অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ
"এই সবার মনে আছে তো, সোমবার শিক্ষক দিবস"। আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান জানানোর দিন। বিদায়ী শিক্ষককে বিদায় সম্ভাষণ করার দিন।
ক্লাসের মনিটর জোরে জোরে বলে দিল কাল প্রত্যেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে আসিস।
রাহুল ক্লাসের সব থেকে ভালো ছেলে।কিন্তু বড্ড গরীব। আজ কেমন রাহুলের মুখটা শুকিয়ে গেল।
সবাই নিয়ে এল ১০০ টাকা চাঁদা। রাহুল শুধু শুন্য হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
একজন বলে উঠল, কি রে রাহুল, মাত্র ১০০ টাকা তাও দিতে পারলি না?
রাহুলের বাবা সামান্য ডাব নারকেল বিক্রি করে কোনো ক্রমে সংসার চালায়। যখন বিক্রি হয় তখন টাকা পায়। যখন হয় না, কিছুই পায় না।
রাহুল মৃদুস্বরে বলল,বাবা বলেছে পরের সপ্তাহে ঠিক দিয়ে দেবে। আজ একদম হাতে টাকা নেই বাবার কাছে।
কয়েকজন হেসে বলল, তোর জন্য কি শিক্ষক দিবস পিছিয়ে দেব? মাত্র ১০০ টাকা তা ও নেই? এই চল আমরা গিফট কিনতে চাই।
রাহুল কে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই ওরা চলে গেল গিফট কিনতে।
রাহুলের খুব ইচ্ছে ছিল ওদের সাথে উপহার কিনতে যেতে। কেউ ডাকল না। চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গেল। ঠোঁটের পাতা কেঁপে উঠল। রাহুল চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখল বন্ধুরা হইচই করে চলে যাচ্ছে উপহার কিনতে।
স্কুল হলঘরটা সুন্দর করে সাজিয়েছে সবাই। রাহুলকে ডাকল না কেউ।
আজই ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। বিদায়ী শিক্ষক নারায়ণ স্যারের" বিদায়ী সম্ভাষণ"।
ছাত্র -ছাত্রীরা নিজ নিজ পারফর্ম করতে শুরু করল মঞ্চে । রাহুল ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। কিন্তু রাহুলের দেখা নেই। রাহুলের নামটাও কেউ বলল না। স্যারের মনটা ছটপট করছে। রাহুলকে দেখতে।
স্যার নিজেই জিজ্ঞেস করল,কী ব্যাপার রাহুল কোথায়? রাহুলকে দেখছি না তো?
ওকে খুব স্নেহ করেন স্যার।
একজন মুচকি হেসে বলল,কী করে আসবে স্যার? চাঁদা দিতে পারে নি তাই লজ্জায় আসে নি।
স্যার খুব কষ্ট পেল ছেলেদের কথা শুনে। স্যারের বক্তৃতা শুরু হলো। প্রথমেই বললেন, আমি তোমাদের শিক্ষা দান করতে এসেছিলাম। আজ শেষ বেলায় বুঝলাম, কিছুই শেখাতে পারিনি।
সবাই অবাক হয়ে শুনছে। স্যার এসব কী বলছে?
আরও বললেন, আমি তোমাদের কাছ থেকে দামী উপহার নিতে আসিনি,এসেছিলাম তোমাদের উপযুক্ত মানুষ করতে। উদারতা, ধৈয্য আর বন্ধুর প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করতে। নীতিশিক্ষা দিতে আমি পারি নি। আজ আমি ভীষণ ভাবে মর্মাহত। তোমাদের কিছুই শেখাতে পারলাম না।
স্যারের বক্তৃতা শেষ হলো কিন্তু কেউ বুঝল না।
এবার উপহার দেওয়ার পালা। স্যারের হাতে তুলে দিল দামী ডিনার সেট। একটা কলম আর ফুলের স্টিকার। স্যার শুধু মাত্র ফুলের স্ট্রিকারটা হাতে নিয়ে বললেন, তোমরা এখন শিক্ষার্থী। বাবার কষ্টের টাকায় আমার জন্য উপহার কেনা আমি নিতে পারব না। সবাই আগে মানুষ হয়ে ওঠো।
স্যার চুপচাপ বেরিয়ে এলেন অনুষ্ঠান থেকে।
অনুষ্ঠান শেষ। ঠিক এমন সময় ছলছল চোখে রাহুল এল হাতে একটা লাঠি নিয়ে।
মাথা নত করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।স্যারের হাতে দিল সুন্দর একটা নকসা করা লাঠি আর একগুচ্ছ রক্তকরবী। লাঠির গায়ে সুন্দর আল্পনা দেওয়া আছে।
রাহুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি এঁকেছি স্যার। আপনার জন্য এনেছি। এটা আপনার খুব প্রয়োজন স্যার।
বুকে জড়িয়ে নিল রাহুলকে।
রাহুল তোকে ও লাঠি হতে হবে। এই সমাজের জন্য।
বৃদ্ধের সম্বল আর সমাজের জঞ্জাল সাফ করতে এই লাঠির খুব দরকার। রাহুল ফুঁপিয়ে উঠলো স্যারের বুকে।
====================
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন