বৃষ্টি
শুরু হয়েছে কি হয়নি, শুধু আকাশে মেঘ করেছে দেখেই, অনেকে আছেন যাঁরা ছাতা
নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। যে সব মেয়েরা জলের ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য
সামান্য কোনও শেডের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন বা বড় বড় ফোঁটা পড়ার আগেই বাস
স্টপেজে পৌঁছে যাওয়ার জন্য ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই লম্বা লম্বা পা ফেলে
প্রায় ছুটছেন কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই অল্প বৃষ্টি মাথায়
নিয়ে যাঁরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন, তাঁদের মাথায় একটু ছাতা ধরার সুযোগ
পাওয়ার জন্য।
না, পুরুষ হলে হবে না। বাচ্চা হলেও নয়।
মেয়েই হতে হবে এবং বয়স হতে হবে ষোলো থেকে ছত্রিশের মধ্যে। না হলে ছাতা ধরে
কী লাভ! কারও কারও ক্ষেত্রে এই বয়সের গণ্ডিটা অবশ্য একটু কম বেশি হয়।
আর
এই সব পুরুষরা বেরোবার সময় মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন, হে মা
কালী, ও বাবা লোকনাথ, হে জগধাত্রী, আজ যেন কোনও মেয়েই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে না
থাকে। বেরোলেও সেই সব ছাতা যেন দরকারের সময় না খোলে কিংবা হ্যান্ডেল ভাঙা
থাকে। হে মা, হে বাবা, এই অভাগাকে একটু দেখো!
এই সব পুরুষরা সারা বছর ধরে অপেক্ষা করেন, কবে আসবে আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস! কারণ, এই দু'মাসই হল বর্ষাকাল।
বৃষ্টির
সঙ্গে আমাদের প্রেম সেই আদিকাল থেকেই। বৃষ্টি আমাদের প্রথম প্রেমিক,
আমাদের প্রথম প্রেমিকা। তাই বর্ষায় জমে ওঠে অনন্য প্রেম। বর্ষা নিয়ে কত যে
গল্প, ছড়া, কবিতা, গান লেখা হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সেই জন্যই হয়তো
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, 'বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে
অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।' এটা আসলে কবিদের ঋতু।
রবীন্দ্র-নজরুলের ঋতু।
রবীন্দ্রনাথের কাছে সব ঋতু
প্রিয় হলেও বর্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিঃসন্দেহে একটু বেশি। তাই
বারবার তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে বর্ষার আগমন, সৌন্দর্য আর প্রস্থান। বর্ষা
নিয়ে তিনি লিখেছেন গান, কবিতা, ছড়া, গল্প এমনকি জীবনস্মৃতিও। তাঁর
বর্ষাবন্দনা এতই সমৃদ্ধ যে, বাংলা সাহিত্যে এমন বর্ষাবন্দনা সত্যিই মেলা
ভার।
তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর সব কবিতা বিষয়বস্তু
অনুসারে সাজানো হলে দেখা যাবে বর্ষার কবিতাই সবচেয়ে বেশি। গানের ক্ষেত্রেও
তাই। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ২৮৩টি। তার মধ্যে বর্ষা
পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০টির মতো। তিনি লিখেছেন, আজি ঝর ঝর মুখর বাদলদিনে
/ জানি নে, জানি নে কিছুতেই / কেন মন লাগে না... কিংবা এমন দিনে তারে বলা
যায় / এমন ঘনঘোর বরিষায়, / এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে / তপনহীন ঘন তমসায়...
'বাদল
দিনের প্রথম কদমফুল' হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন কবি। বলতেন, 'মন মোর
মেঘের সঙ্গী, / উড়ে চলে দিগ-দিগন্তের পানে...' কিংবা বৃষ্টির ছোঁয়ায় যখন
আনন্দে নেচে উঠত মন, তিনি গেয়ে উঠতেন--- হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে / ময়ূরের
মতো নাচে রে...
বর্ষার মধ্যে রয়েছে এমনই সুর, ল'য়ের
মাদকতা যে, বসন্তকালকে বাদ দিলে দেখা যাবে ছয় ঋতুর মধ্যে কেবল বর্ষাকালই
দখল করে আছে রাগ-রাগিণীর বেশির ভাগ জায়গা। সংগীতশাস্ত্রে বর্ষার জন্য আলাদা
ভাবে বরাদ্দ হয়েছে--- মেঘ, মল্লার।
শুধু গান বা
কবিতা নয়, কত গল্প উপন্যাসে যে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে ধরেছেন! বর্ষার প্রেমে
পড়ে ১৩২১ সালের আষাঢ় মাসে 'আষাঢ়' নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি।
বর্ষায়
যে কত লোক প্রেমে পড়েছেন! এক সময় তো বাংলা সিনেমায় আকছারই দেথা যেত,
আচমকা বর্ষার কবলে পড়ে কোনও গাড়িবারান্দার নীচে কিংবা ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা
কোনও গাছের তলায় অথবা কোনও পরিত্যক্ত নির্জন ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে
নায়ক-নায়িকা। হঠাৎ আকাশ বিদীর্ণ করে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বাজ পড়ল কোথাও, আর সেই
বিকট শব্দে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে নায়িকা সপাটে জাপটে ধরল নায়ককে। শুরু হল প্রনয়
পর্ব।
বর্ষায় সব কিছু কি শুধু বড়দেরই হয়! ছোটদের কিছুই হয় না! অবশ্যই হয়।
বৃষ্টির
দিনে অন্ধকার নামলেই বাচ্চারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে এখনও ঠাকুমা-দিদিমাকে
ধরে ভূতের গল্প শোনার জন্য। কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হলেই টপাটপ পড়তে থাকা আম
কুড়োনোর জন্য ছুটে যায় কিংবা শিলাবৃষ্টির সময় শিল কুড়োনোর জন্য সটান নেমে
পড়ে ঝড়-জলের মধ্যেই। খোলা আকাশের নীচে। বড় হয়ে গেলে ফের এই স্বাদ
পাওয়ার জন্য বড়দের মন বড় ছটফট করে।
একটু বড় বয়সে
বৃষ্টিতে ভিজে এসে চা চাননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তেলেভাজা গিয়ে
মুড়ি খাওয়াও বর্ষার একটা অঙ্গ। আর সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলে? খিচুড়ি
অবধারিত। সঙ্গে বেগুন ভাজা।
গভীর রাতে টিনের চালে
একটানা পড়া বর্ষার বড় বড় ফোঁটার শব্দ যাঁরা শোনেননি, তাঁরা বড়ই অভাগা।
সেই শব্দ শুনে এক কবি বলেছিলেন, বর্ষাকন্যার উদ্দাম নৃত্য।
বহুকাল
আগে আর এক কবি, কালিদাস এ ভাবেই মুগ্ধ হয়েছিলেন আষাঢ়ের রূপে। 'আষাঢ়'
শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব আছে। আছে স্বপ্নাবিষ্ট এক
মোহময়তা। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ প্রাণকে ঠান্ডা করার জন্য
বর্ষাকালের কোনও জুড়ি নেই।
প্রতি বছর আটই জুন বর্ষা
আসার কথা থাকলেও সব সময় যে তিনি একেবারে ঠিক সময় মতো আসেন, তা কিন্তু নয়।
তবে আষাঢ় মাসেই আসেন। থাকেন একটানা ভাদ্র মাস অবধি।
আর
বর্ষা এলেই সব খাল, বিল, পুকুর, নদী, নালা জলে ভরে ওঠে। এর পুকুর মিশে যায়
ওর পুকুরের সঙ্গে। এ পুকুরের মাছ চলে যায় তার পুকুরে। তখন শুধু বড়রাই নয়,
কচিকাঁচারাও গামছা নিয়ে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। মাছ খাওয়ার চেয়েও মাছ ধরার যে
কী মজা, তা একমাত্র তাঁরাই জানেন, যাঁরা বর্ষাকালে জমা জলে শখ করে মাছ
ধরেন।
এই সময় চারিদিকে শুরু হয়ে যায় ইলিশ উৎসব।
গঙ্গার ইলিশ। পদ্মার ইলিশ। তার কত রকম রান্নার গাল ভরা নাম--- ইলিশ কোপতা
কারি, লেবু ইলিশ, ইলিশ কাসুন্দি, আস্ত বেকড ইলিশ, কাঁটা গলানো ইলিশ, টক
মিষ্টি ইলিশ, ইলিশ কোরমা, নোনা ইলিশ ভুনা, আনারস ইলিশ, ইলিশ মালাইকারি,
আস্ত ইলিশ রোস্ট, ইলিশ ভিন্দালু, লবনে বেকড ইলিশ, অরেঞ্জ ইলিশ, ইলিশ কোপতা,
ইলিশ পোলাও--- বলে শেষ করা যাবে না। তবে ও সব নয়, বাঙালির পাত মূলত ভরে
ওঠে ইলিশ মাছের পাতুরি, ইলিশ ভাপা, সরষে ইলিশ, ইলিশের টক আর খুব বেশি
হলে--- দই ইলিশে। এমনি ছোট ছোট বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের পাতলা ঝোলও যেন
বাঙালির কাছে অমৃতের সমান। কোনও অংশে কম যায় না, মচমচে ইলিশ ভাজাও। সেই মাছ
ভাজার তেল আর কাঁচালঙ্কা দিয়েই কেউ কেউ অনায়াসে সাবাড় করে দিতে পারেন
পুরো এক থালা ভাত। তাই বর্ষা মানেই ইলিশ মাছ। আর ইলিশ মাছ মানেই বর্ষা।
একটা যেন আরেকটার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
বর্ষাকে
নানা জন নানা রকম ভাবে দেখেন। কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে দেখতেন, 'বাদলের
পরী' হিসেবে। বর্ষাকে তিনি উপভোগ করেছেন অন্তর থেকে। তাই তো বর্ষা চলে
যাওয়ার সময় তাঁর মন বলে উঠেছে--- ওগো বাদলের পরী! / যাবে কোন দূরে, / ঘাটে
বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।
ছন্দের জাদুকর
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেও বর্ষার রূপ আকৃষ্ট করেছিল প্রবল ভাবে। তাই তিনি
বর্ষার সৌন্দর্য দারুণ ভাবে বর্ণনা করেছেন তাঁর বিভিন্ন কবিতায়।
আসলে
বর্ষা হল, মৌসুমী বায়ু যে অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায়, সেই সব অঞ্চলের
একটি ঋতু। মৌসুমী বায়ুর প্রভাব যখন সক্রীয় হয, তখন প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুয়ায়ী এটি বছরের দ্বিতীয় ঋতু। বর্ষার আগের ঋতুটি হল
রৌদ্রতপ্ত--- গ্রীষ্মকাল। আর পরের ঋতুটি হল সুন্দর--- শরৎকাল।
বর্ষা
মানেই শুধু গোটা দেশ সবুজে সবুজ হয়ে যাওয়া নয়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তরতর করে
গাছেদের বেড়ে ওঠা নয়। চাষিদের মুখে হাসি ফোটা নয়। বর্ষা মানে গোটা দেশ
ফুলে-ফুলেও ছেয়ে যাওয়া। এই সময় মন ভাল করে দেয়--- কদম, বকুল, কলমি ফুল,
স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী,
গুল নার্গিস, দোপাটি, অলকানন্দ, রঙ্গন।
কদম : বর্ষা মানেই কদম ফুল। গাছে গাছে ফুটে থাকা কদমফুল বর্ষার প্রকৃতিতে এনে দেয় নজরকাড়া সৌন্দর্য।
বকুল : এই ফুল শুকিয়ে গেলেও এর সুবাস অনেক দিন পর্যন্ত থাকে। তাই একে সুবাসিত ফুল বলা চলে। পাঁচ বৃন্তের এ ফুলে অসংখ্য পাপড়ি থাকে।
শাপলা
: খাল, বিল, পুকুর বা যে কোনও জলাশয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা ফুটে
থাকার দৃশ্য গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য আরও ফুটিয়ে তোলে। আমাদের দেশে সাদা, গাঢ়
লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলা বেশি দেখা যায়।
কচুরিপানা
: প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর আর এক ফুল--- কচুরিপানা। খুব অবহেলিত হলেও এর
সৌন্দর্য হৃদয় কাড়ে। গ্রামাঞ্চলের খাল, বিল, পুকুরে প্রচুর কচুরিপানা হয়।
গাঢ় সবুজ পাতার ওপরে সাদা আর বেগুনি রঙের মিশেল ফুলগুলোকে অসম্ভব সুন্দর
করে তোলে।
কলমি ফুল : কলমি গাছের বৈশিষ্ট্য হল বর্ষার
জল যত বাড়ে, গাছ তত লম্বা হয়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবুজ পাতার ফাঁকে
ফাঁকে উঁকি মারে বেগুনি রঙের মন-মাতানো কলমি ফুল।
দোপাটি
: বর্ষায় খুব আকর্ষণীয় গোলাপি, লাল, বেগুনি, আকাশি, নীল, সাদা-সহ বেশ
কয়েকটি রঙের দোপাটি ফুল মানুষকে চোখ ফেরাতে দেয় না। দোপাটি একক এবং জোড়ায়
জোড়ায়ও ফুটতে দেখা যায়।
দোলনচাঁপা : সাদা রঙের ফুল। বড় বড় পাপড়ি দুটি প্রজাপতির ডানার মতো দেখায় বলে এর ইংরেজি নাম--- 'বাটারফ্লাই লিলি।
চালতা
ফুল : বর্ষার বৃষ্টিতে চিরসবুজ চালতা গাছের রূপ ফুটে ওঠে তার ফুলের
বাহারে। আকারে বেশ বড়, সাদা রঙের পাপড়ি ও হলদে পরাগকেশরের মিশেলে
দৃষ্টিনন্দন চালতা ফুল বর্ষার প্রথম দিকে ফোটে।
বাংলা
ভাষার অমর কাব্য 'মেঘদূত'-এর মহাকবি কালিদাস তো এই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই
বিরোহী যক্ষ্ম মেঘকে দূত করে সুদূর দুর্গম কৈলাশের চূড়ায় পাঠিয়েছিলেন
বিরোহিনী প্রিয়ার কাছে। তিনি এই আষাঢ় মাসেই চিরায়ত কাব্যগ্রন্থ 'মেঘদূত'
রচনা করেছিলেন।
এই বর্ষাকে কত লোক যে কত ভাবে কাজে
লাগায়! ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে কি হয়নি, ফাঁকিবাজ কত লোক যে তার দোহাই
দিয়ে অফিস কামাই করে, তার ঠিক নেই। আবার বৃষ্টি হলে কেউ কেউ বলে ওঠেন--- হে
বর্ষা, এত বেশি ঝোড়ো না যে, আমার প্রেয়সী আমার কাছে আসতে না পারে! ও আসার
পরে এত মুষলধারায় ঝোড়ো, যেন ও যেতেই না পারে।
প্রকৃতির
কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন 'ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।' অন্য দিকে
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন ধ্রুপদী সেই পঙতি, 'গভীর গর্জন করে
সদা জলধর / উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর।'
কবি রঞ্জনা রায়
বৃষ্টিকে নিয়ে এত কবিতা লিখেছেন যে, তাঁকে বর্ষার কবিও বলা চলে। তিনি তাঁর
'বৃষ্টি' কবিতায় লিখেছেন, 'শরীর জুড়ে বৃষ্টি ফোটা খেলা করে / যেন
চেতনার কাচঁ ঘরে গহন রূপকথা / রোমকূপে জন্ম নেয় সজল শ্যামল আষাঢ়/ ভিজে
যাই / ভিজে যায় তপ্ত মিলনক্ষন।'
বাঙালির অতি প্রিয় এই ঋতুর আগমনে পুরো প্রকৃতি তার রূপ ও রং বদলে ফেলে। পেখম মেলে নাচতে শুরু করে ময়ূর।
এর
পাশাপাশি, যাঁরা কবিতার ধার ধারেন না, তাঁদের অনেকের কাছেই বর্ষাকালটা খুব
ভোগান্তির। কেননা আষাঢ় মানেই বৃষ্টির ঘনঘটা। বৃষ্টির তোড়ে যাওয়া যায় না
ঘরের বাইরে। কমে যায় দিনমজুরের আয়-উপার্জনও।
তবু
বর্ষা ঋতুকে বরণ করে নিতে প্রতি বছরই বর্ষা উৎসবের আয়োজন করে বিভিন্ন
সাংস্কৃতিক সংগঠন। বর্ষাপ্রেমীদের মনেপ্রাণে বেজে ওঠে---'পাগলা হাওয়ার বাদল
দিনে, / পাগল আমার মন জেগে ওঠে।'
পুরনো ভারতীয়
সাহিত্যে কবিরা বর্ষাকালকে বিরহের কাল হিসেবেই বিবেচিত করতেন। কারণ, ভারতে
বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে পথঘাট ও মাঠপ্রান্তর জলে ডুবে যেত। চলাচলের জন্য
সে রকম কোনও যানবাহন তখন ছিল না। প্রবাসী স্বামীরা বর্ষা নামার আগেই বাড়ি
ফিরতেন। বণিকেরাও তাই করতেন। কিন্তু কেউ যদি বর্ষার আগে বাড়ি ফিরতে না
পারতেন, তা হলে তাঁকে পুরো বর্ষাকালটাই কাটাতে হত নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে।
বর্ষাকে নিয়ে যত না লেখা হয়েছে প্রেমের কবিতা, তার চেয়ে বেশি লেখা হয়েছে
বিরহের কবিতা। সে জন্য বর্ষাকে বিরহের কালও বলা হয়।
বৈষ্ণব
কবিদেরও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়।
পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস,
গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। বিদ্যাপতির
বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব হিসেবে দেখা
দিয়েছিল মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে
উসকে দেবার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে। এ বর্ষা যেন প্রেমানলে
ঘৃতের ছিটে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে রাধার কণ্ঠে বেজে উঠেছে--- এ ঘোর রজনী
মেঘের ঘটা / কেমনে আইলো বাটে / আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে /দেখিয়া পরান
ফাটে। (চন্ডীদাস)।
আবার রাধা বলেছে--- এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর / এ ভরা বাদর মাহ বাদর / শূন্য মন্দির মোর। (বিদ্যাপতি)।
এখানে বৃষ্টির জল যেন রাধার চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে। যা পৃথিবীর সকল প্রেমিকাকেই ব্যাকুল করে তোলে।
ব্যাকুল
করে তোলে এখনকার লোকজনকেও। তাই তুমুল বৃষ্টির পরেই যখন কলকাতার ঠনঠনিয়া,
কলেজ স্ট্রিট, গড়িয়াহাট-সহ শহরতলির বিভিন্ন নিচু জায়গায় জল জমে যায়, তখন
বহু পুরুষ মানুষ, প্রায় হাঁটু অবধি কাপড় তুলে জল ভেঙে ভেঙে কোনও রকমে টাল
সামলাতে সামলাতে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের দেখার জন্য উসখুস করেন।
না,
কেউ কেউ যে এর ব্যতিক্রম নয়, তাও নয়। তাই যে লোকটা একের পর এক সেলুলয়েড
বানিয়ে এই একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দর্শকদের মজিয়ে রেখেছেন, নির্ভেজাল
আনন্দে ভরিয়ে রেখেছেন, সেই চার্লি চ্যাপলিন অনায়াসেই বলে ওঠেন, আমি
বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালবাসি, যাতে কেউ আমার চোখের জল দেখতে না।
------------------------------------
সিদ্ধার্থ সিংহ
২৭/পি, আলিপুর রোড,
কলকাতা ৭০০০২৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন