কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল । গুটিগুটি পায়ে বাড়ি ফিরল কানাই বাবু।
চোখেমুখে দুঃশ্চিন্তার ছায়া।
ভেতর থেকে মধ্য বয়স্কা এজজন বেরিয়ে এল।
"কি গো,এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? এই যে বললে,আজ ফিরতে একটু রাত হবে। অনেক কাজ বাকি। তাহলে এই ভোর দুপুরে কড়া রোদে বাড়ি এলে যে? শরীর টা খারাপ করছে বুঝি ? একটু ঠান্ডা জল খাবে? কি গো,কিছু বলো? এক টানা কথাগুলো বলে গেল। স্থির ভাবে বসে রইল কানাইবাবু।অনেক পরে বলল,আমায় নিয়ে এত ভেবো না গিন্নী । আমি ঠিক আছি।
আর কিছু খাবো না। একটু ঘুমাতে দাও।
একা বিছানায় শুয়ে থেকে ভাবনাগুলো দোলা পাকাতে থাকে চোখের সামনে।
এই তো সেদিন কত লোকের ভীড়। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। টাইপ করার জন্য। একের পর এক টাইপ করেই চলেছে। ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যেত দিন গুলি।
তারপর কি যে হলো? হঠাৎ কমতে থাকে মানুষের ভীড়। শোনা গেল কি একটা মেসিন আবিষ্কার হয়েছে। অনেক দ্রুত কাজ করতে পারে। ব্যস! ধীরে ধীরে কমতে থাকে কাজ।চাহিদা। তবু আশাহত হয় নি।
বড্ড একা আজ । তবু ছাড়তে পারে নি একাজ।
এত গুলো বছর,যার জন্য সংসারের সবার চাহিদা মিটেছে। সুখের সংসার গড়েছে।
সেই আপন বন্ধুকে কি করে ভুলে যায়?
যাই ঘটে যাক।যার সেবায় এত দিন জীবিকা করেছি।তাকে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। সেই বন্ধু আর কেউ নয় আদরের টাইপ মেসিন।
একে একে সবাই এ কাজ ছেড়ে অন্য পথ বেছে নিয়েছে। তবু কিছুতেই মায়া ছাড়তে পারিনি । এখন বয়স ৬৫ ছুঁই ছুঁই। তবু বুক দিয়ে আগলে রেখেছি টাইপ মেসিন টা।
আদালত চত্ত্বরে এখন ও অল্প কিছু টাইপিস্টদের দেখতে পাওয়া যায়। বেশ কিছু কাজ টাইপ ছাড়া করা সম্ভব হয় না।
আজ ই আদালত পাড়ার কিছু গুন্ডা হুমকি দিয়ে গেছে।জায়গাটা খালি করতে হবে। এখানে বড় অফিস হবে। সব কাজ ই কম্পিউটারে হবে। এসব টাইপ মেসিন আর থাকবে না।
এত দিন বুক পেতে বসে ছিল।আসন্ন নির্বাচনে যদি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয় টাইপিস্টদের জন্য।
সে আশায় জল ঢেলে দিয়েছে।
কিন্তু একথা বাড়িতে কিছুতেই জানাতে পারবে না । তাই চুপচাপ শুয়ে থাকল।
পরের দিন ছেলে বাবার জন্য একটা কম্পিউটার কিনে আনল। বাবার কাছে গিয়ে বলল সব শিখিয়ে দেব তোমায়। টাইপ মেসিন টা বিক্রি করে দাও। কম্পিউটারে কাজ শেখো। দেখবে আবার কাস্টমারে ভরে যাবে।
ধার দেনা করে অনেক কষ্টে এটা কিনেছে। কিছুতেই বাবাকে জানাতে পারবে না। কোথা থেকে ছেলে খবর পেয়েছে, আদালত পাড়ার সব ঘটনা।
বাবার জন্য যেটুকু সম্ভব তাই করল।
বাবা হেসে বলল, আমার আর কম্পিউটার শেখার বয়স নেই খোকা। তুই এটা রেখেদে নিজের জন্য। আমার ওই টাইপ মেসিন ই থাক।
কিছুতেই বাবাকে রাজী করাতে পারল না কম্পিউটার শিখতে। সবার বারন উপেক্ষা করে যথারীতি আবার হাতে ছাতা চোখে চশমা পরে বেরিয়ে পরল কাজে।
বেলা যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রির অন্ধকার নেমে এল। তখনও ফিরল না। একটা কিপ্যাড ফোন ছিল কানাইবাবুর কাছে।
বার দশেক কানাই বাবুর স্ত্রী ফোন করেছে। কোনো উত্তর আসে নি।
টিভি খুলতেই খবর দেখালো।
আদালত পাড়ায় গন্ডগোলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেশ কিছু জন আহত হয়েছে।
এক মুহুর্ত দেরি করল না।
পুলিশে মানুষের ভীড়ে গাদাগাদি। বহুকষ্টে কাছে যেতে ই আঁতকে উঠল। একি! টাইপ মেসিন চেপে জড়িয়ে কে পড়ে আছে?
সবার মুখে এককথা, ইনি হলেন সবচেয়ে পুরান এখানকার টাইপিস্ট কানাই বাবু।
লাঠির ধাক্কায় আহত হয়ে জ্ঞান হারাল কানাইবাবু।
তবু টাইপমেসিন ছাড়েন নি। স্বস্নেহে আগলে রেখেছে দুহাতে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন