Featured Post
রাত দখলের লড়াই : স্বাধীনতার নব দিগন্ত ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
রাত দখলের লড়াই : স্বাধীনতার নবদিগন্ত
রণেশ রায়
“মরা গাঙ গর্জে ওঠে বানে
পূর্ণিমার গরাল টলোমল
গরবিনী নন্দিনী আমার
রাজপথে ফণা তুলে চল”
--- সরোজ দত্ত
আজ ১৫ই আগস্ট ২০২৪, ‘ভারতের ‘স্বাধীনতা’র আটাত্তরতম ‘পবিত্র’ জন্মদিন। এই ‘শুভদিনে’ সকালে উঠে আমরা কী দেখলাম কী জানলাম? আমরা দেখলাম কলকাতার এক প্রান্তে একটা নামী হাসপাতালের ছাদে পতপত করে ‘স্বাধীন’ ভারতের পতাকা উড়ছে।পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে এক জল্লাদ বাহিনী। জানলাম যে ২০২৪ এর ১৪-১৫ তারিখের সন্ধিক্ষনে রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতার শুভলগ্নে এক ‘দেশপ্রেমিক’ ‘অগ্রণী’ বাহিনী যারা এই স্বাধীনতার দৌলতে লুঠ ধর্ষণ আর খুনের অবাধ অধিকার পেয়েছেন তাঁরা এই মহান পতাকা উত্তোলন করেছেন। অনুমান করা যায় তাদের মহান উদ্দেশ্য হলো জানিয়ে দেওয়া যে মেয়েরা নিজেদের স্বাধীনতার অধিকার দাবি নিয়ে ন্যায় বিচারের দাবিতে এই রাতে যে পথের দখলে নেমেছে তাদের শিক্ষা দিতেই এই পতাকার উত্তোলন আর তার সঙ্গে হাসপাতালটা তছনছ করে তাদের শক্তি প্রদর্শন। এই মেয়েদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস এদের নেই। তাই অন্ধকারে লুকিয়ে এদের হয়তোবা যে কুকীর্তি কয়েকদিন আগে ওই হাসপাতালে হয়েছে তার প্রমান বিলুপ্ত করা। আর এটা ঘটেছে পুলিশপ্রশাসনের সামনে বলতে গেলে তাদের সাক্ষী রেখে তাদের নাকের ডগায়। বীর বিক্রমে তাদের এই ধ্বংস লীলা। রাষ্ট্র নীরব দর্শক। রাষ্ট্রের এই নীরবতা তাদের কি এই কাজে সর্মথনের সূচক? জানা নেই। এই নারকীয় কাজের মুখে তৎপর না হয়ে কেন এত “সংযম” কেন পুলিশ জল কামান বা রবার বুলেট ব্যবহার করল না? এই প্রশ্নটা থেকেই যায়। অথচ আজ ওই নারকীয় ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের ওপর লাঠি চালাতে পুলিশ কার্পণ্য করেনি। আন্দোলনকারী মেয়েদের ওপর নির্যাতনেও পুলিশ তৎপর। প্রতিবাদ মঞ্চ ভেঙে দিচ্ছে।পুলিশ গুন্ডামির মুখে সংযত অথচ গুন্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দমনের কর্মসূচিতে অসংযত। আমরা কী রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে পারি, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ বা ‘কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে’। মুখ্যমন্ত্রী কী মনে করেন মানুষ অন্ধ অবুঝ?
বলা হচ্ছে সিপিএম বিজেপি যৌথভাবে এই আক্রমণ চালিয়েছে সরকারকে অপদস্ত করার জন্য। যদি তাও হয় তবেও পুলিশের তথাকথিত সংযত থাকার কারণ বোঝা দায় কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ন্যূনতম ক্ষতিতে জল কামানের মত অস্ত্র ব্যবহার করা যেত। তাতে জনগন সরকারের কাছে কৈফয়ত চাইত না। বিশেষ করে এই আন্দোলনের মঞ্চ যেখানে ভাঙা হয়েছে। আর ব্যাপক জনতা আন্দোলনকারীদের পক্ষে আর তারাও ধর্ষণ ও খুনের জন্য দায়ীদের শাস্তি যেখানে চায়। আর আমাদের কথা হলো যেখানে আক্রমণকারীরা দুর্বৃত্ত সেখানে যে দলেরই হোক না কেন পুলিশকে ব্যবস্থা নিতেই হয়। এই ন্যূনতম ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের আচরণকে সংযত আচরণ বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে ওখানকার উত্তপ্ত অবস্থা ছিল তাই পুলিশকে অবস্থা সামলাবার জন্য প্রস্তুত থাকতেই হয়। আর মুখ্যমন্ত্রী যেখানে নিশ্চিত করে বলছেন ওরা করেছে তবে সেখানে সেটা প্রমান দিয়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তাঁর । আর মেয়েটিকে ধর্ষণ ও খুনে যুক্তদের খুঁজে বার করে যথাযথ শাস্তি দিতে হয়। কিন্তু সে ব্যাপারেও পুলিশ উদাসীন। আসলে পুলিশ প্রশাসনও হয়তো মঞ্চ ভাঙতে চেয়েছিল। তদন্তের প্রমান নষ্ট হোক চেয়েছিল কোন স্বার্থ গোষ্ঠীর স্বার্থে। তাই তারা আগেভাগেই মেয়েটির মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালাবার চেষ্টা করে বলে খবরে প্রকাশ । আর মুখ্যমন্ত্রী কী বলতে পারেন গতকালের গুন্ডাদের হাসপাতালে প্রতিবাদ মঞ্চ ভাঙ্গা আর আজকের পুলিশের কোন দলের প্রতিবাদ মঞ্চ ভাঙার মধ্যে তফাৎ কোথায়? পুলিশও কি সেই গুন্ডার ভূমিকা পালন করছে না ?
যে প্রসঙ্গে আমার ওপরের বক্তব্যের পরিবেশন তা হলো কিছুদিন আগে একটি ডাক্তার মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন ও তার প্রতিবাদে রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে মেয়েদের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, তাদের অধিকারের দাবিতে ভারতের স্বাধীনতার পতাকা নিজেদের দাবিতে নতুন করে হাতে তুলে নেওয়া। স্বাধীনতার এক নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটানো। বলা চলে স্বাধীনতাকে নতুন করে ছিনিয়ে নেওয়া। বিশেষ করে এমন একটা কুৎসিত কাজের নিন্দা করার বদলে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালাবার চেষ্টার যে খবর প্রচারিত হয় তা এ আন্দোলন আরও তীব্র করে তোলে । এই আন্দোলনের অভিমুখ আরও নিদ্দৃষ্ট হয়ে ওঠে এবং সঠিকভাবে। দুষ্কৃতীদের আজের অন্ধকার রাতের অধিকারটা কেড়ে নিয়ে মহিলাদের নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার দাবিতেই এই আন্দোলনের সূচনা। তাঁরা বুঝেছেন যে চলতি সংসদীয় ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থায় দলগত ভাবে সে ব্যাপারে তাঁরা তেমন উৎসাহী নয়। বরং কিভাবে ক্ষমতা পাওয়া যায় সেটাই তাদের ভাবনা।তাই এই আন্দোলনের মিছিলে কোন দলের পতাকাকে তাঁরা গ্রাহ্য বলে মনে করেন না।
আমি নীচের কবিতার কয়েকটি ছত্রে তাঁদের আন্দোলনের বিষয়টা তুলে ধরে আমার তরফে ওদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করবো :
দখল
রাত সে নৈশ অন্ধকার
পিশাচের দখলে সে রাত
ধর্ষণ খুন রাহাজানি অবাধ
নেই নারীর ইজ্জত অধিকার।
চল দখল নিই সে রাত
মাথার ওপর নীল আকাশ তোমার আমার
ভোরের আলোয় তাকে সাজিয়ে তুলি
অন্ধকার শেষে সূর্যের কিরণে এবার।
যে কোন দেশে স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সে দেশের জনগণের আত্মসম্মান বজায় রেখে অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ মানুষ স্বাধীনতা চায় সসম্মানে তার ন্যায্য অধিকার অর্জন করার আশায়। বিদেশী অনুশাসনে এই অধিকার অর্জনের বিষয়টি নেহাৎ দিবাস্বপ্ন ছিল কারণ বিদেশী শাসন বলবত থাকে মানুষের মাতৃভূমির ওপর অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে। মাতৃভূমি ও তার সন্তানদের অধিকার কেড়ে নিয়ে খর্ব করেই শাসকের পররাজ্য লুঠ করার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। কিন্তু স্বাধীনতা মানুষকে তার স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থান পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েই প্রকৃত স্বাধীনতা আর উন্নয়নের পথে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। অর্থাৎ বর্ণ ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অধিকারকে সমান মর্যাদা দিয়ে এগিয়ে যাওয়াকেই একটা স্বাধীন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বলে মনে করা হয়। সমাজের প্রগতি এতেই সম্ভব।অর্থাৎ কোন স্বাধীন দেশের অগ্রগতি একটি বহুমুখী বিষয় যাকে একটা বর্ণ ধর্ম লিংগ নির্বিশেষে অগ্রগমন বলি। খাদ্য বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থান লিংগ সমতা পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। ভারত উপনিবেশকালিন সময়ে কোনটার প্রতিই তার প্রাপ্য পায়নি। বিদেশী শাসন তাদের নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে কোনোটাই ভারতবাসীকে তেমন কিছুই দেয় নি। যতটুকু দিয়েছে তা তাদের অনুগ্রহ বলে বিবেচিত হয়েছে।ভারতবাসীর অধিকার বলে স্বীকৃতি পায় নি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ এবং একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে তা এক অর্থে ক্ষমতার হস্তান্তর। এই স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে অধিকারগুলোকে কাগজে কলমে স্বীকার করলেও নতুন ব্যবস্থাতেও তা কথার কথা থেকে গেছে। প্রকৃত অর্থে ব্যাপক মানুষের অধিকার তেমন স্বীকৃতি পায় নি। প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ মানুষ পায় নি। খাদ্য বস্ত্র স্বাস্থ্য শিক্ষা এখনও বিরাট সংখ্যক মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটায় না। যতটুকু উন্নতি হয়েছে তার সিংহ ভাগের দখল নিয়েছে উচ্চবিত্ত মানুষ। আর আজও ভারত একটা পুরুষতান্ত্রিক দেশ।নারী স্বাধীনতা এখনও অধরা। ধর্মীয় আচার আচরণে মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, মননে আর রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যতায় পরিবেষ্টিত।আর সেইজন্যেই আমাদের আলোচনার বিষয় অভয়ার ধর্ষনের হত্যার জন্য বহু জ্ঞানী গুণী মানুষ মেয়েটির অসাবধানতাকে দায়ী বলে মনে করছেন।পরোক্ষে মেয়েদের স্বাধীন ভাবে চলার অধিকারকে অস্বীকার করছেন। আমাদের সমাজ যে চিরায়ত ধর্ষনের সংস্কৃতি বহন করে চলেছে নারী অধিকারকে পদদলিত করে চলেছে সেটা তারা স্বীকার করেন না। তবে আরও মনে রাখা দরকার এর পেছনে ক্ষতাশালি স্বর্থগোষ্ঠি জড়িত যাদের বৃহত্তর স্বার্থ আছে।তারা ব্যবহৃত হওয়া দুষ্কৃতীদের যা খুশি করার লাইসেন্স দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে শুধু খুন নয় ধর্ষণ করে খুন।
ওপরের আলোচনার প্রেক্ষাপটে নিশ্চিত করে বলা চলে আজকের এই চলমান নারী আন্দোলন এক ঐতিহাসিক আন্দোলন যা সমাজ অগ্রগতির আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। একটাকে ছেড়ে আরেকটাকে ভাবা যায় না।তাদের রাতের রাস্তা দখলের ডাক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।বৃহত্তর পরিসরে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নারী স্বাধীনতার দাবি সেটা তুলে ধরে। এটা নারী আন্দোলনের এক নতুন যুগের সূচনা বলে মনে করা যেতে পারে।একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার প্রক্রিয়ায় এ এক উলম্ফন যা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের একটা দিশা বলে বিবেচিত হতে পারে।আজ এই আন্দোলনে মহিলাদের অভূতপূর্ব সাড়া আমাদের বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করছে, আশা জাগাচ্ছে। আর এই নারকীয় কাণ্ডের কান্ডারীদের বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে।যে মেয়েরা আর তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করছেন তাঁরা অভিনন্দন যোগ্য।
‘রাতের রাস্তা দখল’ এর ডাক কী বার্তা বহন করে? রাস্তা বলতে পৃথিবীতে চলার রাস্তা। আর এই পৃথিবীর রাস্তা তথা চলার পথ আজ অন্ধকার আচ্ছন্ন। তার ওপর দিয়ে চলার অধিকার খুনি, ধর্ষক আর লুঠেরারের দখলে। সে পথ দখল করা মানে প্রগতির পথে এগোবার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। সেটা যে শুধু পশ্চিম বঙ্গের নারীদের অধিকার তা নয় সারা পৃথিবীর নারী পুরুষ সবার জন্যই দরকার। সেটা পাবার অধিকার মানব জাতির সবার। তাই দেখি পশ্চিমবঙ্গের এই স্ফুলিঙ্গ সারা দুনিয়ায় দাবানল জ্বালতে সাহায্য করেছে।এই আন্দোলনকে সক্রিয় সমর্থন জানাতে জেগে উঠেছে দুনিয়ার জনগণ। এই আন্দোলন একটি মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ আন্দোলন যা ন্যায় বিচার দাবি করে। কিন্তু এর মধ্যেই এই আন্দোলনের ডাক সীমাবদ্ধ নয়। এ হল সমস্ত নারী সমাজের প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ডাক যা আজ আর শাসক সম্প্রদায়ের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল নয়। এই অধিকার অর্জন করতে হয় লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এ লড়াইয়ে পতাকাবাহক কোন কায়েমি স্বার্থের নেতৃত্বে লড়াই নয়। সেটা আজ সম্ভব নয় কারণ সংসদীও সব দলই আজ জনগণের স্বার্থে নয় নিজ দলের ক্ষমতা লাভের স্বার্থে উন্মাদ। সে স্বার্থে কায়েমি স্বার্থের কাছে বলিপ্রদক্ত। তারা মানুষের আস্থা হারাচ্ছে বা হারিয়েছে। আজ নারী সমাজেরও এই উপলব্ধি যে কোন কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এই লড়াই শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। আর আজের রাস্তা দখলের ডাকের এই লড়াইয়ের শেষ লক্ষ্যটা হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। অন্য ভাবে বলতে গেলে স্বাধীনতার এক নব দিগন্ত উন্মোচিত করা যা মানব জাতিকে প্রকৃত অগ্রগতির পথ দেখায়। শাসককে অর্ধেক আকাশের প্রাপ্য অধিকার নারী সমাজকে অর্পণ করতে বাধ্য করা।আর নারী হল মানব সমাজের অর্ধেক তাই তাদের মুক্তি ছাড়া মানব মুক্তি অসম্ভব, সাম্যবাদের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। তাই এ লড়াই একই সঙ্গে মানব মুক্তির লড়াই।
আজ মহিলাদের এই জাগরণকে ইতিহাসে অসংখ্য আন্দোলনের বহমানতার প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হয়।ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ বিরোধী সব আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করা হয় রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে।সে সিপাহী বিদ্রোহ হোক নৌবিদ্রোহ হোক অহিংস আন্দোলনের বিকল্প সশস্ত্র আন্দোলন হোক স্বাধীনতার মুখে তেলেঙ্গানার কৃষি বিদ্রোহের মত অসংখ্য বিদ্রোহ হোক। ব্রিটিশ পরবর্তী যুগে এই ধারা অব্যাহত রেখে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে খাদ্য আন্দোলন ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ থেকে এই সেদিদের সারাভারতের কৃষক অভ্যুত্থান সব কিছুই দমন করা হয়েছে সশস্ত্র সেনা বাহিনী পুলিশ বাহিনী আর আঞ্চলিক গুন্ডা বাহিনীর সাহায্যে।কোথাও পুলিশ সংযত ছিল না। অথচ আজ আমাদের এই ঘরের মেয়ের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ নির্বিকার। এমন কী বিরোধীদের প্রতিবাদ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার মত কাপুরুষতার ঘটনা ঘটায় পুলিশ। আর সেটা কার নেতৃত্বে তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। সরকারি দলেরও কিছু বিবেকবান মানুষ সেটা বুঝছে। তবে মানুষের ক্ষোভ যখন বাঁধভাঙা হয়ে ওঠে তখন এই আন্দোলনের ফয়দা কে তুলবে তার ঠিক থাকে না। যেটা বাম আমলে সিঙ্গুর নন্দিগ্রাম লালগড়ে আমরা দেখেছি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী সেদিন তার ফয়দা তুলেছিলেন।জনগণের বিক্ষোভ আন্দোলনের ঘাড়ের ওপর পা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল তার দল।ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কালে শাসনে গিয়ে যদি সেই অত্যাচার নির্যাতনের কাজ চলতে থাকে কায়েমী স্বার্থ আর তার চোর গুন্ডা বাহিনী প্রশ্রয় পায় তবে কী হতে পারে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশ। তার ফায়দা তোলে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি। আমি বিশ্বাস করি না মুক্ত মনা ছাত্র সমাজ এর জন্য দায়ী।এর জন্য দায়ী সেখানকার শাসক আজ যাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হোয়েছে। একই বিষয়ের পূর্বাভাস আমরা এখানে আজ পাচ্ছি। শাসককুলের অত্যাচার যেভাবে বেড়েছে চোর গুন্ডা বদমায়েশ লুঠেরা আর ধর্ষকরা যেভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে মানুষের ক্ষোভ ঘটনা প্রবাহকে সেই দিকে নিয়ে যাচ্ছে।এর ফয়দা যদি সাম্প্রদায়িক দল তোলে তার দায় বর্তায় কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর ওপর।আমি সক্রিয় রাজনীতি অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি বিশেষ করে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পর যখন দেখেছি ওই বিশাল অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়েছে আমাদের চিন্তা ধারা বিরোধী একটা স্বার্থ গোষ্ঠী কোন একটা পতাকা হাতে।আজ আন্দোলনকারী মেয়েরা বোধ হয় সেটা বুঝে কোন দলকে পতাকা নিয়ে আসতে দিচ্ছে না। আর মানুষ দল নির্বিশেষে এই প্রতিবাদ আন্দোলনকে সমর্থন করছে।৮০ বছর বয়সে আমারও আজ ত্রিশংকুল অবস্থা। চিৎকার করে বলতে চাই রাষ্ট্র তুমি আমাকে দমনের জন্য তোমার রাষ্ট্র যন্ত্র ব্যবহার কর তাতে যদি তোমার জিঘাংসা তৃপ্ত হয়। আমি আন্দোলনকারীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী আজ ভিন প্রদেশে চলে আসায় কলকাতায় থাকতে না পারায় তোমাদের প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলাতে পারলাম না বলে। সেই যন্ত্রণা থেকে কিছুটা নিরাময়ের আশায় আমার এই কলম ধরা। আমি আরেকটা বার্তা দিতে চাই। আজ আমরা ভালো থাকি খারাপ থাকি সবাই রাষ্ট্রের কারায় বন্দী। এসো সবাই নজরুলের ডাকে সাড়া দিই:
কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
এসো আমরা সবাই যে যেখানেই থাকি এক একজন সুকান্তের ক্ষুদ্র একটা দেশলাইয়ের কাঠি হয়ে জ্বলে উঠি:
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি;
এত নগণ্য হয়তো চোখেও পড়ি না:
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
আমার শেষ একটা কথা বলে আমি শেষ করছি। মনে রাখা দরকার এ আন্দোলন এক বহমমানতা। এর সার্থকতা আছে ব্যর্থতা আছে কিন্তু মরণ নেই।শেষবিচারেএর জয়অনিবার্য:
এ আন্দোলন ওদের থরহরি কম্পন
এ আন্দোলন আমাদের জীবন স্পন্দন
এ আন্দোলনের নেই মরণ
এ আন্দোলনে আছে জয়ের অনুরণন।
এইভাবে হত্যা করে মৃত অভয়াকে অমর করে গেল জল্লাদরা। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবীতে নন্দিনীর সঙ্গে রাজার একটা কথোপকথন তুলে ধরলাম :
নন্দিনী।। রাজা, এইবার সময় হল।
রাজা ।। কিসের সময়?
নন্দিনী।। আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা।। আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি! তোমাকে যে এই মুহূর্তে মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী।। তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই। আমার অস্ত্র মৃত্যু।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন