Featured Post
কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী ও এই সময় ।। সৌমিক ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আজকের সমাজে মানুষের অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে যে চরম অস্থিরতা চলছে, - সেই প্রাসঙ্গিকতায় বিপন্ন সাধারণ মানসিকতায় শুভবোধ বিকাশে কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী এই সময়েও উল্লেখযোগ্য । ভোটের রাজনীতি , নেতা-মন্ত্রীদের বেলাগাম বিবৃতি , অবাধ অত্যাচার , খুন-জখম , কোভিড পরিস্থিতি , চিকিৎসার দূর্নীতি , মৃত্যু-মিছিল , জীবিকা-সংকট , উচ্চবিত্ত গোষ্টীর আস্ফালন , মিডিয়ার প্রচার প্রতিনিয়ত আমাদের বিভ্রান্ত করছে । প্রকৃত সত্য এখনও গভীর গোপন । আমরা সকলেই যারা নিরাপদে আছি ;- তারা নির্লিপ্ত থেকেছি । কিন্তু উপেক্ষিত জীবনকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে কবির সেই উপহাস মনে পড়ে যায় – 'দোহাই তোদের ! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল !/ ঢের দেখালি ঢাক্–ঢাক্–ঢাক্ আর গুড়্-গুড়্ , ঢের মিথ্যা ছল ।/ এবার তোরা সত্য বল ।।/পেটে এক আর মুখে আরেক – এই যে তোদের ভন্ডামী ,/ এতেই তোরা লোক হাসালি , বিশ্বে হলি কম দামী ।'
স্বার্থসিদ্ধি আর বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মব্যস্ততায় জীবনবোধ আজ হারিয়ে যাচ্ছে । মানুষের সীমিত সামর্থে একটু সুখের জন্য যা বোঝানো হয়েছে সেটাই করে চলেছে । নজরুলের লেখনীতে সমাজে সংকীর্ন ধর্মের গন্ডীর উর্দ্ধে প্রকৃত মনুষ্যত্বকেই সকলের আসল পরিচয় হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছিল । তিনি জাতীয় সংকট ও বিচ্ছিন্নতাবাদের মোকাবিলায় সার্বিক ঐক্যবদ্ধতার উদার আহ্বান জানিয়েছিলেন । তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখনীতে আমলা ও সরকারী কর্মচারিদের সাধারণ মানুষের প্রতি অসদাচারণ ভবিষ্যতে দেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে ;- এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন । সেইকারণে স্বাধীন ভারতবর্ষে জাতিভেদ , সাম্প্রদায়িকতা , বর্ণবিদ্বেষ ও শোষণ যে সব নেতৃস্থানীয় মানুষের স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত শাসনের হাতিয়ার ;- সেইসব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছে কাজী নজরুল ইসলাম এখনও ব্রাত্য । যদিও নজরুলের লেখনী কেবলই 'মানব-ধর্ম' অনুসারী ও 'শোষণ মুক্ত , শ্রেনি বৈষম্যহীন , সাম্যবাদী সমাজ গঠন'-এর নীতিতে স্থির ।--- ' সুন্দরের ধ্যান , তার স্তবগানই আমার উপাসনা , আমার ধর্ম । যে কূলে , যে সমাজে , যে ধর্মে , যে দেশেই জন্ম গ্রহণ করি ,- সে আমার দৈব । আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি -----' ।(প্রতিভাষণ ,১৯২৯)
---'গাহি সাম্যের গান- / মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই , নহে কিছু মহীয়ান ! / নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ , অভেদ ধর্ম জাতি, / সব দেশে,সব কালে,ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।'---
---'মূর্খরা সব শোন, / মানুষ এনেছে গ্রন্থ ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!'---(মানুষ,সাম্যবাদী)
এই সময়ে শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার ঘটলেও , - সংবিধান সংশোধনের প্রয়োগ এবং জীবন-জীবিকায় 'রাস্ট্রীয় সংরক্ষণ নীতি'-এর উল্লেখে 'জাতের'-নামে প্রহসনে মানুষকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দিয়েছে । নজরুলের লেখনীতে ছিল উষ্মা ,---'জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া, / ছুঁলেই তোর জাত যাবে ? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।।'---
আজ অহংসর্বস্ব ধর্মের নামে আড়ম্বরের মাঝে 'ভারতীয়' পরিচিতিটা যেন তুচ্ছতায় পর্যবসিত হয়েছে । জাতীয় স্তরে বৈষম্য বা হিংসা নয় 'ভারতবর্ষের' মর্যাদা রক্ষায় যে কোন শিক্ষা-আর্থ-সামাজিক স্তরের প্রত্যেক নাগরিকের একটা দায়িত্ব আছে । 'হিন্দু-মুসলমান' প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ---'অবতার পয়গম্বর কেউ বলেনি – আমি হিন্দুর জন্য এসেছি । তাঁরা বলেছেন – আমরা মানুষের জন্য এসেছি ; -"আলোর" মত সকলের জন্য ।'---
নজরুলের লেখনীতে ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কার , ভন্ডামী , গোঁড়ামি , নিষ্প্রাণ গতানুগতিক
আনুষ্ঠানিকতা ও সঙ্কীর্ণতাকে নস্যাৎ করে অধ্যাত্মবাদের সূচনা ও মানবতার আহ্বান লক্ষ্য করা যায় ,---'এই সে স্বর্গ , এই সে বেহেশত্ , এখানে বিভেদ নাই -, / যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে – ভাই ভাই ।'--- কিন্তু হিংসায় মদমত্ত মানুষের উসকানিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ নৃশংসতায় বিচলিত কাজী নজরুল ইসলাম সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন , ---'হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ? / কান্ডারী ! বল মরিছে মানুষ , সন্তান মোর মা'র ।'---
দাঙ্গাবাজ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন ---'ইহারা ধর্ম মাতাল । মাত্রার বেশি অ্যালকোহল বা মদ পান করলে যেমন মাতালের পরিণতি অবধারিত মৃত্যু ; তেমনই ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে , সেইসব "ধর্ম-মাতাল"-এরও করুণ পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ।'--- রাজ্য তথা জাতীয় প্রেক্ষাপটে 'জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রোধে' নজরুলের এই ধরনের লেখনীর প্রসার আজকের তরুণদের মাঝে বিশেষ জরুরী । অস্ত্র ব্যবসায়ী ও কিছু ব্যক্তির মদতে 'সন্ত্রাসবাদ' সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে । মগজ ধোলাই করা – 'ভীত সন্ত্রস্ত , সুখের স্বপ্ন দেখা , নিরীহ' মানুষের মৃতদেহ "জঙ্গি লেবেল"-এ ক্ষতিপূরণ আর বিবৃতির অতলে বিলীন হয়ে যায় । ভারতের রাজ্যভিত্তিক সব এলাকায় হয়তো এখনও জীবন-জীবিকার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি ; তবুও দিশাহীন পথিককে "মানুষ"-এর প্রকৃত সম্মান দিয়ে সুস্থিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দেওয়ার জন্য নজরুল বলেছিলেন ---'নতুন পথের যাত্রা পথিক / চালাও অভিযান ! / উচ্চকন্ঠে-উচ্চার আজ - / 'মানুষ মহীয়ান" !' ---
আজ নির্লজ্জ বিছিন্নতাবাদের খেলায় মানুষের স্বাভাবিক , শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব যখন বিপন্ন , তখন নজরুলের সাম্যবাদী আদর্শকে নানান গণমাধ্যমের সাহায্যে সকলের মাঝে পৌঁছানো প্রয়োজনীয় ।আত্মকেন্দ্রিক , কর্মব্যস্ত , নির্লিপ্ত মানুষকে আজও সাহস জোগায় নজরুলের লেখনী ---'বল নাহি ভয় , নাহি ভয় ! / বল্ মাভৈঃ মাভৈঃ , জয় সত্যের জয় ।'---
রাজনীতি , ভোট , ক্ষমতাদখল , পেশী আস্ফালন , নিপীড়ন মানুষের নিত্য দিনের জীবনে এক আতঙ্কের ছায়া ফেলেছে । শুধুমাত্র দিবস –পালন , শখের মিছিল–এ নজরুলের কবিতা উচ্চারণে দিনবদল হবে না । এই অপশাসন ব্যবস্থার অবসানে নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বায় সকলকে সামিল করে প্রতিবাদে অনুরণিত হোক আজকের এই অস্থির পরিবেশ । ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মধ্যরাত্রিতে ৩/৪,তালতলা লেনের ছোট্ট ঘরে লেখা 'বিদ্রোহী' কবিতা আজও সকলের অকুতোভয় জীবনের মর্মবাণী ।---'আমি সেইদিন হব শান্ত , / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না / অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না- / '---
আজকের নারী-স্বাধীনতার বয়ানে সাহিত্য – চলচ্চিত্র – নাটক- সিরিয়ালে বাস্তবের নারীচরিত্র বহুল অপমানিত । আবার ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের 'খড়ির গণ্ডিতে' নারীকে আজও আটকে রেখে মানুষ-মানুষীর স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রকাশ করা হয় । কিন্তু নারীমুক্তি বিষয়ে নজরুলের লেখনী ছিল সাবলীল ---' আমি মহাভারতী নারী , / আমি কৃশ-তণু-অললিতা ; / "স্বাহা"-আমি তেজ তরবারি ।।'
আজও জীবনের অসফলতায় আর হতাশায় ভাগ্যের দোহাইকে অগ্রাহ্য করার জন্য তাঁর লেখনী উৎসাহ যোগায় ---'আমি বিধির বিধান ভাঙ্গিয়াছি , আমি এমনি শক্তিমান ।'--- এই বিপন্ন পরিস্থিতিতে তাঁর মতাদর্শে অনুপ্রাণিত অসংখ্য যুবক-যুবতীরা সেবাব্রতী ভূমিকায় মানুষের পাশে আছেন । কারণ নজরুল 'যৌবনের গান' প্রবন্ধে লিখেছিলেন ---'আমার একমাত্র সম্বল – আপনাদের তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা ; প্রাণের টান ।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত ৩০০০ সঙ্গীতের মধ্যে মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০টি আমরা বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনায় শুনতে পাই । সেইকারনে নজরুলগীতির সঙ্গীত-মাধুর্য্য থেকে আজকের প্রজন্ম বঞ্চিত । আবার উদার অর্থনীতির জোয়ারে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের রোজগারের অভিমুখ আজ নিম্নগামী । সরকারী উদাসীন্যে ও বিদেশী পুঁজির আগ্রাসনে শিল্প ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার
অবদমিত । এমতাবস্থায় ---'আমি চিরবিদ্রোহী বীর , / আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির ।।''--- "অগ্নিবীণার" এই উদাত্ত আহ্বানে অনুপ্রাণিত মৃত্যুভয়হীন এক যোগ্য নেতৃত্ব কর্মতৎপরতায় নিরপেক্ষ সাংগঠনিক প্রয়াসে তুলি , কালি , কলম , রঙ , কাগজ , কাপড় আর গণ মাধ্যমের হাতিয়ার নিয়ে হয়তো কাজী নজরুল ইসলামের 'সাম্যবাদী সমাজ' গঠনের স্বপ্নটিকে এখনও সত্যি করতে পারেন – এই সময় । ভাস্বর হোক নজরুলের 'এক জাতি – এক প্রাণ মন্ত্র' ।
লেখক পরিচিতি –
নাম –সৌমিক ঘোষ
ঠিকানা – ৬৭/জি ; জি.টি.রোড (পশ্চিম)
শ্রীরামপুর – ৭১২ ২০৩,জেলা – হুগলী .
আলাপন – ৮১০০১৭৪৩৬০
ইমেইল – soumikghosh57@gmail.com
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন