কাল নিরবধি
বিজয়া দেব
রান্না করতে গেলে অনেকসময় হাত পুড়ে যায়, তারপর ঠান্ডা জল বরফগলা জল পোড়ার মলম কত কী। তারপরও ফোসকা কিংবা ছ্যাঁকার চিহ্ন থেকে যায়। চলতে চলতে পা মুচড়ে যায় ভাঙ্গা রাস্তায়। তারপর ব্যথা হলুদপ্রলেপ কাজ না হলে ডাক্তারের কাছেও দৌড়োনো। ওখানেও সহজে ডাক্তারের দেখা মেলে না। নম্বরের সারিতে নিজেও একখানা নম্বর হয়ে অপেক্ষা করতে হয়। তখন আবার কাল নিরবধি। কখন যে ডাক্তারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই নিজেই বুঝি না।
দৈনন্দিন জীবনের কিস্যা নিয়ে রাতে ডাইরি লিখি। খুঁটিনাটি সব। কোনও দিন বিকেলে যেদিন চারপাশ খুব ফাঁকা তখন নিজের লেখা ডাইরির পাতা একের পর এক উল্টে যাই। দেখি সময়টা এক গোলকধাঁধা। এ ঘর থেকে ওঘর ও ঘর থেকে এ ঘর, বেরোবার পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তখন পথ খুঁজে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়ি।
"পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি"
এ এমন এক "বন্ধনহীন গ্রন্থি"র কথা বলছেন কবি যে "গ্রন্থি" প্রতিমুহূর্তে আলগা হয়ে যায় আলগা করে দেয় পথচলার বাধা। কিন্তু আজকের এই যে চলতি হাওয়া তাতে ভেসে ভেসে যাওয়ার নাম বুঝি জীবন? যেদিকে হাওয়া সেদিকে তরী ছেড়ে দিলে সে তরতর করে ভেসে যায়, ভারি স্বস্তি। উল্টোস্রোতে দাঁড় বেয়ে যাওয়া কঠিন বটে। তার ওপর ফুটো নৌকো হলে তো প্রাণ নিয়ে টানাটানি।
সেদিন কাজের ঠিকে মানুষটি এসে বিদ্যাসাগরের জীবনী চাইল। তার মেয়ে ইস্কুলে পড়ে। প্রোজেক্ট জমা দিতে হবে। বই কোথায় পাওয়া যায় জানে না। সুতরাং লিখে দিলাম। লিখতে লিখতে মনে হল বিদ্যাসাগর একটানা উল্টোস্রোতে দাঁড় টেনে গেছেন। কীভাবে করলেন সেই অতি কঠিন কাজ তা একটি গুরুতর প্রশ্ন। আজকাল তো এমন হয় না, হচ্ছে না। যদি আজকের এই সময়ে বিদ্যাসাগর জন্মাতেন তাহলে কি তিনি বিদ্যাসাগর হয়ে উঠতেন? তাহলে সময়ের কি একটি ভূমিকা আছে ব্যক্তির হয়ে ওঠার কিংবা না হয়ে ওঠার? আপাতত আমার কাছে হাত পুড়ে যাওয়ার কষ্ট কিংবা পা মুচড়ে যাওয়া কিংবা ডাক্তারের কাছে নম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার গোলকধাঁধা যে তৈরি হচ্ছে নিয়ত তার জন্যে কি দায়ী এই বহমান সময়? হ্যাঁ, সময়ের একটা মুখ আছে - অতীত বিশ্লেষন করলে তা বেরিয়ে আসে।
গতকাল বাইরে কাজ সেরে ফেরার পথে দেখলাম কোনও টিভি চ্যানেল পথের পাশে এক মহিলাকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করছে। বিষয় - ডেঙ্গি। নর্দমার স্থির জলে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে শতশত লার্ভা। পুষ্ট হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছড়িয়ে পড়ছে জনজীবনে। রোগাক্রান্ত করে চলেছে অবিরত। করোনা ডেঙ্গি আর কতশত রোগ।
বাড়তি সাহস হারিয়ে ফেলি। ডাইরির পাতা শুধু এসময়ের সাক্ষী হয়ে থাকে।
==============
#বিজয়া দেব ।
225 পূর্বাচল রোড নর্থ ।
কলকাতা - ৭৮ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন