দুঃখ হলে, কষ্ট পেলে এমনকি আনন্দেও আমাদের চোখে জল চলে আসে। কান্না আমাদের খুবই সাধারণ একটা অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। কান্না অনেক প্রকারের হয়। অনেক মানুষ চিৎকার করে কাঁদেন। আবার অনেক মানুষের কান্নার সময় গলা থেকে কোনও শব্দই হয় না। কান্না কিন্তু শরীরের পক্ষেও প্রয়োজনীয়। অনেক মানুষের আবার চোখে জল আসে না। এই মানুষগুলো ঠিক কাঁদে না, এরা সুস্থ মানুষ নয়।
কিন্তু কেন এই কান্না? মানুষ কাঁদে কেন ? কী এমন হয়, যার ফলে চোখে জল আসে? কোথায় হয়? শরীরে না মস্তিষ্কে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি কাঁদেন।
কান্না কী? এর উত্তরে বলতে হয়, কান্নার তেমন নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। যখন আমরা কষ্ট পাই, যখন আমাদের মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। বিশেষ করে একা অনুভব করলে আমরা বেশি কাঁদি। তাই কান্নাকে বলা যায় মনের রেচক। কান্না মনকে পরিস্কার করে আর আবেগ তাড়িত মনকে শান্ত করে।
মানব জীবনের শুরুই হয় কান্না দিয়ে। মানুষের জন্ম থেকে আমৃত্যু রোজকার জীবনের অনেক উপলক্ষে জড়িয়ে আছে কান্না। কখনো আমরা কাঁদি কষ্ট হলে, কখনো আনন্দে। আবার রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটার সময়ও মা, পিসিমার চোখ থেকে ঝরণার মতো জল পড়তে দেখা যায়।
কান্না আসলে বিশেষ ধরনের উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দেওয়ার একটা জৈবনিক পদ্ধতি। ****
কাঁদার সময় মুখমণ্ডলের পেশি, স্বরযন্ত্রের পেশি, শ্বাসপেশি এবং মুখ খোলা বন্ধের পেশি একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে, তারপর চোখ এবং নাক দিয়ে জল পড়ে। ঠোঁটের কোন গুলো উপরেরে দিকে কুঁচকে গিয়ে দাঁতের পাটি দেখা যেতে থাকে। নাসারন্ধ্র ফুলে ওঠে, মুখ খুলে যায় আর জিভ চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্বরযন্ত্রের পেশিগুলোর সংকোচন - প্রসারণের ফলে বিভিন্ন ধরনের কান্নার আওয়াজ তৈরি হয়।
দেখা গেছে হাসির সময় যে যে পেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, কান্নার সময়ও তারাই সক্রিয় হয়। তবে একথা ঠিক যে, হাসি আর কান্নার অভিব্যক্তি আলাদা হয়।
চোখের উপরের পাতায় থাকে অশ্রুগ্রন্থি বা ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (tear gland or lacrimal gland)। এই গ্রন্থি থেকেই চোখের জল বা অশ্রুর উৎপত্তি। চোখের উপরের অংশের কর্নিয়া এবং শ্বেততন্তুতে থাকে অনেকগুলো ছোট ছোট অশ্রুনালী( tear ducts)। এই নালী পথে অশ্রু পুরো চোখে ছড়িয়ে যায়। এভাবে অশ্রু বা চোখের জল চোখকে আর্দ্র রাখে। অশ্রুনালী ছড়িয়ে থাকে নাসাগহ্বরেও। কোনো ধরনের আবেগ, যেমন বিষাদ, কষ্ট, আঘাত যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন চোখ দিয়ে অশ্রু বা কান্না জল বেরিয়ে আসতে থাকে, এমনকি নাক দিয়েও ঝরে কান্নার জল।
কান্নার সম্পূর্ণ স্নায়বিক কৌশল এখনও জানা যায়নি। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে যতটা জানা গেছে, তাতে এটা বোঝা যাচ্ছে যে কান্নার উপর মস্তিষ্ক মারফত একটা স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ কাজ করে। আমাদের মস্তিষ্ক বেশ জটিল একটা জৈব-যন্ত্র। এই মস্তিষ্কের মস্তিষ্কদণ্ড বা ব্রেনস্টেমের নিম্নাংশের একটা স্নায়ুকেন্দ্র ( পন্টোমেডালারি স্নায়ুকেন্দ্র) কান্নার প্রান্তিক স্নায়ুকেন্দ্র।
সিনেমা, নাটক বা যাত্রায় অনেক সময়ই অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে কাঁদতে হয়, নকল কান্না। প্রাচীন মিশর, চীন প্রভৃতি দেশে মৃত্যুর পর ভাড়া করা কান্নার লোক আনা হত। এই পেশা আজো অনেক মানুষের রুজি রোজগার। মনে পড়ে 'রুদালি' সিনেমার কথা? এই সিনেমাতে এই রকম ভাড়া করা কান্নার লোকেদের জীবন দেখানো হয়েছে। খোদ যুক্তরাজ্যে একটা কোম্পানিই আছে যারা এই নকল কান্নার লোক ভাড়ায় সরবরাহ করে।
ইচ্ছা মত কান্নার এই কৌশলটা তারা অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ত করে। কোন শোকাবহ আবেগ ছাড়াই এই ধরনের কান্না কি করে আসে?
আসলে এখানেও সেই মস্তিষ্ক আর তার সাঙ্গপাঙ্গ উপাঙ্গ দের কৃতকর্ম দায়ী। মস্তিষ্কের করটেক্সের আকার অনেকটা গিরিখাতের মত, এগুলোর উঁচু অংশগুলোকে বলা হয় গাইরাস বা বাংলায় গিরি। এই রকম একটা গিরি থাকে মস্তিষ্কের গোলার্ধের মাঝা-মাঝি তলে, একে সিঙ্গুলেট গিরি বলা হয়। এখানেই কান্নার ঐচ্ছিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, একটা স্নায়ুকেন্দ্র রয়েছে, যেটা আবেগহীন সশব্দ কান্নার আঁতুরঘর।
আবার মধ্যমস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে থাকে একটা জলপ্রণালী, যার চারপাশে থাকে ধূসর পদার্থ। এই অঞ্চলটা যেন অনেকটা রেলওয়ে জাংশানের মত। পুরোমস্তিষ্ক রগখণ্ড আর প্রান্তিয় মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ুতন্তুরা যে খবর বয়ে নিয়ে আসে, তা যদি হয় আবেগ, বিশেষত কষ্ট বা ব্যাথা জনিত কোন অনুভূতি আকুলতা তবে এই ধূসর পদার্থ অঞ্চল উত্তেজিত হয়ে ওঠে আর পড়শি স্নায়ুকেন্দ্র, যাকে আমরা টেগমেন্টাম বলে ডাকি, সেখানে পাঠিয়ে দেয় উত্তেজনার স্পন্দন। এই টেগমেন্টাম এর নির্দেশেই শুকনো কান্নায় ছোঁওয়া লাগে আবেগ আর শোকের, তৈরি হয় বিশেষ ধরনের অভিব্যক্তি। মস্তিষ্কের গভীরে থাকা অবথ্যালামাস ও তখন হয়ে ওঠে সক্রিয়, তার কলকাঠি নাড়ানোর ফলেই কান্নার সঙ্গে যুক্ত হয় কান্না-জল বা অশ্রু। তা বলে এটা ভাবার কোন কারণ নেই, আপনি বা আমি অনন্ত কাল ধরে ইচ্ছা মত কেঁদে যাবো, সেও নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের সেই কর্টেক্স। কতটা চোখের জল পড়লো বা কতটা কাঁদলো কেউ, সে মাপজোকের খবর পৌঁছে যায় কর্টেক্সীয় অঞ্চলে, সেখান থেকে নির্দেশ আসে কান্না কমাবার বা একেবারে থামিয়ে দেওয়ার।
খুব আবেগতাড়িত বা শোকের কান্না কিন্তু আবার পুরোমস্তিষ্কের ললাটখণ্ড আর প্রান্তীয় মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
অনেক দুঃখ, কষ্ট বা শোকের স্মৃতি জমা থাকে মস্তিষ্কের রগখণ্ডের হিপোক্যাম্পাস ও অ্যামিগডালা স্নায়ুকেন্দ্রে। অনেক পুরোনো কষ্টের বা দুঃখের স্মৃতি মনে করে আমরা যে কেঁদে ফেলি তার কারণ এই অঞ্চলে তৈরি হওয়া উত্তেজনার ফল।
সাধারণত দেখা যায় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি কাঁদেন। জার্মান সোসাইটি অব অপথ্যালমোলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে বছরে নারীরা গড়ে ৩০ থেকে ৬৪ বার আর পুরুষেরা গড়ে ৬ থেকে ১৭ বার কাঁদেন। শব্দ করে কান্নার ক্ষেত্রে নারীদের হার ৬৫%। পুরুষরা এদিক থেকে একেবারেই পিছিয়ে! মাত্র ৬% পুরুষ শব্দ করে কাঁদেন ।
শরীরতত্ত্ব বলছে, পুরুষের শরীরে থাকা টেস্টোস্টেরণ হরমোনই কান্নাকে দমিয়ে রাখে। অন্যদিকে, মেয়েদের শরীরে থাকে প্রোল্যাক্টিন যার ফলে তাদের কান্নার প্রবণতা বেশি। কিন্তু এই দু'টো হরমোনের উপস্থিতিই যে নির্দেশ করবে আপনি কাঁদবেন নাকি কাঁদবেন না তা কিন্তু নয়। কারণ কান্না মূলত তিন প্রকার এবং প্রত্যেক প্রকার কান্নার ধরন ও জড়িত রাসায়নিক পদার্থগুলো আলাদা।
চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে প্রোটিনসমৃদ্ধ, ব্যাকটেরিয়ানাশক এক প্রকার তরল পদার্থ নির্গত হয়। চোখ মিটমিট করলে এই তরল পুরো চোখে ছড়িয়ে যায়। এই ধরনের কান্নাকে বলে বেসাল কান্না (basal tears)। এর ফলে আমাদের চোখ সবসততযযযযতময় আর্দ্র এবং সুরক্ষিত থাকে।
পেঁয়াজ কাটার সময় অনেকেই কেঁদে ফেলে, কিন্তু কেন?
এই ধরনের কান্নাকে বলে রিফ্লেক্স কান্না (reflex tears)। রিফ্লেক্স কান্না চোখকে ক্ষতিকর পদার্থ যেমন বাতাস, ধোঁয়া এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ থেকে রক্ষা করে। এর ফলে চোখে হঠাৎ করে পড়া ময়লা, পোকামাকড় চোখ থেকে বেরিয়ে যায়।
আর তৃতীয় ধরনের কান্না হচ্ছে প্রাকৃতিক কান্না (physic tears)। এটা হলো আবেগজনিত কান্না। এই ধরনের কান্নার ফলে আপনার চোখ থেকে ঝর ঝর বাদল ধারার মতো অশ্রুধারা নামতে থাকে! মানসিক চাপ, হতাশা, বিষন্নতা থেকে এই কান্নার সৃষ্টি। এমনকি অনেক সময় অতিরিক্ত হাসলেও আমাদের চোখ থেকে জল পড়ে। এটাও আবেগজনিত কান্না।
ফটোগ্রাফার রোজলিন ফিশার "টপোগ্রাফি অব টিয়ারস" নিয়ে কাজ করার সময় চোখের জলের ব্যাপারে একটি চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কার করেন। তিনি তার নিজের চোখের জলকে একটি স্লাইডে রেখে শুকিয়ে ফেলেন । তারপর আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এটা পর্যবেক্ষণ করেন। "এটা সত্যি মজার ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্লেন থেকে দেখা নিচের কোনো দৃশ্য"। ফিশার বিভিন্ন রকম অশ্রু একই রকম দেখতে কিনা জানার জন্য কয়েক বছর ফটোগ্রাফি প্রজেক্টটি করেন। তিনি নিজের এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীদের থেকে একশর বেশি চোখের জলের নমুনা সংগ্রহ করেন, পরীক্ষা করেন এবং ছবি তোলেন। এর মধ্যে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর অশ্রুও ছিল। তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখের জলেরযে গঠন দেখেন সাধারণভাবে তা ছিল স্ফটিকাকার লবণ।
কিন্তু, বিভিন্ন আবেগীয় অবস্থায় ঝরা জলের আণুবীক্ষনিক পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় এদের আকার এবং গঠন ভিন্ন । সুতরাং, একই রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত দুইটি ভিন্ন ফিজিক টিয়ারসের ছবি ছিল ভিন্ন। মানে আপনি আনন্দে কাঁদলেন আর আপনার বন্ধু দুঃখ পেয়ে কাঁদল … এই দুরকম চোখের জল দেখতে আলাদা হবে। এদের সান্দ্রতা, গঠন, বাষ্পীভবনের হার আরো অনেককিছুতেই পার্থক্য থাকবে।
ফিশারের গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় বিভিন্ন দৃষ্টকোণ থেকে দেখা চোখের শুকনো জলের স্লাইড আকাশ থেকে দেখা বিশাল কোনো দৃশ্যের মতো।তাই তিনি একে বলেন, " মনভূখন্ডের অন্তরীক্ষ দৃশ্য "।
তবে কান্না জনিত এক ধরনের রোগও কখনো কখনো দেখা যায়। অস্বাভাবিক কান্না, কোন কারণ ছাড়াই কেঁদে ফেলা, শোক নেই, দুঃখ নেই অথচ কেঁদে চলা এবং সে কান্না চেষ্টা করেও থামাতে না পারা, এগুলোই সব কান্নার রোগ। কখনো দেখা যায় মস্তিষ্কের ভিতর রক্তক্ষরণে বা সন্ন্যাস রোগে এরকম অস্বাভাবিক কান্নার ঘটনা দেখা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুরোগ রোগীকে এরকম ভাবে কাঁদাতে ওস্তাদ, যেমন অ্যালঝাইমার্স, ডিমনেসিয়া, বহুকাঠিন্য প্রভৃতি। ক্রন্দন -মৃগী রোগে রোগী প্রথমে কেঁদে ফেলে, তারপর খিঁচুনি হয়।
যাইহোক, খাওয়া, ঘুম এরকম বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজকম্মের মতই কান্নাও একটা দরকারি প্রক্রিয়া। আবেগময় কান্না মানুষকে স্বস্তি শান্তি দেয়। শোক, দুঃখের কান্না না থামিয়ে বরং কাঁদতে দেওয়াই উচিত, তাতে সেই মানুষটির ক্ষতি নেই বরং উপকার।
===============================
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন