অনেকের মতে, হাজার চারেক বছর আগে চীন দেশেই সর্বপ্রথম ঘুড়ি ওড়ে। শোনা যায়, চীনা চাষিরা ঝড়ের সময় তাঁদের টুপি সুতো দিয়ে বেঁধে রাখতেন। সেখান থেকেই ঘুড়ির ভাবনা আসে। কেউ কেউ বলেন, দুজন চীনা দার্শনিক মজি আর লু ব্যান সর্বপ্রথম ঘুড়ি আবিষ্কার করেছিলেন। অনেকের অবশ্য ধারণা, ঘুড়ির প্রথম প্রচলন চীনদেশে হলেও সময়টা অতটা আগে নয়, আনুমানিক ১০০০ খৃষ্ট-পৃর্বাব্দ। কয়েকজনের মতে, ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে 'আর্কাইতের' নামে একজন গ্রীক সর্বপ্রথম ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন টেরানটাসে। আবার এমনও শোনা যায় যে, ২০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে হ্যান বংশীয় রাজা হানসিন একবার যুদ্ধের সময় সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্য ওয়ে ফ্যাং শহরে ঘুড়ি উড়িয়ে নিজ প্রাসাদ থেকে শত্রুশিবিরের দূরত্ব মেপে নিয়েছিলেন। ফলে কতটা লম্বা সুড়ঙ্গপথ দরকার, তা তিনি আগেই জেনে নিতে পেরেছিলেন।
চীনা ভাষায় ঘুড়িকে বলা হত 'কাগুজে চিল'। একটা সময় চীনে তৈরি হত 'মু ইয়ুয়ান' অর্থাৎ কাঠের ঘুড়ি। পরে কাগজ আবিষ্কার হলে তৈরি হয় 'ঝি ইয়ুয়ান' বা কাগজের ঘুড়ি। চীনারা সাধারণভাবে ঘুড়িকে বলেন 'ফেং ঝিং'। মোটামুটি ৫০০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি প্রাচ্যের দেশগুলিতে এবং পশ্চিমদিকের আরবীয় দেশগুলিতে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। আফগানিস্তানে ঘুড়িকে বলা হয় 'গুড়িপারান বাজি'। জাপানে বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকেরা দুষ্টের দমন কল্পনায় ঘুড়ি ওড়াতেন। হিয়ান আমলেই জাপানে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। ১৬০৩--১৮৬৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় ছিল জাপানে ঘুড়ির স্বর্ণযুগ। জাপানীদের বিশ্বাস ছিল ঘুড়ি ওড়ালে কৃষিজাত উৎপাদন বাড়ে। তবে শোনা যায়, সেখানে নাকি ঘুড়ির নেশা মানুষকে কর্মবিমুখ করে তুলেছিল। তাই কিছু কাজপাগল জাপানী ঘুড়ি ওড়ানো পছন্দ করতেন না। ঘুড়ি নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল নানা সংস্কার। কোরিয়ার জনশ্রুতি, সিলা রাজবংশের সেনাপতি গিম উ 'শিনের আদেশে তাঁর সেনারা শত্রুশিবির আক্রমণ করার সময় দেখে আকাশ থেকে উল্কাপাত হচ্ছে। অশুভ আশঙ্কায় তারা পালাতে থাকে। তখন গিম একটি ঘুড়ির মাথায় আগুনের গোলা জুড়ে দিয়ে আকাশে ওড়ান। তখন তাঁর সেনারা ভাবে, যে শয়তান আকাশ থেকে নামছিল সে এখন ওপরে উঠছে----এটা নিশ্চয় শুভ সঙ্কেত। তখন তারা নতুন উদ্যমে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে জয়লাভ করে। তাই ঘুড়ি ওড়ানোর সাথে যুদ্ধের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। 'ভোকাট্টা' চীৎকারের মাধ্যমে একের পর এক প্রতিপক্ষের ঘুড়ির সুতো কেটে দেওয়া----যেন মহাশূণ্যে আধিপত্য বিস্তারেরই বহিঃপ্রকাশ।
১৬৯৪ সালে এক ডাচ বণিকের মাধ্যমে ইউরোপে ঘুড়ির প্রচলন হয়। আর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুড়ি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ঘুড়ি আকাশে ওড়ার পেছনে যে বিজ্ঞান আছে, তাকে বলে এরোডায়নামিকস্ বা বায়ুগতিবিদ্যা। পরস্পর-বিরোধী দুটি শক্তি ঘুড়ির ওপর একসাথে কাজ করে। একটি বাতাসের আকর্ষণ শক্তি, অন্যটি সুতোর মাধ্যমে নিম্নাভিমুখী টান। এই দুই শক্তি সমানে সমানে কাজ করে বলেই ঘুড়ি আকাশে ওড়ে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেখলে এদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ঘুড়ি ( যেমন, বাক্স ঘুড়ি, মাছ ঘুড়ি, পতঙ্গ ঘুড়ি) বিশেষত চৌকো ঘুড়ি খুবই উচ্চমানের। এইসব চৌকো ঘুড়ি হয় দ্বি-মাত্রিক---ওড়ার সময় মাথাটি সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। সুতোর টানের জন্য পিছনের চেয়ে সামনের বাতাসে বেশি চাপ দেয়। আর এই চাপের পার্থক্যের জন্য যে লব্ধি বলের সৃষ্টি হয়, সেটাই ঘুড়িকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে। এজন্যই সুতো টানলে ঘুড়ি ওপরে উঠতে থাকে।
ঘুড়ি ওড়ার সময় তিন ধরণের অসাম্য হতে পারে। এদেরকে বলে 'পিচ'( ঘুড়ির ডাইনে-বাঁয়ে আড়াআড়ি অক্ষের ওপর ঘূর্ণন ), 'রোল' (সুতো বরাবর অক্ষের ওপর ঘূর্ণন--এটাই হয় সর্বাধিক ), এবং 'ইঅ' ( উল্লম্ব অক্ষের ওপর ঘূর্ণন)। ঘুড়ির লেজের পাখনাদুটি 'পিচ' নিয়ন্ত্রণ করে। বাতাসের চাপে এগুলি অল্প ওপরে উঁচু হয়ে কিছুটা 'ইঅ'-ও নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুড়িতে ধনুকের মতো যে বাঁকানো কাঠিটা থাকে, সেটি সংনমনশীল। তাই ঘুড়ি ওপরে উঠলে তা বেঁকে গিয়ে 'রোল' নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুড়ির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাতকে তার 'অ্যাসপেক্ট রেশিও' বলে। এটি সাধারণত ১ এর কাছাকাছি হয়। ফলে ঘুড়িকে সহজেই এদিক-ওদিক চালনা করা যায়। এই অনুপাত ১ এর কম হলে ঘুড়িকে আরও দ্রুত এদিক-ওদিক চালনা করা সম্ভব ঠিকই, কিন্তু সেক্ষেত্রে ঘুড়ির সাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঘুড়ি ওড়া নিয়ে রয়েছে বহু বিচিত্র রেকর্ড। ১৯৩৬ সালে জাপানের নারুতো সিটিতে বানানো হয়েছিল একটা বিরাট ঘুড়ি, যার ওজন ছিল প্রায় সাড়ে ন-টন ! এতে কাগজ লেগেছিল ৩১০০ খানা। ১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর ফ্রান্সের আকাশে এক বিশাল ( ৭০৫ মিটার লম্বা ) ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন মাইকেল ট্রায়লেট, ফিলিপ বোস্টন, আর পিয়েরে এগলিন। ঐ বছরেই ১৫ মার্চ একসাথে ২২৩৩ টি ঘুড়িকে আকাশে উড়িয়ে রেকর্ড করেছিলেন জাপানের হিরোসীমা ক্লাবের সদস্যেরা। এই রেকর্ড অবশ্য ভেঙে দিয়েছেন একজন জাপানী ( কাজহিকো ), তিনি একসাথে ৪১২৮ টি ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বড় ঘুড়ির মাপ জানা গেছে ১০৩৪ মিটার। ৯৬৭ জন জার্মান এক ইভেন্টে একসাথে ঘুড়ি উড়িয়ে রেকর্ড করেন। ২০০৯ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এক হাজারের বেশি শিশু। তারা ইউনাইটেড নেশনসের উদ্যোগে ইজরায়েলের গাজার বীচে একসাথে ঘরে তৈরি রংবেরঙের ঘুড়ি উড়িয়েছিল। ১৯৮৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় ওড়ানো হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল ঘুড়ি--বেগ ছিল ঘন্টায় ১৯৩ কিলোমিটার। আবার একজন জাপানী ঘুড়ি প্রস্তুতকর্তা একই লাইন বরাবর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ( ১১২৮৪ টি ) ঘুড়ি উড়িয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছেন।
এখনও অক্ষত আছে ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ১৮০ ঘন্টা ১৭ মিনিট একটানা উড়তে থাকা ঘুড়ির রেকর্ড। উড়িয়েছিলেন আমেরিকার এডমন্ডস কমিউনিটি কলেজের কিছু ছাত্র। এর পরের বছরই ( ১৯৮৩ ) আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে এক ঘুড়িপ্রেমী ৭২৫৭ কিলোগ্রাম ওজনের একটি বিশালাকৃতির ঘুড়ি ওড়ান। সর্বাধিক উচ্চতায় ( সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৮৪৫ মিটার) ঘুড়ি ওড়ানোর রেকর্ড দখলে রেখেছে জার্মানির লিন্ডেনবার্গ শহর (১৯১৯ )। ২০১৪ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর চারজন অস্ট্রেলিয়ান ১১×১১ মিটার মাপের একটি বিশাল ঘুড়িকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪৯২৬ মিটার উঁচুতে তুলেছিলেন। ইংল্যান্ডের ফ্লেক্সফয়েল ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ঘুড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থার ঘুড়িতে চড়ে সবচেয়ে কম সময়ে ( আড়াই ঘন্টায় ) ইংলিশ চ্যানেল পার হবার রেকর্ড আছে। তবে সেই সংস্থার দাবী, বন্দর রক্ষীরা বার বার তাঁদের না আটকালে তাঁরা ২ ঘন্টাতেই ইংলিশ চ্যানেল পার হতে পারতেন।
অনলাইনে বিক্রি হওয়া একটি দামী ঘুড়ি হল ইংল্যান্ডে তৈরি মার্টিন লেস্টার ফ্লেমিংগো কাইট, দাম ১১৫৯১৯ টাকা। এর প্লাস্টিকের ফ্লেমিংগোটি-র ডানার সাইজ ২.৫ মিটার। ঘুড়িটির সুতো ফাইবার গ্লাসের। এছাড়াও অনলাইনে পাওয়া যায় পেপার কাইট ( ৪১৪৩২ টাকায় ১০০ টি ), ঈগল ঘুড়ি ( ৫০ সেন্টিমিটার মাপের--৫৮৬ টাকা), আর লম্বা লেজওলা জার্মান স্পাইডারম্যান ( ৮১৯ টাকা )। তবে পৃথিবীর দুটি দেশে ঘুড়ি ওড়ানো নিষিদ্ধ -- রাশিয়া এবং আইল্যান্ড। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে আবার বিরাট ঘুড়ি ওড়ানোতে নিষেধাজ্ঞা ছিল--যাতে সেই ঘুড়িতে চড়ে কেউ তৎকালীন বার্লিন প্রাচীর টপকাতে না পারে !
ঘুড়ি জগতের পরিভাষাও খুবই বৈচিত্র্যময়---কাঁপকাঠি, পেটকাঠি, চিতেন ভাঙা, ভো-কাট্টা, ভো-ম্মারা, লাট খাওয়া, গোঁৎ খাওয়া, কাহ্নিক, টাংকি, তোল্লাই, লক দেওয়া, চং দেওয়া, ঢিলা, ভলকা, টাইট, খিঁচ, আড় খিঁচ, ডবকা, মাঞ্জা, দাঁত্তি পড়া, নাক্কু, গদ্দা, চপার মারা, দুয়োক্কো, বাড়েনাক্কো, হপ্তা ধরা,,,,,,,,। ঘুড়িও আছে অজস্র নামের---পেটকাটি, লাট্টু, বগ্গা, গ্লাসকাটিং, পাছাপেড়ে, মোমবাতি, চাপরাশ, চাঁদিয়াল, পান্ডা, আদ্দা, তুককল, দেড়কারানি, ময়ুরপঙ্খী, আধিয়াল, ববি, ঘয়লা, চৌরঙ্গী, পান্ডা, একতেল, সিকিতেল, দোতে, বাউনটেক্কা, কড়িয়াল, মুখপোড়া......। চীন, জাপান, ইন্দোচীনে মাছ, ড্রাগন, প্রজাপতি, পরি, পাখী, আর মানুষের আদলেও ঘুড়ি তৈরি হয়। আজকাল ভারতের বাজারেও পাওয়া যায় বার্বি গার্ল, ডোরেমন, মিকি মাউস, ছোটা ভীম, হনুমান, এমনকি সিনেমার নায়ক-নায়িকার আদলে তৈরি বিশাল আকারের ঘুড়ি। টিটাগড়ের পি কে বিশ্বাস রোডে রয়েছে ঘুড়ির বিরাট বাজার। রাজস্থানের জয়পুরের মতি দুংরিতেও রয়েছে বড় ঘুড়ি-পট্টি। সেখানে সবচেয়ে ছোট ঘুড়িকে বলে হাফ সেল আর সবচেয়ে বড় ঘুড়ির সাইজ হল ২-সেল।
তবে, ঘুড়ির প্যাঁচ খেলার প্রসঙ্গ উঠলেই অবধারিত ভাবে আসবে মাঞ্জা বা 'সুতোয় ধার' দেবার কথা। এই মাঞ্জাও আছে হরেক রকমের---লুদদি মাঞ্জা, গোলা মাঞ্জা, ছাড়া মাঞ্জা, টানা মাঞ্জা, ফেত্তি, আড়, চপার,......। ভাত, সাবু, ইসবগুলের ভুষি দিয়ে মন্ড তৈরি করে তাতে মিহি কাঁচের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি হয় এইসব মাঞ্জা। কেউ কেউ তাতে মেশায় বিভিন্ন রঙ, গাব গাছের আঠা, ফেভিকল, ডেনড্রাইট, এমনকি ডিম পর্যন্ত ! তবে বেরিলির সুতো আর লখনউ এর সালামতের মাঞ্জা ভারতবিখ্যাত। কারণ, এইসব মাঞ্জাতে কাঁচগুঁড়োর বদলে ব্যবহার করা হয় হীরা-পালিশের তলানি, যার দাম অনেক বেশি। তবে দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতে ঘুড়ির সুতোয় কাঁচগুঁড়োর মাঞ্জা দেওয়া সম্পূর্ণ বে-আইনী।
ঘুড়ির জন্য আগে আসত জার্মানির কাগজ। এখন দেশি কাগজেই ঘুড়ি তৈরি হয়, এমনকি খুব পাতলা প্লাস্টিক দিয়েও আজকাল ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে। আরেকটি জরুরি উপকরণ হল মেটিয়াবুরুজের বাঁশের কাঠি।
১৯২০-২৫ সালের দুজন ঘুড়িবাজের কথা জানা যায় শংকর সেনগুপ্তের একটি লেখায়। এঁরা হলেন ফ্রী স্কুল স্ট্রীট এলাকার দুই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ম্যাক সুইনি এবং চেটার। এই ম্যাক সুইনির শিষ্য ছিলেন বৌবাজারের মধু গুপ্ত লেনের যতীন্দ্রচন্দ্র ধর এবং মণীন্দ্রচন্দ্র ধর। এই মণীন্দ্র চন্দ্র নাকি মাত্র দেড় হাত সুতোর মধ্যেই এমন মারাত্মক প্যাঁচ দিতে পারতেন যে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল 'দেড়হাতি মণি' ! এই ধর ব্রাদার্সের তৈরি ঘুড়ির ব্র্যান্ডের নাম ছিল 'D' । উত্তর কলকাতার বাসিন্দা রামদুলাল দে-র পুত্র প্রমথনাথ, ঘুড়ি-লাটাইয়ে সেযুগের শেষ কথা, লাটাই থেকেই হয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত লাটুবাবু। মানিকতলার কানাই সেনের বিখ্যাত ঘুড়ি-মাঞ্জার কারখানা বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঘুড়িপ্রেমী সতীশ সামন্তের শৈশবে ঘুড়িতে হাতেখড়ি হয় চারু ওস্তাদ, তিনকড়ি আর হরিহর বাগের কাছে। সেই শৈশবের নেশা পরে জীবিকা হয়ে দাঁড়াল। উত্তর কলকাতার ডি.এল.রায় রোডে 'সতীশের ঘুড়ি'র দোকানে এখনও ময়দানী ঝুলা, ট্রিপল ডোর সহ বিভিন্ন দামী কেমিক্যাল মাঞ্জা দেওয়া ৩-১২ হাজার মিটার সুতোর লাটাই সাজানো থাকে। আগেকার বাঁশ-কাঠের লাটাইয়ের জায়গা অবশ্য ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে সুদৃশ্য শক্ত-পোক্ত প্লাস্টিকের লাটাই। অপর্ণা সেনের 'পারমিতার একদিনে'-র ঘুড়ির দৃশ্য আর স্বয়ং অপর্ণা সেনের সই করা ঘুড়ি সতীশ সামন্তের গর্ব। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি ম্যাচের দিনে বাড়ির ছাদে, এমনকি মাঠের গ্যালারিতেও সবুজ-মেরুণ আর লাল-হলুদ ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। আবার একধরণের শব্দওয়ালা ঘুড়ি আছে, যেগুলো ওড়ার সাথে সাথে একটা সুর বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
ঘুড়ির আলোচনায় পাঁচ ঘুড়ি-বন্ধুর ( মনোরঞ্জন পাল, তরুণ সেন, শ্যামল দে, শঙ্কর নাগ, এবং অমল দে----সবাই সিনিয়র সিটিজেন ) কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। এঁদের কারো বাড়ি শোভাবাজার, কারো শ্যামপার্ক, কারো বাগবাজার। সারা বছর এঁরা মিলিত হবার সুযোগ পান না। কিন্তু জন্মাষ্টমী থেকেই যোগাযোগ হয়। চলতে থাকে একসাথে ঘুড়ি তৈরি, মাঞ্জা দেওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো। শোনা যায়, লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ, বেরিলির ওস্তাদেরা পর্যন্ত হার মানতেন প্যাঁচের মাস্টার মনোরঞ্জনবাবুর 'থাকপি', 'ঝিটকার', 'চুটকি', 'লেটে টেনে', 'টানামানি'.......প্রভৃতি দেশী প্যাঁচের কাছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর শানু লাহিড়ীও লক্ষ্ণৌ থাকাকালীন ছোটবেলা থেকেই ঘুড়িপ্রমী। ইউরোপ-আমেরিকার বেশ কিছু অদ্ভুত-দর্শন ঘুড়ি ও অজস্র বইপত্র তাঁর সংগ্রহে আছে। ১৯৯০ এর দশকে তিনি পাতিপুকুরের গাঁন্ধী সেবাশ্রম সঙ্ঘের শিশুদের ঘুড়ি তৈরি শেখাতে উদ্যোগী হন। শুধু বিনোদন নয়, ঘুড়ি থেকে যে জীবিকার্জনও সম্ভব, তিনি সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। সত্যজিত রায়ও নাকি ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর শতরঞ্জ কে খিলাড়ি ছবিতে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য আছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সরীসৃপ ছবিতে ধৃতিমান ঘুড়ি উড়িয়েছেন। আর হাম দিল দে চুকে সনম সিনেমার ঘুড়ির দৃশ্য আর গান তো অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
কাটাকুটি-যুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বড় ও মজবুত এদেশের ঘুড়ি হল ৪৮ ইঞ্চি লম্বা 'ছাগ'। এর দামও একটু বেশি। ৩৭ ইঞ্চির 'ডিলাক্স ফাইটার'-ও চমৎকার। এটি খুব মজবুত, অনেকদিন টেঁকে। অনেকে আবার ঘুড়ির মাথায় টাকার নোট আটকে দেন। ভারত-পাকিস্তান দু-দেশেই যথেষ্ট জনপ্রিয় ঘুড়ি হল 'টুক্কাল'। এটি রাতেও ওড়ানো যায়। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়, একমাত্র অভিজ্ঞরাই একে ওড়াতে পারেন। সবচেয়ে হাল্কা ঘুড়ি হল পতং। তবে একে শুধুই মনের আনন্দে ওড়ানো যাবে, কাটাকুটি খেলা যাবে না।
এশিয়ার দেশগুলোর মতো জনপ্রিয় না হলেও ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ঘুড়ি ওড়ে। ইংল্যান্ডে টনি স্লেটারের ঘুড়ি বেশ জনপ্রিয়। ফাইটার ফিশ, বাটারফ্লাই, বোম্বে ফাইটার প্রভৃতি ঘুড়িগুলো খুব শক্তপোক্ত, ফাইবারগ্লাসের মোড়কে তৈরি। ওয়েলস-এ পাওয়া যায় মার্টিন লরেন্সের বানানো স্ক্যাম্প, ড্যান্সার, স্কাউট, টাইক.....এইসব নানা আকারের ঘুড়ি। যথেষ্ট সুনাম আছে সানডিয়াগোর ডিক্স ফাইটার এবং অস্ট্রেলিয়ার পিটার লয়েডের ডিজাইনে বানানো পি এল ইন্ডিয়ান ফাইটার ঘুড়িরও। আমেরিকার ওয়াশিংটন, ক্যালিফোর্নিয়া শহরেও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা আছে।
ঘুড়ি কিন্তু শুধু বিনোদনেরই উপকরণ নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঘুড়ি ব্যবহৃত হয়েছিল ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দে। স্কটল্যান্ডের দুজন বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার উইলসন এবং টমাস মেলভিল ঐসময় ঘুড়ির সাথে ম্যাক্সিমাম-মিনিমাম থার্মোমিটার বেঁধে আকাশে ওড়ান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা। এরপর ১৭৫২ সালে ঘটে সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার। মেঘে ঢাকা আকাশে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ও তাঁর ছেলে ঘুড়ি ওড়ান। আর আকাশে বিদ্যুত চমকের পর ঘুড়ির রেশমী সুতোয় বাঁধা চাবিতে হাত দেবার সাথে সাথেই বেঞ্জামিন ছিটকে পড়েন। প্রমাণিত হয় যে, প্রাকৃতিক বিদ্যুতের সাথে ঘরের বিদ্যুতের কোনও গঠনগত পার্থক্য নেই।
টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলও ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এক বিরাট বাক্স ঘুড়ির মধ্যেই নানা যন্ত্রপাতি বসিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এছাড়া স্যামুয়েল ল্যাঙলে, স্যার জর্জ ক্যালে প্রমুখ বহু বিজ্ঞানী তাঁদের পরীক্ষানিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের কাজে ঘুড়ি ব্যবহার করেছেন। বৃটিশ বিজ্ঞানী ডগলাস আর্কিবল্ড বিভিন্ন উচ্চতায় বাতাসের বেগ মাপার জন্য ঘুড়ির সুতোয় বেঁধে দেন অ্যানিমোমিটার। প্রায় ৪০০ মিটার উচ্চতাতেও এই যন্ত্রটি সঠিক তথ্য দিয়েছিল। আরেক জন বৃটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম এডি আবহাওয়াবিদ্যার যন্ত্রপাতি ও শক্তিশালী ক্যামেরা লাগানো এক বিশেষ ধরণের ঘুড়ি তৈরি করেন, যা পরে বৃটিশ আবহাওয়া দফতর নিয়মিত ব্যবহার করা শুরু করে। জাপানে আবার বাড়ি বা মন্দির তৈরির সময় মাটি থেকে ছাদে টালি আর অন্যান্য জিনিসপত্র তোলার কাজেও ঘুড়ি ব্যবহৃত হত।
অস্ট্রেলিয়ান গবেষক হারগ্রাভ্স ১৮০৯ সালে বাক্সঘুড়ি তৈরির পর থেকেই পণ্ডিতেরা বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা চালাতে থাকেন। রাইট ভাইয়েরা যে বিমানের মডেল তৈরি করেন, তার সাথেও ঐ বাক্সঘুড়ির অনেক মিল ছিল।
প্রযুক্তির কাজেও ঘুড়িকে কাজে লাগানো হয়েছে। ১৮৪৭ সালে কানাডা ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নায়াগ্রা নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু তৈরির সময় দড়ি মইকে নদীর এপার থেকে ওপারে নিয়ে যাবার সময় ঘুড়ির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। ১৮৯৩ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন আবহাওয়া সংস্থা ( যেটি এখন 'ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস' নামে পরিচিত ) আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতে ঘুড়ির সাহায্য নিত।
একাদশ শতাব্দীতে চীনারা বিস্ফোরক বাঁধা ঘুড়িকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাঠিয়ে শত্রুদের যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে দিতেন। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই ঘুড়িকে সামরিক কাজে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে ঘুড়ির সাহায্যে উঁচু থেকে বিরাট এলাকায় নজরদারি করা বা শত্রুপক্ষের গতিবিধি চিহ্নিত করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এজন্যই বৃটিশ, ফরাসী, ইটালি আর রাশিয়ান সেনারা নিয়মিত ঘুড়ি ওড়াত। জার্মান নৌ সেনারা আবার সাবমেরিন থেকেই বড় বড় বাক্সঘুড়ি উড়িয়ে বিপক্ষের গতিবিধি বুঝে নিত আর অন্যদের কাছে গোপন সংকেত পাঠাত। আমেরিকান নৌবাহিনীর গোলন্দাজদের নিশানা অনুশীলনের জন্য কমান্ডার পল গার্বার একঝাঁক ঘুড়িকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। তখনও প্লেন আবিষ্কার হয়নি। বহুদূর থাকা শত্রুশিবির খুঁজে বার করতে সেই সময় সৈন্যদেরকে ঘুড়িতে বেঁধে ওপরে ওঠানো হত। মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বার্ডেন পাওয়েল ১৮৯১ সালে এইভাবে একজন সৈনিক-কে ঘুড়ির সাথে বেঁধে ১২০ ফুট ওপরে তুলেছিলেন। বেতার প্রেরক যন্ত্রের এরিয়েল যেমন বেতার সংকেতের সম্প্রসারণ ক্ষমতা বাড়ায়, তেমনই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেতার যন্ত্রের এরিয়েলকে ঘুড়ির সাহায্যে উঁচুতে তুলে যুদ্ধের খবর আদান-প্রদান করা হত। জাপানে বহুকাল আগে ঘুড়ির গায়ে ক্যালিগ্রাফি বা বাহারি অক্ষর লিখে এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গে গুপ্ত সংকেত পাঠানো হত।
পাখির মতই ঘুড়ি কিন্তু উড়ন্ত বিমানের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলির সাথে অসংখ্য ঘুড়ি বাঁধা থাকত, যাতে শত্রুশিবিরের বিমান পেছন থেকে আক্রমণ করতে না পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এইভাবে ঘুড়ির সাথে ধাক্কা লেগে অন্তত ৪ টি জার্মান বিমান ধ্বংস হয়েছিল। এইসব ঘুড়ির নক্সা করেছিলেন হ্যারি সি. সাউলস্।
একবার নাকি এক চোর দামী সোনার মূর্তি চুরি করার উদ্দেশ্যে এক বড়সড় ঘুড়ির মধ্যে ঢুকে নাগোয়া দুর্গের মাথায় পৌঁছবার চেষ্টা করেছিল। তবে সে ধরা পড়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার কিছু জেলে একধরণের পাতার ঘুড়ির সাহায্যে বঁড়শির টোপ বড় মাছ ধরার জন্য দূরের নদীতে নিয়ে যেত । সেইসব ঘুড়ির সুতো হত প্রচন্ড শক্ত। মাঝ- সমুদ্রে জাহাজ হঠাৎ বিপদে পড়লে নাবিকেরা উদ্ধার লাভের জন্য বড় বাক্সঘুড়িতে লাল সংকেত লাগিয়ে উড়িয়ে দিত। মোটরযান আবিষ্কারের আগে একটা সময় শিল্পোন্নত দেশের রাজপথে চলত ঘোড়ার গাড়ি। যে গাড়ি যত বেশি ঘোড়া টানত, তার ট্যাক্সও ছিল তত বেশি। ১৮২২ সালে জর্জ পোকক নামে এক স্কুল শিক্ষক ঘোড়ার বদলে একটি শক্তিশালী ঘুড়ির সাহায্যে ঘন্টায় ৩২ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাতে সক্ষম হন। পরে আরো উন্নত মানের ঘুড়ি দিয়ে তিনি প্রায় দেড়শো কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালান। এগুলি জনপ্রিয়তা পায়, কারণ এতে আর ট্যাক্স দেবার প্রয়োজন থাকল না। মেরু অঞ্চলে স্লেজগাড়িও ঘুড়ির সাহায্যে টানা হচ্ছে।
ভারতবর্ষে ঘুড়ির ব্যাপক ব্যবহারের সূচনা হয় মুঘল যুগে। মূলত খবর আর মনের কথা যথাস্থানে পৌঁছে দিতেই তখন ঘুড়ি কাজে লাগানো হত। মুঘল চিত্রকলায় দেখা যায়, সেকালে ঘুড়ির ল্যাজে আতর মাখানো চিঠি বেঁধে তা উড়িয়ে দেওয়া হত প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে দিল্লি থেকে আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, গাজিয়াবাদ, বেরিলি, আহমেদাবাদ, অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্রই ঘুড়ির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে মনোরঞ্জনের জন্য ঘুড়ি ওড়ালেও পরে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলা হিসেবেই চিহ্নিত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিবছর ঘুড়ির ধারালো সুতোয় বহু পাখি হতাহত হয়। ২০০৫ সালের ১৫ই আগস্ট শুধু পুরোনো দিল্লী শহরেই ঘুড়ির সুতোয় আহত ৩১ টি পাখির চিকিৎসা করেছেন পশুচিকিৎসকেরা। এদের কারো ডানা কেটে গেছে, কেউ ঘুড়ির সুতোয় জড়িয়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে....ভেঙে গেছে হাড়। বেশির ভাগ পাখীরই পায়ের নরম অংশ ধারালো সুতোয় জখম হয়। লাঙ অ্যান্ড কেয়ার ফর অ্যানিম্যালসের পক্ষ থেকে তাই ঘুড়ির সুতোয় ধারাল মাঞ্জা না-দেবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।
কলকাতা শহরে একটা সময় ঘুড়ির লড়াই ছিল পায়রা ওড়ানোর মতোই বাবু-কালচারের প্রধান অঙ্গ। শোনা যায়, ঘুড়ির সাথে নাকি টাকা জুড়ে দিয়ে আকাশের বুকে চলত হারজিতের লড়াই। কলকাতায় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন করেন লক্ষ্ণৌ থেকে মেটিয়াবুরুজে আসা নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। অবশেষে ঘুড়ি প্রেমিকদের সমবেত প্রচেষ্টায় ১৯৫৪ সালে তৈরি হল 'ওয়েস্ট বেঙ্গল কাইট অ্যাসোসিয়েশন'। আর ১৯৮৪ তে গড়ে ওঠে 'ক্যালকাটা কাইট অ্যাসোসিয়েশন'। ফুটবল-ক্রিকেটের দাপটে ঘুড়ি প্রায় হারিয়ে যেতে বসলেও শুনতে আশ্চর্য লাগে যে, ঘুড়ির দলগুলির লিগ আজও চালু আছে। ফুটবলের মতোই সেখানেও দলবদল হয়। রাজ্য কাইট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনায় ১৯৫৪ সালে প্রথম বছরের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ১৫ টি দল। শোনা যায়, ১৯৪৯ সালের আই এফ এ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচকে ঘিরে যেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক সেরকম উত্তেজনাই নাকি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম ঘুড়ির লিগের ফাইনাল খেলায়। ২০০১ সালে এরাজ্যে ঘুড়ির লিগ ও নক-আউটে অংশগ্রহণ করে মোট ৫৩ টি দল। এখন মোটামুটি ৫৬টি দলের লীগ কাম নক আউট ভিত্তিক খেলা চলে ১০ মাস ধরে। শুধু বর্ষার দুমাস ( জুলাই-আগস্ট ) খেলা বন্ধ থাকে। এই সময় এ-রাজ্যের বেশ কয়েকটি দল লক্ষ্ণৌ সহ ভিন্ - রাজ্যে চলে যায়। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্যে লক্ষ্ণৌতেই প্রতিবছর বসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঘুড়ি-টুর্ণামেন্ট। বেশ বড় অঙ্কের আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হয়। চীন-জাপান-থাইল্যান্ড-রাশিয়া থেকেও অভিজ্ঞ প্রতিযোগীরা এতে অংশ নেন। কলকাতায় এক সময় ঘুড়ি ওড়াতে এসেছেন অভিনেতা দিলীপ কুমার। মান্না দে-ও ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মকর সংক্রান্তিতে শ্রীরামপুরের মাহেশেও ঘুড়ির ম্যাচ হয়। তবে সাধারণভাবে অধিকাংশ জায়গায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি উড়লেও কলকাতার বড়বাজারে অক্ষয় তৃতীয়ায়, সরস্বতী পুজোয় বারুইপুর-খড়দহে-উত্তরবঙ্গে, আর রথের দিন নবদ্বীপে প্রচুর ঘুড়ি ওড়ে। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন আবার বেলুড়-দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যেকটি ঘুড়ি কাটলে একটি নির্দিষ্ট অর্থ পুরস্কার দেওয়ার প্রথা আছে। বিহারে গণেশ চতুর্থীতে, আর দক্ষিণ ভারতে 'ওনাম'-এর দিন ঘুড়ি ওড়ে।ওয়াশিংটন, বার্কলে, জিকার পার্ক, ব্রিস্টল, বালিংটন, পোর্টস মাউথ প্রভৃতি জায়গায় প্রতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর চলে ঘুড়ির উৎসব। ভারতের ঘুড়ির শহর আহমেদাবাদে মকর সংক্রান্তির উত্তরণ উৎসবে অসংখ্য ঘুড়ি ওড়ে। বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আয়োজনটিও হয় এখানকার পতঙ্গনগরে। ১৯৮৬ সালে ভানু সিংহ এখানে তৈরি করেছেন একটি ঘুড়ির মিউজিয়াম। এমন মিউজিয়াম রয়েছে বিভিন্ন দেশে, যেমন, চীনের উইফ্যাং-এ ( এখানেই আছে ওয়ার্ল্ড কাইট ফেডারেশনের প্রধান কার্যালয় ), টোকিওর তাইসেইকেন নামে রেস্তোরাঁর ওপরে, তাইওয়ানের জিওফেন-এ, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়, কম্বোডিয়ার নমপেনে, আর মালয়েশিয়ার কাইট পাহাড়ে। জাপানে ঘুড়ি ওড়ে ৫-মে শিশু উৎসবে, কোরিয়াতে নববর্ষে, থাইল্যান্ডে মার্চ মাসে, চীনে সেখানকার লন্ঠন উৎসবে ঘুড়ি ওড়ে। আমেরিকার স্টেট ইন্টারন্যাশনাল কাইট ফেস্টিভ্যাল হয় পেনিনসুলা সমুদ্র সৈকতে। এখানকার ঘুড়ির মিউজিয়ামে আছে পৃথিবীর সব দেশের ঘুড়ি আর তাদের বিবর্তনের ইতিহাস। ২০০৮ সালের ১৯ শে জুলাই ১৩ তম আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আসর বসেছিল সুইজারল্যান্ডের Cret-du-Midi তে। ২০১৪ সালের ১৯ শে অক্টোবর উত্তর মিয়ামীর হলোভার বিচ পার্কে অনুষ্ঠিত ঘুড়ি উৎসবে ওড়ানো হয়েছিল বিশাল 'আইস রে' ঘুড়িটি----এটি লম্বায় ছিল ২৭.৭ মিটার, চওড়ায় ১২.৩ মিটার। আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট থিম থাকে। ২০২০ সালের থিম ছিল, "একটি মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলুন। সে-ই বদলে দেবে গোটা পৃথিবী।" ২০২৩ এর থিম ছিল, "একটি পৃথিবী, একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যত"। ২০২৪ সালের ৭ থেকে ১৪ ই জানুয়ারী আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আসর বসেছিল আহমেদাবাদের বল্লভসদনের সবরমতি রিভারফ্রন্টে। সেখানে ৫৫ টি দেশের ১৫৩ জন ঘুড়িবাজ যোগ দেন। তাঁদের সাথে ছিলেন ভারতের ১২ টি রাজ্যের ৬৮ জন ঘুড়িবাজ এবং গুজরাটের ৮৬৫ জন ঘুড়িপ্রেমী।
ঘুড়ির লীগে অংশ নেওয়া দলগুলির খরচ কিন্তু কম নয়। চার জনের দলপিছু প্রতি মরশুমে খরচ ৬০--৭০ হাজার টাকা। প্রতিযোগিতার উপযুক্ত প্রত্যেকটি ঘুড়ির দাম ১০--২০ টাকা। ম্যাচ পিছু মাঞ্জা দেওয়া সুতো লাগে কমপক্ষে ২০০০ মিটার, যার দাম ৬০০--১২০০ টাকা। খেলার শুরুতে হয় টস। যে পক্ষ টসে জেতে, সেই দল নেয় তাদের পছন্দের দিক্। ম্যাচ শুরু হয় প্রতিদিন দুপুর একটায়, আর শেষ হয় সাড়ে চারটেয়। ম্যাচ রেফারি বা গ্রাউন্ড সেক্রেটারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। ম্যাচ শুরুর আগেই প্রতিযোগিতা কমিটি প্রত্যেক প্রতিযোগীর ঘুড়ি, সুতো পরীক্ষা করে নেয়।
কাজকর্ম ভুলে বাড়ির ছাদে বা খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে কিভাবে যে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে যায়, তা টেরই পাওয়া যায় না। তবে এই ঘুড়ির নেশা শুধু শখ বা বিনোদনের জন্য নয়, অসংখ্য লোক যেমন আকাশে ঘুড়ির লড়াই দেখে আনন্দ-উত্তেজনা পান, তেমনই মানিকতলা-বজবজ-মেটিয়াবুরুজের বহু মানুষের রুজি-রোজগার জড়িয়ে আছে এই ঘুড়ি শিল্পের সাথে। কিছুটা সরকারী উদ্যোগ বোধহয় এই মৃতপ্রায় শিল্পকে আবার চাঙা করে তুলতে পারে। ঘুড়ি-প্রেমী মানুষের সংখ্যা কমে এলেও জীবনমুখী গায়কের সাথে তাই আজ গলা মেলাতে ইচ্ছে করে.......
"পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা
বাতাসে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা।"
==========
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা-৭০০ ০৯২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন