রজনীকান্তের পাঠশালা
প্রদ্যোৎ পালুই
ভানুর বয়স এখন চার বছর। তবে দুষ্টুমিতে সে সবার ওপরে। সবসময় তার কিছু করা চাই। চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কাজের চাপে তার বাবা মা সময় পায় না। ফলে ভানুর দেখাশোনার দায়িত্ব সামলাতে হয় তার দাদু ঠাকুমাকে। কিন্তু একটা শিশুকে নজরদারি করতেই দুটো মানুষকে খাবি খেতে হচ্ছে। এখন পড়াশোনা শুরু করা সময় হয়েছে। ওর বয়সি বাচ্চারা বাংলা ইংরেজির সব লেটার চিনে ফেলেছে। একটু আধটু পড়তে শিখেছে। কিন্তু ও কোন কিছুই শিখছে না। দাদু ঠাকুমা জোর করে বসালে অ-আ, ক-খ যদিও একটু আধটু পড়ে। তবে ওই পর্যন্তই। মিনিট দশেকের মধ্যে বই বন্ধ করে দৌড়ে বাইরে চলে যায়। বই নিয়ে তাকে একঘন্টা বসিয়ে রাখা সত্যিই মুশকিল।
অনেক ভেবেচিন্তে শীতল একদিন নাতিকে নিয়ে রজনীকান্তের পাঠশালায় হাজির হলেন। রজনীকান্ত তাঁর অনেক দিনের পরিচিত। একই গ্রামে বাড়ি। সম্পর্কও ভাল। গিয়ে বললেন, "রজনী, তুমি তো্মার পাঠশালায় আমার নাতিটাকে ভর্তি করে নাও।"
রজনীকান্ত তখন অন্যান্য বাচ্চাদেরকে পড়াচ্ছিলেন। বললেন, "দাদা, তোমার নাতির বয়স কত ?"
পাঠশালার ছেলেগুলোকে দেখিয়ে শীতল বললেন, "বয়স এদের চেয়ে একটু কমই হবে। তবে চালাক চতুর আছে।"
"সবই ঠিক। কিন্তু এত ছোট বয়সে-----
'তুমি এই নিয়ে চিন্তা কোরো না রজনী। নাতিটা বাড়িতে পড়াশুনো শুরু করেছে। কিন্তু ভীষন দুষ্টু। ওকে চোখে চোখে রাখতেই আমি আর তোমার বৌদির ল্যাজেগোবরে অবস্থা। তাই ভাবলাম, তোমার পাঠশালায় অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে যদি একটু মতিগতি পালটায়।"
"আমার তাতে অসুবিধা নেই। তবে ওইটুকু বাচ্চা তো। আমার পাঠশালায় তিন ঘন্টা সময়। অতটা সময় ও কী তোমাদেরকে ছেড়ে থাকতে পারবে ?"
"তুমি তিন ঘন্টা সময় নিয়ে পড়াও ?"
"হ্যাঁ দাদা, তার কমে হয়ে ওঠে না। শুধু তো পড়াশুনো নয়। তার সঙ্গে গল্প বলা, খেলাধুলো করা সবই আমার এখানে হয় কিনা।"
"তাই নাকি ! তাহলে তো খুব ভাল কথা। একই সঙ্গে পড়াও হবে, আবার খেলাধুলোও হবে। বাচ্চাদের তাতে কষ্ট মালুম হবে না।"
"বাচ্চাদের কথা ভেবেই এইরকম ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে।"
"তাহলে তো ভালই হল। আশা করছি, আমার নাতিটা পারবে। আর যদি ও এর মধ্যে বাড়ি যাওয়ার জন্যে বায়না ধরে বা কান্নাকাটি করে তবে একটু আগেই ছেড়ে দিও। তেমন হলে একটু আগে থেকেই না হয় আমি চলে আসব ওকে নিয়ে যেতে।"
"ঠিক আছে। বলছ যখন, পাঠিয়ে দিও তাহলে। তারপর দেখা যাবে।"
পরদিন সকালে বেড়াতে যাবার নাম করে ভানুকে নিয়ে পাঠশালায় হাজির হলেন শীতল। নাতিকে দেখিয়ে বললেন, "রজনী, এই আমার নাতি। নাম ভানু। একে লেখাপড়া শেখানোর প্রাথমিক দায়িত্ব তোমাকে দিচ্ছি। খুব চঞ্চল মন। কোন কিছুতে স্থির থাকতে পারে না। চেষ্টা কোরো যাতে পড়াশুনোয় একটু মতি আসে। বাড়িতে আর কোন বাচ্চা নেই। একা একা পড়তে চায় না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলার জন্য বেরিয়ে যায়। এখানে পাঁচজনের সঙ্গে মিশে যদি একটু পরিবর্তন হয়। তাছাড়া তোমার শাসনে একটু যদি জব্দ-টব্দ করতে পার।"
শীতলের কথাগুলো শুনে ভানু বলে উঠল, 'আমি এখানে পড়ব না দাদু, বাড়ি যাব।"
শীতল পড়লেন মহা ফাঁপরে। এখনই যদি ও বেঁকে বসে তাহলে তিন ঘন্টা ধরে এখানে থাকবে কী করে ! তিনি বোঝালেন, "এখানে পড়তে হবে না। শুধু বসে থাকবি। আর যদি ভাল লাগে তাহলে একটু আধটু পড়াশুনো করবি। এখানে অনেক বন্ধু আছে। ভাল লাগবে। আমি রোজ দিয়ে যাব। আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বসে পড় সতরঞ্চিতে।"
ভানু দাদুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুতেই পড়তে বসবে না। তা দেখে রজনীকান্ত বললেন, "দাদা, তাহলে আর কী হবে ? তোমার নাতি তো বসতেই চাইছে না। জোর করে কী আর আটকে রাখা সম্ভব ?"
শীতল পাশে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে বললেন, "ঠিক আছে, আজ ওকে পড়তে বসতে হবে না। আমি এখানে বসে থাকছি। আমার পাশে বসে ও পাঠশালা দেখুক। কাল আবার দেখা যাবে। রজনীকান্ত ঘাড় নেড়ে বললেন, "তাহলে আজ তাই হোক। দেখা যাক, যদি একটু ইচ্ছা টিচ্ছা জাগে।"
শীতল নিজের পাশে ভানুকে বসিয়ে কিছুক্ষন পাঠশালা দেখালেন। কিভাবে পড়াশোনা হয়, সকলে কেমন পড়ছে এসব দেখিয়ে একসময় নাতির হাত ধরে বাড়ি ফিরে গেলেন।
পরদিন ভানু আর পাঠশালামুখো হল না। বাড়িতে ভানুর বাবা মা-ও এই নিয়ে চিন্তিত। দিন দিন ছেলের দুষ্টুমি বাড়ছে। অথচ ঘরে বাইরে কোথাও পড়াশোনার ধারেপাশে যাচ্ছে না। সবসময় নিজের জেদ বজায় রাখার চেষ্টা।এভাবে চললে ছেলের বখে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তারা ভাবতে লাগল, বাইরে কোন হোষ্টেলে রেখে দিয়ে আসবে কি-না। তাহলে হয়তো কঠোর অনুশাসনে থেকে একটু শুতরে গেলেও যেতে পারে। অবশ্য সেখানে দুষ্টুমি দেখলে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ নাও রাখতে চাইতে পারে। কি যে হবে কে জানে ! ভানুকে নিয়ে চিন্তা বাড়ির সকলের।
একদিন সন্ধ্যায় শীতল ভানুকে ডেকে বললেন, 'দাদুভাই, আজ তোমাকে একটা ভাল গল্প বলব। শুনবে ?"
ভানু আহ্লাদে আটখানা। গল্প শুনতে তার খুব ভাল লাগে। সে বলল, " হ্যাঁ দাদু, বল না একটা ভাল গল্প। অনেকদিন তুমি গল্প বল নি।"
"বলছি, তবে মন দিয়ে শুনতে হবে কিন্তু। উঠে যাওয়া চলবে না।"
"না, আমি কোথাও যাব না। তুমি গল্প বল।"
গল্প শুরু করলেন শীতল, "এক ছিল রাজপুত্র। সে খুব ছোট। সে সারাদিন খেলে বেড়ায়। রাজার ঘোড়া আছে। গাড়ি আছে। রাজার অনেক চাকর-বাকর আছে। তারা ছোট্ট রাজপুত্রকে গাড়িতে করে বেড়াতে নিয়ে যায়। ঘোড়ায় চাপিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। রাজপুত্র বেজায় খুশি। সারাদিন হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেয়। পড়াশুনো করে না।"
ভানু বলল, "রাজপুত্রের দারুন মজা, তাই না দাদু ?"
"সে তো বটেই। খেলতে পেলে সকল ছেলেরই মজা হয়। তোমারও তো খুব মজা হয়, তাই না ?"
"হ্যাঁ দাদু, আমার খেলতে খুব ভাল লাগে।"
"এদিকে একজন চাকরেরও রাজপুত্রের মতন একটি ছোট ছেলে আছে। নাম ছোট্টু। তার তো ঘোড়াও নেই। গাড়িও নেই। চাকর বাকরও নেই। সে কারও সঙ্গে খেলতে পায় না। রাজপুত্রের ওইরকম খেলে বেড়ানো দেখে ছোট্টুর মনে মনে কষ্ট হয়। ইচ্ছা হয় খেলাধুলো করার। কিন্তু কার সঙ্গেই বা খেলবে ! রাজপুত্রকে দেখাশুনো করার কত লোকজন। ছোট্টু তো তার সঙ্গে মিশতেই পারে না। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। অবশ্য ছোট্টু প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় নিয়ম করে পড়তে বসে। পড়তে তার খুব ভাল লাগে। সে নানারকম বই খুলে ছবি দেখে, পড়ে। না বুঝতে পারলে তার মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়।"
ভানু বলল, "ছোট্টু খুব পড়া ভালবাসে ?"
"বাসে তো। দৈনিক সকাল সন্ধ্যায় পড়তে বসে।"
"তারপর বল বল, রাজপুত্রের কী হল ?"
"রাজপুত্রকে সকাল সন্ধ্যায় পড়ানোর জন্য দৈনিক দুজন মাষ্টারমশায় আসেন। কিন্তু তার পড়ায় মন নেই। পড়তে তার ভাল লাগে না। সারাদিন আমোদ আহ্লাদ করে কাটিয়ে দিতে ভাল লাগে। রাজদরবারে সকলেই রাজপুত্রকে খুব ভালবাসে। সে যা পছন্দ করে তাই দেয়, যেখানে যেতে চায় সেখানেই নিয়ে যায়। পড়ার জন্য কেউ জোর করে না।"
"সত্যি, রাজপুত্রের দারুন মজা। কী বল দাদু ?"
"এভাবে রাজপুত্র বড় হল। রাজামশায় ছেলের পড়াশুনোর জন্য খুবই চিন্তিত হলেন। তিনি ছেলের পড়াশুনোর জন্য আরও মাষ্টার মশায় নিয়োগ করলেন। কিন্তু সকলে আসেন আর ফিরে যান। রাজপুত্র পড়তে চায় না। সেজন্য কেউ তাকে বকাঝকা করতে পারে না। রাজপুত্র বলে কথা ! ফলে লেখাপড়ায় সে ভীষন কাঁচা থেকে গেল।
এদিকে ছোট্টু তো চাকরের ছেলে। তাদের বাড়িতে মাষ্টার পড়াতে আসে না। সন্ধ্যায় সে নিজে পড়ে। সকালে পাঠশালায় পড়তে যায়। আর দুপুরে ইস্কুলে পড়ে। তাতেই ছোট্টু লেখাপড়ায় ভাল হয়ে উঠতে লাগল।একসময় ইস্কুলের মাষ্টারমশায়রা ছোট্টুর খুব প্রশংসা করতে লাগলেন। রাজপুত্রের নাম কেউ করে না। এতে রাজার খুব রাগ হয়ে গেল।"
ভানু গম্ভীর হয়ে বলল, "রাজার রাগ হবেই তো। তার লোকেরা ছোট্টুকে মারতে চলে গেল ?"
"না, মারতে যায় নি। তবে রাজা আদেশ করলেন, ছোট্টুর পড়াশুনো বন্ধ করতে হবে। তাঁর রাজত্বে তাঁর ছেলের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হয়ে যাবে চাকরের ছেলে ছোট্টু, এটা চলবে না। কিন্তু ছোট্টু তখন ভীষন ভাল ছাত্র হয়ে উঠেছে। মাষ্টারমশায়রা তাকে ভীষন ভালবাসেন। ফলে ছোট্টু পড়া বন্ধ করল না। তাতে রাজা আরও রেগে গেলেন। তিনি ছোট্টুদের পরিবারের সকলকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন।"
"তখন কী হল ? ছোট্টুর পড়া বন্ধ হয়ে গেল ?"
"তবুও ছোট্টূর লেখাপড়া বন্ধ হল না। রাজপ্রাসাদের বাইরে কিছুটা দূরে ছোট্ কুটিরে থেকেই ছোট্টু পড়াশোনা করতে লাগল। স্কুল, কলেজের পড়া শেষ করে একসময় সে অনেক জ্ঞান অর্জন করল। বড় হয়ে রাজপুত্র মুর্খ থেকে গেল আর ছোট্টু হয়ে উঠল মহাপন্ডিত। এলাকার লোকজন ছোট্টুকে ধন্য ধন্য করল। অনেকে নানারকম কাজের জন্য তার কাছে যুক্তি পরামর্শ নিতে গেল। সে সবাইকে ভালবেসে সাহায্য করতে লাগল। মুর্খ রাজপুত্র রাজপ্রাসাদে থাকলেও তার কাছে কেউ যায় না। ধীরে ধীরে সে একলা হয়ে গেল।"
"দাদু, রাজার লোকেরা ছোট্টুকে তবুও মারল না ?"
"মারবে কী করে ? রাজার তো কোন লোকই রইল না। সবাই ছোট্টুকে ভালবেসে ছোট্টুর লোক হয়ে গেল। রাজপুত্র মনের দুঃখে একলা মন খারাপ করে ঘরের কোনে বসে থাকে। একসময় তার কোন বন্ধুই রইল না।"
গল্পটা ভানু মন দিয়ে শুনেছে। শীতল গল্প থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "দাদুভাই, গল্প কেমন লাগল ?"
"খুব ভাল গল্প। তুমি আমাকে এরকম গল্প আরও শোনাবে ? সন্ধ্যায় টিভিতে তাহলে আর কার্টুন দেখব না। শুধু তোমার গল্প শুনব।"
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে শীতল বললেন, "নিশ্চয়ই শোনাব। প্রতিদিন একটা করে মজার মজার গল্প বলব তোমাকে। আমার সব কথা শুনতে হবে কিন্তু।"
"শুনব তো। কাল থেকে তোমার সব কথা শুনব।"
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ভানু শীতলের কাছে গিয়ে বলল, "দাদু, আজ আমি পাঠশালায় পড়তে যাব।"
"পাঠশালায় যাবে ? সে তো খুব ভাল কথা। ঠিক আছে, মুখ হাত ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর আমি তোমাকে পাঠশালায় নিয়ে যাব।"
ভানু তাড়াতাড়ি করে মুখ হাত ধুয়ে টিফিন খেয়ে দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল রজনীকান্তের পাঠশালায়। রজনীকান্ত তখন সবেমাত্র পাঠশালা শুরু করেছে। বলল, "শীতলদা, আজ আবার নাতিকে নিয়ে এসেছ কেন ? ওতো পড়তে চায় না।"
"ও আজ নিজেই আসতে চেয়েছে। তোমার পাঠশালায় ও পড়তে চায়।"
রজনীকান্ত অবাক। জানতে চাইলেন, "কী দাদুভাই, আমার পাঠশালায় মন দিয়ে পড়বে তো ?"
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ভানু। রজনীকান্ত নিজের পাশে বসিয়ে বই খুলে বললেন, "অ-এ অজগর আসতে তেড়ে---
ভানু রজনীকান্তের সঙ্গে গলা মেলাল। পাশের বেঞ্চে বসে শীতল ভানুর পড়া দেখতে থাকলেন। তাঁর মনের তখন আনন্দের বন্যা বইছে।
-----সমাপ্ত-----
লেখকঃ প্রদ্যোৎ পালুই
বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
পিনঃ ৭২২১২২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন