জীবনের দাবি
সৌমেন দেবনাথ
ভালো লাগতে লাগতে ভালো লাগাতে মরিচা ধরে। ভালো লাগার রং জ্বলে যায়। ভালো লাগার বয়স বাড়লে ভালো লাগা আর থাকে না। ভালো লাগা দীর্ঘস্থায়ীও নয়, টেকসইও নয়। একের ভেতর বৈচিত্র্যের অভাব, একের ভেতর নতুত্বের অভাব, তাই অন্যতে মন রাঙে বেশি। মানুষের মন এমনই, একজনকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে না। একজনকে জানা, একজনকে বোঝা হয়ে গেলে তার প্রতি আর আগের মত তৃষ্ণা থাকে না। কিন্তু জীবনে সুখী হতে হলে একজনকেই একেক ভাবে আবিষ্কার করতে হয়। একজনের ভেতরের দোষ না দেখে গুণ দেখেই সন্তুষ্টি থাকা শিখতে হয়। সন্তুষ্টি শিখতে জানতে হয়, নতুবা সুখী হওয়া যায় না। মানুষের সন্তুষ্টির চেয়ে আফসোস বেশি। কারণ প্রাপ্তির হিসাব না করে করি অপ্রাপ্তির হিসাব।
কসমেটিকসের দোকান আছে আসিফের। সৌন্দর্য বর্ধনের কোন স্নো, পাউডার, ক্রিমের অভাব নেই রুমিলার। ঘর-সংসার সামলাতে গিয়ে সাজ-গোজ করা হয়ে উঠে না তার। আসিফের তাই কড়া প্রশ্ন, লিপস্টিক কি আমি ঠোঁটে দেবো? আমাকে মানাবে?
একান্ত বাধ্য হয়ে রুমিলা ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে এসে বললো, কেমন লাগছে?
আসিফ দেখে রেগে বললো, সাজতে তোমার ভালো না লাগার কারণ কি? ঠোঁটে লিপস্টিক দিলেই কি ভালো লাগে? আমার দোকানে কত কত মেয়ে আসে, কত সুন্দর সেজে থাকে, কত সুন্দর লাগে! তোমাদের ভালো লাগার কোন দৃশ্যত কারণ নেই, না সাজলে। মেয়ে মানুষ সাজতে জানো না, এটা হলো! পুরুষ মানুষ নাকি, যে সাজবে না?
আসিফ বাজারে চলে গেলো। সেজেগুজে না থাকলে এমন বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয় রুমিলাকে। স্বামীর থেকে আর মিষ্টি আচরণ পায় না বললেই চলে। পরপর দুটো সন্তান হয়েছে। বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে রাখতে নিজের খেয়াল রাখা আর হয়ে উঠে না। তাদের সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে যত তারা বড় হচ্ছে। রান্না-বান্না করা, বাচ্চাদের সামলানোর পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চেহারাটা আগের মত সুন্দর নেই। যার সন্তান মানুষ করতে গিয়ে সে জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে সেই-ই সেই জীর্ণতার মানে বোঝে না। স্বামীর চোখে আগের মত সুন্দর আর সে নেই। স্বামীর বোধ-বুদ্ধি বাড়ছে না, বরং তার চোখের সৌন্দর্য বাড়ছে। আর তাই নানা কথা বলে রুমিলাকে। চেনা মানুষ যখন অচেনা মানুষের মত আচরণ করে তখন তাকে নিয়ে নানা বাজে চিন্তা মাথায় আসে। আজ বাড়ি এসেই বললো, তুমি না হয় দুই সন্তানের মা। জবেদের বৌ তো তিন সন্তানের মা। জবেদের বৌকে তো দেখতে তোমার মত নির্জীব লাগে না! দিনে দিনে এত নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছো কেন? আমি কি বাজার-সদাই করি না?
রুমিলা বিরক্তিবোধ করে বললো, পরের বৌ আজীবনই সুন্দর। পরের মেয়ে আজীবনই যৌবনবতী। পরের বৌ কখনো পুরাতন হয় না। পুরাতন হয়ে যায় নিজের বৌ। পৌঢ় হয়ে যায় নিজের বৌ। তুমি না বদলে গেছো!
রুমিলা ঘরে চলে গেলো। ছোট বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকলো। সঠিক মানুষ কখনো বদলায় না। বদলায় সেই মানুষ যে প্রয়োজনে প্রিয়জন সাজে। মনের মানুষটার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত এভাবে অপমানিত হলে নিজেকে নিচু লাগে। প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আচরণ পেলে মরে যেতে ইচ্ছা করে। ওদিকে আসিফ ভাবলো, এত বেশি বলা তাকে ঠিক হচ্ছে না। মনটা যার ভালো তার কাছ থেকে আর কিছু চাওয়া ঠিক না। বেফাঁস কথা বলে ফেলছি ইদানিং।
পরের দিন বাজার থেকে ফেরার পথে ভালো একটা শাড়ি কিনে আনলো। রুমিলাকে দিয়ে বললো, পরলে তোমাকে খুব মানাবে।
রুমিলা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, মানাবে না। এক বিষয় দেখতে দেখতে নতুন কিছু দেখার থাকে না। আর এক বিষয় বেশি দিন ভালো লাগে না। চোখের দোষ দিয়ে লাভ নেই, মনের দোষ। মন নতুন কিছু চায়, নবীনে ধাবিত হয় মন, মন বৈচিত্র্যে বেশি উল্লাসিত হয়।
আসিফ বোকাবোকা হেসে বললো, রাখো আক্ষেপ। কাল তুমি এ শাড়িটা পড়বে। বাচ্চাদের নিয়ে আমরা ঘুরতে যাবো।
রুমিলা আসিফের এমন বাক্যে স্থির না হয়ে বললো, মনকে নিয়ত ক্ষত করে শাড়ি, গহনা, কসমেটিকস এনে দিয়ে কি সৌন্দর্য বাড়ানো যায়? লোভী নারী যা চায় তাই আনো তুমি, আমি কি চায় তুমি তা জানোই না। সংসারটা ঠিক মত যদি করতে আমার থেকে সৌন্দর্য চাইতে না, মায়া চাইতে। সংসারটা ঠিক মত যদি বুঝতে দরদ বাড়তো, অনিহা না।
আসিফকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রুমিলা ঘরে চলে গেলো। মনে অশান্তি থাকলে ঘর সাজাতে ইচ্ছে হয় না, নিজেকে সাজানো তো দূরের কথা। দিনে দিনে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে আত্ম-সম্মানে আঘাত করে কথা বলে ঘরের মানুষটিই। ঘরের মানুষ সাথে থাকে, কিন্তু সাথের করে না। মেশে, কিন্তু মিশে যায় না। জড়ায়, কিন্তু জড়িয়ে থাকে না।
পরের দিন ওরা ঘুরতে যাবে। নিজের দুটো বাচ্চাকে সাজাতে সাজাতে নিজেও একটু সাজলো। সাজলেও আর চোখের নিচের কালো দাগ কাটে না। কপালে টিপ দিলেও সৌন্দর্যটা আগের মত ফোটে না। কালারফুল শাড়ি পরলেও গ্লামারটা আগের মত জাগে না। স্বামী যে তাকে অপছন্দ করে তার তো কারণ আছেই। নারীর কাজ পুরুষের মনোরঞ্জন, কিন্তু স্ত্রীর কাজ তো স্বামীর মনোরঞ্জন না। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দৈহিক সৌন্দর্য প্রাধান্য পেতে থাকলে সে সম্পর্কে মনোদ্বন্দ্ব থাকবেই। রুমিলা খুব হীমন্যতায় ভোগে। আসিফ রুমিলাকে আপদমস্তক দেখে নিয়ে বললো, বাহ্, খুব সুন্দর লাগছে।
গত দুদিন বকাবাজির কারণে আজ যে তার স্বামী তার রূপের প্রশংসা করলো এটা রুমিলার কাছে স্পষ্ট। মুখ থেকে যে কথা ঝরে তার ভেতর আন্তরিকতার ঘাটতি থাকে, মন থেকে যে কথা ঝরে তাতে থাকে রস টইটম্বুর স্নিগ্ধতা। আসিফের কথার ভেতর আন্তরিকতার চেয়ে যান্ত্রিকতা অনেক বেশি। সেসব কথা মনকে তৃপ্তি দেয় না। পাশে আসে, পাশে থাকে না। পর পর বোধ হওয়া মানুষ যতই কাছে থাকুক পর পরই লাগে।
যাহোক, ওরা স্থানীয় একটি পার্কে ঘুরতে গেলো। রঙিন চশমা পরে ঘুরছে আসিফ, দুই সন্তানের বাবা সে যেন না, তরুণ যুবা। আর চঞ্চল দুটো বাচ্চাকে সামলাতে সামলাতে হয়রান রুমিলা। বাচ্চাদের সাথে এই যুদ্ধটুকুই তার বাঁচার শেষ সম্বল। আশপাশের মানুষ দুটি চমৎকার বাচ্চাকে যত না দেখছে তার চেয়ে বেশি দেখছে দুই সন্তানের মাকে। আসিফ খুব করে খেয়াল করলো ব্যাপারটি। তাই বললো, এদিকটা থেকে চলো।
ওরা খোলা মাঠে গিয়ে বসলো। বাচ্চা দুটো খেলছে। এদিকেও যে দুই চারজন ছিলো, তারাও কৌণিক চোখে চেয়ে চেয়ে রুমিলাকে দেখছে। আসিফ বললো, অন্যরা তোমাকে এভাবে দেখবে কেন? আর সাজবে না, আটপৌরে থাকবে।
রুমিলা একগাল হেসে বললো, তোমার কাছে আমার চাহিদা ফুরিয়ে গেলেও অন্যদের কাছে আমার চাহিদা শেষ হয়নি। পর্দায় নায়িকার প্রথম দর্শন আর সারা সিনেমায় দর্শন এক রকম না। প্রথম প্রথম সব দর্শনই সৌন্দর্যমণ্ডিত।
আসিফ বিরক্তবোধ করে বললো, বাইরে আসাটাই ভুল হয়েছে।
রুমিলা নাকে হেসে বললো, বখাটেরাই অন্য নারীদের দিকে শকুন চোখে তাকায়। তুমি যখন জবেদের বৌয়ের ভেতর সৌন্দর্য দেখো ওটা বখাটেপনার চোখ। সভ্য স্বামী কখনো তার অসুন্দর বৌকেও অন্যের সাথে তুলনা করে না। সভ্য স্বামী মানে সত্যিকার অর্থেই যে স্বামী সে তার স্ত্রীকে পরীর মত দেখে। দুটো সন্তান যে স্ত্রী তার স্বামীকে উপহার দিয়েছে সেই স্বামী তার স্ত্রীকে পরীর চেয়ে আরো সুন্দর কিছু ভাবতে জানে। বখাটেদের সাথে রঙ্গ করা যায়, সংসার করা যায় না।
আসিফ দীর্ঘশ্বাস কেটে বলে, আমাকে অনেক খোঁচা দাও। আমি তোমাকে যায়-ই বলি না কেন, আমিই তোমার ভাল চাই। তুমি আমাকে সুযোগ পেলেই বাঁকা কথা বলো। আমি যদি সত্যই খারাপ হতাম আমি তোমাকে রাখতাম না। আমি তোমাকে ছায়া দিয়ে রাখি তুমি সেটা জানো না। আমি তোমার এক ধরণের বেষ্টনি তুমি উপলব্ধিও করো না। অভাব কি জিনিস, অনটন কি জিনিস তোমাকে কখনো জানতে দেয়নি। আমার কোন একটি কথা তোমার মনের বিরুদ্ধে গেলেই এক সপ্তাহ ধরে খোঁচাও। আমি রক্তাক্ত হই, কিন্তু আমি সেটাও বুঝতে দেই না।
রুমিলা স্বামীর কথাগুলো শুনে থ বনে গেলো। প্রত্যাশিত মানুষের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কথা শুনলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। যার কথাকে বাণী ভেবে স্বপ্ন দেখতো, হঠাৎ করে সেই-ই গরল ছড়ালে দুঃস্বপ্ন দেখতো। আজকে আবার অমৃত ছড়ানোর কারণ বুঝে উঠলো না। মনের মধ্যে দ্বিধার হাওয়া বইতে থাকলেও আজ আর বাঁকা কথা বলে আজকের ঘুরাঘুরিকে নিরানন্দ করতে চাইলো না। নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকলো। পাশাপাশি থাকতে থাকতে বোঝাপড়াতে অনেক ভাটা পড়ে। পাশাপাশি থাকতে থাকতে সম্পর্কের স্রোতে শ্যাওলা জমে। ঝড়-ঝঞ্ঝা না এলে নতুন করে চেনার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
পরের দিন দোকানে গেলো আসিফ। নিয়মিত দোকানে পত্রিকা রাখে। একটা খবরে তার নজর আটকে গেলো। 'প্রেমিকের হাত ধরে পালালো দুই সন্তানের মা'।
খবরটা গুরুত্ব দিয়ে পড়লো সে। দোকান থেকে বাইরে এসে বাড়ি ফোন দিলো। রুমিলা কি করছে, বাচ্চারা খেলছে না ঘুমাচ্ছে খোঁজ নিলো। বিয়ের পরপর বাড়ি বারবার ফোন দিতো। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে আর তেমন ফোন দিতো না৷ গুরুত্বহীনতায় গুরুত্বহীনতা বাড়ে, গুরুত্ব দিলে গুরুত্ব বাড়ে। আসিফের ফোন পেয়ে রুমিলা খুব খুশি হলো।
দোকানে এসে দেখে তার দুজন বিক্রয়কর্মী সেই নিউজটা পড়ছে আর ঐ বৌটার সমালোচনা করছে, ঐ স্বামীটার সমালোচনা করছে আর প্রেমিক পুরুষটাকে বাহবা দিচ্ছে। একজন বিক্রয়কর্মী বললো, স্বামীটা হয়ত স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারতো না।
অন্য বিক্রয়কর্মী বললো, যৌবনের খাই না মেটাতে পারলে স্বামীর ক্যারিয়ার, সন্তানের মায়া নারী ভুলে যায়রে।
প্রথম বিক্রয়কর্মী বললো, বয়স হয়েছে, অল্প বয়স্কা মেয়ে বিয়ে করা যাবে না। এমন কাণ্ড যে পুরুষটার জীবনে ঘটলো লোকলজ্জার ভয়ে মুখ দেখাবে কি করে?
আসিফ ভীত-সন্ত্রস্ত হলো। রুমিলা তাকে পছন্দ করে না। কবে না সে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। পাশে থাকতেই পাশে থাকার মানুষকে মূল্য দিতে হয়। দুপুরের খাবার আনতে আর বিক্রয়কর্মীকে পাঠালো না। সে নিজেই বাড়ি এলো খেতে। খেতে বসে রুমিলার রান্নার প্রশংসা করতে থাকলো। বললো, তোমার রান্না কচু খেলেও গাল ধরে না। করলা খেলেও তিতো লাগে না। তোমার রান্নার হাত খুব সুন্দর।
রুমিলা হেসে বললো, রান্নার হাত সুন্দর হয়ে কি হবে? আমি তো আর সুন্দর না।
আসিফ খাওয়া বন্ধ করে বললো, তুমি সুন্দর না, কিন্তু তুমি আমার।
এমন বাক্য শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না রুমিলা। তার মুখে হাসি ফুটলো। তারপর বললো, আজ তো কচু কিংবা করলা রান্না করিনি। তবুও এই দুই তরকারির আজ প্রশংসা!
আসিফ বললো, তোমাকে যা যা বলা হয়নি, সব বলবো। তোমাকে যা যা আমার দেয়, সব দেবো। সময় গড়ালেই ভুল দৃশ্যমান হয়। আমি বুঝেছি, ধরে রাখতে না জানলে কেউ-ই পাশে থাকে না।
খাওয়া শেষ করে দুটো বাচ্চার গালে, মুখে চুমু দিয়ে আবার দোকানে চলে গেলো। দোকানের অবিবাহিত ঐ দুই বিক্রয়কর্মী একই বিষয় নিয়ে সারাদিন আলাপ করছে। একজন বললো, কিছু থেকে কিছু হলেই নারী পুরুষকে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে, শিক্ষিত বা প্রতিষ্ঠিত মেয়ে বিয়েই করা যাবে না।
অন্যজন বললো, আরে সংসার, সন্তান ফেলে যার তার হাত ধরে চলে যাচ্ছে নারী। পত্রিকা খুললেই এই খবর। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, স্বামী ডাক্তার, স্বামী অধ্যাপক কিছুই মানছে না স্ত্রী। তাও কার হাত ধরে যাচ্ছে দেখেছিস? ড্রাইভার, রিক্সাচালক, পাশের বাসার বেকার এদের হাত ধরে চলে যাচ্ছে। অর্থ, যশ সব আছে তবুও থাকছে না। কেন? যৌবনের বাজখাঁই চাহিদা মিটছে না। শারীরিক সুখ মানসিক ভালোবাসা বা আর্থিক ক্ষমতা দিয়ে মেটানো সম্ভব না।
আসিফ দুইজনকেই গরম দিয়ে থামিয়ে বেচাকেনাতে মনোনিবেশ করতে বললো। না থেমে একজন বললো, আসিফ ভাই, প্রেম সুন্দর; গোপন প্রেম আরো সুন্দর।
অন্যজন বললো, দোকান সামলানো যত সহজ, ঘর সামলানো তত সহজ না।
বলারও অধিক বলা হয়ে যায় আকার-ইঙ্গিতে। আসিফ ইশারার কথা বুঝতে পেরে বললো, একজন দুইজন স্বামীর ঘর ছাড়ছে, এসব কোন উদাহরণ না। একজন দুইজন নারীর অবিবেচনাপ্রসূত কাজের জন্য সবাইকে বিচার করা ঠিক না।
দুইজন বিক্রয়কর্মীকে নানা কথা বলে বোঝাতে পারলেও নিজের মনের মধ্যে পত্রিকার খবরটি বাজতে থাকলো। স্বামীর ভালোবাসা স্ত্রীর তেমন চোখে পড়ে না। স্বামী না থাকলেই স্ত্রী বোঝে স্বামীর ভূমিকা কতটুকু। স্বামীর বাস্তববাদী কথাতে স্ত্রী মায়াচ্ছন্ন হতে পারে না, পাশের বখাটে কোন ছেলের রোম্যান্টিক কথা শুনলে কাতর হয়ে পড়ে। আশপাশে মুখোশ আটা এমন মানুষের অভাব নেই। মুখোশধারীদের মিষ্টি কথায় অবিবেচক নারীরা পাও ফেলে। মুখের উপর মুখোশ থাকা মানুষ পরনারীর ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস দ্রুত অর্জন করতে পারে। মোহ থেকে ভালোবাসতে জানা পাশের বাসার লোকের সাথে ঘর-সংসার ছাড়তে পারে, অথচ হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে জানা স্বামীর ঘরে থাকতে জানে না।
এসব ভাবতে ভাবতে আসিফ চিন্তিত হয়ে পড়লো। বাসায় ফেরার পথে নতুন ব্র্যান্ডের নতুন কসমেটিকস নিয়ে বাসায় এলো। তা দেখে রুমিলা বললো, এভাবে কসমেটিকস এনে দিয়ে দিয়ে প্রমাণ করছো যে আমি অসুন্দরই! তোমার আদর্শ ও উদ্দেশ্য কিছুই বুঝি না।
আসিফ বললো, ওভাবে ভেবো না। আমাদের দোকানের নতুন কসমেটিকস আগে তুমিই ব্যবহার করবে। নতুন কসমেটিকস দোকানে এলেই তোমার কথা মনে পড়ে। এসব আমি অনেক ভালোবেসেই আনি।
স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে হাত বাড়িয়ে কসমেটিকস নিলো। আর বললো, ইদানিং তোমার ভেতর অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছো, আমি কিন্তু অত গুরুত্বপূর্ণ না। আমি কিন্তু মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকাও ইনকাম করি না।
আসিফ ইতস্তত করে বললো, তুমি সংসারে এভাবে ঝগড়াটাকে জিইয়ে রেখো না। এতে কেউ শান্তি পাবো না। তোমার আমার সংসারে তুমি আমি কেন বিবাদ ডাকবো?
পরের দিন পত্রিকা পড়তে গিয়ে আর একটা খবরে আসিফের নজর বাঁধলো। 'স্ত্রী সন্তান থাকতেও নতুন বৌ নিয়ে ঘরে এলো স্বামী'।
আর খবর রেখে এই খবরটা কাঁটাছেড়া করছে দোকানের সেই বিক্রয়কর্মী। একজন বললো, সমবয়সী বিয়ে করলে বৌ তো আগে বুড়িয়ে যাবেই। স্বামী তো আর অকারণে নতুন বিয়ে করে না!
অন্যজন বললো, হায়রে মানুষ, হিংসাকে রোধ করতে পারে না, লোভকে রোধ করতে পারে না, ক্রোধকে রোধ করতে পারে না, পারে না কামকেও রোধ করতে।
আসিফ বিক্রয়কর্মীদের কথা না বলে কাজ করতে বললো। খবরটা যাতে দৃশ্যমান হয় এমন ভাবে পত্রিকা ভাজ করে বাড়ি এসে বেডের উপর ফেলে রাখলো আসিফ। পড়বে না পড়বে না রুমিলা পত্রিকা পড়লো এবং উক্ত খবরে নিবিষ্ট হলো। আসিফ তাকে পছন্দ করে না, কথায় কিংবা আচরণে বুঝিয়েছে। নতুন বিয়ে যে করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? মুখে হাত দিয়ে দাঁতে নখ কাটতে থাকলো রুমিলা। পুরুষকে বিশ্বাস করা যায় না। এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকে না কখনোই তারা। সত্যই যদি এসব খবর পড়ে পড়ে তার স্বামী এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে তবে তার কি হবে, তার সন্তানদের কি হবে? তার সামাজিক সম্মানহানি কতটুকু হবে? মনে মনে শপথ নিলো সে স্বামীকে আর উল্টা-পাল্টা কথা বলে রাগিয়ে দেবে না। স্বামীর প্রতিটি যৌক্তিক কথায় কথা মেলাবে। স্বামীর বেখেয়ালিপনা থাকলেও স্বামী সেবাকে গুরুত্ব দেবে।
বাড়ি থাকলেই বিয়ের পরপর আসিফ যেমন রুমিলার হাত হুটহাট ধরতো, হাত ধরে টান দিয়ে কাছে নিতো, চুল ধরতো, কান ধরতো, নাক ধরতো, দুই হাতকে বেড়ি করে জড়িয়ে ধরতো এখন ঠিক তেমনটি করে। রুমিলা হেসে নিয়ে বলে, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের মূলে সমাজ ভাবে দুজনের মধ্যে কারো না কারো যৌবনে ভাটা পড়ার বিষয়টি। হাজার কারণের মধ্যে এটি একটি কারণ, নাকি এটিই মূল কারণ?
আসিফ রুমিলাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে, দুই সন্তানের মা যদি বৃদ্ধা হয়ে যায়, দুই সন্তানের বাবা কি যুবক হয়ে যায়?
কথাটি রুমিলার খুব ভালো লাগলো। হেসে নিয়ে বললো, এবার তবে ছাড়ো। রান্না করতে হবে।
আসিফ নাছোড়বান্দা, বলে, তুমি ছিলে আমার যৌবনের দাবি, এখন তুমি আমার জীবনের দাবি।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো রুমিলা। মনটা আজ খুব ভালো। গুণগুণ করে গান গাচ্ছে আর রান্না করছে। আর পিছন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা শুনছে আর দেখছে আসিফ।
সম্পর্কের মধ্যে কি সুন্দর জোয়ার এসে গেলো। ছোট খাটো ভুল-ত্রুটি, ইচ্ছা, চাওয়া, শখ বিসর্জন দিলেই স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে নিজেদের মধ্যে। হৃদয়ের বিশালতা সম্পর্কের মাঝে বিরাজিত থাকলেই শত অসুন্দরও সৌন্দর্যের সংগাকে ছাড়িয়ে যায়।
মুড়াপাড়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ থেকে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন