আবছা অন্ধকার ঘরটাতে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। তিনজন মানুষ বসেছে এক গোপন আলোচনায়। এতটাই গোপন আলোচনা যে ঘরের সবকটা জানালা দরজা বন্ধ রয়েছে, যাতে কাক পক্ষীতেও টের না পায় যে এখানে তিন মাথা এক হয়েছে।
- "তাহলে এখন আমাদের কাজ কি?"
- "আমাদের তেমন কিছু করতে হবে না। যা করার সুভাষ চন্দ্র বোস আর তার ফৌজ করবে। আমাদের কাজ দেশের ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা। আর বোসের পথ সুগম করা। বিশাল ফৌজ নিয়ে এগিয়ে আসছেন বোস। কুড়ি হাজার ভারতীয় সেনা যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। এমনকি লক্ষী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে পাঁচশো নারী সেনাও রয়েছে। গতকাল সিঙ্গাপুরে এক প্রকাশ্য জনসভায় রাস বিহারী বোস আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বোসের হাতে তুলে দিয়ে, তাকে সর্বময় নেতা ঘোষণা করে, তাকে 'নেতাজী' বলে সম্বোধন করেছেন। বিভিন্ন ব্রিগেড নিয়ে গঠিত হয়েছে এই বিশাল বাহিনী। যেমন আজাদ ব্রিগেড, গান্ধী ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেড এবং রাণী ঝাঁসী ব্রিগেড। আজাদ হিন্দ ফৌজ যত এগোতে থাকবে, যত লড়তে থাকবে তত লোকক্ষয় হবে, তত অস্ত্রক্ষয় হবে, ফৌজের রসদ কমতে থাকবে। আমাদের কাজ হবে যে লোকক্ষয়, যে অস্ত্রক্ষয় হবে সেটা পূরণ করা। সেনাদের খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য ঘাটতি পূরণ করা, আহত সেনাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ফৌজ ভারতে ঢুকলে আমাদের দায়িত্ব বহুগুন বেড়ে যাবে। সেইজন্য আমাদের মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হবে। পরিস্থিতি বুঝিয়ে সাহায্য চাইতে হবে। সেই টাকা দিয়ে রসদ, অস্ত্র জোগাড় করে, যোগান দিতে হবে। গৌহাটিতে বসে এসব করা সম্ভব নয়, এরজন্য আমাদের দুর দুরান্তরে, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে হবে। মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের দাসত্ব মোচনের জন্য যে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে, সে কথা তাদের বোঝাতে হবে। সবাই বুঝবে না। সবাই এগিয়ে আসবে না। কিন্তু কেউ কেউ আসবে। তাদের নিয়েই এগোতে হবে। তাদের নিয়েই সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। অনেকে বিরোধিতা করবে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। সব থেকে বেশি সাবধান থাকতে হবে টিকটিকিদের থেকে। চারিদিকে টিকটিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের মধ্যে মিশে রয়েছে। যা করার খুব গোপনে করতে হবে। আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে খুব ভেবেচিন্তে, ভালোভাবে যাচাই করে তবেই কাউকে দলে ঢোকানো হবে। না হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।"
- "কিন্তু আমরাতো মাত্র পাঁচজন। তারমধ্যে দুজন অর্থাৎ অরুণ আর পরাশর এখন কোলকাতায়। কবে ফিরবে তার কোনও ঠিক নেই! এই পাঁচজনেের পক্ষেতো খুব বেশি টাকাকড়ি জোগাড় করা সম্ভব হবে না!"
- "আজ আমরা পাঁচজন। কিন্তু সদস্য সংখ্যাতো ক্রমশ বাড়বে। আজ এখানেই কথাবার্তা শেষ করতে হবে। বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। তিনজন একসঙ্গে এখান থেকে বের হবো না। তাহলে কারও নজরে পড়ে যেতে পারি। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে আবার আমরা এখানে মিলিত হবো।"
আলোচনা শেষ হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে যে যার মত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দুই
গ্রামের ছেলে মহাদেব। বাবা, মা,ছোটো বোনকে নিয়ে তাদের চারজনের সংসার। সে এখনো বিয়ে করেনি। নিজের জমিতে চাষবাস করে। আজ চাষের কাজে না গিয়ে সে তার তলোয়ারটাকে একটা পাথরে ঘষে চলেছে, আর মাঝে মাঝে তার ধার পরখ করছে। নকুল গগৈ যেতে যেতে মহাদেবকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই গ্রামেই নকুলের মাসির বাড়ি। মাঝে মাঝেই সে আসে এই গ্রামে তার মাসির বাড়িতে। মহাদেব তার সমবয়সী। আগে থেকেই আলাপ পরিচয় আছে।
তাকে দেখে নকুল বললো, "মহাদেব, সকাল বেলায় তলোয়ারে ধার দিচ্ছো কেন? যুদ্ধে যাবে নাকি?"
- "দেশের অবস্থা ভালো নয় নকুল। গোরারা চারিদিকে খুব অত্যাচার চালাচ্ছে। শুনলাম তিনসুকিয়ায় একটা বাড়ি থেকে দুজন মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের গ্রামে এই খবর আসতে খুব হৈচৈ হচ্ছে। সবাই খুব আতঙ্কে আছে। আমাদের বাড়িতেও মা বোনেরা রয়েছে। সেইজন্য আগে থেকে অস্ত্রটাতে ধার দিয়ে রাখছি। যাতে বাড়িতে হামলা হলে কাজে লাগাতে পারি।"
- "কিন্তু মহাদেব, যদি তোমার বাড়িতে হামলা হয়, তুমি একা একটা তলোয়ার দিয়ে কজনকে ঠেকাতে পারবে? গোরাদের কাছে বন্দুক আছে, লোকবল আছে। তুমি একা কিছুই করতে পারবে না। না পারবে বাড়ির মেয়েদের সম্ভ্রম বাঁচাতে, না পারবে তোমার প্রাণ বাঁচাতে।"
কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে মহাদেব প্রশ্ন করে, "তাহলে কি করা যায় বলতো নকুল! আমরা কি পড়ে পড়ে মার খাবো? কিছুই করতে পারবো না?"
- "কেন পারবে না? চেষ্টা করলে সবকিছুই পারা যায়। তাছাড়া এ সমস্যা কেবল তোমার একার নয়। এই সমস্যা, এই ভয়, এই আতঙ্ক এখন সব বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। তোমাদের গ্রামে অনেক ছেলে আছে, তাদের সবার সঙ্গে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করো। তাদের একজোট করো। সবাই একজোট হয়ে থাকলে কেউ তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের গ্রামে আমরা একজোট হয়েছি। রাতে পালা করে পাহারা দিই। সবাই মিলে টাকা দিয়ে গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করে রেখেছি। গোরা সাহেবরা খারাপ উদ্দেশ্যে আমাদের গ্রামে ঢুকলে, প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে না। আমাদের গ্রামে চল্লিশজন ছেলে আছে। গনধোলাই কাকে বলে দেখিয়ে দেবো। গোরাদের জন্য আমরা পুরোপুরি তৈরি। তোমরাও একজোট হও। গ্রামের ছেলেদের জড়ো করো। বোঝাও যে এই সমস্যা কারো একার নয়। যে কোনও বাড়িতে গোরারা হামলা করতে পারে। যে কোনো সময়ে যে কোনো বাড়ি থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতে পারে। তখন কপাল চাপড়ানোর বদলে, আগে থেকে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরা করে রাখো। না হলে যে কোনো পরিবার যখন তখন বিপদে পড়তে পারে।"
- "আমি আজই সবাইকে ডেকে ব্যবস্থা করছি। আমাদের গ্রামে ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ছেলে আছে। আমরাও নিজেদের স্বার্থে একজোট হবো। তারপর টাকা জোগাড় করে বন্দুক কিনবো।"
- "আগে সবাইকে একজোট করো, সংঘবদ্ধ করো। তারপর আগ্নেয়াস্ত্র কেনার কথা ভাববে। আমি আবার আসবো। শুনবো তোমাদের সংগঠনের কথা"
সলতে পাকানোর কাজটা নিখুঁতভাবে নকুল করে দিল। সে জানে বাকি কাজটা মহাদেব করবে। নিজের গরজেই করবে।
গৌহাটি সহরে বাস করলেও বীরেন্দ্রর আদি বাড়ি শিলচরে। মাঝে মাঝে সে শিলচরে যায়। সেখানে তাদের বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে তার কাকা জ্যাঠারা থাকে। বাড়ি পৌছে বীরেন্দ্র তার জ্যাঠার ছেলে হরিহরের মুখে শুনলো এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে। একজন মদ্যপ গোরা সাহেব শিকারে বেরিয়ে, সারাদিন বন্দুক হাতে ঘুরে কোনো শিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে এক বৃদ্ধকে গুলি করে মেরে দেয়। ঘটনাটা শুনে রাগে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে বীরেন্দ্র। সে বলে, "দুশো বছর ধরে আমরা গুলি খেয়ে চলেছি! এখনো যদি সচেতন না হই এভাবেই গুলি খেয়ে মরতে হবে সকলকে।"
হরিহর পাল্টা প্রশ্ন করে, "কি করতে পারি আমরা? কি করার আছে আমাদের? যে প্রতিবাদ করতে যাবে সেই গুলি খাবে।"
- "একজনে যে কাজ করতে পারবে না, দশজনে করো। গ্রামের ছেলেদের ডাকো, জোটবদ্ধ হও। তারপর সবাই মিলে ঐ গোরাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। চলো আমরা দুজনেই কাজ শুরু করি।"
হরিহরকে সঙ্গে নিয়ে বীরেন্দ্র বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে ছেলেদের বোঝাতে থাকে। তাদের একজোট হওয়ার জন্য, সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। গ্রামের ছেলেরাও বুঝতে পারে একজোট না হতে পারলে, রুখে না দাঁড়ালে সাহেবদের অত্যাচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না। কাউকে বাঁচতে দেবে না এই গোরা সাহেবরা। মেরে ফেলবে সবাইকে। এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে মার খাওয়ার আগে পাল্টা মার দিতে হবে।
- "একটা গোরা গ্রামে ঢুকে বেয়াদবি করলে, তোমরা ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ছেলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হায়নার মত দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করবে।"
- "সাহেবদের কাছেতো বন্দুক থাকে বীরেন্দ্র। বন্দুকের সামনে আমরা দাঁড়াবো কি করে?"
- "একজন সাহেবের কাছে কটা বন্দুক থাকে? কটা গুলি থাকে? বন্দুক দিয়ে সে একা কজনকে ঘায়েল করতে পারবে? দরকার হলে তোমরা গাছের আড়াল থেকে তির ছুঁড়বে, বর্শা ছুঁড়বে, পাথর ছুঁড়বে। আঘাতে আঘাতে জেরবার করে দেবে। সাহেবও গুলি চালাতে থাকবে। একসময় গুলি শেষ হয়ে যাবে। তখন তোমরা আড়াল থেকে বেরিয়ে সবাই মিলে ঘিরে ধরে আক্রমণ করবে, যাতে জ্যান্ত ফিরে যেতে না পারে। এতদিন ওরা তোমাদের আতঙ্কিত করে রেখেছে। এবার তোমরা ওদের আতঙ্কিত করে তুলবে"।
বীরেন্দ্রর কথার মাঝেই একজন বলে উঠলো, "তোমার কথাই ঠিক বীরেন্দ্র। কাল থেকেই আমরা তির, তলোয়ারের অভ্যাস শুরু করবো। নিখুঁত নিশানায় তির ছোঁড়ার জন্য অভ্যাসের প্রয়োজন।"
- "খুব ভালো। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো তোমাদের অনুশীলন।
বীরেন্দ্র নিশ্চিত হয় যে তার গ্রামের ছেলেরা সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে। এবার তারা নিজেদের তৈরি করে নেবে আত্মরক্ষার জন্য। তারপর আসল লড়াইয়ের বীজমন্ত্র তাদের দেওয়া হবে।
পড়াশোনার জন্য গৌহাটিতে এসেছে মুকুন্দ। বাবা চা বাগানের শ্রমিক। চা বাগানের সামান্য মজুরিতে কোনও রকমে দিন গুজরান হয়। চা বাগানের সাহেব মালিক অত্যন্ত বদমেজাজী। কথায় কথায় চাবুক চালায়। আহত, ক্ষতবিক্ষত করে দেয় শ্রমিকদের। বয়স্ক শ্রমিকরাও ছাড় পায় না। চাবুকের আঘাতে জর্জরিত শ্রমিকদের সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে সময় লেগে যায়। কাজ বন্ধ, মজুরি বন্ধ, গরীব শ্রমিকরা দেনায় জর্জরিত হয়ে যায়। কঠিন সমস্যার মধ্যে দিন কাটে তাদের। অনেক দিন হলো মুকুন্দর বাবা টাকা পাঠায়নি। টাকার জন্য মুকুন্দ বাড়ি যায়।
চারিদিক শুনসান। রাস্তাঘাটে লোকজনের চিহ্ন নেই। পুরো পরিবেশটা যেন থমথম করছে। বাড়ির কাছে পৌছে একটা গোঙানির শব্দ পেল মুকুন্দ। মনে হচ্ছে শব্দটা তার বাড়ির ভেতর থেকে আসছে। দৌড়ে গিয়ে সে ঘরে ঢোকে। দেখে তার বাবা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তার মা মেঝেতে বসে কাঁদছে। মুকুন্দকে দেখে কান্নার বাঁধ ভাঙলো তার মায়ের। কি হয়েছে জানতে চায় সে। অনেক বার জিজ্ঞাসা করার পর তার মা বলে, "চা বাগানে উৎপাদন অনেক কম হওয়াতে গোরা মালিক রেগে গিয়ে চাবুক দিয়ে প্রচন্ড মেরেছে শ্রমিকদের। সেই মারে মারাত্মক আহত হয়েছে অধিকাংশ শ্রমিক।"
মুকুন্দ জানতে চায়, "তাহলে কাল কারা চা বাগানে কাজ করবে?"
- "সাহেব হুমকি দিয়ে গেছে, গ্রামের সব জোয়ান ছেলেদের কাল বাগানে যেতে হবে। কাজ করতে হবে।"
ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মুকুন্দ। চিৎকার করে তার বয়স্যদের ডাকতে থাকে, "রঘু, নীলকান্ত, ব্রজেশ্বর কোথায় তোরা?
মুকুন্দর ডাকে তার বয়স্যরা হাজির হলে, মুকুন্দ তাদের প্রশ্ন করে, "তোরা কাল চা বাগানে কাজে যাবি?"
- "তাছাড়া কি করবো? নাহলেতো চাবুক খেয়ে ঘরে শুয়ে থাকতে হবে।"
- "সেতো কাজ করতে গেলেও চাবুক খেতে হবে। তোরা কি এভাবেই মরবি বলে ঠিক করেছিস?"
- "কি আর করবো! সাহেবতো কাল আসবে বলে গেছে। সবাইয়ের ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে!"
- "সাহেব একা তোদের এতজনের ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যাবে! তোরা সবাই মিলে পারবি না সাহেবের ঘাড় ধরতে?"
- "কি বলছিস মুকুন্দ!"
- "মেরুদন্ড সোজা করে ভেবে দেখ, আমাদের ভিটে, আমাদের মাটি, আমাদের দেশ। অথচ সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে কয়েকটা লাল মুখো বাঁদর এসে দিনের পর দিন আমাদের ওপর চাবুক চালাবে আর আমরা মেনে নেব!"
- "তাহলে আমরা কি করবো?"
- "আপাতত হাতে লাঠি তুলে নে। সাহেবের চোখে চোখ রেখে পরিস্কার অস্বীকার কর চা বাগানে কাজ করতে। তারপর দেখ কি হয়।"
- "কিন্তু কাজ না করলে খাবো কি?"
- "উল্টো দিক দিয়ে ভেবে দেখ, কাজ না করলে তোরা যেমন মজুরি পাবি না, তেমনি বাগানের মালিকেরও ব্যবসা চলবে না। চা উৎপাদন না হলে বাগান রেখে তার কি লাভ? দলবদ্ধভাবে একবার শক্ত হয়ে দাঁড়া, দেখবি সাহেব নুয়ে পড়বে। নিজের দোষ স্বীকার করবে। আহত মানুষদের ক্ষতিপূরণ করবে। তোদের একটু শক্ত থাকতে হবে। অভাবের তাড়নায় ভেঙে পড়লে চলবে না। তোরা শক্ত থাকলে, সাহেব ঝুঁকে পড়বে। তোরা ভেঙে পড়লে সাহেবের চাবুক চলতে থাকবে। কি করবি তোরা ভেবে দেখ, পড়ে পড়ে মার খাবি, নাকি রুখে দাঁড়াবি।"
- "রুখে দাঁড়াবো। অনেক মার খেয়েছি। আর মার খাবো না। এবার পাল্টা মার দেবো।" ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে ওঠে একজন।
ক্রমশ ভিড় বাড়ছে মুকুন্দদের ঘিরে। প্রায় পঞ্চাশ জন যুবক এসে জড়ো হয়েছে। ক্রমশ শক্ত হচ্ছে তাদের চোয়াল। বদ্ধ হচ্ছে মুষ্ঠি। সবাই ঠিক করলো কাল একটা ফায়সালা করবে সাহেবের সঙ্গে। যে যার বাড়ি থেকে লাঠি, বর্শা, তির, ধনুক বের করে আনলো। তৈরি হলো সাহেবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
পরের দিন সকাল। গ্রাম জুড়ে থমথমে ভাব। প্রতিটা বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। উৎকন্ঠার সঙ্গে সময় গুনছে গ্রামের মানুষ। এই বুঝি সাহেব এলো, অবাধ্য ছেলেগুলোর ওপর বেপরোয়া হয়ে চাবুক চালাতে শুরু করলো। ভাবতে ভাবতেই ঘোড়ায় চেপে সাহেব এলো। এসেই হুঙ্কার ছাড়লো, "হেই ইয়ং মেন, হয়ার আর ইউ অল? কাম আউট ফ্রম হোম অ্যান্ড কাম উইথ মি অ্যাট গার্ডেন।"
মুকুন্দ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হাতে লাঠি। সে উত্তর দিলো, "নো মিষ্টার এলিসন। নো বডি ইস রেডি টু গো উইথ ইউ।"
- "হোয়াই?"
- "বিকজ লার্জ নাম্বার অফ পিপল অফ দি ভিলেজ আর হাইলি ইনজিওরড। দে নিড ট্রিটমেন্ট। অ্যাট ফার্স্ট ইউ হ্যাভ টু বেগ অ্যাপলজি অ্যান্ড কমপেনসেট ফুললি। দেন আদার পিপল উইল থিঙ্ক অ্যাবাউট ইয়োর গার্ডেন।"
মুকুন্দর কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে এলিসন সাহেব। বলে, "হু দ্য হেল ইউ আর? আই নেভার সিন ইউ অ্যাট হেয়ার।"
- "আই অ্যাম মুকুন্দ। সন অফ ইনজিওরড শ্যাম সুন্দর হাজারিকা। বাট হু আর ইউ? হোয়াট ডু ইউ ডু অ্যাট হেয়ার? গো ব্যাক ইওর কান্ট্রি।"
উদ্ধত সাহেবের চাবুক ধরা হাত শূন্যে উঠলো। শূণ্যে উঠলো মুকুন্দর হাতে ধরা লাঠি। সেইসঙ্গে শূণ্যে উঠলো মুকুন্দর পাশে এসে দাঁড়ানো আরো দশ বারোজন যুবকের হাতের লাঠি। প্রমাদ গুনলো সাহেব। ঘোড়া ঘুরিয়ে ফিরে গেল। যাওয়ার আগে হুমকি দিয়ে গেল, "আই উইল কাম ব্যাক সুন।"
কিছুক্ষণ পরে সাহেব আবার ফিরে এলো। এবার তার হাতে চাবুকের বদলে বন্দুক। সঙ্গে দশজন লাঠিধারী রক্ষী। অবশ্য ইতিমধ্যে মুকুন্দ তার মোর্চা গুছিয়ে নিয়েছে। এলিসন সাহেব গ্রামে ঢুকে শূণ্যে গুলি ছুঁড়লো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বাড়ির, বিভিন্ন গাছের আড়াল থেকে ছুটে আসতে লাগলো ঝাঁকে ঝাঁকে তির, বর্শা, পাথর। কিছু তির বিঁধলো ঘোড়ার গায়ে, সাহেবের শরীরে। পাথরের টুকরোতে ফাটলো সাহেবের কপাল। তার হাত থেকে খসে পড়লো বন্দুক। একজন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে লাথি মেরে বন্দুকটাকে অনেক দুরে সরিয়ে দিলো। ত্রিশ জন ছেলে লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো লাঠিধারী দশজন রক্ষীর উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়ে লাঠি ফেলে পালালো রক্ষীরা। গনপিটুনী খেয়ে সাহেবও গ্রাম ছাড়লো।
এলিসন সাহেব প্রথমে ভেবেছিলো আইনি ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তার শুভাকাঙ্খীরা তাকে বিরত করলো। বোঝালো যে এখন সময়টা ইংরেজদের পক্ষে অনুকূল নয়। তাছাড়া আইনি ব্যবস্থা নিলে বেশ কিছুদিন চা উৎপাদন বন্ধ থাকবে। আখেরে লোকসান হবে। ওসব না করে একটা সমঝোতা করে নেওয়া ভালো। পরিস্থিতি বুঝে সমঝোতার পথে হাঁটলো এলিসন। জয় হলো মুকুন্দর। মুকুন্দ তার বয়স্যদের বললো, "দেখলিতো এরা সব কাগজের বাঘ। একটু রুখে দাঁড়ালেই এদের জারিজুরি শেষ। তবে যতদিন এরা এদেশে থাকবে, ততদিন আমাদের উপর অত্যাচার চালাবে। এই দেশ থেকে এদের সমুলে উপড়ে ফেলব হবে।"
- "কিভাবে?"
- "সেটা খুব তাড়াতাড়ি হবে। দেশ নায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস বিরাট সেনা বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। যখন ঐ বিশাল বাহিনী ভারতে ঢুকবে, তখন ঐ বাহিনীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তোরা হাত বাড়াবিতো?"
তিন
মুকুন্দ, বীরেন্দ্র, নকুল তিনজন আবার মিলিত হয়েছে নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে। ভুমিকা ছাড়াই মুকুন্দ বলতে শুরু করলো, "একদিন আমার মনে সংশয় ছিল যে আমরা মাত্র তিনজন কতটা কি করতে পারবো! আজ হিসাব করে দেখা যাচ্ছে যে কয়েকশো যুবককে আমরা বাস্তব পরিস্থিতিটা বোঝাতে পেরেছি। অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করে দিতে পেরেছি। তারা সর্বশক্তি দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এমনকি দেশের জন্য, জাতির জন্য, সার্বভৌমত্বের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে তারা প্রস্তুত। আসামের বিভিন্ন জেলায়, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা আমাদের সদস্যরা গৌহাটির আসে পাশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।"
মুকুন্দ থামতেই বীরেন্দ্র বলতে শুরু করে, "আমার কাছে খবর এসেছে যে আমাদের দুই সাথী অরুণ এবং পরাশর কলকাতা থেকে বেশ বড় অঙ্কের রসদ এবং বেশকিছু সদস্য সংগ্রহ করে গৌহাটির পথে রওনা দিয়েছে। এছাড়াও বিহারের পাটনা, উড়িষ্যার কটক, এবং উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ সংগঠিত হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারতে ঢোকার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে মণিপুরী, কুকি, নাগা যুবকরাও সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছে। অতয়েব আমাদের স্বাধীনতা কেবল সময়ের অপেক্ষা। এবং..."
বীরেন্দ্রর কথার মাঝেই নকুল বলতে শুরু করে, "বিশ্ব যুদ্ধের পরিস্থিতি এখন চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে। মিত্র শক্তি ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করেছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি জাপানের সমর্থন যেমন আছে। তেমনি রসদ যোগানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের দখল করা আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপ দুটো তারা আজাদ হিন্দ ফৌজকে দিয়েছে। নেতাজী এই দ্বীপ দুটোর নতুন নামকরণ করেছেন 'শহীদ' এবং 'স্বরাজ'। সামরিক অভিযানের সুবিধার জন্য ভারতের নিকটবর্তী রেঙ্গুনে সামরিক দপ্তর গঠিত হয়েছে। রেঙ্গুন থেকে নদী, পাহাড়, অরণ্য পেরিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ পায়ে হেঁটে ভারতের দিকে রওনা হয়েছে। পিঠে সামরিক বোঝা নিয়ে প্রতিদিন তারা কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার হাঁটছে। আজাদ হিন্দ ফৌজ এখন আরাকানের পথে।"
সারা দেশ আনন্দে মেতে উঠেছে। ঘরে ঘরে উৎসব হচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মস্থানে প্রার্থনা চলছে আজাদ হিন্দ ফৌজের সফলতার জন্য। দেশের যুব সমাজ মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য। দেশের হয়ে লড়ার জন্য। এরমধ্যে রেডিও মারফত খবর এসেছে আজাদ হিন্দ ফৌজ আরাকান দখল করেছে। এগিয়ে আসছে ইম্ফলের দিকে।
প্রত্যেক দিনই আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রগতির খবর আসছে। বিভিন্ন জেলায়, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহাদেব, হরিহর, রঘু, নীলকান্ত, ব্রজেশ্বরের মত শয়ে শয়ে ছেলেরা বাড়ি ঘর ছেড়ে গৌহাটির আসে পাশের অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে সংগঠনের পরবর্তি নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। যত এগিয়ে আসছে আজাদ হিন্দ ফৌজ, তত কোনঠাসা হচ্ছে ইংরেজ তথা মিত্র শক্তি। মহাদেব, হরিহররা আর গোপনে নয়, প্রকাশ্যে রাস্তায় এসে 'জয়হিন্দ' ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে।
আবার এসেছে সাফল্যের খবর। আবার উদ্বেলিত দেশ। আবার গগনভেদী 'জয়হিন্দ' স্লোগানে মুখরিত ভারত বর্ষ। ভারতের সীমানায় প্রবেশ করে ব্রিটিশদের মৌডক সেনা ছাউনিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ ফৌজ। ব্রিটিশ সেনারা ভয়ে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। প্রচুর অস্ত্র করায়ত্ব হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের। তারপর আরও সাফল্য। কোহিমা দুর্গ দখল করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। কোহিমা ডিমাপুর রোডের একটা ক্যান্টনমেন্ট করায়ত্ব হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর। এরপর মণিপুরের দিকে এগোতে থাকে বাহিনী। মণিপুরের বেশ কিছুটা অংশ অধিকৃত হয় বাহিনীর। মণিপুরের মৈরাংয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। এবার শুরু হলো ইম্ফল দখলের লড়াই। দীর্ঘদিন ধরে চললো লড়াই। আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রায় তিন মাস অবরোধ করে রাখে ইম্ফলকে।
আচমকাই পট পরিবর্তন হলো বিশ্ব যুদ্ধের এবং বিশ্ব রাজনীতির। একই সঙ্গে পরিবর্তিত হলো ঋতুর। এলো বর্ষাকাল। প্রচন্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগে রসদের যোগান প্রায় বন্ধ। খাদ্য, বস্ত্রের অভাব সেইসঙ্গে বিষাক্ত কীট পতঙ্গের উপদ্রবে পরিবেশ ক্রমশ প্রতিকূল হয়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে। অন্যদিকে মিত্র শক্তি প্রচন্ড আক্রমণে দখল করে নেয় বর্মার উত্তরাঞ্চল। জাপান বাহিনী রেঙ্গুন ছেড়ে পালায়। রেঙ্গুন চলে যায় মিত্র শক্তির দখলে। ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে লড়াই চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইংরেজ বাহিনী কামান, ট্যাঙ্ক এবং আকাশ পথে আক্রমণ করে দিশেহারা করে তোলে আজাদ হিন্দ ফৌজকে। ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজ অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয়ে হতাশ হয়ে পড়ে বীরেন্দ্র, মুকুন্দ, নকুল, মহাদেব, হরিহরের মত সারা দেশের হাজার হাজার, লাখ লাখ তরুণ যুবক। তাদের মুখে একটাই প্রশ্ন "আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে স্বাধীনতার জন্য?"
না, বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র দুবছর পরে ভিন্ন পথে এসেছিল স্বাধীনতা। তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রবল ঝড় ইংরেজদের ভারতে রাজত্ব করার স্বপ্ন এবং মনোবলকে চুরমার করে দিয়েছিল।
।। সমাপ্ত ।।
==========================
দেবাংশু সরকার,
M.G.ROAD, BUDGE BUDGE,
KOLKATA - 700137.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন