Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

প্রবন্ধ ।। দ্বন্দ্ব তত্ত্বের আলোয় সাহিত্যে কল্পকথা ও কল্পচিত্র ।। রণেশ রায়


দ্বন্দ্ব তত্ত্বের আলোয় সাহিত্যে কল্পকথা ও কল্পচিত্র 

রণেশ রায়


সাহিত্যে ও সাহিত্যিকের সঙ্গে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টির ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকলেও  সাহিত্যকে নেহাত সাহিত্যিকের স্বপ্ন বিলাস অলস কল্পনার এক আবেগঘন ক্ষণিক মুহূর্তের  নান্দনিক প্রকাশ বলে মনে করার কারণ নেই।  প্রকৃতিরই অংশ মানুষ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঁচে যা তার চেতনায় আলোকিত। সেটা  তার মনোজগত তথা মানসলোক। এই মনোজগতকে মানুষ কথায় প্রকাশ করতে পারে ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারে ইঙ্গিতে উপমায় প্রকাশ করতে পারে। সাহিত্যিক তাকে নিজের জীবন বোধ  সৌন্দর্য বোধে নান্দনিক করে তোলেন সন্দেহ নেই। তিনি সাহিত্যে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর এই শিল্প সৃষ্টি   নেহাত স্বপ্ন বিলাস জীবনবোধ বর্জিত কল্পনার জালবোনা নয়, তার থেকে বেশি আরো কিছু যা  সাহিত্যিকের জীবন দর্শন জীবন বোধ সমাজের দায়িত্ব বোধকে বেষ্টন করে থাকে। 


এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে সামগ্রিকতার প্রেক্ষাপটে বিচার করা দরকার । এই সামগ্রিকতা হল এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যা প্রকৃতি মানব সমাজ আর প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে এই সমাজ। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে এই বস্তু জগৎ বা ভৌত জগৎ। মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে এই বস্তুজগতকে অবলোকন করে তার বিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।তার মনোজগতে প্রতিবিম্বিত হয় এই প্রকৃতি এই মানব সমাজ তার প্রকৃতিকে মানব সমাজকে অবলোকন করার সঙ্গে সঙ্গে। বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে তার স্নায়ুজগতে। তার মনোজগৎ উদ্ভাসিত হয়। আবার মনোজগৎ এইভাবে যে বার্তা পায় সেটা তাকে উপলব্ধিতে সাহায্য করে। অতীত বর্তমানকালকে সে যেভাবে অবলোকন করে তা তাকে  জীবনটাকে বুঝতে সাহায্য করে। তার জীবন বোধ তৈরি হয়। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে ভবিষ্যতকে দেখে মানুষ। সাহিত্যিক তা দিয়ে তাঁর কল্পনার মালা গাঁথেন। এক কল্পচিত্র তৈরি হয় যা একান্তই সাহিত্যিকের নিজের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করতে চান  তিনি। এর থেকে সৃষ্ট হয় কল্পকথা যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে ভাষায় রূপ পায়। ছন্দ তাল লয়ে কবিতায় সেজে ওঠে। অর্থাৎ বস্তুজগত যেমন মনোজগতের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি মনোজগত প্রকৃতি জগৎ মানব সমাজের দিক নির্দেশ করে তাকে বুঝতে সাহায্য করে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাসি কান্না প্রেম ভালোবাসা জীবন যুদ্ধকে বোঝার চেষ্টা করেন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য চর্চায়। এসবই তাঁর কল্পকথা হয়ে কল্প চিত্র সৃষ্টি করে যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন ভাবে রূপ পায়। সৃষ্টি হয় সাহিত্য শিল্প।সেখানে মনোজগতের প্রকৃতিজগতের ওপর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াটাও গুরুত্বপূর্ন। এখানেই বস্তু জগৎ ও মনোজগতের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা তাৎপর্যপূর্ণ যা আর বস্তুজগতকে বাদ দিয়ে কল্প বিলাস থাকে না। কবিতায় উভয় জগতের বিষয়টা মূর্ত হয়ে ওঠে। তা বাস্তব অবস্থা থেকে উঠে এসে লেখকের কল্পজগতে এক কল্পচিত্র সৃষ্টি করে। সে আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠে তাঁর ভাবের জগতে তাঁর ভাবনা সাহিত্য  তাঁর কল্পকথায়। 


কিভাবে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মানুষ বহির্বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে বহিদৃষ্টি দিয়ে তার অন্তদৃষ্টি কিভাবে এই দেখাকে প্রতিবিম্বিত করে মনোজগতে উদ্ভাসিত করে সেটা আমরা আলোচনা করতে পারি। আর এই প্রক্রিয়াতেই মনোজগতে এক কল্পচিত্র আঁকা হয় যাকে সাহিত্যে শব্দের সাহায্যে ভাষার সাহায্যে সাজিয়ে তোলা হয়।এটা শুধু কবিতা নয় সাহিত্যের সব বিভাগেই দেখা যায়। সাহিত্য সৃষ্টির রহস্যই এর মধ্যে ধরা থাকে। শিল্প সৃষ্টিতে সাহায্য করে।


কেউ যখন চোখ দিয়ে দিনের আলোয় বাইরেটা দেখে তখন জীবনের সব আলো যেন বর্ষিত হয় তার ওপর। আমরা জীবনের আলো দুভাবে দেখি -----  অন্তদৃষ্টি দিয়ে আর বহিদৃষ্টি দিয়ে। বহিদৃষ্টি দিয়ে সকালে সূর্য উঠলে তার আলোয় এই ভৌতিক জগৎটা নেহাত  একটা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ হিসেবে দেখি যেটা চোখ নামক একটা ইন্দ্রিয়ের বাহ্যিক অনুধাবন। কিন্তু মানুষের একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে যা দিয়ে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দিয়ে  বাহ্যিক এই দেখাকে অনুভূতির স্তরে নিয়ে যায় মানুষের মনোজগতে। সেখানে শুধু চোখ নয় প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয় বাহ্যিক অনুভূতি ছাড়াও  অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমাদের বিভিন্ন অনুভূতিকে হৃদয়ের গভীরে নিয়ে যায়। যেমন কোন কিছু চোখে দেখলে দেখা বিষয়টা  আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করে, পৌঁছে যায়  গভীর মননে। সঙ্গে সঙ্গে চেতনার জগৎটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।আলো যার ওপর বর্ষিত হয় শুধু তার অবয়ব আমরা দেখি না। তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভবও করি। যেমন সুন্দর হাসি মুখ দেখলে আমাদের মননে এক আনন্দ অনুভূতি আনে। শুধু দেখা নয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করলে বিষয়টার বৈশিষ্ট্য আমাদের মনকে স্পর্শ করে। শব্দ শুনলে তা হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হয় যা বিভিন্ন বার্তা  পোঁছে দেয় আমাদের মননে। কোন কিছু খেলে তার স্বাদে  আমাদের মনে আনন্দ নিরানন্দর ঢেউ খেলে যায়। এই আলো বর্ষিত করে দ্রষ্টার ভাবনায় তার আঁচার আচরণ এক কথায় জীবন যাপনে। সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে তার মনোজগতটা খুবই আবেগ প্রবন ও মর্মস্পর্শী হয়। বাইরের  জগৎটাকে তিনি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অবলোকন করেন, চোখে দেখেন শ্রবণে শোনেন স্পর্শে পান বা ঘ্রাণে বোঝেন।  এই আলো তাঁর অন্তরলোকে যে বার্তা পাঠায় তা স্নায়ু জগৎকে উজ্জীবিত করে।  তার চেতনায় আঘাত করে।  সাহিত্যিক তাঁর  আবেগ দিয়ে তাকে গ্রহণ করেন তাকে নিংড়ে নিয়ে গল্প কবিতা উপন্যাস ছড়ার মাধ্যমে প্রকাশ করেন।  সৃষ্টি হয় সাহিত্য।  সূক্ষ অনুভূতির সাহায্যে সাহিত্যের মাধ্যমে বস্তুজগতের সঙ্গে মনোজগতের মিলন ঘটে। এছাড়া তিনি তাঁর স্মৃতির সাহায্যে অতীতকে তুলে এনে বর্তমানের সঙ্গে তার মেলবন্ধন ঘটান, ভবিষ্যতকে যে ভাবে অবলোকন করেন তাঁর ছবি আঁকেন। এর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় তাঁর শিক্ষা সংস্কৃতি অভিজ্ঞতা। এ সবকিছুর সমবেত উপস্থাপন ঘটে সাহিত্যে তথা গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাসে। সাহিত্যিক মনোজগতের সূক্ষ অনুভূতির সাহয্যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন । এর জন্য তাঁকে স্মৃতির সমুদ্র মন্থন করতে হয় বর্তমানকে অবলোকন করতে হয় অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে ভবিষ্যতের ছবি এঁকে। সৃষ্টির পেছনে এক মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া কাজ করে যা সাহিত্যের ভাবনার জগৎকে আবেগ দিয়ে কল্পনা দিয়ে রাঙিয়ে নেয়। সাহিত্যিকের মনোজগত এই প্রক্রিয়ায় আলোকিত হয়।


 একজন সাহিত্যিক একই সঙ্গে একজন  দার্শনিক। তিনি জীবনটাকে তার মনন দিয়ে দেখেন। তাঁর মনোলোক দিয়ে দেখা জীবনবোধ দিয়ে মানস লোকে জীবনকে উপলব্ধি করা তাঁর জীবন দর্শন। তাঁর জীবন বোধ দিয়ে তাঁর এই দেখা যাকে তিনি তাঁর সৃষ্টিকল্পে সাজিয়ে তোলেন। তিনি তখন আর নেহাত দ্রষ্টা নন তিনি একজন স্রষ্টাও।বলা চলে জীবনের রূপকার। ভবিষ্যত কোনদিকে  বাঁক নেয় তা অবলোকন করেন। তাই দেখা যায় রাষ্ট্র যখন এই পরিবর্তনকে ভয় পায় তখন দার্শনিকের ওপর নেমে আসে সন্ত্রাস এমন কি তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইতিহাস তাই বলে। কার্যত একজন শিল্প সাহিত্যিক যার সাহিত্য চর্চায় জীবনবোধ মূর্ত হয়ে ওঠে তিনি একই সঙ্গে দার্শনিক। এখানে সাহিত্যের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক। সেজন্য দেখা যায় সাহিত্যিককেও প্রায়ই রাষ্ট্রের বিষ নজরে পড়তে হয়।


জীবনটাকে শুধু দেখা নয় তাকে তার কার্যকারণ দিয়ে বোঝা তার বিবর্তন প্রক্রিয়াটা জানা আর জীবনের ভবিষ্যত দিক নির্দেশকে আগাম অনুমান করে তার চিত্রকল্প গড়ে তোলা হয় জীবনদর্শনে।বস্তুজগতের সঙ্গে মনোজগতের মিলন ঘটে সাহিত্যিকের জীবনদর্শনে। সেখানে একটা জীবনবোধ কাজ করে যা মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই তিনি শুধু জীবনটাকে দেখেন না জীবনদর্শন তার দেখায় গুরুত্বপূর্ন । যার মননে জীবনদর্শন জীবন বোধ প্রতিভাত হয় তিনিই দার্শনিক। একজন দার্শনিক তাঁর জীবনদর্শনে যা দেখেন তার পেছনে দৌড়ান না তাকে তার মনোলোকে এমন ভাবে অবলোকন করেন যে তিনি ঘটনার ওপর লাগাম পরাবার পথটা বাতলে দিতে পারেন। তিনি তখন আর বিধাতার পায়ে নিজেকে সঁপে দেন না। ঘটনার স্রোতে গা ভাসান না কোন জনজাতির জীবনযাপন আচার আচরণ সমাজ পরিচালনা এক কথায় অর্থনীতি রাজনীতি খেলাধুলো প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দৈনন্দিন যে কাজকর্ম তার প্রতিফলন ঘটে মানুষের  মনোজগতে। সৃষ্টি হয় মানুষের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির একটা অংগ সাহিত্য। গল্প কবিতা উপন্যাস নাটক প্রবন্ধের মাধ্যমে সংস্কৃতির অংগ  হিসেবে সাহিত্যকে উপস্থিত করা হয় তার নিজস্ব আঙিনায় আমরা যাকে  সাহিত্যের আঙিনা বলছি। অনেকে অবশ্য বলেন কোন একটা সামাজিক ধরণের ওপর নির্ভর করে কিভাবে মানুষের কার্যকলাপ তার মনোজগতে প্রতিভাত হয় তা। এক এক ধরণের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় তা এক এক ভাবে প্রতিফলিত হয়।  সেই দিকটাকে অনুসরণ করে বলা হয় যে অর্থনীতির উপরিকাঠামো  হল রাজনীতি আর সংস্কৃতি। সাহিত্য সংস্কৃতির অংগ।  তাই আর্থসামাজিক  ব্যবস্থা নিরপেক্ষে সাহিত্য তার দিশা পায় না।  আমরা এই বিতর্কে এখানে যাচ্ছি না। 


উল্লেখযোগ্য যে জীবন বোধ নির্মাণ বিনির্মাণে সাহিত্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মানুষের মননে যে মূল্যবোধ সুপ্ত থাকে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে যদি সাহিত্যিক তার জীবনের সৌন্দর্যবোধ মূল্যবোধকে সাহিত্যের আঙিনায় রূপ দিতে পারেন তাকে তাঁর কল্পলোকের সাহায্যে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এর জন্য দরকার সাহিত্যিকের অন্তর্লোকের এক জীবনবোধ যা মানুষের সেবায় নিযুক্ত। সুতরাং বাস্তব বর্জিত জীবনে প্রতিভাত না হওয়া নেহাত নিজের কল্পলোকের সাহায্যে বিমূর্ত ভাবে কিছু তুলে ধরে মানুষকে সস্তার বিনোদনের যোগান দেওয়া প্রকৃত সাহিত্যের কাজ নয় যদিও অনাগত সুন্দর স্বপ্ন দেখা ভবিষ্যতের ছবি আঁকে সাহিত্য কারণ সে তার সমস্ত সৌন্দর্য রাশি নিয়ে একদিন আসবে বলে সাহিত্যিকের যুক্তিতে কল্প স্বর্গে তা ধরা পড়ে।


সাহিত্য মানুষের জীবন ধারণ ও ধরনের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিবিম্ব। বিভিন্ন সময় কালে মানুষের জীবন ধারণের ধরন সামাজিক ব্যবস্থা ভিন্ন তাই বিভিন্ন ব্যবস্থায় সাহিত্যের ধরন আলাদা। গুরুত্ব পায় ও আলোকিত হয় সমাজজীবনে বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও তার কাজের আপেক্ষিক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া কান্ড। একই সময় কোন গোষ্ঠী ও তার জীবন জীবিকা শাসক বর্গের কাছে উপেক্ষিত হলেও উপক্ষিত মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তাদের নিজস্ব সাহিত্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই। এমন কি রাষ্ট্রের সক্রিয় বিরোধিতার মুখেও।তাই একই দেশে বিভিন্ন সময়ে যেমন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য দেখা যায় তেমনি একটা সময়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী বিভিন্ন ধারার সাহিত্য গড়ে তোলে। তাই সাহিত্য জগতে বৈচিত্রের মেলা।


আমরা দেখলাম যে সাহিত্যে মানুষের জীবনবোধ বিশেষ গুরুত্ত্বপূর্ণ কারণ মানুষের সুখ দুঃখ আনন্দ নিরানন্দ বাদ বিবাদ নিয়ে সাহিত্য চর্চা। প্রকৃতি মানুষকে ধারন করে, তার বেঁচে থাকার উপাদান যোগায়। তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের সমাজ সম্পর্ক প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে জীবন বোধ। জীবনবোধকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় না। বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সম্পর্কটা ভিন্ন হয় বলে সাহিত্যের ধরনেও ভিন্নতা আসে। আবার প্রকৃতির মানুষের ওপর প্রভাব, প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির ওপর দখলদারি  বাড়ে বলে প্রকৃতিকে অবদমন করা হয় বলে মানুষে প্রকৃতিতে সম্পর্কের ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে। এর ফলে সাহিত্যিকের মননে তার প্রভাব দেখা যায় যা সাহিত্যের নির্মাণ বিনির্মাণের কাজকে প্রভাবিত হয়। বিষয়টা উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরা হয়। যেমন প্রাচীন কালে দাস ব্যবস্থায় দাস মালিকরা দাসের শ্রমে জীবন যাপন করত।দাসেরা শোষিত হত।দুধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে।দাস প্রভুদের আধিত্যবাদকে কেন্দ্র করে সাহিত্য, সে সমাজে মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে সাহিত্য। মালিক পক্ষের সাহিত্যে জীবন বোধ একভাবে প্রতিভাত হতো, মনে করা হত দাস ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই জন্মেছে। প্রভুর প্রতি আনুগত্য মানে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য। দাস মালিকরা অনুগ্রহ করে তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। সেই অনুযায়ী দাস প্রভুদের মাহাত্ম, কল্পিত ঈশ্বরের জয়গানে মুখরিত হত তাদের সাহিত্য। এর বিপরীতে দাসদের ওপর নির্যাতন তাদের বিদ্রোহ ভাষা পেয়েছে তখনকার প্রগতিশীল সাহিত্যে যাতে একটা নতুন মূল্যবোধ রূপায়িত হয়েছে। প্রতিভাত হয়েছে আগমনী সামন্ত ব্যবস্থার আগমনী বার্তা। একই ভাবে সমাজ বিবর্তনে সামন্ত প্রভুদের মাহাত্ম তার পরবর্তীতে বেনিয়াবাদ পুঁজিবাদের আবির্ভাব মানুষের মূল্যবোধের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য চর্চা হয়ে উঠেছে বহুমুখী। প্রভাবশালী শাসক গোষ্ঠীর বন্দনা যেমন সাহিত্যে জায়গা পেছে তেমনি নিপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম সমাজ বদলের সংগ্রাম জায়গা পেয়েছে। একই মানব সমাজে  বিজ্ঞানের উন্নতি যেমন  হয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহারে প্রকৃতি তেমনি  ধ্বংস হচ্ছে।মানুষের মূল্যবোধে বিবর্তন এসেছে। সাহিত্যে তার গুরুত্ব বেড়েছে। সাহিত্যে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন প্রতিভাত হয়েছে আজ তেমনি প্রকৃতির ওপর সভ্যতার বর্বর আক্রমনের নিন্দা ভাষা পাচ্ছে সাহিত্যে।শাসক শোষক সম্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিপরীত ভাবনা যা সমাজতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ।



আমরা বলেছি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বস্তুজগত মানুষের মননে কল্পজগতে প্রতিবিম্বিত হয়। সাহিত্যিক তাঁর পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করেন সৃষ্টি করেন কল্পকথা কল্পচিত্র যা সুর ছন্দ লয়ে ভাষায় সেজে ওঠে সাহিত্যিকের সাহিত্য চর্চায়। মানুষের মনন সাহিত্যের মাধ্যমে বস্তুজগতের ও সমাজজীবনের কর্ম কাণ্ডকে অবলোকন করে তাকে নিজের ভাবনায় রাঙিয়ে নেয়। প্রশ্ন হলো কোনটা প্রধান। বস্তুলোক না মনোলক কোনটা সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহিত্যের আধার হিসেবে কাজ করে। যারা সাহিত্য সৃষ্টিতে মনলোককে প্রধান বলে মনে করেন তাঁরা মনে করেন বস্তুজগত জগৎ যেমনই হোক না  কেন সাহিত্যিক তাঁর ভাবনায় তাকে যেভাবে দেখেন কল্পনায় তাকে যে ভাবে ভাবেন সেভাবে নিজের ভাবনায় তাকে উপস্থাপন করেন। পাঠকের স্বাধীনতা আছে তাঁর মনন দিয়ে তাকে বুঝে নিতে। তার ফলে বিমূর্ত ভাবে গল্প কবিতাকে পরিবেশন করার সুযোগ থাকে, তাকে নিজের মত করে বুঝে নেয় পাঠক। লেখক যা বলতে চান সে তাকে না বুঝলেও তা যদি পাঠকের মননে আনন্দ উৎসারিত করতে পারে তবেই সাহিত্যিকের পরিবেশন সার্থক বলে এঁরা মনে করেন। আর যাঁরা মনে করেন বস্তুজগতটা প্রধান তার আধারে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তাঁরা বস্তুজগতকে  তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে চেনার চেষ্টা করেন। যেটা যেমন তাকে পাঠক সেভাবে দেখতে পারে। সাহিত্যিক সমাজের ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে ছবি আঁকতে পারেন।সাহিত্য সমাজের কাজে লাগে পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে নেহাত পাঠকের মনোরঞ্জন করে না, বিমূর্ত ভাবে তাকে পরিবেশন করে না। বস্তু ও ভাবের এক দ্বিমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। হেগেলের মত দার্শনিকরা বস্তু ও ভাবের মধ্যে ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনকে জীবনের ভালমন্দকে ব্যাখ্যা করেছেন । তাঁর অনুগামী সাহিত্যিকরা সাহিত্য কর্মকে সাহিত্যিকের মনের রঙে রাঙানো বলে মনে করেন। রামায়ন মহাভারতে সাহিত্যিকের কল্পনায় চরিত্রের সৃষ্টি। তার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সেখানে মানুষকে দেবতার আসনে নয়তো রাক্ষস খোক্ষস বা অসুর বলে চিত্রিত করা হয়ছে। আবার এ যুগের সাহিত্যিক  রবীন্দ্রনাথকে সত্য মিথ্যা নিয়ে বলতে শোনা যায়, সেই সত্য যা রচিবে তুমি ঘটে যা তা সত্য নহে। বস্তু ও তার সৌন্দর্য বর্ণনা কোন কিছুর নামকরণ নিয়ে তিনি বলেন, আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ চুণী উঠলো রাঙা হয়ে। অপরদিকে বস্তুবাদী ভাবনায় বস্তু প্রাধান্য পায়। বস্তুজগতকে সাহিত্যের আধার বলে বিবেচনা করা হয়। কার্ল মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন অনুসরণ করে সমাজের শ্রেণী দ্বন্দ্বকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে মনে করেন। আর শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিকে সাহিত্যিকের কাঙ্ক্ষিত জীবন বোধ বলে দেখেন। তাকে কেন্দ্র করে মার্কসবাদী সাহিত্য গড়ে ওঠে যেখানে তথাকথিত শ্রেণীনিরপেক্ষ সাহিত্য সৃষ্টিকে শোষক সম্রদায়ের স্বার্থ সিদ্ধ করে, শোষণ নিপী়রণের হাতিয়ার বলে মনে করা হয়। তাঁরা মনে করেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী নিরপেক্ষ সাহিত্য বলে কিছু হয় না।


====================




মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩