ভাবে প্রশস্ত করে তোলার নামান্তর।

পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য সাহিত্য উভয়ের প্রতি গিরীন্দ্রমোহিনীর বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাছাড়া "বালিকার কল্পনা-বিকাশের সহায়তা কল্পে পিতা তাঁহাকে Paul and Virginia, Theodosius, Constancia প্রভৃতি পুস্তক ও গল্প বাঙ্গালায় ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইতেন। তাহা হইতে এবং মাতামহী সংগৃহীত 'মহানাটক', 'কোকিলদূত', 'যোজনগন্ধা', 'বাসবদত্তা', 'ইসফজোলেখা', 'কবিকঙ্কণ' প্রভৃতি পাঠ করিয়া গিরীন্দ্রমোহিনীর কাব্যপ্রতিভা স্ফূরিত হইয়া ওঠে" এমন কথা জানান যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। পিতা হারাণচন্দ্র মিত্রের এই লালন শিশু গিরীন্দ্র'র কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী হয়ে ওঠার বীজক্ষেত্র ছিল। ফলস্বরূপ, পার্ণেলের হার্মিট কাব্যের ভাবকে অবলম্বন করে বাংলা কবিতা লিখে ফেলেন মাত্র বারো বছর বয়সেই। তবে, হারাণচন্দ্র কন্যার বিবাহের সময় 'গৌরীদান' থেকে বিরত ছিলেন। এতে হারণচন্দ্রের  'মডারেট উদারপন্থী' মনোভাবের ঝলকানি প্রকাশ পেলেও নবজাগরণের নবীন চিন্তায় আলোকিত পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায়না যখন শোনা যায় বিবাহের সময় গিরীন্দ্রের বয়স মাত্র দশ বছর। এটা উনিশ শতকের দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ বাঙালির স্পষ্ট প্রতিফলিত রূপ। যেখানে পিতা হারাণচন্দ্র কন্যাকে ফলিত জ্যোতিষের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণা দিচ্ছেন; বাংলা-সংস্কৃত সাহিত্যের পাশাপাশি গ্রীক, ইংরেজি প্রভৃতি পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটাচ্ছেন; সেখানে প্রচলিত যুগের হাওয়ার অনুবর্তী হয়ে দশ বছরে বিবাহ দিয়ে পড়াশোনার ছেদ ঘটাচ্ছেন। যদিও গিরীন্দ্রমোহিনীর স্বামী নরেশচন্দ্র দত্ত কবির শিক্ষালাভের বিরোধীতা করেননি, অনেকটা উদারচেতা নবীন চিন্তার বশবর্তী হয়েই। তবুও, এই শিক্ষালাভ করতে দেওয়ার গতি কতদূর নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছিল এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে যায়। কারণ, গিরীন্দ্রমোহিনীর ইংরেজি শেখার জন্য কোনো 'গুরুমহাশয়' নিয়োজিত হয়নি, এমনকি "গুরুমহাশয়ের কাছে না পড়িলে বিদ্যাশিক্ষা হয় না" একথা কবি নিজমুখে অভিমানে জানানোর পরেও। ইংরেজি শেখানোর ভার স্বামী নরেশচন্দ্র নিজে নিলেও তা যে বিদ্যোৎসাহী গিরীন্দ্রের শিক্ষার গতিকে আশানুরূপ দিশা দেখাতে পারেনি তা অনুমেয়। প্রসঙ্গত, সেই সময় (১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ) প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রদের সঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছেন কাদম্বিনী বসু। বাঙালি কাদম্বিনী হয়ে উঠছেন প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক। আবার কিছু সময় পরে চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা হন। এমনকি কবি কামিনী রায় রীতিমত শিক্ষায়তনে শিক্ষালাভ করে হয়ে উঠছেন ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্রাজুয়েট। ১৮৭৮ সালে মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার স্বীকৃতও হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষালাভের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা কিংবা স্বনির্ভরতার কথা ভাবা তো দূরের বিষয়। আত্মতৃপ্তির জন্য, আঁধার থেকে আলোয় আসবার জন্য যে শিক্ষার সহযোগ প্রয়োজন; আর তা যে শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষিত প্রতিটি গৃহবধূর স্বতঃস্ফূর্ত পাওনা হয়ে উঠছে না তা গিরীন্দ্রজীবনের থেকেও গিরীন্দ্রকবিতাতেই বেশি করে চিত্রিত আছে। কারন, জীবনের দৃশ্য পুরোটা দেখা যায় না, কিন্তু জীবন দিয়ে লেখা কবিতাতে তার স্পষ্ট রূপ ধরা হয়ে থাকে চিরকালের জন্য। গিরীন্দ্র কবিতায় (বঙ্গমহিলাগণের হীনাবস্থা) বলছেন— "নয়ন থাকিতে সদা অন্ধের মতন,/ বদন থাকিতে নারে বলিতে বচন।/… নাহি জানি কবে বিদ্যা অমূল্য ভূষণ,/ কামিনীকূলের হৃদি করিবে শোভন।"
অপরপক্ষে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (চৈত্র, ১৮০২ শক) সেই সময় জানাচ্ছেন, "... বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ., এম.এ., পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার জন্য যেরূপ শিক্ষা প্রদত্ত হয় তাহা বুদ্ধিপ্রধান শিক্ষা, হৃদয়প্রধান শিক্ষা নহে, অতএব ঐ প্রকার শিক্ষা স্ত্রীজাতির পক্ষে উপযুক্ত শিক্ষা নহে।" ভাবা যায়! আসলে সমাজে মেয়েদের শিক্ষার থেকে বেশি কার্যকরী 'মেয়েলি শিক্ষা'; 'নারীসুলভ গুণ'গুলি ধরে রাখার (এখনও সমাজ 'মেয়েলি', 'পুরুষালি' এভাবে দেখতে অভ্যস্ত) শিক্ষা তথা 'স্ত্রীজনোচিত শিক্ষা' বেশি প্রাধান্যযুক্ত। গিরীন্দ্রমোহিনী অন্তঃপুর শিক্ষার দৌলতে এ সহজেই বুঝেছিলেন। আর তাছাড়া তিনি "কিছুদিন শিখে পড়া ছেড়ে দিলেন। সম্ভবত: বিশাল পরিবারের অনেকেই আপত্তি জানিয়ে থাকবেন গৃহবধূর পড়াশোনার ব্যাপারে" (গোপা দে, উনিশ শতকের তিন নারী কবি) — এমনটাও জানা যায়। ফলত, গিরীন্দ্রের শিক্ষালাভের সুলভ দৌড় যে শেষ অবধি সুলভ থাকেনি তা বোঝা যায়। আর, সাংসারিক ঘেরাটোপে সন্তান ধারন এবং সন্তান পালনের মতো আবশ্যিক দুই মুখ্যকর্মকে সামলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কতটা যে শক্ত (বিশেষত উনিশ শতকের পিতৃতান্ত্রিক একান্নবর্তী পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে) তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যথারীতি, গিরীন্দ্র তাঁর কবিতায় সেই দৃশ্যও সহজাত করে তুলবেন তা স্বাভাবিক— "এ সংসারে এই রীতি, যে যাহার গতিমুক্তি,/ তা হতে তার দুর্গতি, তাই দেখি নয়নে;/ চাতকিনী বাঁচে প্রাণে জলধর-জীবনে/ কাল-নিদাঘেতে তাই, হয় তার দুর্গতি।" বোঝা যায় গিরীন্দ্রের 'কবিতা'য় ছিল তাঁর কাছে এক মুক্ত জানালা, অন্যতম প্রধান অবলম্বন।

গিরীন্দ্রমোহিনীর ছিলেন বউবাজার নিবাসী দুর্গাচরণ দত্তের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ। গিরীন্দ্র তাঁর কবিত্বের কদর ও উৎসাহ শ্বশুরগৃহ থেকে কতটা পেতেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না পাওয়া গেলেও স্বামী নরেশচন্দ্র যে তাঁকে কবিতা লেখায় অনুৎসাহী করেননি সে প্রমাণও কম নেই। গিরীন্দ্রের লেখা কয়েকটি পত্র, যেগুলি স্বামী এবং অপর কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখা। বিশেষত, যেখানে স্বামী নরেশচন্দ্রের প্রতি নবপ্রেমের আকুলতা এবং বরেণ্য ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের (সাল ১৯৭১। কবির নবজাতক প্রথম সন্তানকে সুস্থ করে তুলেছিলেন ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার) প্রতি শ্রদ্ধাশীল কৃতজ্ঞতার প্রকাশ পেয়েছে। সেই লেখাগুলি স্বামী নরেশচন্দ্রই পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন নিজ উদ্যোগে। গিরীন্দ্রের লেখা অন্যান্য অনেক কবিতা থাকা সত্ত্বেও সেগুলি ছেড়ে গোপন পত্রের পুস্তিকা আকারে প্রকাশে গিরীন্দ্রমোহিনী কতটা আনন্দ এবং উৎসাহ পেয়েছিলেন তা বলা যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগত পত্রের অনুমতিহীন প্রকাশ ব্যক্তি গিরীন্দ্রমোহিনীকে শুধু লজ্জায় আবদ্ধ রাখেনি, ক্ষুব্ধও করেছিল। সেক্ষেত্রে 'কবিতাহার' কাব্যগ্রন্থের আয়োজন তাঁর 'কবি' রূপে আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনে 'বিশেষ' হয়ে উঠেছিল। 'জনৈক হিন্দু মহিলার পত্রাবলী' (১৮৭২ খ্রি.) পুস্তকের পত্রলেখিকার 'কবি'রূপে আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে গৌরবময় হয়ে উঠেছিল। তবে 'কবিতাহার' কাব্যগ্রন্থে ছিল না কবির নিজের নাম। 'জনৈক বঙ্গ-মহিলা কর্ত্তৃক লিখিত' রূপে ছাপা নামের আড়ালে থাকা গিরীন্দ্রমোহিনী'কে স্বনামে উজ্জ্বল হতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত। 'কবিতাহার'(১৮৭৩), 'ভারতকুসুম' (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর মৃত্যু ঘটে (১৮৮৪ খ্রি.) স্বামীর। তিন বছর পর প্রকাশিত হয় শোককাব্য 'অশ্রুকণা' (১৮৮৭ খ্রি.)। স্বর্গীয় স্বামীকে উৎসর্গ করে লেখা কাব্যগ্রন্থের কবি-নামে 'গিরীন্দ্রমোহিনী' নাম থাকলেও ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ভেদে 'দেবী' ও 'দাসী'র পৃথককরণ তখন বর্তমান ছিল। 

গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর 'কবিতাহার' কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ বাংলা কবিতায় নারীকণ্ঠের আধুনিক হয়ে ওঠার পথ'এর এক বড় পদক্ষেপ। যে পথ পুরুষের অনুপ্রেরণায়, পিতৃতন্ত্রের ছাতার নিচে তৈরি হতে থাকলেও ধীরে ধীরে তা মুক্ত হতে শুরু করে। নারীর কবিতার আকাশে পূর্ণতার পথে যাত্রা করার এই সূচনার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল কবি গিরীন্দ্রমোহিনীর আবির্ভাবের। অনেকে শুরু করেও ধরে রাখতে পারেননি। গিরীন্দ্রমোহিনী পেরেছিলেন। তাই, প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর দীনবন্ধু মিত্র যেমন নিজের রচনা করা নাটকাবলী উপহার দিতে চান তাঁকে; তেমনই শেষ অবধি ১৯২৪ সালে গিরীন্দ্র'র মৃত্যুর পরেও কবিতা সংকলন 'অলক' (১৯২৭) প্রকাশিত হয়। কবিত্বের সহজাত স্ফূরনের পাশাপাশি জীবনের শেষ অবধি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ, একনিষ্ঠতা গিরীন্দ্রমোহিনীকে নতুন মাত্রা প্রদান করে। উনিশ শতকের নারীকণ্ঠের মূল্যবান দৃষ্টান্ত করে তোলে। তাঁর লেখা 'অশ্রুকণা' (১৮৮৭ খ্রি.) বাংলা শোককাব্যের এক মাইল ফলক। যদিও ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রায় সার্ধশতাধিক কবিতা অবলম্বনে লেখা 'আভাষ' কাব্যগ্রন্থে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব লুকিয়ে আছে। কারন, জীবন সম্পর্কে পরিণত অভিজ্ঞতার উদ্ভাস সংযমের আলোকে পরিবেশন করেছেন কবি এই কাব্যে। আবার ১৯০৬ লেখা 'স্বদেশিনী' কাব্যগ্রন্থ তাঁর স্বদেশচেতনার স্মারকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। নারীর 'ঘর' থেকে 'বাইরে' বেরিয়ে এসে স্বদেশমন্ত্রে জাগরণের এই কাব্য নারীকণ্ঠকে কয়েকগুণ বেশি এগিয়ে দিয়েছিল তা বলাই যায়। নারীকণ্ঠে সমাজসচেতনার পাশাপাশি বলিষ্ঠ, দৃপ্ত স্বরের উপাদান আমদানিতেই আলোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী।

গিরীন্দ্রের শিক্ষালাভ এবং এই বেড়ে ওঠার আড়ালে তাঁর পিতা এবং পারিবারিক ভূমিকাকে সঙ্গত কারনেই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারন, উনিশের শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দাঁড়িয়েও মেয়েদের শিক্ষালাভের জমি প্রস্তুত হওয়ার পরেও নারীশিক্ষায় পারিবারের উৎসাহ-প্রদান বিরল তো বটেই; বরং বিপরীতও। কিন্তু শুধু বালিকা বিদ্যালয় এবং অন্তঃপুরে শিক্ষালাভই নয়; 'পাঠগ্রহণ'-এর প্রতি গভীর অনুরাগই যে তাঁকে বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল একথা ভুললে চলবে না। তাঁর শিক্ষাগ্রহণ নারী হিসাবে নয়, বরং ব্যক্তি হিসাবেই। তাই কবিত্বের পিঠে 'নারী-কবি'র শিরোপা গুণীজনেরা এঁটে দিলেও, জীবনচর্যায় নিজে 'নারী' থেকে 'ব্যক্তি' গিরীন্দ্রমোহিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই নারীর শিক্ষা এবং অবস্থান নিয়ে প্রশ্নও তুলে গেছেন মাত্র চোদ্দ বছর বয়স থেকেই। এই প্রশ্ন তোলার মধ্যেই তাঁর নিজস্বতার স্মারক প্রতিষ্ঠিত। নারীত্বের আধারে গড়া ব্যক্তিত্বের পূর্ণ প্রকাশে আলোকিত গিরীন্দ্রমোহিনীর জন্মদিন সদ্য অতিক্রম করেছি আমরা। এই ১৮-ই আগস্ট সত্যই স্মরণে রাখার মতো একটি দিন।


গ্রন্থঋণ: 
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চ অনন্যা— স্বপনকুমার মণ্ডল। 
বঙ্গের মহিলা কবি— যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।


                         ————

 সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়। (গবেষক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য)
Vill- Bhairabpur
P.O- Mahanad
P.S- Polba
Dist.- Hooghly
Pin- 712149
West Bengal

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩