Featured Post

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

ছবি
  নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে  গ্রন্থ-প্রকাশ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে এক ফর্মার ১০টি পুস্তিকা : এই প্রকল্পে লেখক-কবিদের থেকে কোনো খরচ নেওয়া হবে না।        পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বইগুলি প্রকাশিত হবে। লেখক/কবিকে সশ্রদ্ধায় সৌজন্য সংখ্যা দেওয়া হবে।       যাঁদের আগে কোন বই হয়নি , তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। নতুনদের উপযুক্ত লেখা না পেলে বাকিদের লেখা নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরিত হবে।       লেখা সকলেই পাঠাতে পারেন। মেলবডিতে টাইপ করে বা word ফাইলে ।   ই-মেল : nabapravat30@gmail.com  (এবং হোয়াটসঅ্যাপেও)। বইয়ের শিরোনামসহ ১৫টি কবিতা বা ১৫টি অণুগল্প পাঠাতে হবে , শব্দ সংখ্যা বা লাইন সংখ্যার বাঁধন নেই । মনোনীত হলে মানানসই বইয়ের ফরম্যাটে যে কটি যাবে রাখা হবে ।       সঙ্গে লেখক পরিচিতি , ঠিকানা , যোগাযোগের ( কল ও হোয়াটসঅ্যাপ )   নম্বর ও এক কপি ছবি দেবেন। লেখক পরিচিতিতে অবশ্যই জানাবেন, এটি আপনার প্রথম প্রকাশিত বই হবে অথবা পূর্ব প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা। অনলাইন বা মুদ্রিত পত্রিকা বা সমাজ - মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাও পাঠানো যাবে । তবে কোনও গ্রন্থভুক্ত লেখা

নিবন্ধ ।। স্বাধীনতা দিবস পালনের স্মৃতি ও প্রাসঙ্গিক দু-একটি কথা ।। অরবিন্দ পুরকাইত

স্বাধীনতা দিবস পালনের স্মৃতি ও প্রাসঙ্গিক দু-একটি কথা 

অরবিন্দ পুরকাইত 

    দেশের আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের এই আনন্দময় মুহূর্তে ফিরে-দেখতে গুটিকয় কথা। আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় স্বাধীনতা দিবস পালন ছিল না। গ্রামের মধ্যে কোথাও এক-আধ জায়গায় পতাকা তোলা হত মনে পড়ে। ছোটবেলা যখন বাবা-দাদা ও কাজের লোকেদের জন্যে 'জলপান' (মূলত পান্তা) নিয়ে যেতাম, কৈশোর বা যৌবনে যখন মাঠে তলা ভাঙতাম বা রুইতাম, তখন কোনও দিন সকালবেলা মাইকের শব্দ শুনতে পেতাম গ্রামের দিক থেকে। আমরা পরস্পর বলাবলি করতাম, কী ব্যাপার, মাইক বাজছে কেন! দেশাত্মবোধক গান শুনতে শুনতে বুঝতে পারতাম দিনটা স্বাধীনতা দিবস। ওই পর্যন্তই। আমরা মাঠে কাজ করতাম, দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে মাঠে যেতাম, অথবা 'বেলান্তে' করে দুটো আড়াইটার সময় একেবারে সেদিনের মতো কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরতাম। আমার ভাবতে আজও ভাল লাগে যে আর অনেকের— বিশেষত চাকুরিজীবীদের মধ্যে— দিনটা যখন নিছক একটি ছুটির দিন, ভরা চাষের মরশুম হিসাবে চাষিদের কাছে সেটা উদয়াস্ত পরিশ্রমের দিন, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও দশের উদরান্নের নিমিত্ত আগাগোড়া কাজের দিন।
     এখন তুলনায় স্বাধীনতা দিবস পালন অনেক বেশি। গ্রামের মধ্যে বিরল দু-একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও, সংঘ-সমিতি, সাধারণ মানুষের বাড়িতেও এখন পতাকা উত্তোলন করা হয় বা টাঙানো থাকে জাতীয় পতাকা। যানবাহনে লাগানো থাকে।
     যে-কোনো দেশের শান্তি-সুস্থিতি, উন্নতি-প্রগতি ইত্যাদির জন্য তার স্বাধীন সত্তা একান্তই আবশ্যক। কিন্তু কোনও কোনও দেশ অন্য দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, লুণ্ঠন করে তার সম্পদ, সেখানকার মানুষদের উপর করে অত্যাচার। আমাদের ভারতবর্ষও বিদেশিদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে বারবার। তার পিছনে সেইসব বিদেশিদের ভূমিকা যেমন আছে আমাদের দুর্বলতাও নগণ্য নয়। আপন জাতি, গোষ্ঠী এমনকি ব্যক্তির স্বার্থ বৃহত্তর দেশের স্বার্থের থেকে বড় করে দেখতে বাধেনি কারও কারও। তার জন্যে নির্লজ্জ চাটুকারিতা থেকে এমনকি খাল কেটে কুমির আনার দৃষ্টান্তও দেখেছে ইতিহাস। স্বদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা। পরবর্তীকালে দেশের লোকের বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার দৃষ্টান্ত যেমন আছে, ধরিয়ে দেওয়াও বেনজির নয়।

     আমাদের দেশ যারা বিভিন্ন সময় আক্রমণ করেছে, তাদের অনেকে রয়েও গেছে এ দেশে, মিশে গেছে এদেশের মূল ধারার সঙ্গে, ভারতবর্ষ আরও বেশি করে মিশ্র জাতিতে পরিণত হয়েছে। ইংরেজ বাণিজ্যের জন্য এসেছিল, কিন্তু আমাদেরই অযোগ্যতা, অপরিণামদর্শিতা, স্বার্থসিদ্ধির মানসিকতা, বিশ্বাসঘাতকতার কারণে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে সামিল না হতে পারার পরিণতিতে বণিকের মানদণ্ড এক সময় রাজদণ্ডরূপে দেখা দিল। কৃষক আন্দোলনগুলি সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের উৎখাতের জন্য না হলেও দেশে যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিল তা কি সমাজের উন্নত স্তর থেকে সেইভাবে সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছিল? পেলে ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম হত। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ একাধারে বীরত্ব ও বিশ্বাসঘাতকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রয়ে গেছে। শতবর্ষ পরে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অনেকেই উপদ্রব হিসেবে দেখেছে। তারও পূর্বে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ দেশের শহরাঞ্চলের শিক্ষিত সমাজের— তথাকথিত আলোকিত অংশের সহানুভূতি বা সমর্থন লাভে বঞ্চিত। ফলে যা হবার তা হয়েছে, স্বল্প সংখ্যক ইংরেজ ক্রমশ গেড়ে বসেছে শাসন ক্ষমতায় এবং এদেশের ধন-সম্পদ জনসম্পদ কাজে লাগিয়েছে নিজেদের ব্যাবসাবৃদ্ধি তথা নিজেদের দেশের উন্নতিতে। এ দেশের সম্পদ তথা কাঁচামাল সে দেশে গিয়ে শিল্পজাত হয়ে এদেশেই এসেছে উচ্চ মূল্যে বিক্রির অভিলাষে। এ দেশের চাষিদের দিয়ে জোর করে নীলচাষ করানো যার অন্যতম কুখ্যাত দৃষ্টান্ত। এদেশের মানুষের ক্ষোভ হয়েছে গগনচুম্বী, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। শহরের শিক্ষিত সমাজের অনেকেই বিদেশি শাসনে স্বস্তিবোধ করেছে (রবীন্দ্র-অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন), তাদের ভাষা শিখে অফিস-কাছারিতে কাজকর্ম জুটিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে, সমাজে বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে। কেউবা পয়সার জোরে জাতে-উঠে পয়সা খরচ করেই নেকনজরে থাকতে চেয়েছে শাসক ইংরেজের। প্রয়োজনে শোষণ করেছে স্বদেশেরই চাষি-মজুর, গরিবগুরবো মানুষকে। রাজ-সরকারে যারা চাকরি করবে, শাসকের দমন-পীড়ন-অত্যাচারের প্রতিবাদ তাদের কাছ থেকে সচরাচর আশা করা যায় না। নাগরিক সমাজ একদা সুলতানি আমলে ফারসি শিখে অফিস-কাছারিতে কাজ জুটিয়ে সমাজে গণ্যমান্য হয়েছে (রামমোহন বা মধুসূদনদের পরিবার যেমন)। ইংরেজ আমলে ১৮৩৮ সালে ইংরেজি সরকারি ভাষা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে-কোনো ভাবে তা শিখে নিজেদেরকে ইংরেজের অধীন করে ফেলেছে চাকুরি জুটিয়ে। ম্লেচ্ছদের সেরেস্তায় সারাদিন কাজের শেষে দিনান্তে তথাকথিত উচ্চবর্ণের বাবুগণ সর্বাঙ্গে গঙ্গাজল ছিটিয়ে বা স্নান করে অন্দরমহলে ঢুকেছে। ফল হয়েছে কী, আমাদের দুর্বলতা, স্বার্থপরতা, উদাসীনতা ইত্যাদির কারণে শাসকের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদির মাত্রা বেড়েছে। ফলে একসময় অতিষ্ঠ মানুষের মধ্যে সম্মিলিত আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বেশি করে উপলব্ধ হয়েছে।

     কোনও দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি রামমোহন রায়কে অত্যন্ত আনন্দিত করত। তেমন সংবাদে ভোজসভা দিতেও দেখা গেছে তাঁকে। আবার কোনও কোনও দেশের পরাধীনতায় কষ্ট পেয়েছেন। আনন্দ পেয়েছেন ইংলন্ড বা ফ্রান্সে উদারনৈতিক দল জিতলে। কিন্তু নিজের দেশের স্বাধীনতা নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না রামমোহনের। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধেও প্রায় ওই একই কথা বলা যায়। ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের সেই প্রথম দিক এঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্যে সচেষ্ট হলে ইতিহাস হত অন্য রকম আর সেইসঙ্গে এইসব ব্যক্তিত্বের জীবনকথাও লেখা হত অন্যরকমভাবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রথম জোরালো কণ্ঠ যে রামমোহন, অ্যাডামসের আইনের প্রতিবাদে নিজের ফারসি সাপ্তাহিক 'মিরাত উল আখবার' বন্ধ করে দিয়েছিলেন যিনি, সেই রামমোহন সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে ইংরেজ জাতিকে মুক্তিদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করেছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন ইউরোপীয়রা অবাধ বাণিজ্যের অধিকার লাভ করুক এ-দেশে। তাতে করে তাদের সঙ্গে ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক স্থাপিত হবে (ভূমিকা, রামমোহন রচনাবলী, প্রধান সম্পাদক অজিতকুমার ঘোষ; সম্পাদকমণ্ডলী মণি বাগচি, শিবদাস চক্রবর্তী ও আবদুল আজীজ আল্‌ আমান। হরফ প্রকাশনী)। নীলচাষ নিয়ে গণআন্দোলনের সময়, নীলকররা অনেক পতিত জমি চাষ করেছিল এবং চাষিরা বাড়তি হারে মজুরি পেত এই যুক্তিতে নীলকরদেরও জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন রামমোহন। দেশের জন্যে অনেক করেছেন রামমোহন বা বিদ্যাসাগর, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে তাঁদের উদ্যোগ বা অবদান সেভাবে চোখে পড়ে না। ব্রিটিশের একান্ত অধীন থেকেই মূলত সমাজ সংস্কারে নিজেদের কাজ করে গেলেন! অতি সাধারণ মানুষদের সম্বন্ধে তাহলে আর কীই বা বলার থাকতে পারে!

     শাসনকে আরো নির্বিঘ্নে কায়েম রাখার জন্যে ইংরেজ বিভেদনীতি শুরু করেছিল— ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় তারা, বাংলাকে ভাগ করতে পারলে সম্মিলিত বাঙালির ঐক্যে ফাটল ধরবে এবং তার ফলে শাসনের সুবিধা হবে এই চিন্তা মাথায় রেখে। কিন্তু প্রবল হয়ে উঠল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথও সেই সময় পথে নামলেন জনগণের সঙ্গে, কণ্ঠে নিজেরই স্বদেশি গান নিয়ে। আমরা তাঁর হাত দিয়ে পেলাম সাময়িকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কালজয়ী কত যে স্বদেশী গান! রবীন্দ্রনাথ পরে আর সেভাবে সরাসরি পথে নামেননি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। বড় ইংরেজ ও ছোট ইংরেজের কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বড় অর্থাৎ গুণী ইংরেজ বরেণ্য তাঁর কাছে। কিন্তু প্রয়োজনে প্রতিবাদে পিছপা হননি। সশস্ত্র বিপ্লব, গুপ্তহত্যা ইত্যাদিকে সর্বান্তকরণে সমর্থন বা বিদেশি সামগ্রীতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বরদাস্ত করতে পারেননি। কিন্তু সর্বধর্মসমন্বিত স্বদেশ-সাধনার প্রবক্তা দেশমাতৃকার বরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে জানিয়েছেন সর্বান্তকরণ অভিনন্দন। যাই হোক, সেসব অনেক পরের কথা। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটল ইংরেজ। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে। ইতোমধ্যে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টার ফলস্বরূপ ফাঁসি হয়ে গেছে ক্ষুদিরামের। ১৯১৯ সালে ঘটানো হল কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। নিদারুণ বেদনা থেকে প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ততদিনে এক প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে উঠে এসেছেন মহাত্মা গান্ধি। ১৯২১ সালে অহিংস নীতি-আশ্রয়ী তিনি ইংরেজদের তৈরি আইন অমান্যের ডাক দিলেন। ১৯৩১ সালে হিজলি জেলে বন্দিদের উপর ইংরেজের গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক্ষেত্রে কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও পূর্বে প্রতিবাদী দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বেশ খানিক বিপরীত মেরুর, 'ইঞ্জিনিয়ার' কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তকে।  ১৯৩১ সালে লবণ আইন ভঙ্গ করতে ডান্ডি অভিযান করলেন গান্ধিজি। তাঁর অহিংস আন্দোলনের নীতিকে অনেকে মেনে নিতে পারেনি, কিন্তু তাঁর ডাকে ধনী-দরিদ্র আপামর দেশবাসী সাড়া দিয়ে পথে নেমেছে, পাথেয় জুগিয়েছে। বাইজি-বারবণিতারাও তার ব্যতিক্রম নয়। গান্ধির অহিংস আন্দোলনের উপর আস্থা রাখতে না পেরে পাশাপাশি বহু তরুণ মারের বদলে মার নীতি অবলম্বন করতে চেয়েছেন; তাঁদের বিশ্বাস, তা না হলে অত্যাচারী ইংরেজদের হটানো যাবে না এ দেশ থেকে। শুরু হল অনুশীলন সমিতি, গুপ্ত সমিতি। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে হল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। আলোড়ন তুলেছে অত্যাচারী সিম্পসনকে হত্যা করতে রাইটার্স বিল্ডিংসে বিনয়-বাদল-দীনেশের বিখ্যাত সেই অলিন্দযুদ্ধ।
     মহাত্মা গান্ধির উপর শ্রদ্ধা রেখেও, কার্যকরী ভিন্ন পথ অবলম্বনের কথা ভাবলেন সুভাষচন্দ্র বসু, সশস্ত্র সমরের প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি। ছদ্মবেশে বিদেশে পাড়ি দিলেন। জাতিধর্মগত ভেদাভেদহীন নারী-পুরুষের সম্মিলিত আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ভারতের স্বাধীনতার জন্যে তাঁর সর্বান্তকরণ প্রচেষ্টা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসে। কে ভুলতে পারে দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে দেশবাসীর আত্মবলিদানের আত্মবিশ্বাসী উদাত্ত সেই ডাক, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।' ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের শিরে সংক্রান্তি অবস্থার মধ্যে ১৯৪২ সালে গান্ধিজি দেন 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক। সত্যিকারের গণআন্দোলনে উদ্বেল হয়ে ওঠে সারা ভারত। রব ওঠে চারিদিকে, 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো', 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে'। মেদিনীপুরে বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা— 'গান্ধিবুড়ি'— বিরল দেশপ্রেমের নজির দেখিয়ে আত্মবলিদান করলেন।
     সার্বিক আন্দোলন, আঘাত, অসহযোগিতার বাতাবরণে এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ইংরেজ। প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ-শাসন-অন্তে দেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু যাবার আগে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষকে দুর্বল করে দিতে কার্যত তাকে তিন টুকরো করে দেওয়া হয়। পরে, মূলত আপন ভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে ভারতের সহায়তায় যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনমুক্ত পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ায়, ১৯৭১ সালে এক দেশ সত্যিই তিন দেশে পরিণত হল।

     কত শহিদের রক্তে রাঙা পরম কাঙ্ক্ষিত এ স্বাধীনতা আমাদের! বিপ্লবী থেকে কবি-গীতিকার। অহিংস থেকে সশস্ত্র বিপ্লবীদের কণ্ঠে দৃপ্ত ধ্বনিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দে মাতরম্' মন্ত্রসম। আমাদের গীতিকবিরা লিখেছেন কত না দেশাত্মবোধক গান! নজরুলের বলিষ্ঠ সব গান প্রেরণা জুগিয়েছে বিপ্লবীদের। চারণ কবি মুকুন্দ দাস গণজাগরণের ব্রতে কণ্ঠে গান নিয়ে ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে।

     পরাধীন দেশে তথাকথিত নিম্নবর্ণের অধিকার নিয়ে সোচ্চার এবং তাদের ভোটাধিকারের জন্যে দীর্ঘ আন্দোলনের জনক, বহু বিদ্যায় ভূষিত বাবাসাহেব আম্বেদকরের সুযোগ্য নেতৃত্বে তৈরি হয় স্বাধীন ভারতের সংবিধান, যা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে দেশচালনার আকর গ্রন্থ হিসাবে চালু হয়। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। অনেক শোষণ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে অর্জিত এই স্বাধীনতা তথা তার স্বীকৃত সংবিধানের মর্যাদা যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয় তা দেখা আমাদেরই দায়িত্ব। সে বিষয়ে আমাদের সর্বদা সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। বিবিধের মাঝে মহান মিলনকে আমরা যেন কোনোভাবেই বিস্মৃত না হই। শত ফুল বিকশিত হোক।
     গত বছর সাতাততম স্বাধীনতা দিবসের সকালবেলা কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরছি। মগরাহাট স্টেশনে নেমে সাইকেলে বাড়ি যাওয়ার পথে হরিশংকরপুরে দেখতে পেলাম একটি সংঘের বারান্দার সামনে এক বয়স্ক মানুষ— আমাদের পরিবারের মতোই হয়তো কৃষিজীবী সম্প্রদায়েরই— পরম যত্নে একাধিক রঙের আবির সহযোগে জাতীয় পতাকা আঁকছেন মাটিতে আর পাশে চুপটি করে বসে একাগ্র মনে দেখছে একটি ক্ষুদে— তাঁর নাতিই হবে— এই শিল্পকর্মটি। ভাললাগায় ভরে উঠল মনটা। কোথাও দেখলাম গ্রামের প্রবীণ মানুষটিকে দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করানো হচ্ছে। কী ভাল যে লাগে এ দৃশ্য দেখে! বিশেষত যখন মনে পড়ে একাধিক কাছের মানুষের এমন অভিজ্ঞতা— মধ্যরাতে বড় মাপের ধোপদুরস্ত রাজনীতিকের একের পর এক সংঘ-সমিতিতে স্বাধীনতা দিবস উদ্্যাপন করা— পায়ের জুতো দুটো খোলার যাদের অবকাশ হয় না পতাকা উত্তোলনের সময়! আমাদের এটিই ভাল— বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সম্মান পাওয়ার অনেক জায়গা আছে, আমাদের গ্রামের— পাড়ার— বহুদর্শী সবচেয়ে বয়স্ক/বয়স্কা সাধারণ মানুষ— নাই বা হলেন তিনি কোনও ক্ষেত্রের বিশিষ্ট— একটু মর্যাদা পান।

==================

অরবিন্দ পুরকাইত

গ্রাম ও ডাক— গোকর্ণী, থানা— মগরাহাট, জেলা— দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, ডাকসূচক সংখ্যা— ৭৪৩ ৬০১।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। 'স্বাধীনতা, স্বদেশ ও স্বকাল' বিষয়ক সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩১ আগস্ট ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান