Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। নিতান্ত হালকা মামলা ।। চন্দন ব্যানার্জী


-১-

 

“তোমার লাকটা খুব ভাল৷”

“কী করে বুঝলেন?”

“তুমি এরকম একটা সহজ কেস দিয়ে কেরিয়ার শুরু করছ৷আমার বেলায় একটা খুবই প্যাঁচালো কেস এসেছিল৷”

“আমি তো প্যাঁচালো কেসই করতে চাই৷সহজ কেস করতে থাকলে মাথায় জং ধরে যাবে৷”

-“কিন্তু তোমার কপালে তো জুটল একটা নিতান্ত হালকা মামলা৷”

-“তা যা বলেছেন৷আমাদের ট্রেনিং ক্লাসে কত জটিল ব্যাপার শিখে এলাম আর এখানে প্রথম কেসটাই, আপনার ভাষায়,নিতান্ত হালকা মামলা৷”

ওপরের কথোপকথনটা হচ্ছিল লালবাজারে ক্রাইম ব্রাঞ্চে সদ্য যোগ দেওয়া তরুণ অফিসার উপেন তরফদারের সঙ্গে তার বস কালিদাস রায়ের৷উপেনের কাছে প্রথম কেসটাই এসেছে একটা পাতি আত্মহত্যার কেস৷নিউ হাইটস আবাসনের আটতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে রামকৃষ্ণ বটব্যাল আত্মহত্যা করেছেন৷মাঝবয়সী ভদ্রলোক৷অকৃতদার৷আটতলার ঐ ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন৷ওনার ঘর থেকে সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে৷আপাততঃ এটুকু প্রাথমিক রিপোর্টই লোকাল থানা থেকে এসেছে৷পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট,হাতের লেখার ম্যাচিং এর ফরেন্সিক রিপোর্ট,ষে জানালা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তার ফোটোগ্রাফ,সিসিটিভির ফুটেজ, সাক্ষীদের জবানবন্দি ইত্যাদি সহ বিস্তারিত রিপোর্ট পরে আসবে৷বিস্তারিত রিপোর্টের সঙ্গে থানার বক্তব্যও থাকবে৷তাতেই কোন ধারায় কেসটা নথিভুক্ত হয়েছে তাও লেখা থাকবে৷সেটা ঠিকঠাক লেখা হয়েছে কিনা সেটা দেখাই উপেনের কাজ৷বোঝাই যাচ্ছে,আত্মহত্যার ধারা দেওয়া হবে৷এতে মাথা খাটানোর কোন জায়গাই নেই৷একেবারেই ‘রুটিন’ ব্যাপার৷সত্যিই এটা নিতান্তই হালকা মামলা৷এই ধরণের কেস সাধারণতঃ থানা থেকেই হ্যাণ্ডেল করা হয়৷লালবাজারে আসেই না৷কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে মিডিয়ায় এত হৈচৈ হয়েছে যে ওপরতলার নির্দেশে কেসটা লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চে রেফার করা হয়েছে৷অগত্যা ...৷

ঊপেন ভাবছিল ট্র্রেনিং এর সময় কত জটিল বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হত৷আর এখানে এই তার ব্যবহারিক প্রয়োগ!সে শিখে এসেছে যে খুব তুচ্ছ ব্যাপারেও মাথা খাটাবার বিষয় থাকে৷যেমন,যে কোন ওষুধের এক্সপায়ারি ডেটের পর তার গুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং সেটি ব্যবহার করলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়না৷বরং সেটি বিষাক্ত হয়ে যায়৷তাহলে ডেট এক্সপায়ার হওয়া বিষের ক্ষেত্রে কী হবে?ওর গুণ নষ্ট হয়ে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না৷তাহলে ওটা কি আর বিষ থাকবেনা?নাকি,যে কোনও ডেট এক্সপায়ার হওয়া ওষুধের মত ওটাও বিষাক্ত হয়ে যাবে?এসব হল ছাত্রঠকানো প্রশ্ন৷দীর্ঘক্ষণ গ্রুপ ডিসকাশন করেও কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি৷তবে মাথা খাটাবার পক্ষে এটা একটা ভাল প্রশ্ন৷

এরকমই একটা জটিল কেস স্টাডির কথা মনে পড়ে গেল৷এক সিনিয়ার উকিলের কাছে এক গরিব ছাত্র আইন পড়তে এসেছিল৷তার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ঐ শিক্ষক উকিল তখন কোন দক্ষিণা না নিয়েই তাকে শিক্ষাদান করতে রাজি হলেন৷তবে তিনি তো উকিল৷ছাত্রটিকে একটি চুক্তির আওতায় আনলেন৷চুক্তিতে এটাই লেখা থাকল যে ওকালতি পাস করার পর ছাত্রটি যখন তার প্রথম মামলা জিতবে,তখন সে শিক্ষককে পুরো দক্ষিণার টাকা দিয়ে দেবে৷কালক্রমে ছাত্রটি পাস করে উকিল হয়ে গেল৷তবুও কিন্তু শিক্ষক তাঁর প্রাপ্য টাকা পেলেন না৷অগত্যা শিক্ষক ছাত্রটির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন৷তিনি তো উকিল৷মামলা করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না৷

আদালতে ওনার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাঁর যুক্তি খুবই ধারালো৷তিনি বললেন, “ধর্মাবতার৷এই কেসে আমি হয় জিতবো,নয় হারবো৷যদি জিতি তো তার অর্থ হবে আদালত মেনে নিচ্ছে যে আমার দাবি অনুসারে ছাত্রটি আমার প্রাপ্য টাকা দিতে বাধ্য৷যদি হারি তার অর্থ হবে ছা্রটি তার প্রথম মামলা জিতেছে৷তাই চুক্তি অনুসারে সে আমার পাওনা মিটিয়ে দেবে৷অর্থা হারি বা জিতি উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্রটি আমাকে প্রাপ্য টাকা দিতে বাধ্য থাকবে৷”

অকাট্য যুক্তি৷উপস্থিত সকলে বলাবলি করতে লাগল যে এতবড় একজন সিনিয়ার উকিলের কাছে তরূণ ছাত্র উকিলটি গোহারাণ হেরে যাব৷অনেকে আবার বলল, ছাত্রটি হেরে গেলে প্রমাণ হবে সিনিয়ার উকিল ভদ্রলোক উকিল হিসেবে খুব ভাল হলেও শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ,কারণ,তাঁর ছাত্র জীবনের প্রথম মামলায় হেরে ভূত হয়েছে!তাই এই কেসটা ওনারও পরীক্ষা৷

এবার ছা্র উকিলটি বলতে উঠল, “হুজুর,আমি যদি কেসে জিতে যাই তার অর্থ হবে আদালত মনে করছে উনি আমার কাছে কোন টাকা দাবি করতে পারেন না,তাই ওনাকে টাকা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনা৷যদি আমি হেরে যাই তার অর্থ হবে আমি এখনও পর্যন্ত কোন মামলায় জিতিনি৷প্রথম মামলা জিতলে তবেই তো টাকা দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে৷তাই চুক্তি অনুসারে ওনার কোনও প্রাপ্য হয়না৷অর্থা হারি বা জিতি উভয় ক্ষেত্রেই উনি আজকের দিনে আমার থেকে কোন পাওনা আদায় করতে পারেন না৷”

এটাও অকাট্য যুক্তি৷উপস্থিত সকলে বলাবলি করতে লাগল যে শিষ্যটি গুরুর কাছে বেশ নিষ্ঠা সহকরে শিক্ষাগ্রহণ করেছে৷সিনিয়ার উকিল শিক্ষক হিসেবে সফল৷তাহলে আদালতের রায় কী হওয়া উচি? দীর্ঘক্ষণ গ্রুপ ডিসকাশন করেও এ প্রশ্নের কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি৷মাথা খাটাবার পক্ষে এটাও একটা অত্যন্ত ভাল প্রশ্ন৷

এইসব জটিল ব্যাপারে মাথা খাটিয়ে এসে এখন তাকে এই নিতান্ত হালকা মামলায় আইনের কোন ধারা লাগবে সেটা দেখতে হবে!

যথাসয়ে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সব কাগজপত্র চলে এল৷মৃত রামকৃষ্ণ বটব্যাল আত্মহত্যাই করেছেন৷সুইসাইড নোটের হাতের লেখার সঙ্গে ওনার  বিভিন্ন জায়গায় লেখার মিল পাওয়া গেছে এবং হাতের লেখাটা যে ওনারই সে ব্যাপারে হস্তলেখা বিশেষজ্ঞর শংসাপত্রও আছে৷সিসিটিভির ফুটেজ, সাক্ষীদের জবানবন্দি ইত্যাদি সবই আত্মহত্যার তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করছে৷কেবল পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট এখনও আসেনি৷এলেই উপেন আত্মহত্যার ধারা দিয়ে কেসটার অন্তিম রিপোর্ট দিয়ে দেবে৷

পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট যথাসয়ে এল৷কিন্তু একী?’কহানি পে টুইস্ট?’

মৃত্যু হয়েছে পিস্তলের গুলিতে৷গুলি কে কখন কীভাবে করল?ব্যাপারটার বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার৷উপেন নিজেই সরেজমিনে তদন্ত করতে থানার ওসির সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছল৷

-২-

“তুমি সত্যি সত্যিই আমাকে মারতে চাও?”

-“না না৷আমি তো শুধু ভয় দেখাচ্ছিলাম৷”

-“তাহ’লে গুলি চালালে কেন?”

-“পিস্তলে তো গুলি ভরা ছিলনা৷”

-“বললেই হ’ল,পরিষ্কার গুলি চলেছে৷আগুনের ফুলকি,ধোঁয়া,কানফাটানো শব্দ সবই দেখেছি আর শুনেছি৷তুমি বুঝতে পারনি?”

-“বুঝতে তো পেরেছি৷কিন্তু পিস্তলে তো গুলি থাকার কথা নয়৷কে গুলি ভরল?কখন ভরল?”

-“ভাগ্যিস তোমার নার্ভের অসুখ আছে৷হাত কাঁপে৷তাই গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমি এযাত্রা বেঁচে গেলাম৷”

-“তুমি তো জানই,আমি রেগে গেলে পিস্তল বাগিয়ে গুলি চালাবার মত করে থাকি৷কিন্তু পিস্তলে গুলি ভরা থাকেনা৷আগেও তো অনেকবারই...”

কথোপকথনটা হচ্ছিল নিউ হাইটস আবাসনের সাততলায় মিসেস শিউলি হাজরার সঙ্গে তার স্বামী নবদ্বীপ হাজরার৷সুন্দরী শিউলির বয়স তিরিশের কোঠায়৷তার স্বামী নবদ্বীপের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি৷‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’ হ’লে যা হয় আরকি;দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকে৷ নবদ্বীপের দুটো ফ্ল্যাট-সাততলার এই ফ্ল্যাটটায় সস্ত্রীক থাকে আর ঠিক ওপরের আটতলার ফ্ল্যাটটায় ভাড়াটিয়া রামকৃষ্ণ বটব্যাল থাকে৷নবদ্বীপ পরে জেনেছে রামকৃষ্ণ শিউলির কলেজেই পড়ত৷ওর থেকে দু’বছরের সিনিয়ার৷ খবরটা জানার পর নবদ্বীপের ধারণা হয়েছে ওদের দুজনের নিশ্চয়ই সম্পর্ক ছিল এবং এখন ওরা আবার কাছাকাছি আসতে চাইছে৷এই জন্যই ইদানিং নবদ্বীপ আর শিউলির দাম্পত্য কলহ বেড়ে গেছে৷বেশ কয়েকবার কলহ চলাকালীন পিস্তল বের করে নবদ্বীপ গুলিও চালিয়ে দিয়েছে৷কিন্তু পিস্তলে গুলি ভরা থাকেনা বলে কোনও অঘটন ঘটেনি৷একবার তো ওদের কলহের মাঝে ভাড়া দিতে আসা রামকৃষ্ণের সামনেই এরকম ঘটনা ঘটেছিল৷তখনও গুলি চলেনি৷এবারও যখন পিস্তল বের করে নবদ্বীপ গুলি চালিয়েছিল,শিউলি গুরুত্ব দেয়নি৷ও জানত পিস্তলে গুলি নেই আর তাই ঘাবড়াবার কিছু নেই৷কিন্তু বিকট আওয়াজ,সঙ্গে আগুনের ফুলকি আর ধোঁয়া দেখে সে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল৷

নবদ্বীপ বাড়িওয়ালা এবং সে মৃতব্যাক্তির ঠিক নিচের ফ্ল্যাটেই থাকে; তাই রামকৃষ্ণ বটব্যালের মূত্যুরহস্যের তদন্ত করতে এসে স্বাভাবিকভাবেই উপেন নবদ্বীপের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এল৷পুলিশি জেরায় নবদ্বীপ-শিউলির দাম্পত্যকলহ এবং নবদ্বীপের পিস্তল থেকে গুলিচালনার ব্যাপারটা জানা গেল৷নবদ্বীপের বক্তব্য যে পিস্তলে গুলি ভরা ছিলনা সেটার সপক্ষে কোনও প্রমাণ ছিলনা৷

নবদ্বীপ বলল, “স্যার৷আমি যা বলছি আমার স্ত্রী শিউলি তার সাক্ষী৷”

উপেন বলল, “উনি নিজের স্বামীকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যে বলতেই পারেন৷সেটাই স্বাভাবিক৷”

-“আমাদের ভাড়াটিয়া রামকৃষ্ণ বটব্যালও দেখেছে যে পিস্তলে কখনই গুলি ভরা থাকেনা৷ওর সামনেই আমি এরকম মিছিমিছি গুলি চালিয়েছি৷”

–“কিন্তু উনি তো সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বেঁচে নেই৷তাই নিজের স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টার অপরাধে ৩০৭ ধারায় আপনাকে আটক করা হচ্ছে৷”

নবদ্বীপ আর শিউলি দুজনেই হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল৷

উপেন বলল,”কিচ্ছু করার নেই৷এই কেসে বিশেষ কিছুই হবেনা,কারণ গুলিটা শিউলি দেবীর গায়ে লাগেনি৷কিন্তু..”

-“কিন্তু কী স্যার৷”

-“গুলিটা সম্ভবতঃ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেছে৷ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুসারে রামকৃষ্ণবাবু গুলিতে মারা গিয়েছেন৷ঐ গুলির ব্যালিস্টিক রিপোর্টে যদি দেখা যায় যে আপনার পিস্তল থেকে  ছোঁড়া গুলিতেই রামকৃষ্ণবাবু  মারা গিয়েছেন তাহলে কেসটা বদলে গিয়ে ৩০২ ধারায় রামকৃষ্ণবাবুকে খুনের মামলা হয়ে যাবে৷সেক্ষেত্রে ভগবান ছাড়া কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবেনা৷”

-“কিন্তু সবাই জানে যে রামকূষ্ণবাবু ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন৷উনি তো আত্মহত্যা করেছেন৷”

-“সেসব আদালতের বিচার্য৷আপনাকে আপাততঃ আটক করছি৷ব্যালিস্টিক রিপোর্ট পজিটিভ এলেই আপনাকে গ্রেফতার করে কোর্ট চালান করব৷”

তদন্তে এসে আর একটা বিষয় সামনে এল৷ঐ বিল্ডিং-য়ে ছয়তলায় বাইরের দিকের দেওয়ালে রংয়ের কাজ হচ্ছিল৷মিস্ত্রিরা ভারা বেঁধে কাজ করছিল৷যদি কোনও মিস্ত্রি হঠা ওপর থেকে পড়ে যায়,তাহলে তাকে বাঁচানোর জন্য একটা শক্তপোক্ত জাল ছয়তলার মেঝে বরাবর আটকানো হয়েছিল,যেরকম জাল সর্কাসে ট্রাপিজে খেলা দেখাবার জন্য ব্যবহৃত হয়৷বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে খুবই কড়া৷ঐ জাল না লাগালে ভারা বেঁধে কোনও কাজ করার অনুপতি দেওয়া হয় না৷কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে অহেতুক পুলিশি ঝামেলা হবে যেটা ওঁরা চান না,তাই এমন সিদ্ধান্ত৷

রামকৃষ্ণবাবুর দেহটা ঐ জালের ওপরেই পড়েছিল৷তাই আত্মহত্যা করার জন্য ওপর থেকে ঝাঁপ দিলেও উনি মারা যেতেন না৷উনি কিন্তু বাঁচেনওনি৷বন্দুকের গুলিতে ওঁর মৃত্যু হয়েছে৷বোঝাই যাচ্ছে নিচে সাততলার ফ্ল্যাটের জানালার সামনে দিয়ে যখন তিনি পড়ছিলেন,তখনই নবদ্বীপ হাজরা তাঁর স্ত্রী শিউলি হাজরাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন,যেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে রমকৃষ্ণবাবুকে আঘাত করে আর সেটাই রামকৃষ্ণবাবুর মৃত্যুর কারণ৷তাই এটা আত্মহত্যার মামলা নয়,বরং অনিচ্ছাকৃত হত্যার মামলা৷এখন গুলিটা ঐ পিস্তলেরই সেটা ব্যালিস্টিক রিপোর্টে প্রমাণ হওয়ার অপেক্ষা৷

যথাসময়ে ব্যালিস্টিক রিপোর্ট এল এবং যা ভাবা হয়েছিল রিপোর্টে সেটাই এল৷এবার তাহলে নবদ্বীপ হাজরাকেই অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করার আর কোনও বাধা রইল না৷উপেনবাবুর তরফ থেকে তদন্ত শেষ৷

-৩-

কালিদাস রায় বললেন, “রিপোর্ট তো দিচ্ছ,কিন্তু একটা খটকা তো রয়েই গেল৷”

উপেন বলল, “আবার কীসের খটকা?সব তো ক্রিস্টাল ক্লিয়ার৷

-“অভিযুক্ত নবদ্বীপ বারবার বলছে যে পিস্তলে গুলি ছিল না৷কখনও থাকে না৷শিউলিও সেটাই বলছে৷আগে একাধিকবার নবদ্বীপ তাকে লক্ষ্য করে পিস্তলের ট্রিগার টিপেছে৷কোনওবারই গুলি চলেনি৷গুলি থাকেই না৷”

-“কিন্তু এবার তো ছিল৷তাই ওসব ছেঁদো কথায় কোনও লাভ হবে না৷ ধোপে টিকবে না৷”

-“যদি কথাটা সত্যি হয়?”

-“মানে?আপনি কী বলতে চাইছেন?”

-“ধর, অন্য কেউ পিস্তলে গুলিটা ভরে দিয়েছে সকলের অজান্তে?”

-“তার উদ্দেশ্য কী?”

-“শিউলিকে খুন করা আর এমনভাবে করা যাতে নবদ্বীপ ফেঁসে যায়৷হতেও তো পারে,তাই না?”

-“কিন্তু কে করবে?”

-“যে দুজনেরই শত্রু৷”

এই সময় চিঠিপত্রের তাড়া নিয়ে কনেস্টবল রামলালের প্র্রবেশ৷কালিদাস রায়ের টেবিলে চিঠিগুলো রেখে রামলাল চলে গেল৷কালিদাস রায় ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে প্রথমে চিঠিগুলি দেখবেন আর নির্দিষ্ট অফিসারদের মার্ক করে চিঠিগুলি তাদের টেবিলে পাঠিয়ে দেবেন৷সবই ‘রুটিন’চিঠি,বিভিন্ন থানা থেকে এসেছে৷কিন্তু একটা খাম একটু অন্য রঙের এবং মাপের৷কালিদাস খামটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বললেন, “এটা দেখছি প্রাইভেট চিঠি,আমার নামেই এসেছে৷কী ব্যাপার কে জানে!”

খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পড়ে ফেললেন কালিদাস৷তাঁর ভ্রুযুগল কুঁচকে উঠল৷পড়া শেষ হলে তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, “সবই নিয়তির পরিহাস!তুমি বলছিলে না,তুমি হালকা মামলা চাও না৷প্যাঁচালো মামলা চাও৷চিঠিটা পড়৷”এই বলে উপেনের দিকে এগিয়ে দিলেন চিঠিটা৷

উপেন চিঠিটা পড়তে লাগল৷

এসিপি সাহেব,

যখন আপনি চিঠিটা পড়বেন তখন আমি সকলের ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে৷ চিঠিটা পোস্ট করার দুদিনের মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন৷ততক্ষণে আমার লাশটা মর্গে পৌঁছে যাবে৷আত্মহত্যা করে আমার জীবন শেষ করে দিয়েছি৷আমার কলেজের বান্ধবী শিউলি আমার সঙ্গে বেইমানি করে আমারই বাড়িওয়ালা বুড়ো ভাম নবদ্বীপ হাজরার সঙ্গে সুখে ঘর করবে,এ আমি মেনে নিতে পারছি না৷শিউলি এতদিন পর আমাকে দেখেও আবার প্রত্যাখ্যান করেছে৷ ওর শাস্তি মৃত্যু৷বুড়ো ভামটা ঝগড়া হলেই ওকে ফাঁকা পিস্তল দিয়ে গুলি করে আর এভাবেই ওদের দাম্পত্য কলহ থেমে যায়৷এবার আমি বুড়োর পিস্তলে সত্যিকারের গুলি ভরে এসেছি৷এবার দাম্পত্য কলহ হলেই বুড়ো গুলি চালাবে আর শিউলি মরবে৷বুড়োও খুনের দায়ে ফাঁসবে৷কিন্তু শিউলির মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারব না৷কারণ,আমি যে ওকে ভালবাসি৷তাই আমি কাল সকালেই স্যুইসাইড করছি৷

শিউলিকে বাঁচার একটা সুযোগ দিতে চাই বলে এই চিঠিটা লিখলাম৷চিঠিটা আপনার হাতে পড়ার আগে যদি ওদের দাম্পত্য কলহ হয় তাহলে শিউলি শেষ৷আর তখনও পর্যন্ত দাম্পত্য কলহ না হলে আপনিই শিউলিকে বাঁচাবেন৷ওর জীবন নিয়ে এই ফাটকাটা আমি খেললাম৷আমি তো থাকব না,আপনিই বুঝে নেবেন শিউলির ভাগ্যে কী আছে?মৃত্যু.না,জীবন?আমাদের অতীত ভালবাসার কথা স্মরণ করে এই সুযোগটা ওকে দিলাম৷

এবার বিদায়৷

ইতি-

রামকৃষ্ণ বটব্যাল

চিঠিটা পড়ার পর উপেনও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷

কালিদাস বললেন,”তাহলে তোমার প্রথম মামলাটা নিতান্ত হালকা মামলা নয়৷রামকৃষ্ণের মৃত্যুর কারণ কী?আত্মহত্যা,খুন,না অ্যাক্সিডেন্ট?”

উপেন জিজ্ঞাসা করল, “অ্যাক্সিডেন্টের কথা উঠছে কেন?”

-“কারণ,গুলিটা যে ঐ সময়েই শিউলিকে আঘাত না করে রামকৃষ্ণকেই আঘাত করবে,সেটা এক মুহূর্ত আগেও কেউ অনুমানও করতে পারেনি৷তাই ওটা অ্যাক্সিডে্ন্ট৷”

-“কিন্তু…”

-“ঠিক ধরেছ,এতে একটা কিন্তু আছে৷অ্যাক্সিডেন্টে কারও হাত থাকে না৷এক্ষেত্রে ও-ই নিজের হাতে পিস্তলে গুলি ভরেছিল বলে এতে ওর নিজেরই হাত আছে৷”

-“বুঝলাম৷খুনের কথা উঠছে কেন?”

-“খুন করার উদ্দেশ্যেই পিস্তলে গুলিটা ভরেছিল অপরাধী৷গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্য কাউকে আঘাত করে মৃত্যু ঘটিয়েছে,সেটা আলাদা কথা৷তাই এটা খুনই৷তবে গুলিটার টার্গেট ও ছিল না বলে এটাকে অনিচ্ছাকৃত খুন বলা যায়৷”

-“কিন্তু...”

-“ঠিক তাই,এখানেও ‘কিন্তু’৷খুনি আর খুন হওয়া ব্যক্তি কখনও একই ব্যক্তি হতে পারে না৷”

-“বুঝলাম৷আত্মহত্যা কেন?”

-“আত্মহত্যা মানে নিজেকে হত্যা করা৷হত্যার উদ্দেশ্যেই পিস্তলে গুলি ভরেছিল ও আর সেই গুলিতে ও নিজেই খুন হল গুলিটা টার্গেট মিস করায়৷তাই ও নিজেই নিজেকে খুন করেছে,যদিও অনিচ্ছাকৃত ভাবে৷নিজেকে হত্যা করা মানেই আত্মহত্য্য৷”

-“কিন্তু...”

“হ্যাঁ,এখানেও কিন্তু৷উপেনের আত্মহত্যার উদ্দেশ্য তো ব্যর্থ হয়েছে মিস্ত্রিরা ঐ জালটা বিছিয়ে দেওয়ায় যেটার কথা উপেন জানতই না৷পিস্তলে গুলিটা তো ও আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ভরেনি৷ তাই এটা আত্মহত্যা নয়৷”

-“তাহলে কী দাঁড়ালো?”

-“দাঁড়ালো এটাই যে এটা অ্যাক্সিডেন্ট,অথচ অ্যাক্সিডেন্ট নয়৷ খুন,অথচ খুন নয়৷আত্মহত্যা,অথচ আত্মহত্যা নয়৷৷এবার তো তোমার কাজ৷তুমিই ঠিক কর এটা তাহলে কী?কোন ধারা দেবে?”

-“হুমম্,এতো দেখছি বড়ই প্যাঁচালো মামলা৷”

-“তুমি তো প্যাঁচালো মামলাই চাইছিলে৷এবার বোঝো ঠ্যালা!”


       =======০০০=======

 

 চন্দন ব্যানার্জী,
        Flat no. B/1/105,
        PRANTIK,
        Sonarpur Station Road,
        Teghoria.SONARPUR,
        Dt. South 24 Parganas

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩