যোগবানি এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে ছুটে চলেছে বিহার ।
অন্তরা যাবে আরারিয়া, ওখানেই তার নতুন চাকরির পোস্টিং।
সেখানে গিয়ে নতুন ভাবে বাঁচতে চায় অন্তরা...
সকাল এগারোটা, ট্রেন এসে থামে কাঠিহারে । এখান থেকে লোক নামার থেকে যেন ওঠার সংখ্যাই বেশি , ভীর অনেকটা বেড়ে গেল।
আবার ট্রেন ছাড়ে অন্তরা জানালা দিয়ে বাইরে দেখে-' স্বচ্ছ নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। অন্তরার নিজেরও মনে হচ্ছে,' সেও প্রবাসী মেঘের মতো অজানা পথে ভেসে যাচ্ছে',ভাবনায় ডুবে যায় অন্তরা,' আর মাত্র এক মাস বাকি দুর্গাপূজার,'। এবার পূজোতে অন্তরাকে বোধহয় আরারিয়াতেই কাটাতে হবে।
গত দুর্গাপূজাতে অঙ্কিতের সঙ্গে পূজোটা খুব ভালই কেটেছিল তার, আজ যেন তার জীবনে চারপাশটা শূন্য শূন্য লাগছে'।
পেছনের দিনগুলোর কথা ভাবতে না চাইলেও বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মনের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যায় অন্তরার।
ওপাশে এক কালো মত মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে বটে কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে তিন-চারজন ভদ্রলোক তাদের মধ্যে একজন লম্বা-চওড়া, ফর্সা করে সুন্দর ভদ্রলোক বোধহয় মহিলাটার স্বামী, তিনিও বসার জায়গা পাননি অথচ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তালপাখা দিয়ে হাওয়া করে চলেছে স্ত্রী- বাচ্চাকে ।
অন্তরা ভাবে,'সত্যি কারের ভালোবাসা বোধহয় এমনটাই হয়'।
বিকেল চারটে ট্রেন পৌঁছালো আরারিয়া স্টেশনে।
এক বাঙালি প্রফেসরের বাড়িতে অন্তরা পেইন গেস্ট হিসেবে থাকবে। সব কিছু আগে থেকেই ফোনে ঠিক করা আছে।
প্রফেসর ভদ্রলোক স্টেশনে এসেছেন অন্তরাকে রিসিভ করতে।
রাস্তায় আস্তে আস্তে প্রফেসর ভদ্রলোক বললেন-
'আমাদের বাড়িতে তোমার কোন অসুবিধা হবেনা মামনি', কারণ বাড়িতে কেবল আমি আর আমার স্ত্রী থাকি, আমাদের একমাত্র ছেলে সে কলকাতায় থাকে, খুব ভালো পোস্টে চাকরি করে সে। ছুটিছাটায় বাড়িতে আসে।
তবে দুর্গা পূজোতে কখনো বাড়ি আসে না, ছেলে বলে, 'কলকাতার পূজো ছেড়ে কেউ বিহার যায়'?
আমাদেরও ডাকে ওখানে কিন্তু আমরাও পূজোর মধ্যে বাড়ি ছেড়ে যেতে চাই না ।
এবার ভালোই হলো -'আমাদের একাকিত্বের সাথ দিতে তুমি চলে এলে"।
গাড়ি এসে যেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালো, 'অন্তরা দেখে অবাক'!
সারা বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা , বড় সদর গেট দিয়ে ঢুকে কিছুটা বাঁধানো রাস্তা ,রাস্তার দু'পাশে রয়েছে নানা রকম ফুলের গাছ।
তারপর বিশাল দোতলা বাড়ি ।
অন্তরার মনে হচ্ছে কোন এক বাগান বাড়িতে প্রবেশ করছে সে ....
ছোট থেকেই অন্তরার বড় বাগান যুক্ত বাড়ি খুব পছন্দ , কিন্তু কলকাতায় এতো ফাঁকা জায়গা কোথায়?
বাড়ির ভেতর থেকে বছর পঞ্চাশের এক সুন্দরী মহিলা বেরিয়ে এলেন,' উনি বুঝি প্রফেসর বাবুর স্ত্রী'।
অন্তরা দুজনকে প্রণাম করলে- মহিলা খুব খুশি হয়েই বললেন,' থাক মা থাক ,আজকাল তো ছেলে -মেয়েরা এই সৌজন্যতা ভুলেই গেছে'।
অন্তরা ইচ্ছে করেই বাংলা ভাষায় ওনাদের কাকু কাকিমা বলে ডাকে, ওনাদেরও এই ডাক শুনতে খুবই ভালো লাগে।
অন্তরা মনে মনে ভাবে এখানে আসার আগে কত চিন্তাই না সে করেছে , এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে সে।
যে ঘরে অন্তরা থাকবে সেই ঘরটি প্রফেসর বাবুর স্ত্রী আগে থেকেই সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছেন, ভদ্রমহিলাকে যেমন দেখতে সুন্দর তেমন তিনি তার বাড়িটিও রেখেছেন খুব পরিপাটি করে ।
নতুন জায়গা ,নতুন ঘর আজ রাতে অন্তরার ঘুম আসবে না কারণ জায়গা বদলে প্রথম রাত তার ঘুম হয় না কোথাও ।
জানালা দিয়ে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, আজ কালেই বোধ হয় পূর্ণিমা বাইরে চাঁদের আলোয় অনেকটা স্পষ্ট।
অন্তরার মনে পড়ে,' গত লক্ষ্মীপূজোর কথা,
অঙ্কিত তাদের বাড়িতে প্রসাদ খেতে এসে সেদিনই বলেছিল -'তার সাথে মেঘার আলাপের কথা'।
সাথে এও বলেছিল,' মেঘা অন্তরার মতো সাদামাটা না, অনেকটা স্মার্ট'।
এর আগেও অঙ্কিতের মুখে শুনেছে যে অন্তরার সাজ একটু সেকেলে, সে কেন শাড়ি, চুরিদার পরতে ভালোবাসে? জিন্স টপ কেন পরে না ?
সেদিন কোথাও যেন অন্তরার মনে কথাটা সুঁচের মতো বেঁধেছিলো।
আস্তে আস্তে অঙ্কিত দেখা করা বন্ধ করে দিল।
কিছু দিনের জন্য অন্তরা একদম ভেঙে পড়ছিল। তারপর এই নতুন চাকরিটা পেয়ে সে বাঁচার পথ খুঁজে পায়।
আজ অন্তরার অফিসে প্রথম দিন ছিল ,'জয়েন করে সকলের সাথে আলাপ মিটিয়ে নিজের কাজ বুঝে নেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু কাজ ছিল না তাই সারে চারটের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো।অন্তরা শুনতে পেল পাশের ঘরে কাকু কাকিমা মনে হচ্ছে কার সাথে কথা বলছেন, অন্তরা সেদিকে না গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে চার কাপ কফি নিয়ে কাকু -কাকিমা ঘরে ঢুকে,
প্রফেসর গিন্নি বলেন ,'আরে অন্তরা তুমি আবার কফি করে আনতে গেলে কেন '? আমাকে ডাকলেই তো পারতে- মা।
প্রফেসর গিন্নি ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,'জানিস বাবাই মেয়েটা বড্ড ভালো রে'!
ওহো ! তোমার সাথে তো আলাপ করাইনি, 'অন্তরা এই দেখো ,এটা আমার ছেলে, আমি আদর করে ওকে বাবাই বলে ডাকি,'কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এল।
অন্তরা মুখে নমস্কার বলে,'কফির কাপটা হাতে দিতে যাবে , অন্তরার হাত থেকে কাপটা নিচে পড়ে যায় কাকে দেখছে সে, এ তো অঙ্কিত!
অন্তরা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসে, পিছে পিছে অঙ্কিতও আসে,
অন্তরা পিছন ফিরে বলে,' আমি জানতাম না এটা তোমাদের বাড়ি জানলে কখনো এখানে আসতাম না।'
অঙ্কিতা অন্তরার একটা হাত ধরে বলে,' আমার দ্বারা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ,আমাকে ক্ষমা করো '!
আরো বলে,
'আমি এখানে আসার আগে তোমাদের বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম তুমি এখানে,
তাইতো ছুটে এলাম বাড়ি'।
অন্তরা বলে,' কেন তোমার মেঘা কি হলো'?
আঙ্কিত বলে, ছাড়ো ওর কথা , এক কথায় বলতে গেলে মেঘা একটা কল গার্ল আর আমার কপাল ভালো যে আমি খুব তাড়াতাড়ি সেটা বুঝতে পেরেছি তা নয়তো তোমার মত মেয়েকে আমার হারাতে হতো ।
অঙ্কিত দেখে অন্তরার খাটের উপর জিন্স প্যান্ট -টপ ছেড়ে রাখা আছে ।
অন্তরা কে জিজ্ঞেস করল,'তুমি এগুলো পরে অফিস গেছিলে'?
হ্যাঁ,
কেন ? তুমি তো এগুলো পছন্দ করতে না?
অন্তরা উত্তর দেয়,' তুমি পছন্দ করো তাই'।
অন্তরা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অঙ্কিত কে জড়িয়ে ধরল।
অঙ্কিত বলল,'তুমি যেমন ছিলে তেমনই থাকবে আর আমি আমাদের সম্পর্কের কথা আজই বাড়িতে জানাবো'।
।। সমাপ্ত।।
✍️ মিনাক্ষী মন্ডল
বাঁশবেড়িয়া, হুগলি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন