পরিবর্তন
নীলেশ নন্দী
আমার স্ত্রী বর্ষার মধ্যে কিছুদিন ধরে অল্প অল্প করে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এই পরিবর্তন যে সে পরিবর্তন নয়। আপনারা বলবেন, পরিবর্তন তো জীবনের অঙ্গ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে পরিবর্তন ঘটবেই। এটাই নিয়ম। কিন্তু আমি বর্ষার মধ্যে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করছি, তা আমার কল্পনাতীত। এ কি সেই বর্ষা, যার সঙ্গে এতদিন ধরে ঘর করে চলেছি? ব্যাপারটা তাহলে গোড়া থেকে বলা যাক।
আমি খুব বড়লোক ঘরের ছেলে। ছোটবেলা থেকে দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা কি, তা বুঝিনি। আমার বন্ধুদেরও বুঝতে দিইনি। কারও কোন আর্থিক সমস্যা হলে তার সমাধান করে দিয়েছি। গরীব ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ দিয়েছি। আরও অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও করেছি। এসবই আমি মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। মা সবসময় আমাকে মানুষের পাশে থাকতে বলেছে। বলেছে অনেক গরীব মানুষের সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না। আমাদের উচিত তাদের পাশে থাকা। যদিও এসবের জন্য বাবার কাছে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
এরপর ধীরে ধীরে বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। আমি তখন সদ্য কলেজ জয়েন করেছি। সেই সময়ে আমার পরিচয় হয় পিয়ালীর সঙ্গে। সে খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে এবং অত্যন্ত সুন্দরীও বটে। প্রথম থেকেই সে আমার মনের জায়গা সম্পূর্ন দখল করতে শুরু করেছিল। সেও আমাকে খুব পছন্দ করত। প্রতিদিন আমার পাশে এসে বসত। অধিকাংশ সময়ই তার সঙ্গে গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিতাম। মেয়েটি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। আমি তাকে প্রতিদিন দারুণ দারুণ সব উপহার দিতাম। ব্যাস, কয়েকদিনের মধ্যেই পিয়ালী আমার হয়ে গেল। সম্পূর্ন আমার। ভাবতেই মনের ভেতর ভালোবাসার নদীর ঢেউ উথাল-পাথাল হতে লাগল। প্রপোজ করার দিন তার ডান হাতের অনামিকায় দামী সোনার আংটি পরিয়েছিলাম। তারপর আমরা কত ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরেছি। একে অপরের হাতে হাত রেখে মূল্যবান সময় কাটিয়েছি।
আমি নিশ্চিতরূপে ধরে নিয়েছিলাম বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্ককে মেনে নেবে। কারণ ভালোবাসার মানুষের থেকে দূরে থাকার যে কষ্ট, তার আঁচ তারা আমার গায়ে লাগতে দেবে না, তা জানতাম। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমি যখন পিয়ালীকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম বাবা-মায়ের কাছে আমাদের বিয়ের অনুমতি নেওয়ার জন্যে, তখন সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াল তার স্ট্যাটাস। আমাদের মত বড়লোক ঘরের স্ট্যাটাসের সঙ্গে পিয়ালীদের মত পিতৃ-মাতৃহীন কাকার কাছে পালিত গরীব ঘরের মেয়ের স্ট্যাটাস কখনও মেলে না। আমি বাবার কাছে হাতজোড় করে আমাদের সম্পর্ককে মেনে নেওয়ার জন্য ভিক্ষে চাইছিলাম। কিন্তু বাবার মনের বরফের প্রাচীরের সামান্যটুকুও গলল না। পিয়ালী কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমিও ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল। গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছিল। না, আমি পিয়ালীকে ছাড়া থাকতে পারব না। একটু পরে মা ঘরে এসেছিল। বলেছিল, "তোরা পালিয়ে যা। দুজনে মিলে দূরে কোথাও পালিয়ে যা। বিয়ে কর, সন্তান হোক। তারপর দেখবি বাবা ঠিক মেনে নেবে। তখন আবার এখানে চলে আসিস।"
মায়ের কথায় আমি সহমত পোষণ করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে বরং উল্টোটাই লেখা ছিল। বাবা মায়ের কথা আড়াল থেকে শুনে নিয়েছিল। তারপরেই মাকে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে বলেছিল, "ওর আজ থেকে ঘরের বাইরে বেরনো বন্ধ। আমি ওর জন্য বড়ঘরের মেয়ের সম্বন্ধ দেখছি। ঘর থেকে আর বেরোবে মেয়ে দেখতে যাওয়ার দিন।"
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ততদিনে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চোখের তলায় কালো দাগ পড়ে গিয়েছিল। উস্কো-খুস্কো চুল, বড় বড় দাঁড়ি-গোঁফ। সেই অবস্থাটাকে যথা সম্ভব আড়াল করে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। পাত্রী আমার একমাত্র এবং বর্তমান স্ত্রী বর্ষা। আমার মনের অবস্থা সেই সময়ে প্রবল খারাপ ছিল। শুধু একটিবার যদি পিয়ালীর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম, খুব ভালো হত। আমি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম পিয়ালীর সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। পাত্রীপক্ষের আমাকে দারুণ পছন্দ হয়েছে। বাবা আমার অনুমতি না নিয়েই বর্ষার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছিল।
এরপর একদিন আমি পিয়ালীর বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে কারোর দেখা পাইনি। না পিয়ালীর, না তার কাকার। পাশের বাড়ির জেঠুকে জিজ্ঞেস করলে বলেন তিনিও নাকি জানেন না তারা কোথায়। বেশ কিছুদিন ধরে তারা বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। অনেক খুঁজেও তাদের কোন খোঁজ পাইনি। আর তারপরই হল ধুমধাম করে বর্ষার সঙ্গে আমার বিয়ে।
প্রথম দিন থেকেই বর্ষাকে আমি মেনে নিইনি। সে যে সুন্দরী নয়, পতিব্রতা মেয়ে নয়, এমনটা নয়। কিন্তু যে সমস্ত মনটুকু পিয়ালীকে দিয়ে দিয়েছে, তার কাছ থেকে নতুন করে আর কিই বা পাওয়া যাবে? আসলে মন তো একটাই। কিন্তু একদিন ঝড়বৃষ্টির রাতে সবটা যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। বর্ষা হয়ত বাজকে প্রচন্ড ভয় পায়। ঘন ঘন তড়িৎ বর্ষণে প্রবল ভয় পেয়ে সে আমার বুকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল। তড়িৎ বর্ষণের বেগ যত বাড়ছিল, ততই সে আরও শক্ত করে জামা খামচে ধরছিল। আমার হঠাৎ করেই সেই স্পর্শ পেয়ে কেন জানি মনে হচ্ছিল এ স্পর্শ আমার চেনা। আমি তার গালের খুব কাছে আমার গাল নিয়ে গিয়ে আলতো স্পর্শ করলাম। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। এই গালের ছোঁয়া আমি আগেও পেয়েছি। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমার কি কোন মনের ভুল হচ্ছে?
সেদিনই প্রথম বর্ষার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। তারপর ধীরে ধীরে ক্যালেন্ডারের তারিখ যত বদলাচ্ছে, ততই বর্ষার শারীরিক বদল হয়ে চলেছে। তার ঠোঁট, নাক, চোখ, কপাল, সব। এ মুখ আমার খুব চেনা। সে আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রেম পিয়ালী। আমি জানিনা সেদিনের পর পিয়ালী আমায় ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিল? জানিনা তার সঙ্গে কি হয়েছিল? তবে সে আজও আমায় ভুলতে পারেনি। কোনদিন পারবেও না, তা আমি জানি। পিয়ালী আমায় সত্যিকারের ভালোবেসেছে। আমি কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, "আমায় ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে?"
সে আলতো হেসে বলল, "তোমায় ছেড়ে কোথায় যাব? আমি তো সবসময় তোমার সঙ্গেই আছি।"
==================
নাম:- নীলেশ নন্দী।
ঠিকানা:- মধ্যমগ্রাম; কলকাতা:- ৭০০ ১৩০।
নীলেশের লেখার হাত চমৎকার। গল্পের ভাষাও অত্যন্ত ঝরঝরে। এই গল্পটা দারুউউণ লিখেছে। এমন আরও গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুন