Featured Post
নববর্ষের নেপথ্যে কিছু কথা ।। আবদুস সালাম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নববর্ষের নেপথ্যে কিছু কথা
আবদুস সালাম
মানুষের সাথে পঞ্জিকার সম্পর্ক অতি পুরাতন। মেসোপটেমিয়া কিংবা নীলনদের প্রাচীন সভ্যতায় লক্ষ্য করা যায় মাঝবয়সী কৃষকেরা দিন-তারিখ, ঋতু বুঝেই ক্ষেতে চাষ করতে নামতো। দিনক্ষণের হিসেব কষেই করতো পুরোহিত উপাসনা।
খ্রিষ্টীয় মাসগুলোকে সন্নিবিষ্ট করার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পায় দ্বিতীয় রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াসের নাম । জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস করার কৃতিত্বও তার।
কয়েক শতক পরে জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় এলে বর্ষ পঞ্জঈতএ আনেন সংস্কার , যা প্রচলিত ছিল ১৫৮২ সাল পর্যন্ত। তবু ও সঠিক হিসাব থাকতো না । পোপ অষ্টম গ্রেগরী দ্বায়ীত্ব নেওয়ার বছর জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের দুরাবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন । তিনি আরো একদফা সংস্কার করলেন পঞ্জিকাতে। আজ অব্দি যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।
ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম খ্রিষ্টাব্দের ধারণা আনে পর্তুগীজরা। আর এটিকে জনপ্রিয় করেছে ইংরেজরা। তারও আগে এ মাটিতেই পা ফেলেছিল আরব-তুর্কি-আফগানরা। সাথে করে নিয়ে এসেছে হিজরি সন। নবী মুহম্মদ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। বছরটাকে ভিত্তি ধরে পরবর্তীতে হিজরি পঞ্জিকার উদ্ভাবন ঘটে। বস্তুত হিজরি সনই প্রথম বিশুদ্ধ চান্দ্র সন। প্রাচীন আরবে মাস চান্দ্র হলেও বছর ছিল সৌর। অর্থাৎ চাঁদনির্ভর মাস পার হয়ে প্রতিবছর এগারো দিন পিছিয়ে পড়তো তারা। কারণ, সৌর বছর ৩৬৫ দিনে হলেও চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিনেই আটকে যায়। এভাবে একমাস পিছিয়ে গেলে পরের বছর নববর্ষ পালিত হতো ১ মাস পরে। অর্থাৎ সে বছরে ত্রয়োদশ মাস হিসাবে আরেকটা মাস যোগ হতো।
মুসলমানদের আগমনের আগে ভারতের মানুষ পঞ্জিকা ব্যবহার করতো। আল বিরুনির ভারততত্ত্ব মোতাবেকই সন প্রচলিত ছিল । উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমাদিত্যের নামে বিক্রমাব্দ, চতুর্থ শতকের দিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামে গুপ্তাব্দ, উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের নামে হর্ষাব্দ, সম্ভাব্য শক-ক্ষত্রপদের নামে শকাব্দ ছিল সবচেয়ে পরিচিত। তাছাড়া বিভিন্ন আঞ্চলিক সন তো ছিলই।
সেনরাজাদের আমলেই বাংলার মানুষ শকাব্দের সাথে পরিচিত হয়। বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের পর হিজরি এবং শকাব্দ- দুটোরই ব্যবহার দেখা যায়। সেই সাথে ছিল পরগণাতি নামে আরেক কিসিমের সাল গণনা। সেন বংশের পতনকাল থেকে এই সনের উত্থান বলে ধারণা।
অন্যান্য সনগুলোর উৎস যতটা হুটহাট বলে দেওয়া যায়, বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে বিষয়টা অতো সহজ না। বঙ্গ তো আর কোনো শাসকের নাম না, যে শিলালিপি দেখে শাসনকাল খুঁজে একটা কিছু বলে দিলেই কেল্লাফতে। বঙ্গ একটা আঞ্চলিক পরিচয়। হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা এক জনপদের নাম। প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় মানুষেরা জীবনযাপনের তাগিদে ঋতুর হিসেব রাখতো, তেমন ভাবনা স্বাভাবিক। তারপরেও বঙ্গাব্দের জন্মকথায় চারজন শাসকের দাবি নিয়ে পণ্ডিতেরা বিভাজিত। তিব্বতিয় রাজা স্রং সন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, সুলতান হোসেন শাহ এবং মহামতি সম্রাট আকবর।
তিব্বতীয় রাজার দাবিটা আসে ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির কাছ থেকে। ভদ্রলোক 'লে নেপাল' নামক পুস্তকে বলেছেন, রাজা স্রং সন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ও পূর্ব-ভারত জয় করেন। তার নামের সন থেকেই বাংলা সন শব্দ যুক্ত করে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয় বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, স্বয়ং তিব্বতেও ঐ সময়ে কোনো অব্দ প্রচলনের নজির নেই। স্রং সনের বাংলা আক্রমণেরও নিশ্চিত তথ্যও পাওয়া যায় না আদতে। অন্যদিকে সন এবং সাল শব্দদ্বয় বাংলা কিংবা তিব্বতি কোনটিই নয়। প্রথমটি আরবি এবং দ্বিতীয়টি ফারসি। অর্থাৎ ইতিহাস কিংবা যুক্তির ছাঁকনিতে দাবিটি ধোপে টেকে না।
আনুষ্ঠানিক নাম
পহেলা বৈশাখ
অন্য নাম
বাংলা নববর্ষ
পালনকারী
বাঙালি জাতি
উপাসনার রঙ
রামধনু
তাৎপর্য
জাতিগত
উদযাপন
হালখাতা, বৈশাখী মেলা
পালন
বাংলাদেশ (১৪ এপ্রিল)
ভারত (১৫ এপ্রিল)
শুরু
১২:০১
সমাপ্তি
১২:০০
সংঘটন
বার্ষিক
বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকা প্রথম মাস ।পহেলা বৈশাখ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। যাকে আমরা নববর্ষ বলে সবাই উদযাপন করি। এ দিনটি সকল বাঙ্গালীর প্রাণ -প্রিয় উৎসব ।হিন্দুরা যেমন দুর্গাপুজো ,কালীপুজো করেন , মুসলমান জনগণ করেন ঈদ, ঈদোজ্জোহা ইত্যাদি ইত্যাদি । এই সব উৎসবগুলো পালিত হয় জাতিভিত্তিক। কিন্তু বাংলায় নববর্ষ এমনই একটা উৎসব যেখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ জৈন সবাই একসঙ্গে একসাথে একই দিনে পালন করে ।এটি (পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান )অধুনা বাংলাদেশ ,পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরাতে সাড়ম্বরে পালিত হয় । এখন এটি সার্বজনীন উৎসব।
গ্রামীণ রীতি হিসেবে ভোরে কৃষকরা নতুন জামা গায়ে দিয়ে পান্তা ভাতে বিভিন্ন রকম (সানাপোড়া )ভর্তা দিয়ে, পিঠে, পুলি ,মিষ্টি খেয়ে দিনের সূচনা করতেন। আবার অনেক জায়গায় পার্শ্ববর্তী সাত,আটখানা গ্রামকে ঘিরে আয়োজন করা হতো বৈশাখী মেলার । বিভিন্ন গ্রামীণ জিনিসপত্র সেখানে কেনাবেচা হতো । কোন কোন জায়গায় আবার বউমেলা, ঘোড়া মেলার ও আয়োজন হতো বলে জনশ্রুতি আছে ।
অধুনা বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ে ঈশা খাঁর আমলে বউ মেলা হতো ।সেখানে স্থানীয় বটতলায় কুমারী নববধূ মায়েরা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য পূজা দিতে আসতো এমন কথা ও শোনা যায় ।অনেক সময় পাঠা বলি ও দেওয়া হতো। শান্তির বার্তা হিসাবে পায়রা ওড়ানো ব্যবস্থা থাকত সোনারগাঁয়ে ।যামিনী সাধন নামে এক ব্যক্তি নাকি নববর্ষের দিন ঘোড়া চড়ে সবাইকে প্রসাদ দিয়ে বেড়াতেন। নববর্ষ পালনের যাঁকযমকের স্মৃতি কে মনে রেখে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই বাংলায় নাকি পহেলা নববর্ষের উদযাপন শুরু হয়! সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনে মধ্যে সকল খাজনা আদায় প্রক্রিয়া সমাপ্ত হত। এরপর পহেলা বৈশাখ জমির মালিকগণ নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত হতো বিভিন্ন আনন্দদায়ক উৎসব , অনুষ্ঠান । সৌরপঞ্জি অনুযায়ী বাংলা নববর্ষের পালন রীতি বহু প্রাচীন থেকেই ।তখন আমাদের পুরো বাংলাদেশ (অধুনা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ), আসাম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যে বর্ষবরণও বছরের প্রথম দিনের উদযাপনের বিভিন্ন তথ্য আমাদের সামনে আসে। (বাংলা নববর্ষ পালনের ইতিহাসে সম্রাট আকবর কে স্মরণ করলে ও সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক নাকি নববর্ষ উদযাপনের মূল উদ্যোক্তা বা হোতা ।) তবে রাজা শশাঙ্কের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কোন দলিল ইতিহাসবেত্তাগণ সামনে আনতে পারেননি। তাই অগত্যা সম্রাট আকবরকেই এই রীতির প্রচলনের শিরোপা তাঁর মাথায় উঠিয়ে দিয়েছি ।
সম্রাট আকবর যে পঞ্জীকা চালু করেন তার নাম "তারিখ -ই -এলাহি "। এই পঞ্জীকার মাসের নামগুলো ছিল আর্যাদিন,কার্দিন, বিসুয়া,তীর---ইত্যাদি । পরে এই নাম পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ -আষাঢ়- শ্রাবণ হয় ।তবে অনেকে আবার মনে করেন বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে যেমন বিশাখা- জাইস্থা- শ্রাবণী-শার ইত্যাদি নাম অনুসারে বাংলা মাসের নাম হয়।
মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী । এদিকে হিজরী পঞ্জীকা গণনা হয় চান্দ্র মাস অনুযায়ী।চান্দ্র মাসের বছর হয় ৩৫৪বা ৩৫৫ দিনে আর সৌর পঞ্জী অনুযায়ী বছর হয় ৩৬৫দিনে । ১০ দিন করে এগিয়ে এগিয়ে আসে । কৃষকদের ফসল বোনা ফসল কাটার হিসেব নিয়ে ভ্রান্তি ছড়াতো। যেহেতু কৃষিকাজ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে হয়। হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী তা মিলত না এবং খাজনা দেওয়া বছরের বিভিন্ন সময়ে হতো । এরফলে কৃষকেরা মাঝে মাঝে মহাবিপদে পড়তো । খাজনা আদায় কারীরা এই সুযোগে বহু রকমের অত্যাচার ও করতো । এই কাহিনী আমাদের সবার জানা । এই সমস্যার কথা সম্রাট কে জানানো হলে তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য সচেষ্ট হন। খাজনা আদায় এবং কৃষকদের কথা মাথায় রেখেই সম্রাট আকবর বর্ষপঞ্জির সংস্কার করার কথা ভাবতে শুরু করেন। যেই ভাবনা সেই কাজ । ডেকে পাঠালেন তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তানায়ক ফতেউল্লাহ সিরাজীকে ।সম্রাট আকবরের নির্দেশে। সৌর পঞ্জী ও হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে বাংলার বর্ষপঞ্জি নিয়ন্ত্রণ করার আদেশ দেন। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ থেকে বাংলা মাস গণনা করা শুরু হয় ।তবে আনুষ্ঠানিকভাবে খাজনা আদায় শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর থেকে। নাম দেওয়া হয় "ফসলী- সন "পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন নামে অভিহিত হয়। তবে এটা ঠিক থাকে যে চৈত্র মাসের শেষ দিন খাজনা আদায় প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। বছরের প্রথমদিন কৃষকদের মিষ্টি বিতরণ। আয়োজন করা হতো বিভিন্ন রকমের বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান।
সম্রাট আকবরই সর্ব প্রথম বাংলাদেশে হালখাতার প্রচলন শুরু করেন এবং এটি ব্যবসায়ী মহলে সাড়ম্বরে তার প্রতিপালিত হতো ও অদ্যাবধি হয়ে আসছে ।
বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে। ১৫ই এপ্রিল কে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ নববর্ষ উদযাপন বাঙালির প্রধান আকর্ষণ , বিশেষ করে অধুনা বাংলাদেশে।২০১৬ সালে" ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ" থেকে এক মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানে এসে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিগণ এটিকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে ।
ভারত ১৫ই এপ্রিল কে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করে। সৌরপঞ্জী মেনে যেহেতু এটা পালিত হচ্ছে তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
এখন দেখা যাক গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর হকিকত।এটি হল ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টাব্দ । এটি একটি সৌরপঞ্জি ।গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী হলো সম্পূর্ণ গাণিতিক বর্ষপঞ্জি । এতে বারটি মাসের উপস্থিতি আছে। এটি পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জি ও বটে । ১৫৮২ সালে চব্বিশে ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রোয়োদশ গ্রেগরির আদেশ বলে এই বর্ষ পঞ্জি মেনে চলার বিধান দেন। তখন থেকেই এই ধারা চলে আসছে। সেইহেতু এর গুরুত্ব অপরিসীম।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক সুনীল কুমার বন্দোপাধ্যায় বলেন "সৌর বিজ্ঞানভিত্তিক গাণিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল সোমবার সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু" ।
এখন আমরা দেখব সম্রাট আকবরই কি বঙ্গাব্দ স্রষ্টা? বিংশ শতকের প্রথম দিকে " পহেলা বৈশাখ-নববর্ষ" নিয়ে তেমন কোন লেখা আমরা দেখি না । তবে এই তথ্য নিয়ে হঠাৎ এত বাড়াবাড়ি শুরু হলো কিভাবে?
২০০৫ সালে অমর্ত্য সেন (আগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান ) বইটিতে দাবি করে বসেন যে বাংলা নববর্ষের স্রষ্টা সম্রাট আকবর।আর তখন থেকেই চালু হয়ে যায় যে সম্রাট আকবর নাকি বঙ্গাব্দ বা নববর্ষ চালু করার হোতা !এমন একটা চমকপ্রদ তথ্য ।যা সবার খুব প্রিয় । তার স্রষ্টা আবার একজন মুসলমান। মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়! এখন যারা আকবরকে নববর্ষের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করেন তাদের যুক্তি ১৫৮৪ সালে (তারিখ- ই -ইলাহী )চালু করেন কিন্তু তার ভিত্তি বছর ছিল ১৫৫৬সাল, হিজরী সন ছিল ৯৬৩ । অর্থাৎ বঙ্গাব্দ শুরু হয় ২৯ বছর আগে থেকেই।
সত্যি ই কি আকবর বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন চালু করেন? প্রশ্ন থেকেই যায়----
১) ইতিহাস বলে আইন-ই-আকবরীর ত্রিশ পাতা জুড়ে বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জির কালক্রমিক বিবরণ পাওয়া যায়।আর সবশেষে রয়েছে তারিখ- ই -ইলাহী ।কিন্তু এতে কোথাও বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের কোনো উল্লেখ নেই।
এখন প্রশ্ন তাহলে আইন-ই-আকবরীতে তার কোনো উল্লেখ নেই কেন?
২) আইন-ই-আকবরীতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে আকবর হিজরী সন পছন্দ করতেন না । তাই তিনি (তারিখ-ই-ইলাহী-র) সূচনা করেন ।
তিনি যদি বঙ্গাব্দ সূচনা করতেন তবে ভিত্তি বর্ষ নিজ প্রবর্তিত (তারিখ-ই-ইলাহী)-র সাথে সামঞ্জস্য না রেখে হিজরীর সাথে কেন মেলালেন ?
৩) আকবর এর শাসনকালে সারা ভারতবর্ষ ১২ টি সূবা তে ভাগ ছিল ।তাহলে তিনি বাংলার জন্য পৃথক ভাবে বর্ষপঞ্জি তৈরি করলেন কেন? অন্য রাজ্যের জন্য কোন কেন করলেন না?এ প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায় সবসময়। মুলতান ,কাবুলের জন্যে ও তো আলাদা বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে পারতেন?
আমরা দেখব বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক হিসেবে কার পাল্লা ভারী ?
বিক্রমী বর্ষপঞ্জী নামে একটি বর্ষপঞ্জি ও আমাদের দেশে আছে। এটা হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। অনুমান করা হয় এটা খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে নাকি সাল গণনা শুরু হয়!
তবে এর কোনো ভিত্তি বা নথি নেই ।সবটাই অনুমান নির্ভর। তবে নাকি রাজা শশাঙ্কের সময় ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা মাস গণনা শুরু হয়! এটার ও কোনো ভিত্তি নেই। অনুমান নির্ভর ?
৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়। সেদিন নাকি শশাঙ্ক সিংহাসনে আরোহন করেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সে সময়ে শশাঙ্কের ক্ষমতায় আসাটা নেহায়েত অনুমান। ৭ম শতকের শুরুর দিকে শশাঙ্ককে গৌড়ের শাসক হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাপিডিয়ায় শশাঙ্কের সময়কাল ধরা হয়েছে ৬০০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ। তারপরের প্রায় এক হাজার বছরের মধ্যেও বঙ্গব্দের ধারণা মেলেনি। অথচ এই সময়ের বহু তারিখ যুক্ত উপাত্ত আমাদের হাতে আছে। তার চেয়ে বড় কথা, "শশাঙ্কের অধীনস্থ মাধব বর্মণ তার গঞ্জাম লেখতেই গুপ্তাব্দ ব্যবহার করেন। "(এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা- ১৪৫)
বঙ্গব্দের প্রচলন যদি শশাঙ্কই করতেন, তবে সেখানে বঙ্গাব্দ না হয়ে গুপ্তাব্দ কেন? বঙ্গাব্দের আর কোনো নজির নেই কেন? বস্তুত সুনীলকুমার যুক্তির প্রতি গুরুত্ব দেননি। খ্রিষ্টাব্দ ধরে পেছনে গিয়ে কাকতালীয় ভাবে বাংলা ১ম বর্ষে পৌঁছে তাতে শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহনের তকমা জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ মতবাদটাই ঐতিহাসিকভাবে ভিত্তিহীন।
বাংলা সন বা সাল কে বাঙলা বর্ষ হিসেবে ডাকা হয়। ।এই শব্দ দুটো আরবি ও ফারসি। অতএব এই নাম যে ভারতীয় কেউ করেনি তাই নিশ্চিতরূপে বলা যেতে পারে । অবশ্যই মোঘল আমলে এর সূচনা হয় তারিখ ই ইলাহী সূর্য ভিত্তিক ক্যালেন্ডার ।
শকাব্দ অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। এখানেও বারো মাস ছিল বটে তবে সৌর বর্ষ পঞ্জী বলা যায় না।
বিক্রমী বর্ষপঞ্জী তৈরীর কৃতিত্ব কিন্তু বিক্রমাদিত্যের প্রাপ্য।
পরবর্তী সময়ে শকাব্দে থাকা নাম গুলোর নামের সাথে মিল দেখে বাঙলা মাস গুলোর নামকরণ করা হয়। শকাব্দ অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি মতো ছিল ।এখানে বাংলা বারো মাস ছিল বটে কিন্তু সৌর বর্ষপঞ্জি সেটা বলা যায়না।
বিক্রমী বর্ষ পঞ্জীর জনক হিসেবে বিক্রমাদিত্যের নাম এখানে অবশ্যই বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রজারা বিক্রম পঞ্জীর সাথে মিল রেখে ঠিকমতো খাজনা দিতে পারত না । কোনো কোনো বছরে দু'বারও খাজনা দিতে হয়েছে।
বাংলা সনের উদ্ভব নিয়ে সবথেকে জনপ্রিয় ধারণায় যুক্ত সম্রাট আকবরের নাম। প্রখ্যাত বহু পণ্ডিত এ মতের পক্ষে রায় দেন। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই ফেব্রুয়ারি সিংহাসনে আরোহন করেন। তৎকালে প্রচলিত হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে সেটা ৯৬৩সন। বর্তমান খ্রিষ্টাব্দ ২০২৩ থেকে আকবরের সিংহাসন আরোহনের সন ১৫৫৬ বিয়োগ করলে দেখা যায়, (২০২৩ - ১৫৫৬) = ৪৬৭। এই বিয়োগফলের সাথে তৎকালীন হিজরি সন ৯৬৩ যোগ করা হলে দাঁড়ায় (৯৬৩ + ৪৬৭) = ১৪৩০; যা বাংলা বর্তমান সালকে নির্দেশ করে। সহজভাবে বলতে গেলে, বাংলা সন = ৯৬৩ + (খ্রিষ্টীয় সন ১৫৫৬)।
1556 খ্রিস্টাব্দের 14 ই ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয় ।সেই সময় থেকে বাংলা সন চালু হয়। তবে পহেলা বৈশাখ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল না হয়ে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি হতে পারত! ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে( তারিখ ই ইলাহী ) সৌর পঞ্জিকার প্রচলন অনেকটাই যুক্তিযুক্ত। আরবি হিজরী সনের অবাস্তবতা সৌর পঞ্জিকা প্রণয়নের তাগিদ তিনি অনুভব করেছিলেন। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন নিঃসন্দেহে । হিজরী মাসের ক্যালেন্ডার যে কেবল রমজান, শবে বরাত, দুই ঈদ পালন করা ছাড়া অন্য কোন কাজে লাগে না । তাই সৌর পঞ্জীকার সংস্কারের উদ্যোগ নেন ।
এখন দেখা যাক রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত বাংলা সনের আদি বিন্দু ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল ।হয়তো বেশ কয়েকবার সংস্কারের ফলে 12 থেকে 14 কিংবা15 এপ্রিল এসে পড়েছে । এখন প্রশ্ন তবে এই পঞ্জিকা সংস্কার করলো কে? ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে যদি বাংলা সন চালু হয় তাহলে তারা তার আগে বাংলা সনের তারিখ থাকা অসম্ভব। কিন্তু আকবরের বহুপূর্বে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি দেবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলকে প্রথিত বাংলার সন তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায় ।এগুলো তবে কোথা থেকে এলো তার সমাধান কিন্তু এখন আমরা খুঁজে পাইনি।
হিজরি সন থেকে বাংলা সন বের হবার ডায়াগ্রাম; সূত্র: বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা, পৃষ্ঠা: ৫৯
সম্রাট আকবরের আমল মধ্যযুগের ভারতে স্বর্ণযুগ হিসাবে গণ্য। শাসন, তদারকি এবং রাজস্ব আদায় সহজ করার জন্য গোটা সাম্রাজ্যকে ভাগ করেন আকবর। টোডরমলের তত্ত্বাবধানে প্রবর্তিত হয় নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, যা দশসালা বন্দোবস্ত নামে স্বীকৃত। এর ঠিক কাছাকাছি সময়ে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সনের সূচনা ঘটে জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর তত্ত্বাবধানে। আকবরের প্রবর্তিত এই নতুন সন পরিচিতি পায় 'ইলাহি সন' হিসাবে। হিজরি সন পুরোপুরি চন্দ্র নির্ভর হবার কারণে ভারতের ঋতুর সাথে মিলতো না। রাজস্ব আদায়েও অসুবিধা হতো। এজন্য মাসগুলোকে চন্দ্রনির্ভর রেখে বছরকে সৌর করে ঋতুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া হয়। ফসলি সন হিসেবে এর কার্যকারিতা ছিল যুগোপযোগী।
আকবরের দিকে মন্ত্রিপরিষদ সম্রাটের কাছে এর সমাধান চেয়ে আর্জি করলে সম্রাট আকবর ফতে উল্লাহ সিরাজী কে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির সংস্কার করেন । এটিই আমাদের এখন বাংলা বর্ষপঞ্জি।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ই মার্চ বাংলা সন বা সাল গণনা শুরু হয়। ১৫৫৬খ্রীস্টাব্দে ৫ই নভেম্বর তার সিংহাসনে আরোহণ করার দিন থেকেই এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৫৫৬সালে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলাদেশে নববর্ষ প্রবর্তন করেন এবং সেটা পহেলা বৈশাখ।অদ্যাবধি এই ধারা আমরা পালন করে আসছি।
১৭০০সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন মুর্শিদকুলী খানকে। রাজস্ব এবং অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন তিনি। সে সময় দ্রুত তাকে বাংলা থেকে সরিয়ে ফেলা হলেও ১৭১৬ সালে নাজিম পদে উন্নীত হয়ে আবার ফিরে আসেন। ততদিনে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়ে গেছে ১৭০৭ সালে। মোগল সাম্রাজ্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। দিল্লির মসনদ দখলের জন্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে কাকে খাবে এমন অবস্থা। এর মধ্যেই ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ স্থানান্তরিত হলো। দিল্লির সেই অস্থির দিনগুলোতেও বাংলা ছিল স্থিতিশীল। আরো স্পষ্টভাবে বললে বলা যায় রাজস্বের সম্পর্ক বাদ দিলে বাংলা ছিল দিল্লির শাসন থেকে এক প্রকার মুক্ত।
মুর্শিদকুলী খান;
মুর্শিদকুলী খান কেবল দেওয়ান ও সুবাদার ছিলেন, তা না। তিনি একজন সত্যিকার শাসকের মতো সংস্কার আনেন পুরো ব্যবস্থার। আগেই বলা হয়েছে, দিল্লি তখন ঝিমিয়ে পড়েছে। ১৭২২ সালে মুর্শিদকুলী খান পূর্ববর্তী টোডরমল এবং শাহ সুজার প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব পদ্ধতির সংস্কার করলেন। রাজস্ব বৃদ্ধি পেলো বিস্ময়কর রকম। তার প্রবর্তিত ব্যবস্থা মালজামিনী নামে বিখ্যাত। এই ব্যবস্থায় জমিদাররা কিছু সম্পত্তি জামিন রাখার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেতো। রাজস্ব আদায়ে অপেক্ষাকৃত বিশ্বস্ততার কারণে হিন্দু জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠে ঠিক এই সময়টাতেই।
বাংলা সন এবং আকবরের ইলাহি সনের মধ্যে যে ঐতিহাসিক শূন্যস্থান, তা পূরণের জন্য মুর্শিদকুলী খান গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবর ইলাহি সনের প্রবর্তন করেন। সেই সনকে ভিত্তি ধরে ঠিক রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই মুর্শিদকুলী খানের সময় বাংলা সন জন্ম নেয়। এ কারণে মাসের ফারসি নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল নক্ষত্রের নামানুসারে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ… এভাবে। বিশাখা থেকে বৈশাখ ,জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, অসাধা থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভদ্রা থেকে ভাদ্র,-অশ্বিন থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক( মৃগশিরা নক্ষত্রের অপর নাম), অগ্রহায়ণী থেকে অগ্রহায়ণ , পুষ্যা থেকেপৌষ, মগা থেকে মাঘ ,ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন চিত্রা থেকে চৈত্র।
সাতটি বারের ও নাম হয়েছে নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহ থেকে। মঙ্গল- বুধ- বৃহস্পতি -শুক্র- শনি গ্রহ থেকে। উপগ্রহ থেকে সোম ( চন্দ্রের প্রতিশব্দ ),সূর্য একটি নক্ষত্র থেকে (নক্ষত্র প্রতিশব্দ রবি)।
ইলাহি সন থেকে উৎপত্তি ঘটলেও বাংলা সালের মাস এবং দিনের নাম পূর্বপ্রচলিত শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। আবার স্মরণ করা দরকার, মুর্শিদকুলী খান স্থানীয় হিন্দু অভিজাত এবং সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।
রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে চাপ আসতো প্রায়ই। সাধারণ মানুষেরা ফসল না কেটে তো আর খাজনা দিতে পারতো না। অনেকটা সে কারণেই নবাবেরা পূণ্যাহের প্রবর্তন করেন। নবাবের বাড়িতে উৎসব ও খাবার দাবারের আয়োজন থাকতো আর সাধারণ মানুষ তাতে যোগ দেবার পাশাপাশি রাজস্ব পরিশোধ করতো। নবাবের বাড়িতে মেহমান হিসেবে আপ্যায়িত হওয়াটা কম কথা না। রীতিমতো উৎসবে পরিণত হয়ে গেল দিনটা। নববর্ষ চালুর ইতিহাসের পূণ্যাহের তাৎপর্য ব্যাপক। খুব সম্ভবত ব্যবসায়ীরা সেখান থেকেই হালখাতার অনুপ্রেরণা পেয়েছে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
===========================
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন