অগ্নিযুগের স্ফুলিঙ্গ : বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বোস
শেফালি সর
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বোস। যে সমস্ত বিপ্লবী ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন, যারা ভারত মায়ের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রক্ত টগবগ করে উঠত, যাদের বুকের মধ্যে ছিল সিংহের বিক্রম, যাদের পেশিতে লোহার বল, আর স্নায়ুতে ছিল ইস্পাতের ক্ষমতা, তাদের মধ্যে অন্যতম বীর ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বোস। ১৮৮২ সালের ৩০ শে জুলাই এই বাংলার মেদিনীপুরে সত্যেন্দ্রনাথ বোস জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম অভয়াচরণ বোস ছিলেন মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক। আট ভাই বোনের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বিতীয়। প্রবেশিকা ও এফ আই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। বিয়ে ক্লাসের ফাইনাল না দিয়েই মেদিনীপুরেরই কালেক্টর অফিসে কাজ নেন। তারপর ১৯০২ সালে অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ও রাজনারায়ণ বসুর গুপ্ত সমিতিতে তিনি যোগদান করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ' সোনার বাংলা ' প্রচার পুস্তিকার মাধ্যমে যে বার্তা প্রচার হয়েছিল তার অগ্রণী ছিলেন স্বয়ং সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সেই পুস্তিকা বিতরণের জন্যই গ্রেফতার হতে হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুকে। সত্যেন্দ্রনাথের হাত ধরেই কিশোর ক্ষুদিরাম বিপ্লবী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কিশোর ক্ষুদিরাম বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথের দৃপ্ত আহবানে দেশ মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
সত্যেন্দ্রনাথ বোস বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, ও বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী কে অত্যাচারী কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার দায়িত্ব দেন। ব্যর্থ সেই অভিযানের পরে কলকাতার মুরারি পুকুর রোডে পুলিশ যে অভিযান চালায়, সে অভিযানের ফলশ্রুতি হিসেবে ধরা পড়ে একে একে শ্রী অরবিন্দ, উল্লাস কর দত্ত, ও বারীন ঘোষ। এবারেই ধরা পড়েছিল নরেন গোসাই। নরেন গোসাই বিপ্লবের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে বিশ্বাসঘাতকের মত রাজ সাক্ষী হতে রাজি হয়েছিল। ক্ষণিকের প্রলোভন এর বশে একে একে অনেক বিপ্লবীর সন্ধান দিয়েছিল। বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তাই তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন যদি তাকে একটা রিভলবার যোগান দেয়া হয় তাহলে তিনি নিজেই নরেন গোঁসাইকে হত্যা করবেন। কিন্তু আলিপুর জেলে আসার আগেই ক্ষয় রোগী আক্রান্ত হন। এই জন্য তিনি নিজেদের হাসপাতালে ভর্তি হলেন। পরে তিনি রাজ সাক্ষী হওয়ার ভান করে নরেন গোসাই এর সঙ্গে দেখা করতে যান। তারপর তিনি হেমচন্দ্র কানুনগোর দেওয়া রিভলবারে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন। বিচার ব্যবস্থায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। সত্যেন্দ্রনাথকে বাচাতে কানাইলাল দত্ত দায়ভার নিলেন। প্রথম বিচারে মুক্তি হয়েছিল কিন্তু বিচারকের পুনরায় বিচারের আদেশ আবারো তার ফাঁসির আদেশ হয়। তিনি শহীদ হওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশি হন। আমার বলার কিছুই নেই। হ্যাঁ, আমি নরেন গোসাইকে হত্যা করেছি। আমার কবে ফাঁসি হবে তাই জানতে চাই। বিচারব্যবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে যিনি অকপটে গলা তুলে এ কথা বলতে পারেন,- জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে যিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়তে পারেন, তিনিই তো ভারত মায়ের মুক্তির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ১৯০৮ সালে একুশে নভেম্বর সত্যেন্দ্রনাথের ফাঁসি হয়। ব্রিটিশ সরকার জেলের বাইরে অগণিত মানুষের ভিড় দেখে ভয় পেয়ে গেছিল তাই তার দেহ জেলের মধ্যেই সৎকার করা হয়েছিল। ভারতের বুকে বেড়ে ওঠা ' মুক্তির মন্দির সোপান তলে আজও অগ্নিযুগের বিপ্লবের ইতিহাসের ভেজা পাতায় কান পাতলে সেই সব বীরের হুংকার শোনা যায়। আগামী প্রজন্মের কাছে সেই খবর পৌঁছে দেওয়ার দায়ভার আমাদের সকলের।
---------------:-------------------
শেফালি সর
জনাদাঁড়ি
গোপিনাথপুর
পূর্ব মেদিনীপুর
৭২১৬৩৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন